রুমকি রায় দত্ত

রূপান্তর
কার্জন গেট ছাড়িয়ে বি-ডি-এ এর দিকে চলে গেছে যে রাস্তাটা। ঠিক মোড়টায় বসে একটা কাশ্মীরি ছেলে এক মনে মেহেন্দি পড়াচ্ছে। দুপুরের রোদে ভিরটা কম। সামনে সাজানো মেহেন্দি ছাপ, মেহেন্দি কোন। ললিত গাড়ি নিয়ে সোজা ঢুকে পড়ল বি-ডি-এ যাওয়ার রাস্তায়।সামনেই ফাঁকা জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে ড্রাইভারের সিট থেকে নেমে পড়ল। পিছন ঘুরে দু’পা এগিয়ে থেমে গেল। থুতনি ধরে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল, যেন কোনো দ্বিধা কাটালো। দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো মেহেন্দি ওয়ালার পাশে। তখনও ছেলেটি মেহেন্দি পড়াতে ব্যস্ত। ললিত দেখতে লাগলো ছেলেটির শিল্পকলা আর মেয়েটির মেহেন্দি আঁকা হাত। ওর মনটা উৎপীড়ন করতে লাগলো। বারবার যেন হাতটা এগিয়ে যেতে চাইছে মেহেন্দিওয়ালার সামনে। সেই ছোটো থেকেই ওর এমন হয়। মেয়েদের সাজের জিনিস দেখলেই ওর মনটা উৎপীড়ন করতে থাকে। মা বলত, ছোটো বয়সে এনন নাকি সবার হয় কিন্তু ওর বন্ধুদের তো হতো না, তুপাইয়ের ও হয় না! বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই উৎপীড়নটা আরও বেড়েছে। মাঝে মাঝে ললিত নামের খোলোসটা ছেড়ে বেরিয়ে আস্তে ইচ্ছা করে ওর। কিন্তু পারেনা, বিশাখা, তুপাই, পুপাই এদের কথা ভেবে। আগেও পারেনি, পরিবারের কথা ভেবে। হয়তো কোনো দিনই পারবে না। এই ভয়ানক যন্ত্রনার কথা কাওকে বলতেও পারেনা অথচ এ ভাবে বেঁচে থাকাও কঠিন হয়ে উঠছে দিনে দিনে। এতবড় ব্যবসা—অর্থ-সম্পদ কোটি কোটি টাকার মালিক ললিত রায়, রাস্তায় অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে একটা মেহেন্দীওয়ালার সামনে।

মেহেন্দি আঁকা হাতটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে মেয়েটি। তার পুরুষ বন্ধুটি মেহেন্দি ওয়ালাকে টাকা মিটিয়ে দিয়ে দুজনে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ক্রমশ মিলিয়ে গেল। ছেলেটি ললিতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘স্যার, কিছু বলবেন’? স্যার শুনেই ললিত কি যেন একটা বলতে যাচ্ছিল,বলল না, মনের কথাটা বললে ছেলেটি ওকে পাগোল বলে তাড়া করতো। একটা কোর্ট-প্যান্ট পড়া লোক যদি হাতে মেহেন্দি পড়তে চায়, পাগোল ভাবাটাই স্বাভাবিক। নিজের পরিবার যে সত্য কথাটা মানতে চায়নি, সেখানে এই অপরিচিত ছেলেটা ওকে পাগোল ভাবলে ভুল তো কিছু নয়। প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে ছেলেটি আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘স্যার, কিছু বলবেন’? ললিত বলল, ‘আমাকে একটা মেহেন্দি কোন দাও’।

ললিত গাড়িতে গিয়ে বসলো কিন্তু বাড়ি না গিয়ে সোজা চলে গেলো “কৃষ্ণসায়র”। এখানে মাঝে মাঝে এসে বসে, ভালো লাগে অর।ঝোপের আড়ালে বসে থাকা জোড়া গুলো কে দেখতে ওর ভালোলাগে। মেয়ে গুলকে দেখে ওর ভীষণ হিংসা হয়। সেই কলেজ জীবন থেকেই ওর পুরুষ বন্ধু পাওয়ার জন্য মনটা ছটফট করে। আকৃতিতে ও একটা পুরুষ হলেও অন্তরে ও যে নারী। বাড়িতে স্ত্রী-পুত্র আছে, কিন্তু মনটা পুরুষ সঙ্গ পেতে চায়। অন্ধকার নামতেই ও গাড়িতে স্টার্ট দেয়, ফিরে আসে বাড়িতে। সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসে দোতলায়, ড্রইংরুমের সাদা সোফাটাই এলিয়ে দেয় ওর পুরুষের আবরণ পড়া দেহটা।চোখ বন্ধ করে মনটাকে শান্ত করতে চায়।

