রুমা ঢ্যাং / কচ্ছপের বেঁচে থাকা

আমার উপলব্ধিতে শ্রদ্ধেয় দেবব্রত সান্যালের উপন্যাস "কচ্ছপের বেঁচে থাকা"
বইমেলা থেকে ফিরে এসে তার একদিন পরে বেশ কিছু সংগ্রহীত বই এর মধ্যে থেকে কবি দেবব্রত সান্যাল দাদার প্রথম উপন্যাস "কচ্ছপের বেঁচে থাকা" নিয়ে পড়তে বসলাম। কালো মলাটের ভেতর সাদা অক্ষরে বইয়ের নাম ও হাল্কা একটা ছবি। উপন্যাসিক তাঁর উপন্যাস শুরু করলেন কলেজ জীবনের শেষ অধ্যায় দিয়ে যখন ফাইনাল সেমিস্টার শেষ করে প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত উপন্যাসের প্রধান চরিত্র শান্তনু চট্টোপাধ্যায় (উত্তরবঙ্গের একটি জেলা শহরের ছেলে) এন.টি.পি.সি র আবেদনপত্র জমা দেওয়ার তোড়জোড় করছে। এরপর প্রথম কাজের ক্ষেত্রে নানান ভালো মন্দ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সে প্রথমে কলকাতা ও পরে দক্ষিণ ভারতের কুদ্রেমুখে এসে উপস্থিত হয় তারই সমবয়সী ভিন্ন ধর্ম, ভাষা, আদর্শের সহকর্মীদের সাথে। এরপর টিকে থাকার লড়াইয়ে কখনও মজা, বিদ্রুপ, হিংসা, স্বার্থপরতা, ওপরমহলের চাপ, ইউনিয়নের ক্ষোভ, জীবনসংশয়ের পাশাপাশি একটু একটু করে গড়ে ওঠা প্রেম ও বিশ্বাস এবং সততার ছাপ রেখে
জীবনধারণ করা এসবই উঠে এসেছে গল্পে। তবু তার কচ্ছপের আয়ুকাল সে কামনা করে না। এইরকমই একটা চাপা টেনশন আর উপন্যাসিকের মজার ছন্দে নিজের লেখার গুনে "কচ্ছপের বেঁচে থাকা" জীবন্ত হয়ে উঠেছে। জীবনের শুরু থেকে হিরোসুলভ আত্মসচেতনতাবোধ, অহংকার, অল্পে সন্তুষ্ট থাকার গুন নিয়ে শান্তনু চট্টোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত। একজন রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন বাবার আদর্শে গড়ে ওঠা চরিত্র শান্তনু পুজোপাঠ এর থেকেও বাবার শ্রাদ্ধের বদলে স্মরণসভা সমর্থন করে, আবার কখনও প্রাকৃতিক দৃশ্য বা প্রেমের আভাসে বা মনখারাপে কবিতা লিখে মনোবল সঞ্চয়ও তেমনই করে। উপন্যাস পড়তে পড়তে স্বভাবিক ভাবেই আমাদের চেনাজানা অনেক বিখ্যাত নায়ক, কমেডিয়ানকে ভেবে নেওয়াই যায়। বিশেষত কমেডিয়ানের কথা যখন ভাববেন বা তার চেহারার কথা বা বোকা বোকা টাইপের চরিত্রের কথা যখন মাথায় আসবে ঠিক তখনই উপন্যাসিক সেই ধারণা নস্যাৎ করে বলেন -' যদি কারোর ধারণা হয় আমাদের বিপদ ভঞ্জন পালের চেহারা যেমন হয় তেমন, তাহলে ভুল হবে। পালকে দেখতে মোটেই খারাপ বলা যাবে না,...' শান্তনুর চরিত্রে উপন্যাসটির প্রথম থেকে দেখতে পেলাম এক নিজস্ব আত্মগরিমা, যা তাকে পরবর্তীকালে কর্মক্ষেত্রে অনেক কাজেই নিশ্চিতভাবে জেতার জন্য কনফিডেন্স দেয়। 

