‘বালাকুঠীর ওরে খোকন ব্যাপারি
তেরোশ টাকা দিয়া ব্যাপারি
কিনিয়া রে আনিছেন হাতি’
রাধাকান্তকে রাধাকান্ত হয়ে উঠবার অবসর না দিয়েই সোমেশ্বরী পুরোন সব দেশকালের গল্প জুড়ে দিলে বিষণ্ন সন্ধ্যে নেমে আসে।হালকা কুয়াশায় স্মৃতির স্তরে স্তরে ফেলে আসা সময়ের মহার্ঘ টুকরোগুলি কিছুতেই কিন্তু জোড়া লাগে না। রাধাকান্তর নাকে এসে লাগে মুসুরির ডালের গন্ধ আর রসুন তেলানি মাখা ঢেকিশাকের চচ্চড়ির সুস্বাদ।সোমেশ্বরী জানে,বোঝে এবার কইকান্তকে আবার শোনাবে রাধাকান্ত বারবার শোনানো সেই দান্তাল হাতির মাহুতের গল্প।কিংবা ভরা হাটে হারিয়ে যেতে যেতে আকালু গাড়িয়ালের কিভাবে বাওকুমটা বাতাসের স্রোতে নেমে যাওয়া।এইভাবে হাট ও হাটের পেঁচাল শুনতে শুনতে উত্তরের টাড়িবাড়ি পাথারে পাথারে চিরিদিনের সব বেঁচে থাকার পরম্পরাসুত্র জেগে উঠতে থাকে আদ্যন্ত এক হাহাকারের মতন। তখন শোক ও শ্লোকের অন্দরে অন্দরে স্মৃতির কাঁপন!রাধাকান্ত কইকান্ত সোমেশ্বরী যে দীর্ঘ জীবন পেরিয়ে এলো,যে জীবনের দীর্ঘতার আলোয় ছায়ায় কেমনতর মায়ামমতার কুহকও জেগে উঠলো; তা কিন্তু যাপনের অভ্যাসের তাড়সে গানবাজনানাচের পাকে পাকে জড়ানো কালখন্ড হয়ে সময়াতীতকে উস্কে দিতে দিতে নদির পাড়ের দিকে, নদীভাঙ্গনের দিকে,নদীচরের হোগলাকাশিয়ার থোপে থোপে লুকিয়ে থাকা গুলাবাঘার পুরাতন দৃশ্যসমগ্রতাই বয়ে নিয়ে আসে। মহাজনের আড়তে গুড় চিঁড়া খেতে খেতে, অথবা মজা গুয়ার আমোদে রসস্থ শরীর মনে শীতের পালাগানের আসরে, কুষানের ছুকরি নাচের বর্ণবহুলতায় এক বহুব্যপ্ত জীবনকেই বুঝি নুতনতর করে তুলে আনা হয়।
২।
‘আরে ডোল ডং ডং ডোল ডং ডং
কাঠল খুটার ওরে দোতোরা রে’
সোমেশ্বরীর বাপ হরমোহন ছিল ৮০ হালের জোতদার.৯ নদী ৫ ফরেষ্ট ডিঙ্গিয়ে আস্তে হত তার জোতে। হরমোহনের বাপের বাপ ছিল ডাকাতের বংশ।হরমোহন ছিলেন ব্যতিক্রম।জোতদারি দাপ তার থাকলেও তাও তেমন ছিলই না।শান্ত ও সমাহিত মানুষ।কীর্তন গাইতেন ভালো। খোলের বাজনা শুনতে শুনতে চোখ ভেসে যেত জলে। দোতোরাও বাজাতেন ভালো। চাঁদের রাতে ডারিয়া ঘরে দেহতত্ব গাইতেন।হরমোহনের ছিল জলঢাকা নদীর চরে মস্ত মহিষের বাথান।পাতালু,হেরম্ব,মকবুল,পাইলা এরা ছিল বা্থানের মইষাল।৫০/৭০ মহিষ থাকতো বাথানে।জলে শরীর ডুবিয়ে মহিষেরা বিশ্রাম করতো।আর মহিষের পিঠে চেপে মইষালরা গেয়ে উঠতো বুক হু হু করা গান-
‘মইষ চড়ান মোর মইষাল রে
ও রে কোনবা চরের মাঝে
এল্যা কেনে তোর ঘান্টির বাইজন
না শোনং মুই কানে’
সেই সব আদিগন্ত সময়পরবের ভিতর ঢুকে পড়তে পড়তে সোমেশ্বরী তার বাল্যস্মৃতির দিকে আকুলতা নিয়েই বুঝি চলে যেতে থাকে।সেই সব দিনের উত্তাপে হাত রাখতে গিয়ে সে তার বিষাদকে শুশ্রুষা দিতে গিয়ে হয়তো দু কলি গানও গেয়ে ওঠে,
‘গাও হেলানী দিয়া/নাচ রে গোলাপি
জোর হেলানী দিয়া/নাচ রে গোলাপি’
গান গাইতে গাইতে তার শরীরে নাচের ভঙ্গিও চলে এলে সে নিজেকে নাচ ও গানের ভিতর ছেড়েই দেয় আর তুমুল আকুতি নিয়ে বাল্যস্মৃতির কাছেই আশ্রয় নিতে থাকে,নিজেকে বিষাদে মিশিয়ে দিয়ে,কান্নায় ডুবিয়ে দিয়ে এভাবেই তাকে শেষাবোধি বিষাদ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে রাতের পাকঘরে,কৈমাগুরসিঙ্গিমাছের ঝাঁকের কাছে।হায় রে জীবন!আদিঅন্ত এক মানবজীবন!
৩।
‘ভেলোয়ার মুখত দেখং
মইফুলের বাহার’
জীবনের এই সব কিছুই তো আর জীবনযাপনে লগ্ন থাকে না!বদলাতে বদলাতে কোথায় যে নিয়ে যায় জীবন! রাধাকান্ত কইকান্তর দুনিয়াদারির অংশ হয়ে হাটের কোলাহলের ফাঁকে কিভাবে সন্ধ্যে নেমে আসে। কুপির আলোয় পাইকার ব্যাপারিরা নিজেদেরকে গুছিয়ে নিতে নিতে ঘরে ফেরার এক টানও টের পায়।নদী পেরিয়ে ফরেষ্ট পেরিয়ে বালুবাড়ি কাশিয়াবন টপকে টপকে মানুষের যেতে থাকা।এই যাওয়া আবশ্যিক এক যাপনের যাপন হয়ে ওঠবার মতন।বাতাসের ভিতর কোথাও আরোগ্য লুকিয়ে থাকে কি!না কি বাতাসটাতাসের মধ্যেই গাড়িয়ালেরা নেমে পড়ে,গাড়িয়ালকে পথা দেখিয়ে নিয়ে যেতে থাকে পাগল ও মিশকিন। গাড়িয়াল গান তোলে, গান চরাচরের ধ্বনি প্রতিধ্বনিকে আগলে রাখতে রাখতে একসময় গানের গতিস্বভাবেই সর্বদিকেই গড়িয়ে পড়তে থাকে, পাগেলামতি নদীর গতিপ্রকৃতির মতন।কইকান্তর খুব ঘুম পায়। সে রাধাকান্তর দিকে চোখ মেলে দেয়। আর সেই চোখের শুণ্যতার সাদায় বুঝি মিশে থাকে একটা নিম কাঠের দোতোরা।
Tags:
মুক্ত গদ্য