বিশাখা বলে, ‘কি গো,স্নান সেড়ে নাও, সাতটা বাজলো যে। আমি কফি নিয়ে আসছি’। সত্যিই ললিতের এখন স্নান দরকার। কোর্টটা কে কাঁধে নিয়ে পা বাড়াল নিজের ঘরের দিকে। ডুবিয়ে দিল নিজেকে বাথটবের শীতল-উষ্ণ মিশ্র জলের মধ্যে।

[২]

বিশাখার রেখে যাওয়া কফির কাপটা হাতে নিয়ে এসে দাঁড়ায় দক্ষিণের বারান্দায়।মাঝে মাঝে নিজেকে অপরাধী মনে হয় ।নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে,বিশাখাকে কি ও ঠকাচ্ছে? বিশাখা আজও ওর ভাল বন্ধু হয়ে উঠতে পারেনি। নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নেয়। টাকা-পয়সা,গাড়ি-বাড়ি সামাজিক সম্মান এমনকি দুটো সন্তান—সবই ও বিশাখাকে দিয়েছে, কোনো অভাব তো রাখেনি। কাপটা রেখে উঠে যায় বাথরুমে, প্যান্টের পকেটে মেহেন্দি কোনটা ছিল ওটা নিয়ে এসে বসে ব্যালকোনিতে রাখা বেতের চেয়ারটায়। দু’হাতের আঙ্গুলের খেলা চলতে থাকে মেহেন্দি কোনাটা নিয়ে। ভাবতে থাকে সেই দিনটার কথা ,যেদিন ও প্রথম ওর নারী সত্তার কথা উপলব্ধি করে।

তখন ক্লাস সিক্সের ছাত্র। বাথরুমের সামনে দেখেছিলো, ক্লাস এইটের একটা দিদি, একটা দাদার ঠোঁটে চুমু এঁকে দিচ্ছে। সেদিন ওর মনও উথাল-পাথাল করেছিল ঐ দাদাটার ঠোঁটে চুমু আঁকার জন্য।দোতলার ক্লাসরুমের জানালার ধারে বসেও তাকিয়ে থাকতো একতলার মেয়েদের ক্লাসরুমের দিকে।দাদারা,বন্ধুরা সবাই ঠাট্টা করত,সবাই ভাবতো ও মেয়ে দেখছে আর ওর বুক ফেটে যেত,ওই মেয়েদের সাথে খেলার জন্য। তখন ললিতের মনে হতো ছুটে গিয়ে ওদের সাথে খেলে। ফুটবল ওর কোনোদিনই ভালোলাগেনি। কুমিরডাঙ্গা-কানামাছি-রুমালচুরি এ সবেই ওর মন পড়ে থাকতো। মাসের পর মাস—বছরের পর বছর ঐ এক যন্ত্রনা বুকে নিয়ে একটু একটু করে বড় হয়েছে ললিত। যৌথ পরিবারে বড় হয়েছে ললিত।ছোটো থেকেই ওর ঘর ছিল আলাদা। পাশের বাড়ির মালা, মনা ওদের পুতুল খেলতে দেখে ওর ও পুতুল খেলতে ইচ্ছা করত।কৃষ্ণনগরের বারোদোলের মেলা থেকে ওর কাকার মেয়ে খুকু অনেক পুতুল নিয়ে এসেছিল।একদিন তার বেশ কতগুলি খুঁজে পাওয়া গেল না, সেদিন ললিতের ঘর খুঁজলে তার সব কটিই পাওয়া যেত।

