অসুরপুরে সোর উঠেছে জোরসে সামাল সামাল তাই
কামাল ! তু নে কামাল কিয়া ভাই’ !
‘দামাল ছেলে’র একটা চেহারা বোধয় নজরুলের ‘কামাল পাশা’ কবিতায় রয়েছে । এ তো অনেক পুরনো কথা । সেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সময়কালের । এ যুগের দামাল ছেলেদের ‘কামাল’ করার পন্থা-প্রকরণ বদলেছে । কয়েক মাস আগে কোন এক রাজনৈতিক দলের বাহুবলী কর্মী কলেজের ভেতরে এক শিক্ষিকার মুখে জলের জগ ছুড়ে ছিলেন । শোনা যায় তার দলের নেতারা নাকি তাঁর পিঠ চাপড়ে ছিলেন দলের ‘দামাল ছেলে’ বলে । কে যেন সেদিন জিজ্ঞাসা করছিল ‘দামাল ছেলেরা সব গেলো কোথায়? আমি বলি, যাবে কোথায়, আছে তো ! তবে অন্য চেহারায় । আগে রকে বসে সিগারেট ফুঁকত । ছোট ছেলেদের দুষ্টুমি দেখে এড়িয়ে যেতাম আর এখন কলেজের অধ্যক্ষকে মেরে চশমা ভেঙ্গে দিলেও ‘ছোট ছেলেদের দুষ্টুমি’ আখ্যা পায় । দুষ্টুমির ধার ও ভার বেড়েছে । ফারাক এ’টুকুই ।
বাংলার দামাল ছেলেদের নিয়ে আমাদের সমাজ জীবনের কত গৌরব গাথা, কত গল্প আমাদের সাহিত্য নাটক, কবিতা, চলচ্চিত্র ও সঙ্গীতে । সেই ১৯১১র জুলাইএ এগারোটা দামাল ছেলের ফুটবল কীর্তি – গোরা সেনাদের হারিয়ে আই এফ এ শিল্ড জিতে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরব-গাথায় যায়গা করে নেওয়া, কে ভুলবে বাংলার দামাল ছেলেদের সেই গৌরব-কথা ! বাঙালি দামাল ছেলেরা এখন আর তেমন ফুটবল খেলে না । তাদের দামলপনা এখন যে ভিন্ন আশ্রয়ে ফুলছে, ফাঁপছে । কবি সুকান্ত দামাল ছেলেদের একটা ছবি এঁকেছিলেন তাঁর ‘আঠেরো বছর বয়স’ কবিতায় –
‘আঠেরো বছর বয়স কী দুঃসহ
স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠেরো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি ।
সুকান্ত ডাক দিয়েছিলেন ‘এ দেশের বুকে আঠেরো আসুক নেমে’ । স্বাধীনতার সংগ্রামে বাংলার দামাল ছেলেদের গৌরবগাথা রচনা করেছিলেন ক্ষুদিরাম, প্রফুল্লচাকি, সূর্য সেনরা । স্বাধীনতার পরের তিনটি দশকে সুকান্তর ‘এদেশের বুকে আঠেরো’ নেমে এসেছিল অন্তত তিনটি দশক জুড়ে । তারপর আশির দশক পর্যন্তও দামালপনা আর আঠেরোর আবেগের কিছু অবশেষ ছিল ।
এলোমেলো হওয়া শুরু সত্তরের দশক থেকে। ‘এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে’, সুকান্তর সেই স্বপ্ন বুকে নিয়ে এক ঝাঁক তরুণ দামাল শোনালেন ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’ রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে। বলা ভালো দামালরা ব্যবহৃত হলেন। সত্তরের দশকটাই যেন হয়ে গেলো বাংলার আদর্শবাদী দামাল ছেলেদের মৃত্যুর দশক। কবি বিমল ঘোষ তাঁর কবিতার পংক্তিতে সেইসব দামালদের পরিণতির ছবি এঁকেছিলেন এইভাবে –
‘কিনু গোয়ালার গলি
