বাংলা ভাষায় কথা শুরু ঠিক কবে, কিভাবে মনে পড়ে না। আর সক্কলের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল ভাষা চেনা বা বাংলা ভাষার সাথে হাঁটা। অনেকদিন আগেকার আমারই একটা পুরনো ডায়েরী খুঁজে পেলাম। ভুলে যাওয়া গোটা ইতিহাস এক নিমেষে হাতের মুঠোয়, প্রতিটা দিন, প্রতিটা মূহুর্ত। একরাশ খুশি, অনেকগুলো রাগারাগি, অভিমান একঝলকে ঝিলমিলিয়ে উঠল। রোজের খুচরো খুচরো কথা যারা কিনা লেপমুড়ি দিয়ে ছিল ভুলে যাওয়া ঠান্ডায়, তারা সব উঠে এল মিঠে রোদে পিঠ সেঁকে নিতে। আমিও তাই রোদে আসন পেতে ভিজে চুল মেলে দিলেম, আর ডায়েরী কোলে নিজের লেখা পড়তে পড়তে বাংলা ভাষার ইতিহাস জানতে জানতে গর্বে, কখনো রাগে বেগুনী হলুম। ভুলে গেছিলাম বলে আবার কখনও বা চোখের কোনাটা ঝাপসা হয়ে গেল। একটা করে পাতা উল্টোই, এদিকে সময় এগতে থাকে , সূয্যিটা একমনে হেলতে থাকে একদেওয়াল ধরে আরেক দেওয়ালে।
প্রথম পাতা :
প্রাচীন ভারতবর্ষে সর্বসাধারণের কথ্যভাষা ছিল প্রাকৃত ভাষা। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ অব্দ থেকে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত একাধারে লিখিত ও কথ্য ভাষারূপে ভারতের নানা জায়গায় এ প্রাকৃত ভাষাসমূহ প্রচলিত ছিল। সাধারণ মানুষের কথ্যভাষা প্রাকৃত থেকেই বাংলা ভাষার উৎপত্তি। ধারণা করা হয় প্রাচীন ভারতের প্রাকৃত ভাষাগুলোর মধ্যে পালি অন্যতম, যার জন্ম খ্রিষ্টজন্মেরও কমপক্ষে ছ শ বছর আগে। পালি ছিল মধ্য বিহারের মগধ অধিবাসীদের মুখের ভাষা। পালি মুখ্যত কথ্য ভাষা হলেও তার সুনির্দিষ্ট ব্যাকরণ ছিল এবং তাতে কাব্য, নাটক ইত্যাদি রচিত হয়েছিল।যুগ যুগ ধরে ভারতে যেমন সংস্কৃতের কদর বা ইউরোপে ল্যাটিনের, গঙ্গার এপারে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পালিও ঠিক তাই । কিন্তু এত যে পুরোনো ভাষা, এত সুদূরব্যাপী যার বিস্তার, এবং এত সব মূল্যবান ঐতিহাসিক নিদর্শন যার রয়েছে সেই পালি তার যথাযথ মর্যাদা পায়নি। এই অসম্মান ও অনাদর পালির মতো সম্ভ্রান্ত ভাষার পাওনা ছিল না।তাই পালির মৃত্যু ঘটেছে বহু শতাব্দীকাল আগেই। অর্থাৎ এখন আর এ ভাষার কোনো স্থানীয় জাতি নেই, বা সে অর্থে মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহারের মানুষ নেই; কেবল সাহিত্যিক ও ধর্মীয় ভাষা হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। গৌতম বুদ্ধ এ ভাষাতেই ধর্ম প্রচার করেছিলেন।এই ভাষাতেই ত্রিপিটক লেখা।সংস্কৃতের সাথে এর সম্পর্ক অনেকটা বোনের মতো। পালি এবং সংস্কৃত, যদিও নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে দুজনের মধ্যে, আর্যভাষার সম্পূর্ণ পৃথক ও স্বাধীন দুটি ভাষা-শাখা। এই অর্থে আর্যভাষাই এই পালি এবং সংস্কৃত ভাষার প্রকৃত মা। এই আর্যভাষা মূলত ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশেরই সদস্য। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশ হল, যেসব ভাষা ইউরোপের অনেকটা অংশজুড়ে এবং বৃহত্তর দক্ষিণ এশিয়ায় ছড়িয়ে পরে, তাদের সম্মিলিতভাবে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-পরিবার বলা হয়। পৃথিবীর অর্ধেকের চেয়েও বেশি মানুষ এ পরিবারভুক্ত ভাষায় কথা বলে থাকেন। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা সহ গ্রিক, ল্যাটিন, ইংরেজি, হিন্দি, ফারসি, ফরাসি, ডাচ, নেপালি ইত্যাদি ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। আনুমানিক পাঁচ হাজার বছর পূর্বে এই মূল ভাষার অস্তিত্ব ছিল।
দ্বিতীয় পাতা :
খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ সাল থেকে ইন্দো-ইউরোপীয় পরিবারের ভাষাভাষী লোকেরা ইউরোপ ছাড়িয়ে আটলান্টিকের উপকূল এবং ভূমধ্যসাগরের উত্তর কূলের দিকে আসতে শুরু করে। পারস্য ও ভারত জয়ের মধ্য দিয়ে তারা ছড়িয়ে যায় এশিয়ার দূর এলাকাসমূহে। সমসাময়িক সময়েই সিন্ধুর অধিবাসীগণও গাঙ্গেয় সমভূমি এবং পশ্চিমদিকে ইরান এবং আফগানিস্তানে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দের মধ্যে দুটি ভাষা-শাখা, ভারতীয় আর্যভাষা ইন্দো-আর্য এবং ইন্দো-ইরানীয় ভাষা, আলাদা হয়ে যায়।
ভারতীয় আর্যভাষার ইতিহাসে তিনটি প্রধান স্তর লক্ষ করা যায়।
১.. প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা : খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ৬০০ অব্দ । ঋকবেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ, ব্রাক্ষ্ণণ্য ও উপনিষদ এই সময়ের।
২.. মধ্য ভারতীয় আর্যভাষা : খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ থেকে ১০০০ খিস্টাব্দ । রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, নাটক, গীতিকাব্য, চম্পুকাব্য, ব্যাকরণ অলঙ্কারশাস্ত্র ইত্যাদি। বাল্মীকী, ব্যাস, পাণিনি, ভাস, কালিদাস, বাণ, দণ্ডী, কৌটিল্য(চাণক্য) এ ভাষার বিখ্যাত লেখক; এবং পালি-বৌদ্ধ জাতক, ত্রিপিটক পালি ভাষায় লেখা হয়েছে এই সময়ে।
৩.. নব্য ভারতীয় আর্যভাষা : খ্রিস্টাব্দ ১০০০ থেকে বর্তমান কাল । পাল রাজাদের আমলে রচিত বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ।
সমগ্র উত্তর ভারতে, আফগান সীমান্ত থেকে আসাম সীমান্ত পর্যন্ত, হিমালয় থেকে মহারাষ্ট্র পর্যন্ত ছিলো আর্য ভাষাগোষ্ঠীর বিস্তার। আর্যরা ভারতে আসার আগে থেকেই এখানে ভেড্ডি, অস্ট্রিক, দ্রাবিড় প্রভৃতি অনার্যরা বাস করত। সংস্কৃতকে বলা চলে বাংলার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। মাগধী প্রাকৃত বা গৌড়ী প্রাকৃত- যে ভাষার থেকেই বাংলার জন্মের কথা যতই বলি না কেন, প্রকৃত সত্য হচ্ছে, আজকের বাংলা ভাষা পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষা থেকে শব্দ গ্রহণ করে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। বাঙালির রক্তে যেমন মিশে আছে বহু জাতি- ভেড্ডি, অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, মঙ্গোল, আলপাইন, আর্য, শক,হুণ, আরব, তুর্কী, মোগল, পাঠান প্রভৃতির রক্ত, তেমনি তার ভাষার মধ্যেও রয়ে গেছে অজস্র বিদেশি শব্দ। বাংলার মধ্যে ঢুকে নিজের অজান্তেই সে কখন হয়ে উঠেছে বাংলা শব্দ।খ্রিস্টিয় সপ্তম শতকে মাগধী প্রাকৃতকে অবলম্বন করে বাংলা ভাষার বুনিয়াদ স্হাপন হয়। কিন্তু তারও আগে হাজার বছর ধরেই, ধীরে ধীরে, চলছিল এই সৃষ্টিকাজ।প্রায় এক হাজার বছর আগে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ লেখা হয়। অনুমানিক খ্রিস্টাব্দ ৬০০ থেকে ১২০০ এর মধ্যে। এ সময় বাংলায় চলছিল গুপ্ত-পাল-সেন-বর্মণদের রাজত্ব। গুপ্ত এবং পালরা ছিলেন বৌদ্ধ। তাই চর্যাকার বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রতি তাদের কোনো বিদ্বেষ ছিল না। কিন্তু কলিঙ্গের বর্মণ এবং কর্ণাটকের সেন রাজারা ছিলেন ব্রাক্ষণ্য বাদী। সিংহাসনে বসেই তারা রাজ্য থেকে বৌদ্ধদের বিতাড়িত করেন। আর্য এবং সেনরা বাঙালিদের তাদের মাতৃভাষা বাংলা থেকে বঞ্চিত করে রেখেছিল। আর্যদের কাছে অনার্যরা মানুষ বলেও গণ্য হত না। এ কারণেই বিভিন্ন গোত্রের অনার্যরা আর্যদের কাছে পরিচিত ছিল দস্যু, রাক্ষস, যক্ষ, নাগ, পক্ষী, কুকুর, দৈত্য প্রভৃতি নামে। অর্থ্যাৎ, বহিরাগত এসব রাজারা বাংলাকে কোনো প্রকার মূল্যই দেয়নি। কিন্তু তবুও তারা বাংলা ভাষাকে চিরদিনের জন্য মুছে দিতেও পারেনি।