ললিত তখন কলেজে পড়ে,একদিন সুযোগ বুঝে নেমে পড়লো মনের অদম্য ইচ্ছা পূরণে। মার একটা লালপাড় শাড়ি আর কাকিমার সাজের জিনিস দিয়ে সাজালো নিজেকে।সেদিন শুধু বাকি ছিল মেহেন্দী।মেয়েলী সাজে বিভোর ললিত ভুলেই গিয়েছিল, দরজার ছিটকিনি টা ভাল করে আটকায় না। আর সেদিনের সেই ভুলে যাওয়ার মাশুল আজও গুনে চলেছে। খুকু হঠাৎ ঢুকে পড়েছিল ওর ঘরে। ললিতের ঐ রূপ দেখে ভয়ে চিৎকার করে মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়।উফ! সেই দিনটার কথা ললিত মনে করতে চায় না।,তবু মনে পড়ে। –এর পরই বাবা এসে মাথাটা ঠুকে দিয়েছিল দেওয়ালে আর কাকা একটানে কাপড় খুলে বিবস্ত্র করেছিল ওকে। সেদিন ওরা কেউ বঝেনি,বুঝতে চায়নি।মহাভারতের দ্রৌপদীর লজ্জা আর ললিতের লজ্জা সেদিন মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিল। কেউ ওর প্রকৃত অস্তিত্বটাকে মেনে নেই নি। সব বুঝেও ওর নারীর অস্তিত্বকে মুছে ফেলার আয়োজনটাও সেইদিনই শুরু হয়ে যায়। ওর নারীর অস্তিত্বকে দমন করার জন্য খোঁজ চলতে থাকে আরেক নারীর। ললিত অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিল,পারেনি। মা সারাদিন গুমরে গুমরে কাঁদত, মায়ের মুখ চেয়ে পালাতেও পারেনি।আর পালিয়েই বা যেত কথায়? ওর এই বাহ্যিক আবরণ নিয়ে নারী সমাজের একজন হওয়া যায়না, আবার ওর অবস্থানটাও  মেনে নেওয়ার মত উদার মনস্ক সমাজ এখনও হয়নি বরং ওর পুরুষ শরীরে নারীর অস্তিত্ব আছে শুনলে,ওকে ওর পরিবারকে হাসির বস্তুতে পরিণত করবে।সমাজে ওর বাবা-কাকার উঁচু মাথাটা নিচু হয়ে যাবে।একটা পুরো পরিবারকে বিসর্জন দেওয়ার থেকে নিজেকে বিসর্জন দেওয়াটা ওর সেই সময় সঠিক বলে মনে হয়েছিল। তাই বাবা-কাকার কথায় মাথায় শোলার মুকুট তুলেছিল।ফুলশয্যার রাত থেকেই ও বিশাখাকে সব সত্যি জানাতে চেষ্টা করেছে,আজ ও সে চেষ্টা চলছে—পারেনি বারবার চেয়েও বলতে পারেনি।বিশাখার নিষ্পাপ মুখটা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে,ভয় পেয়েছে বিশাখার প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে—যদি প্রশ্ন করে কেন ললিত সব জেনেও ওর জীবনটা নষ্ট করল? কি বলবে ললিত?

...বিয়ের পর অনেক দিন পর্যন্ত ও বিশাখাকে ছুঁতে পারেনি।ভেবেছিল বিশাখা নিজেই সব বুঝতে পারবে। বিশাখার উদ্যোগে একদিন শরীর জেগেছে। জৈবিক ক্রিয়া তার নিজের নিয়মেই ঘটে যায়। শরীর শুধু স্পর্শ বোঝে। এই ভাবে তুপাই,পুপাই ওদের জীবনে এসেছে। প্রমান হয়েছে ললিত একজন সুস্থ পুরুষের দাবীদার, তবু কেন ওর নারী হতে ইচ্ছা করে জানে না ললিত। সময়ের সাথে সাথে যুগ বদলেছে।এখন ইচ্ছা করলে একটা মানুষ রূপান্তরিত হতে পারে,কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন অসম্ভব মানসিক জোড় আর পরিবারের সমর্থন।কিন্তু দুটিই ললিতের নেই।অনেকবার ভেবেছে আর কারোর কথা ভাবেনা,এবার থেকে বাকি জীবনটা নিজের জন্যই বাঁচবে। তুপাই সতেরো, পুপাই বারো। এই সময় ললিতের রূপান্তর টা ওরা না মানতে পারলে ওদের ক্ষতি হতে পারে,এই আশঙ্কায় পিছিয়ে এসেছে বারবার।

[৩]

