জিললুর রহমান

 ‘এই কবিতা এমনি থাকুক সহজ এবং সুশিক্ষিতা’

বিষন্ন বালকের জানালার ফাঁক গলে দূর দিগন্তের দিকে চেয়ে থাকা কবিতা। উদ্ভ্রান্তির মাঝে প্রেয়সির এক চিলতে হাসি কবিতা। কবিতা আনন্দের মিষ্টি ঝলক, আবার কবিতাই বিষন্নতার ম্লানমুখ, একতাল গাম্ভীর্য। শব্দের পরে শব্দ সাজিয়ে অনন্ত সম্ভাবনা তৈরি হলে কবিতা জন্ম নেয়। কবিতা মোক্ষ – কবিতা রূপক উপমা নিয়ে অদ্ভুত স্বপ্নরাজ্যে ঘুরিয়ে আনে পাঠককে - কবিকে করে তোলে স্বপ্নাতুর। আল মাহমুদের ভাষায় “কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুল খোলা আয়েশা আক্তার”।

যে অনন্ত শব্দগুচ্ছের নাম কবিতা, তার মূলে রয়েছে ধ্বনির অবিস্মরণীয় অনুরণন। আদিতে যখন লিখিত ভাষা ছিলো না, তখনও মানুষ হৃদয়ের গভীরে উচ্চারণ করেছে ধ্বনি। মানুষের অবসর, তার শ্রম কিংবা সংগ্রাম – সকল কাজেই গুনগুনিয়ে লতিয়ে উঠেছে কিছু ধ্বনি। হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত এইসব ধ্বনিগুচ্ছই আদিতম কবিতার অপ্রকাশ্য স্বরূপ বৈকি! পরে পরে, বর্ণের আবির্ভাবে বিমূর্ত ভাষা মূর্ত হয় - খোদাই হয়, পাথরের গায়ে, তাল ও শালের পাতায়। 

এই কবিতা চিত্রকলার মতো আদি শিল্প মাধ্যমও বটে। বর্ণের জন্মের পর, বর্ণগুলো বিবর্ণ পাতায় ইতস্তত সাজাতে সাজাতে জন্ম নিলো অজর কবিতা। মুনি ঋষিদের হাতে সৃষ্টি হলো মহাকাব্যের। কোথাও গিলগামেশ এর কাব্য, কোথাও রামায়ন, মহাভারত, আবার কোথাও বা ইলিয়াড, ওডেসি। তারও অনেক পরে, এমনকি আল কুরআন এর ভাষাও কবিতা বৈকি। 

মনের ভাব প্রকাশই যদি কবিতার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তবে সকল বেদনার ভাষা কবিতা, সকল আনন্দের ভাষা কবিতা। কিন্তু আজ আমি কিছু বললেই কি তা কবিতা পদবাচ্য হয়? কিছু লিখলেই কি তা কবিতা পদবাচ্য হবে? যদি না হয়ে থাকে, তবে কী এমন বস্তু এই কবিতা নামের সোনার হরিণ, যার পেছনে দৌঁড়াতে গিয়ে অনেকেই হারিয়েছে জীবনের প্রবল বৈভব! 

কোন মোক্ষ লাভের নেশা কবিকে তাড়িয়ে ফেরে ঘর থেকে পথে, পথ থেকে আড্ডায়? সে কোন ‘পরশ পাথর আমি খুঁজে ফিরি খ্যাপার মতোন’? এখনও ঘোরের মধ্যে সে কোন বনলতা প্রশ্ন রাখে “এতদিন কোথায় ছিলেন”? কে এই বনলতা? কে তারে দেখেছে হৃদয়ে? সিংহল সমূদ্র থেকে কেন কবি ফিরে আসেন এই বাংলার মাঠ লতা ভাঁটফুলের সৌন্দর্যের কাছে? কবি আজ আর নেই জাগতিক জীবনে, কিন্তু বনলতা আমাদের বুকের গহীনে নিয়ত বাস করে। এই বনলতা সেনের চোখ চুল আর অপেক্ষার অফুরাণ ধৈর্য পাঠক মনের অবিচ্ছেদ্য ভালোবাসা। এরকম একজন বনলতা সেন এর জন্ম নেওয়া মানে এক নতুন জীবনানন্দীয় মিথের জন্ম নেওয়া – একটি কাহিনী, একটি প্রেমের আর অনেক পাওয়া না পাওয়ার বেদনা। 

তেমনি সহস্র বছরেরও অনেক অনেক আগে কনো এক কবি মেঘের খামে পাঠিয়েছিলেন ভালোবাসার বার্তা – শকুন্তলা হয়তো সে বার্তার রাখেনি খবর, কিন্তু মেঘে মেঘে বেলা অনেক গড়িয়ে গেলেও আমরা ভুলিনি সে মেঘবার্তার বাণী। সে উজ্জ্ব্যিনিপুর নেই, নেই কবি কালিদাস, তবু, “তাহার কালের স্বাদ ও গন্ধ, আমিতো পাই মৃদুমন্দ, আমার কালের কণামাত্র পাননি মহাকবি”। আজ শকুন্তলা কী কবি কালিদাস আর এমনকি এযুগের রবীন্দ্রনাথ সকলেই স্বপ্নলোকের বাসিন্দা। কিন্তু মহাযুগের ওপার হতে কবিতার বাণী আমাদের কান এসে পৌঁছেছে ঠিকই। 