উপন্যাসটির মধ্যে আরও যা পাই তা হল চরিত্রের নিজের শহরের প্রতি টান , স্থানের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা যাতে উপন্যাসিকের আবেগ দ্রবীভূত আছে, কর্মসূত্রে দূরে গিয়েও নিজের জন্মস্থানে না থাকতে পারার অসহায়তা আমাদের মানে পাঠকের মনে সাড়া জাগায়। শান্তনুর জীবন সংশয়কালে অচৈতন্য অবস্থায় শৈশবে ফিরে যাওয়া, বাবার স্মৃতি, বাবার শিক্ষাদান এসব কিছুই পাঠককে আবেগতাড়িত করে গল্পের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে দেয়, পাঠক উৎসাহী হয়ে ওঠে। সুনীতার প্রতি নিয়ন্ত্রিত ভালোবাসা শান্তনুকে ধীরে ধীরে সব পাওয়ার সন্তোষ প্রদান করে। কোনরকম প্রলোভনে পা না বাড়ানো শান্তনুকে বারবার তার হিরোসুলভ চরিত্র উদ্ঘাটন করে। পাঠক চরিত্রের ওপর ভরসা ও বিশ্বাস রেখে গল্পে এগিয়ে যেতে পারে।

মজাসুলভ অথচ কাব্যরসে রচিত ডায়ালগ এবং লেখার স্টাইল পাঠককে প্রণোদিত করে। মাঝে মাঝে কবিতা প্রেমীকে কবিতার স্বাদও মেটাতে সক্ষম হয় এই উপন্যাস। ২৪ টা খণ্ডে শান্তনুর বেকার জীবন থেকে প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনিয়ারিং জীবন বর্ণিত এবং পরবর্তী জীবনকালের আভাস দিয়ে সমাপ্ত। শেষে উপন্যাসিক শান্তনুকে সুনীতার আসার জন্য প্রকৃতির দরবারে হাজির করিয়ে আর্জি জানিয়েছেন সেজে উঠতে। শেষের কিছু লাইন পাঠককে নিশ্চিতভাবে মুগ্ধ করবে যেখানে উপন্যাসিক লেখেন- 

'...চিল্কার বুক থেকে মাথা উঁচু করে থাকা গাছেদের একজন হয়ে যেতে ইচ্ছে করছিলো। এটা আমার মৃত্যুকে বুকে টেনে নেওয়ার ইচ্ছে নয়, জীববের ভালোলাগাকে অমর করে রাখার আকাঙ্ক্ষা।

ঘাড় গুঁজে চুপ করে থাকলেও
শিকারীর হাত থেকে কি নিস্তার আছে?
কচ্ছপদের তো অমরত্বের আশীর্বাদ নেই।।'

উপন্যাসিক গল্পকে এতটা জীবন্ত করেছেন যে আমার মনে হয় তিনি নিজেও বেশ সংশয়ে ছিলেন যে কাকতালীয়ভাবে কোন ঘটনা বা পাত্র সত্যিকারের মিলে যেতে পারে তাই শেষে সে স্বীকারোক্তিও লিখে দিতে তিনি ভুল করেননি। দক্ষিণের ভাষা, নাম, চেহারা বা জীবন সবটাই নিঁখুত, উপন্যাসিকের নিজের অভিজ্ঞতার ফসল। প্ল্যান্ট ও মাইনসের কিছু কিছু টার্মস আমার মতো সাধারণ পাঠককে ভাবাবে আবার বেশ কিছু জায়গায় সেসব কাজকর্মের বিস্তারিত বর্ণনাতে পাঠকসমাজ একটা ধারণা পাবে ভারতের দক্ষিণের প্ল্যান্ট ও মাইনসের কাজকর্মের। এই মুদ্রাস্ফীতির যুগে আমার জেনারেশনের পাঠক উপন্যাসিকের তৎকালীন স্যালারি আর খরচ জেনে একটু বিস্মিত হবে বৈকি, সেকথা নিশ্চিত বলা যায়।

সবশেষে বলি, জীবনের প্রতিষ্ঠিত হবার গল্প হল 'কচ্ছপের বেঁচে থাকা', একজন মানুষকে কর্মসূত্রে জন্মস্থান থেকে অনেক দূরে ভিন্ন ভাষা, ভিন্নধর্মী মানুষের সাথে সমন্বয়সাধনের গল্প হল এই 'কচ্ছপের বেঁচে থাকা', যে মানুষ একাধারে জীবিকা নির্বাহে সংগ্রাম চালায় অন্যধারে সুনীতার প্রেমিক হয়ে ভরসাদান করে। ছোটবেলায় শোনা সেই খরগোশ আর কচ্ছপের দৌড় প্রতিযোগিতায় লক্ষ্য স্থির রেখে ধীরে ধীরে জীবনে প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে গিয়ে বেঁচে থাকতে পারার নামই হল 'কচ্ছপের বেঁচে থাকা'। শান্তনুর জীবনের কিছু অংশের বর্ণিত গল্পের নামকরন ' কচ্ছপের বেঁচে থাকা' এ ব্যাপারে সার্থকতা লাভ করেছে।






একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

নবীনতর পূর্বতন