অনেক দিন পর বিশাখা রাতে ললিতের ঘরে এসেছে। ইদানিং বিশাখাই নিজের মনের দিক থেকে বড় একটা সাড়া পায় না। ললিত ঠিক করেছে আজ ও বিশাখাকে ফেরাবে না। আজ বিশাখা যেমন ভাবে চায়বে তেমন ভাবেই তৃপ্ত করবে বিশাখাকে। এরপর আর বিশাখা হয়তো এমন সুযোগ পাবেনা ওর কাছ থেকে।

বিশাখা ঘরে এসে দাঁড়িয়ে আছে আয়নার সামনে, দেখছে নিজেকে। ললিত উঠে গিয়ে একটা সিগারেট ধরালো,ওটা শেষ হলে আরেকটা।তীব্র সিগারেট পোড়া গন্ধে ঘরটা ভরে গেল। বিশাখার সিগারেটের গন্ধ ভালো লাগে। পুরুষের সিগারেটের গন্ধ মাখা পুরু ঠোঁট বিশাখার ভীষণ পছন্দ। বিবাহিত জীবনে এই প্রথমবার বিশাখা যেন পুরুষের স্পর্শ পাচ্ছে।

রাতে ঘর ছেড়ে নিজের ঘরে যাওয়ার সময় বিশাখার চোখ পড়লো ললিতের আনা মেহেন্দী কোনটার দিকে। এগিয়ে গিয়ে ওটা তুলে নিল নিজের হাতে। বিছানায় পড়ে থাকা ললিতের দিকে একবার তাকিয়ে না জানি কি ভেবে মুচকি হেঁসে বেরিয়ে এলো ললিতের ঘর ছেড়ে।নিজের ঘরে ঢুকে একবার দেখে নিলো পুপাই কে, অঘোরে ঘুমাচ্ছে। এতগুলো বছর এই মানুষটার সাথে সংসার করেছে অথচ কোথাও যেন একটা ফাঁক থেকে গেছে। বিশাখা ললিতের সবটা এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। সব সময় যেন মনেহয় ওর মন আর শরীর আলাদা কথা বলে। বিশাখা নিজেকে প্রশ্ন করে ফাঁকি কি তবে ওর নিজের মধ্যেই আছে? ও কি নিজেই এতদিন নিজেকে সঁপে দিতে পারেনি? আজ ও অনেক পরিতৃপ্ত। আরও কিছুক্ষন ললিতের বাহুডোরে থাকতে ইচ্ছা হচ্ছিলো ওর। বাথরুমে জলধারার নিচে দাঁড়িয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষন।বেড়িয়ে এসে একটা পিল নেয়, তারপর ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। চেয়ে থাকে তারা ভরা আকাশের দিকে।

[৪]

ললিতও বাথরুমে ধুয়ে ফেলছে পুরানো জীবন, মন—শুধু শরীরটা পালটে ফেলার পালা এবার। জলের ধারার সাথে ধুয়ে যাচ্ছে গ্লানি,দঃশ্চিন্তা আর পিছুটান। বিশাখা আসার আগেই ও একটা ডেট নিয়েছে আমেরিকার “জন হপকিন্স মেডিকেল সেন্টারে”। ১৯৬৬ সালের পর থেকেই এই সেন্টারটি ললিতের মত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। ঠিক চারমাস পর ও ডেট পেয়েছে।এর মাঝে ললিতের অনেক কাজ। সবার আগে বিশাখাকে স্বাবলম্বী করতে হবে।ওকে ব্যবসার সব কিছু শেখাতে হবে।তুপাই আর দু’মাস পরেই আঠারো হবে,ও ব্যবসার হাল ধরার আগে যাতে বিশাখা ব্যবসা-সংসার সব চালাতে পারে সেটা বিশাখাকে হাতে ধরে শেখাতে হবে ললিতকেই। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে ললিত। ধীর পায়ে হাঁটতে থাকে বিশাখার ঘরের দিকে।বিশাখা দাঁড়িয়ে এক মনে আকাশ দেখছে। পাশে এসে দাঁড়ায় ললিত, আলতো হাত ছোঁয়ায় বিশাখার পিঠে। একটু যেন চমকেই ওঠে বিশাখা। ধাতস্ত হয়ে প্রশ্ন করে, ‘এখনো ঘুমাও নি?’

না, ঠিক ঘুম আসছে না। তোমাকে কিছু কথা বলার ছিল।

বলো—

ললিত বিশাখাকে নিজের চোখের সামনে ঘুরিয়ে নেয়। মুখের উপর স্থির দৃষ্টি ফেলে প্রশ্ন করে, পারবেনা তুমি এই ব্যবসার সব দায়িত্ব নিতে?