তবে কি কবিতা সে সকল অনন্ত অক্ষর যা হাজার বছর ধরে রয়ে যাবে মানুষের মনে? সিন্ধু নদের মতো বয়ে যাবে বিপুল বৈভবে পীরপাঞ্জালের গা ধুয়ে ধুয়ে? কবিতা নশ্বর জগত থেকে কবিকে অবিনশ্বরতায় নিয়ে যায়। এমন অনেক কবিতার চরণ আমরা জানি, যার রচনা কার হাতে হয়েছে তা আমাদের জানা নেই, কিন্তু প্রতিনিয়ত আমাদের উদ্ধৃতিতে, যাপিত জীবনে এর ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। 

সময়ের সাথে সাথে তাই কবিতা উন্নীত হয় এমন এক মাত্রিকতায়, যা কেবল মনের ভাব প্রকাশেই সীমিত নয়, তাকে হয়ে উঠতে হয়েছে “উপমাই কবিতা” আর “শব্দের প্রকৃষ্টতম বিন্যাস”, যা মহাকালের সীমানা ডিঙ্গিয়ে আমাদের ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যায়। কবিতা অজর, কবিতা নির্বাণ লাভ করে। কবিতা মেল বন্ধন রচনা করে যুগের সাথে যুগের, হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের। 

কবিতার চলে নানান নীরিক্ষা, নানা দর্শনের প্রভাবে কবিতায় ঘটে নানা বাঁক বদল। চর্যাগীতিকার কবিরা বৌদ্ধ মতের অনুসারী হয়ে যে সব চরণ রচনা করেন, পরবর্তীতে ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির প্রভাবে মনসা মঙ্গল কাব্য বা চন্ডীমঙ্গল কাব্য সে একই ভাব, ভাষা, বা শব্দ প্রকরণে উচ্চারিত হয় নি। আবার বিষাদ সিন্ধুর মেজাজ সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার পরে যদি আমরা মেঘনাদ বধ কাব্যে আসি, সে তো প্রচণ্ড তোলপাড়। আর রোমান্টিসিজমের বরপুত্র বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা সে কোন অতলে ভাসিয়ে ডুবিয়ে আনে কবিতার পাঠক হৃদয়কে? আর যদি জীবনানন্দের ভাষায় বলি, “আলো অন্ধকারে যাই – মাথার ভেতরে / স্বপ্ন নয়, - কোন এক বোধ কাজ করে।/ স্বপ্ন নয় – শান্তি নয় – ভালোবাসা নয়, / হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!” 

কবিতা তাই বোধের বহিঃপ্রকাশ, সময়ের সাথে সাথে চির পরিবর্তমান। কবিতায় তাই কালের আঁচড় লেগে থাকে। আমাদের যুগেও কবিতায় নানা নীরিক্ষা কর্ম পরিলক্ষিত হয়েছে। কেউ সচেতনভাবে আর কেউবা অবচেতনে নিজ প্রতিভায় কবিতাকে এক এক ধাপে উন্নীত করার প্রয়াস পেয়েছেন। কবিতা তাই ধীরে ধীরে ব্যক্তিক বোধের ভেতর থেকে সমষ্টির প্রগাঢ় উচ্চারণে পরিণত হয়। তাইতো উচ্চারন হয় – “শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে কিরাতেরা উঠিয়েছে হাত / হিয়েনসাঙ্গের দেশে শান্তি নামে দেখ প্রিয়তমা, / এশিয়ায় যারা আনে কর্মজীবি সাম্যের দাওয়াত / তাদের পোষাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকোমা”। কবিতা আজ নানা মাত্রিকতায় নিজেকে মেলে ধরে। মানুষের দুঃখ, বেদনা, প্রতিবাদ, ব্যররথতা, আকুতি সবই আজ কবিতায় ঢুকে পড়েছে। 

কবিতায় লোককথার ব্যবহার, মিথ ও আন্তর্বয়ন ইত্যাদির কারণে বিগত নব্বই দশক থেকে কবিতার একটা নতুন চেহারা আমাদের সামনে উপস্থিত হতে থাকলো। নানা নামে নানা অভিধায় কবিতার সংজ্ঞায়নে অনেকেই অনেক সময় ব্যাপৃত থেকেছেন। আমার কেবলি আবেদন, সে আবুল হাসানের ভাষায়, “এই কবিতা এমনি থাকুক সহজ এবং সুশিক্ষিতা’। মনে অবশ্যই রাখতে হবে ‘অন্তর বাজে তো, যন্তর বাজে’।

-- 

Dr. Mohammad Zillur Rahman Secretary General, SAARC Academy of Cytopathology & Histopathology (SACH) HOD & Associate Professor, Pathology, Chittagong Medical College, Chittagong, Bangladesh.  Email: drzillur@gmail.com Website: new.cmcpath.com & sach-web.org


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

নবীনতর পূর্বতন