তৃতীয় পাতা :
বাংলা ভাষা হল দক্ষিণ এশিয়ার পূর্বপ্রান্তের প্রায় ৩০ কোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলা বিশ্বের বহুল প্রচলিত ভাষাগুলোর মধ্যে এর অবস্থান চতুর্থ । বাংলা ভাষা হল বাংলাদেশের প্রধান ভাষা; ভারতে বাংলা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কথিত ভাষা। অসমীয়া ও বাংলা ভৌগলিকভাবে সবচেয়ে পূর্বে অবস্থিত ইন্দো-ইরানীয় ভাষা।বাংলা ভাষাকে সংস্কৃতের মেয়ে বলা হয়। এর কারণ সংস্কৃতের সাথে বাংলা ভাষার সম্পর্ক নিবিড়। প্রশ্ন হতে পারে, এই সম্পর্কের ভিত্তি কী? ভিত্তি প্রধানত শব্দকোষগত। সংস্কৃত আর বাংলার মধ্যে শব্দকোষ আর রূপতাত্ত্বিক নিয়মের মিল আছে এবং সেই নিয়মের ভিত্তিতেই সংস্কৃতকে বাংলার জননী বলে মনে করা হয়। কিন্তু বাক্য বিন্যাসের দিক থেকে যদি দেখা হয় তবে কোনো ভাষাই অন্য ভাষার দুহিতা হতে পারে না, বাংলাও এর ব্যাতিক্রম নয়। বাংলা ভাষা ঐতিহাসিকভাবে পালির সাথেই বেশি সম্পর্কিত ছিল। তবে কিনা মধ্য বাংলায় চৈতন্য যুগে ও বাংলা সাহিত্যের আধুনিক রেনেসাঁসের সময় বাংলার ওপর সংস্কৃত ভাষার প্রভাব বৃদ্ধি পায়।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল প্রকাশিত ‘বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি প্রতিবেদন ২০০৯' অনুষায়ী বর্তমানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যা ৬৮২ কোটি ৯৪ লাখ। এরা প্রায় ৬ হাজার ভাষায় কথা বলে। তবে ভাষাতত্ত্ববিদরা মনে করছেন,আগামী একশ বছরের মধ্যে প্রায় তিন হাজার ভাষা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এক হিসেবে দেখা গেছে, আজকের পৃথিবীতে প্রতি দুই সপ্তাহে একটি করে ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, পৃথিবীতে এমন ৫১টি ভাষা আছে যেগুলোর প্রতিটিতে মাত্র একজন করে ব্যবহারকারী রয়েছে! এ চিত্র থেকে একটা বিষয় পরিস্কার যে, বিশ্বের জীবন্ত ভাষাগুলো দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। এই বিলুপ্তির হার বন্যপ্রাণী কিংবা গাছপালা বিলুপ্তির হারের চেয়েও বেশী।
চতুর্থ পাতা :
"আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি /আমি কি ভুলিতে পারি? " একুশ আমার চেতনায়,একুশ আমার প্রেরণায়। একুশ আমার অহংকার,একুশ আমার অলংকার। কবির ভাষায়-
“একুশ আমার ব্যাথায় কাতর চোখের বারিধারা,
একুশ আমার শূণ্য হিয়ায় আকাশ ভরা তারা।
একুশ আমার রক্ত রঙ্গিন কৃষ্ণ চূড়ার ডাল,
একুশ আমার ঝাঁঝড়া হওয়া চোট্ট ঘরের চাল। "
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে যে ঘটনা ঘটেছিলো তা প্রতিটি বাঙালির হৃদয়কেই রক্তাক্ত করে। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট ভারতের বুকের এক অংশ কেটে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। পাকিস্তানের আবার দুটি ভাগ ছিলো, পশ্চিম পাকিস্তান আর পুর্ব পাকিস্তান। বাংলা ভাষা এবং বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি চরম অবজ্ঞা পোষণ করে যে দিন হাতে নতুন শিকল পড়ানো হয় তার পরিনাম হয় মারাত্বক। পাকিস্তানের নব্য উপনিবেশ বাদী, ক্ষমতালিপ্সু,শাসকরা শুরু থেকেই মানুষের উপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালাতে থাকে। প্রথমেই তারা ফন্দি