কেন? —তুমি থাকতে আমি কেন? বেশ তো সামলাচ্ছো তুমি।

না বিশাখা, এবার সব তোমাকে বুঝিয়ে দিতে চাই।

কেন?

আজ নয়, অন্য কোনো দিন। তুমি সব জানবে। আমি সব তোমাকে শিখিয়ে দেবো। ধরে নাও না আমি যদি না থাকি।

না থাকি মানে? তুমি কি কোথাও যাচ্ছো?কবে? কতদিনের জন্য?

যদি বলি, সারাজীবনের জন্য।

বিশাখার পরের প্রশ্ন শোনার অপেক্ষা না করেই নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায় ললিত। 


[৫]

আমেরিকা পৌঁছানোর পর থেকেই অদ্ভূত এক অনুভুতি কাজ করছে ললিতের মনে। অদ্ভূত একটা টেনসন,এক নতুন জীবনে প্রবেশের নাকি পুরানো জীবনের পিছুটান। এক চাপা উত্তেজনা নিয়ে এসে দাঁড়ালো পূর্ব নির্ধারিত রুমের সামনে।এখান থেকেই শুরু হবে ওর রূপান্তরেরে প্রথমধাপ। আর কিছুক্ষন পরেই জেনেটিক সেক্স নির্ধারন করার জন্য দু’জন হরমোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ওকে নিয়ে ঢুকে যাবে নির্নয়ক রুমে। হরমোন থেরাপিতে ওর কোনো ক্ষতি হতে পারে কি না সেটা না জানা পর্যন্ত ও কিছুতেই নিশ্চিন্ত হতে পারবে না। এখন বেশ কিছুদিন ওকে থাকতে হবে আমেরিকেতেই। এই মেডিকেল সেন্টারের কাছেই এক হোটেলে উঠেছে ললিত। এখনও প্রাথমিক পর্যায়ের অনেক কিছুই বাকি। এরপর সুগার-ক্লোরেস্টোরেল টেস্টের জন্য ব্লাড স্যাম্পেল নেওয়া, বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বলেছেন,ট্রিটমেন্ট শুরু হওয়ার আগে ওর হার্ট,লিভার ঠিক আছে কি না সেটাও পরীক্ষা করে দেখা হবে।সব টেস্টের রিপোর্ট হাতে পেতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে।

প্রায় চার-পাঁচ ঘন্টা কেমন একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে কেটে গেল ললিতের। এই তো শুরু, এখনও অবাক হওয়ার অনেক বাকি। হসপিটাল থেকে ফেরার পথে, ভাবতে থাকে ললিত। মনের জোড়টা বাড়াতে এতগুলো বছর লেগে গেল ওর। অনেক আগেই হয়তো মুক্তি পেতে পারতো, শুধু একটু সাহসের প্রয়োজন ছিল। ঠিক তাও নয়, আসলে ও তখন তো জানতোই না এভাবে ‘খোদার উপর খোদ্গারি’ করা যায়, মানে এও সম্ভব! একটা মানুষের রূপান্তর ঘটিয়ে আরেকটা মানুষ তো ঈশ্বরেরই সমতুল হয়ে যায়। সত্যিই ভাবলে অবাক লাগে ললিতের,একটা মানুষ পুরুষাঙ্গ সরিয়ে কত সহজেই নারিতে পরিণত হতে পারে আজকের দিনে। সত্যিই একেই বলে বিজ্ঞানের অগ্রগতি। হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন এসে বসেছে রাস্তার ধারে সাজানো পার্কিটাতে। পিছনে দাঁড়ানো ফোয়ারার জলের ছিটে চোখে মুখে এসে পড়েতেই যেন ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এলো ললিত। বিকেল হয়ে গেছে। এর মধ্যেই ওর পাশ-ফেলের রিপোর্ট এসে যাওয়ার কথা।

এর মধ্যেই ডাক্তার জানিয়েছেন ললিত ট্রিটমেণ্ট নিতে পারবে হোটেলে ফিরে ললিতের এক অদ্ভূত অনুভূতি হতে ললিতের। এটায় কি তবে মুক্তির স্বাদ? প্রথম পদক্ষেপেই যদি এত আনন্দ হয়, তবে শেষটায় না জানি কি হবে ললিতের মনে ... 