আঁটে কিভাবে এদেশের মানুষের মুখের ভাষাকে কেড়ে নেওয়া যায়। এ অংশের মানুষকে বসে রাখার জন্য তারা বাংলাভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং বাঙালিদের ঘাড়ে পাকিস্তানি সংস্কৃতি চাপিয়ে । পাকিস্তানের রাষ্ট প্রধান মোঃ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে এক সমাবেশের ঘোষনা করেন যে,উর্দু ভাষাই হবে পুর্ব পাকিস্তানের মূল ভাষা। কিন্তু দেশের ছাত্র যুবকরা সে সমাবেশেই প্রতিবাদ করেন। । প্রতিবাদের ভাষা এবং এর ব্যাপকতা ক্রমেই বাড়তে থাকে।পাকিস্তানি সরকার সকল প্রতিবাকে পাশবিক শক্তি দ্বারা দমনের চেষ্টা চালায়। তাদের একপেশে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামে অবর্তীন হয় দেশের মানুষ। এদেশের দামাল ছেলেরা মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বজ্রকঠিন শপথ গ্রহণ করে। র্পূব বাংলার র্সবত্র ছড়িয়ে পড়ে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন। আন্দোলনের পুরোভাগে এসে দাঁড়ায় এদেশের ছাত্র ও যুবসমাজ। আন্দোলনে সংগ্রামে বাংলা ভাষা একুশে ফেব্রুয়ারী তারিখে প্রতিবাদ সভা এবং মিছিল হবে তা আগেই ঘোষনা দেওয়া হয়েছিলো। পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করার জন্যে সরকার ১১ ফেব্রুয়ারী ১৪৪ ধারা আইন জারী করে। ২০শে ফেব্রুয়ারী রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্ররা গোপন বৈঠক করে এবং সিদ্ধান্ত হয় যেমন করে হোক তারা ১৪৪ লঙ্ঘন করবেই।সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একুশে ফেব্রুয়ারীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে আহত হয় ছাত্রদের প্রতিবাদ সভা। সভা শেষে তারা মিছিল বের করে। সেদিন ছাত্রসমাজের প্রতিবাদী কন্ঠে ধ্বনিত হয় অধিকারের দাবি। প্রাদেশিক অধিবেশন বসেছিল সেসময়। ভাষার দাবিতে সোচ্চার মিছিলটি এগিয়ে যায় প্রাদেশিক ভবনের দিকে। মিছিলটি ছত্রভঙ্ঘ করার জন্যে পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের বেপরোয়া গুলি বর্ষনের ফলে রাজ পথে লুটিয়ে পড়ে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, সফিউল প্রমূখ দামাল ছেলেরা। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে তারা লিখে যায় এক অনন্য ইতিহাস। তাদেঁর নিঃসৃত রক্তে সে দিন লেখা হয়ে যায় পুর্ববাংলার অমোঘ ভাগ্যলিপি। তাদের এ মহান ত্যাগের ফলেই বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার সম্মান লাভ করে। বাঙালির স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে থাকে সেই দিন। ভাষা শহীদদের ত্যাগের বিনিময়ে ২১শে ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পেয়েছে। ভাষা শহীদরা তাদের জীবন দিয়ে আমাদের শিখিয়েছে, একুশ মানে মাথা নত না করা। মূলত একুশের যে আন্দোলন তা শুধু ভাষার আন্দোলন নয়, তা ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের আন্দোলন। এ ধরনের আন্দোলন অতীতেও ছিল, বর্তমানের আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
পঞ্চম পাতা :
বর্তমান বিশ্বে প্রায় কোটি কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত The Summer Institute of Linguistics এর হিসেবে অনুয়ায়ী ব্যবহারকারীর সংখ্যার দিক থেকে বাংলার অবস্থান ৪র্থ।" আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিয়নে বাংলাকে ২য় সরকারী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।১৯৬১ সালের মে মাসে বাংলা ভাষার ব্যবহার বন্ধ করার প্রতিবাদে ভারতের আসামের শিলচর শহরে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছেন ১১ জন। রাজ্য সরকার শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয়। এরপর আসামে বাংলাকে সরকারী ভাষা বলে মেনে নেওয়া হয়।
বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায় করতে গিয়ে বাঙালীরা যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা ইউনেস্কোর নজরে আনার জন্য প্রচেষ্টা শুরু হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর। এই প্রচেষ্টা সফল হয়। ওই দিন ইউনেস্কোর ৩০তম অধিবেশনে ২১শে ফেব্রুয়ারীকে ‘আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবস' হিসাবে স্বীকৃতি জানানোর প্রস্তাব উত্থাপন করে এবং অপর ২৫টি দেশের সদস্যরা সেটিকে অনুমোদন করে। এরপর থেকে সারা বিশ্বে প্রতি বছর পালিত হয়ে আসছে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।' ইউনেস্কোর পর জাতিসংঘও একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০০৮ সালের গত ৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এ স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে জাতিসংঘ ভাষা শহীদদের প্রতি নিঃসন্দেহে ব্যাপক সম্মান দেখিয়েছে। জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে এখন ছয়টি ভাষা স্বীকৃত। এসব ভাষা হলো- ইংরেজি, চাইনিজ, আরবি, ফরাসি, রাশিয়ান ও স্প্যানিস। এর মধ্যে রুশ ভাষায় কথা বলে বিশ্বের প্রায় ১৭ কোটি মানুষ । কিন্তু বাংলায় কথা বলে প্রায় ২৫ কোটি মানুষ। ফলে রুশ যদি জাতিসংঘের অফিশিয়াল ভাষা হওয়ার যোগ্যতা রাখে তাহলে বাংলা কেন পারবে না? যদি ভারত এবং বাংলদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা এই বিষয়ে জোরদার করে তাহলে একদিন না একদিন বাংলাভাষা অবশ্যই জাতিসংঘের অফিশিয়াল ভাষার স্বীকৃতি পাবে। বাংলা ভাষা যদি জাতিসংঘের অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায় তাহলেই 'ভাষা শহীদ'দের আত্মত্যাগ স্বার্থক হবে। আমার মতে কেবল ফেব্রুয়ারিতেই নয়, মাতৃভাষার চর্চায় আন্তরিক থাকতে হবে সারা বছর। বাংলাভাষা শুদ্ধভাবে বলতে ও লিখতে হবে এবং এ ভাষার সাহিত্য ও সম্পদের সাথে আমাদের পরিচিতি বাড়াতে হবে। কেননা মাতৃভাষার গৌরব বাড়লে আমাদেরও গৌরব বাড়বে।
ডায়েরি পড়তে পড়তে হারিয়ে গিয়েছিলাম সেই সময়কার দিন গুলোতে। চমক ভাঙ্গে দূরে আজানের মন কেমন করা সুরে। ঠান্ডা হাওয়াতেই ডায়েরীটা বুকে জড়িয়ে বসে থাকি। পাখিরা ঘরে ফেরে, আমি আর ফিরতে পারি না। শাঁখ বেজে ওঠে দূর দূর বাড়ি থেকে, কাঁচঘেরা কৃষ্ণমন্দিরে বেজে ওঠে সন্ধ্যা-আরতির ঘন্টা, হিম হিম ধূপের গন্ধে কুয়াশা ঘেরে আমার চারধার। আলতো নরম একটা ভালোলাগা এসে জড়িয়ে ধরে আমায়, খানিকটা মেঘ যেন কি করে জমে ছিল পাশের আমগাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে। আরও কত মেঘ যেন মনে হল কুয়াশার জামা পড়ে দূরে দূরে ঘুরে উড়ে ভেসে গেল। কানে কত কত ফিসফিসে স্বরে অচেনা ভাষার অজানা ডাক পেয়ে সাতটা সাগরের সাতটি ভাষার নদী এঁকে বয়ে গেল এ মেঘ থেকে ও মেঘ। তবু আমি ঘরে ফিরিনি, একা একা আমার ডায়েরি বুকে চেপে বসে থেকেছি। কুয়াশারা আশপাশ ভরেছে আলভোলা আতরে, চোখ বুজে নিঃশ্বাসে টেনে নিয়ে ফুসফুসের কুঠুরিতে কুঠুরিতে ভরে নিয়েছি সেই সময়ের বাংলার ভিজে ঘাসের গন্ধ। মেঘেরা সরে গেছে অনেক অনেক দূরে। আজকের দিন বুনেছে রূপকথা।আমার বাংলা ভাষার রূপকথা।
Tags:
প্রবন্ধ