আগামী সপ্তাহে ললিতের সাথে দুজন মানসিক চিকিৎসকের সাক্ষাতের দিন ঠিক হয়েছে।ওরা যাচাই করবেন ললিতের মানসিক পরিস্থিতি। এই পথে এগোতে গেলে অনেক বাঁধার সম্মুখিন হতে হবে ললিতকে। মানসিক ভাবে ললিত রূপান্তরের জন্য প্রস্তুত কি না,বা কি ভাবে ওকে প্রস্তুত করতে হবে সেটা জানাবে এই দুই জন চিকিৎসক।

প্রায় মাস খানেক তুপাই-পুপাইকে ছেড়ে আছে। মাঝে মাঝে মন কেমন করে, এতদিন তো ওদের ছেড়ে থাকেনি। এখন থেকেই ললিত যেন একটা মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছে... অফিসে ফোন করে জেনেছে, বিশাখা ভালো করেই অফিস সামলাচ্ছে। এখন অনেক নিশ্চিন্ত ললিত। এর মাঝেই চিকিৎসক রিপোর্ট পাঠিয়েছে ললিত রূপান্তরের জন্য ৭০% তৈরি,বাকি ৩০% প্রস্তুতি ওকে কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে নিতে হবে।

[৬]

আমেরিকার প্রাথমিক পর্ব মিটিয়ে ললিত বাড়ি ফিরেছে। মাঝে একদিন কোর্টে গিয়েছিল। উকিলের মাধ্যমে এফিডেবিট করে ফার্স্টক্লাস জুডিশিয়াল ম্যজিস্ট্রেটের কাছে জানিয়ে এসেছে ও যা বুঝেছে তা ঠিক বুঝেছে এবং যা করতে চলেছে তা পরে আর পরিবর্তন করা যাবে না জেনেই এই কাজ করতে চলেছে। এখন শুধু অপেক্ষা পুলিশ এনকোয়ারীর। ললিতের নামে কোনো ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে কি না,কি কারনে এই রূপান্তরের সিদ্ধান্ত......এই সব বিষয়ে পুলিশ ক্লিনচিট দিলেই ললিত শুরু করাবে হরমোন থেরাপি। ললিত ঠিক করেছে পুলিশ ক্লিনচিট পেলেই ও বাড়িতে মানে বিশাখাকে ওর সিদ্ধান্তটা জানিয়ে দেবে। 

বিশাখা প্রায় বিধ্বস্তের মতো সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠেছে। আর কিছুই লুকানো নেই, পুলিশ অফিসে গিয়েছিল । সেখানেই বিশাখা সব জানতে পেরে গেছে। বিশাখার মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। যে লোকটা কে এতকাল স্বামী বলে জেনে এসেছে,যে ওর দুই সন্তানের বাবা—সেই লোকটা হঠাৎ এমন একটা সিদ্ধান্ত নিল আর ও জানতেও পেল না! ওর ভাবতেও আশ্চর্য লাগছে, তুপাই-পুপাইএর বাবা আছে অথচ বাবা নেই । লোকটা বেঁচে থাকবে কিন্তু অন্য শরীরে। ললিত বেঁচে আছে অথচ ওর নামে কোনো ভোটার কার্ড থাকবে না। তুপাই-পুপাই এর স্কুলে বাবার নামের জায়গায় ললিত রায় লেখা থাকবে কিন্তু সে না মৃত, না জীবিত। সে তখন “ললিতা রায়” একজন নারী,সে কি করে দুজনের বাবা হতে পারে? বিশাখার পাগোলের মত অবস্থা।কি ভাবে ছেলে দুটোকে নিয়ে ও সমাজের মুখ-মুখি দাঁড়াবে? কি বলবে ও সমাজের ছোঁড়া প্রশ্নবাণের উত্তরে? মনে মনে ভাবে—না এ কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না,কিছুতেই ও ললিতকে এই হীন কাজ করতে দিতে পারে না। হ্যাঁ এটা ওর কাছে হীন কাজই.....পরিবারের বিপন্ন অস্তিত্বের সামনে ললিতের ব্যক্তিগত সুখ-সন্ধান বিশাখার কাছে হীন কাজই।

বিশাখা ছুটে আসে,উদ্ভ্রান্তের মত দাঁড়ায় ললিতের সামনে। ওকে প্রশ্নবাণে ঝাঁঝরা করতে থাকে। হয়তো বিশাখার দিক থেকে এমন আচরণ সঠিক,কারণ বিশাখা উপলব্ধি করতেই পারেনি ললিতের এই দ্বৈত সত্তার যন্ত্রণা এতগুলো বছর ধরে কণ্টকময় জীবন বয়ে বেড়ানোর যন্ত্রণা। বিশাখার প্রবল আপত্তির সামনে ললিত প্রতিদিন খান খান হতে থাকে। মাঝে মাঝে নিজের জীবন টা শেষ করে দিতে ইচ্ছা হয় ওর.....চিৎকার করে ঈশ্বরের কাছে প্রশ্ন করে.....কোন অপরাধে ভগবান ওকে এই ভয়াবহ জীবন দিলেন? ....শুধু ললিত নয় ওর এই সিদ্ধান্তে বিশাখার জীবন কণ্টকময় হয়ে উঠেছে। ঘরে-বাইরে ওকে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে... ওর অকাল বৈরাগ্যের কারনে। তুপাই উনিশ...মা-বাবার অশান্তির উত্তাপ ওকেও দগ্ধ করছে। হঠাৎ করে ও যেন অনেক বড় হয়ে গেছে।

[৭]

আইনি জটিলতা আর মানসিক জটিলটা কাটাতে কাটাতে দেঢ় বছর কাটিয়ে দিয়েছে ললিত। বিশাখার একটা অনুরোধ ও রেখেছে,বাইরের সমাজ এমনকি নিজের সন্তানদের সঙ্গেও যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন করেছে। বিশাখা ললিতের সব পরিচিত মহলে জানিয়ে দিয়েছে ললিত অসুস্থ...ডাক্তারের নির্দেশে ওকে স্পেশাল কেয়ারে রাখা হয়েছে।

ললিত এখন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের নির্দেশে ক্রসড্রেসিং পদ্ধতির মধ্যে আছে। বাড়িতে এখন মেয়েদের পোশাক পড়ছে। বেশ কয়েক মাস ধরেই চলছে ওর এই ক্রসড্রেসিং থেরাপি। এখন এইসব পোশাকে ললিত বেশ সাবলীল। এরপরই শুরু হবে ওর হরমোন থেরাপি। বিশাখা আজকাল আর এই দক্ষিণের ঘরটার দিকে আসেও না,ললিতের দিকে তাকাতেও ওর ঘেন্না করে। বিশাখার বাবা মা বেঁচে নেই,‌ থাকলে নিজের মেয়ে কে এমন এক অপদার্থের হাতে তুলে দেওয়ার আত্মগ্লানিতে হয়তো আত্মহত্যা করতো। বিশাখার দাদা-বৌদিও অনেক বুঝিয়েছে ললিতকে,কিন্তু ললিত দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এর মধ্যেই ওর নাম পরিবর্তনের কাজ সাড়া হয়ে গিয়েছে। এখন ও আর ললিত রায় নয়। নামের পাশে আকার জুড়ে ওএখন ললিতা। এই পরম তৃপ্তির পথে কাঁকর ছড়াতে ও কিছুতেই সুযোগ দেবেনা বিশাখাকে। একবার যে সিদ্ধান্তটা ও নিয়ে ফেলেছে আর সেটা কোনোমতেই বদলাবে না,আর বলি দেবে না নিজের স্বাধীনতার। এসবের মাঝেই ঘুরে এসেছে আমেরিকা থেকে... শুরু হয়েছে ওর হরমোন থেরাপি। আমেরিকা তে থেকেই ও পুরো ট্রিটমেন্টটা করাতে পারত কিন্তু করবে না,ও বদলা নেবে। যে সমাজের মাঝে থেকে এতো দিন যন্ত্রণা ভোগ করেছে,সেই সমাজের মাঝে থেকেই ও ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হবে।

ললিতের শরীরে স্ত্রী হরমোন ইস্ট্রজেন ধীরে ধীরে তার প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। দাঁড়ি-গোঁফ প্রায় বিলুপ্তির পথে,শরীরের লোম ও অনেক কমে এসেছে। ললিত মাঝে মাঝেই নিজেকে উন্মুক্ত করে দাঁড়ায় আয়নার সামনে, মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকে নিজের শরীরের পরিবর্তন,বুকের আকার সামান্য পরিবর্তন হয়েছে আরও সময় লাগবে পুরো পরিবর্তন হতে। কোমরের আকারেও পরিবর্তন হয়েছে,চামড়ায় এসেছে নারীর মত পেলবতা। শুধু কিছু অবাঞ্ছিত লোমের উপস্থিতি এখন ওর সৌন্দর্যের পথের কাঁটা হয়ে আছে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর আমেরিকায় যেতে হচ্ছে ওকে। সঙ্গে চলছে কাউন্সেলিং মানসিক প্রস্তুতির বাকি ৩০% ফাঁক পূরণের চেষ্টা।

হরমোনের প্রভাবে ললিতের গলার স্বরের অনেক পরিবর্তন হয়েছে।গলা ভেঙে এক মধ্যবর্তি পর্যায়ের আওয়াজ হচ্ছে,না মোটা না সরু,ঠিক কৈশরের স্বরভঙ্গ হলে যেমন হয়। লেজারের সাহায্যে অবাঞ্চিত লোমও নষ্ট করা হয়েছে। এখন ওর হাতের গঠন সেই মেহেন্দী পড়া মেয়েটার হাতের মত দেখতে লাগে।আঙ্গুল ও হাতের গঠন মেয়েদের মতই সুন্দর হয়ে উঠেছে।ললিত মাঝে মাঝেই ওর সুন্দর হাতের সুন্দর আঙ্গুলের নখে ডিপ রঙের নেল পালিশ পড়ে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে। 

আমেরিকা থেকে সবে ফিরেছে ললিত। ওর ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্ট হয়েছে,এখন ও দুটি উন্নত বক্ষের অধিকারিনী। আরও নমনীয় ও কমনীয় হয়ে উঠেছে ওর নারী সুলভ সৌন্দর্য। ওর পুরুষালী মুখের আদলও কেটে-ছেঁটে বাদ দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নারীর কমনীয়তা। ললিত আর এখন বিশাখার স্বামী নয়, রাধার দুই সখী। ললিত ভালো করেই জানে বিশাখা ওকে কিছুতেই এই রূপে মানিয়ে নিতে পারবে না,কিন্তু ললিতের তাতে বিশাখার উপর কোনো অভিমান নেই,ও বোঝে বিশাখা,তুপাই,পুপাইয়ের সমস্যা কিন্তু এ তো শুধু ওর মুক্তি নয়,এ  সমাজের প্রতি এক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করাও।

বাড়ি ফেরার পর থেকেই ললিত পুরোপুরি ললিতা,শুধু যৌনাঙ্গটার মুক্তি বাকি। দু’হাত ভরে মেহেন্দী পড়েছে ললিত। লেডিস পার্লার থেকে মেয়েরা এসে ফেসিয়াল করে দেয় ওর। চুল্টাও স্টেপকার্ট,কখনও হাঁটু পর্যন্ত স্কার্ট আবার কখনও বিভাজিকা বের করা ডিপ গলার টপ-জিন্স। কিন্তু এখনও ওর মুক্তির স্বাদ ফিকে। ওর এই সাজ-পোশাক,পরিবর্তন সবই এই চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছে। মাঝে মাঝে পুপাই কে আদর করতে ইচ্ছা করে ওর,কিন্তু সে আবেগ কে ও রুদ্ধ করে রেখেছে। ওর জীবনটা আর বিষাক্ত করতে চায়না ললিত। নিজেকে সতর্কতার সঙ্গে ওর দৃষ্টির আড়ালে রাখে। এখন আর ওর নারী দেহটা এই চার দেওয়ালে আবদ্ধ থাকতে চায় না।এতদিন নারীসঙ্গ ভোগ করেছে,এখন পুরুষ সঙ্গ পেতে চায়। আর মাত্র ক’টাদিন বাকি এর পরই মুক্তি ললিতের ,জন্ম নেবে এক পূর্ণাঙ্গ নারী ‘ললিতা রায়’। ওর বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মেল পাঠিয়েছে।ওকে আমেরিকা যেতে হবে,ওর শরীর থেকে জন্মগত পুরুষাঙ্গটি বাদ দিয়ে তৈরি হবে স্ত্রী অঙ্গ।শরীরের বাইরের ,ভিতরের পরিবর্তন নিয়ে ললিত নামের পুরুষটি হারিয়ে যাবে চিরতরে বিদেশী জনসমুদ্রে।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

নবীনতর পূর্বতন