সোনার টুকরো ছেলেরা সব অশ্বমেধের বলি
বারুদগন্ধ বুকে নিয়ে আকাশে ফোটে জ্যোৎস্না
ময়লা হাতে ওকে তোরা ছুঁস না
ওরে মন, পৃথিবীর গভীর - গভীরতর
অসুখ এখন’
সত্তর দশকে অসুখের শুরু । আর আশির দশকে মধ্যভাগ থেকে এতোদিনের চেনা দামাল ছেলেরা কেমন বেবাক বেপাত্তা হয়ে গেলো । তারা গেলো কোথায় ? এমন তো নয় যে তারা সব চাকরী-বাকরী পেয়ে প্রভুত উন্নতি করে হারিয়ে গেলো । আসলে তাদের দামালপনা অন্য খাতে বইয়ে দেওয়া হল । দিলেন তাঁরা, যারা এইসব দামালদের ব্যবহার করে ওপরে উঠলেন । দামাল ছেলেরা সব কেমন যেন পুতুল হয়ে গেল । ‘যেমন নাচান তেমন নাচি’ । তাদের সামনে কোন আদর্শবাদ নেই, নেই তার নিজের সমাজ ও পারিপার্শিকের প্রতি কোন ভালোবাসা, ভালোবাসার আবেগ । তারা হয়ে গেলো নেই রাজ্যের বাসিন্দা ।
প্রয়াত অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর ‘ছন্নছাড়া’ কবিতাটির কথা নিশ্চয়ই মনে পড়বে । ওদের কথা লিখেছেন পরম সংবেদনায় –
‘ওরা বিরাট এক নৈরাজ্যের – এক নেইরাজ্যের বাসিন্দা
ওদের জন্য কলেজে সিট নেই
অফিসে চাকরি নেই
কারখানায় কাজ নেই
ট্রামে বাসে জায়গা নেই
খেলায মেলায় টিকিট নেই
হাসপাতালে বেড নেই
বাড়িতে ঘর নেই
খেলবার মাঠ নেই
অনুসরণ করবার নেতা নেই
প্রেরণা জাগানো প্রেম নেই
ওদের প্রতি সম্ভাষণে কারুর দরদ নেই ......’
এতো নেইএর মধ্যেও তবু ওরা ছিল । মৃতদেহ সৎকার করতে, পাড়ায় রাত-পাহারা দিতে, হাসপাতালে মুমুর্ষু রোগীর পাশে রাত জাগতে এরা একডাকে ঝাঁপিয়ে পড়তো । বিয়ে বাড়িতে গেঞ্জি গায়ে কোমরে গামছা বেঁধে পরিবেশনের বালতি নিয়ে ছুটোছুটি করতো এই সেদিনও । এখন অবশ্য ফোন করলেই মৃতদেহ সৎকারের সু-সজ্জিত গাড়ি চলে আসে, ক্যাটারিংএর কর্মীরা স্যুট-টাই পরে পরিবেশন করে । পাড়ার ছন্নছাড়ারা অতয়েব অন্য আশ্রয়ে । এখন আর অচিন্ত্যকুমারের দেখা সেইসব ছন্নছাড়াদেরও বাড়বাড়ন্ত হয়েছে । রাস্তায় কোন বৃদ্ধের রক্তাক্ত দেহ পড়ে থাকলেও ‘প্রাণ আছে, প্রাণ আছে’ উচ্ছ্বাসে ট্যাক্সি থামায় না তাকে হাসপাতালে পৌছে দিতে । এখন চোর অপবাদে দাগিয়ে আর এক মেধাবী তরুণকে পিটিয়ে মেরে ফেলেও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের কোন ভাবান্তর দেখতে পায় না !
‘আমাদেরই ছেলে বিজয় সিংহ হেলায় লঙ্কা করিল জয়’ বলে দামাল ছেলেদের কোন প্রাচীন গৌরবগাথার আবেগে যাবো না । কিন্তু এও তো জানি যে ঐসব ছেলেদের দামালপনা আমাদের সামাজিক ইতিহাসেরও উপাদান হয়ে যায় । বাঙালির দামালপনার চির শ্রেষ্ঠ প্রতীক হয়ে আছেন সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস । সেই কবে দেড়শো বছর আগে ‘থাকবোনাকো ঘরের কোণে, দেখবো এবার জগৎটাকে’ এই মন্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন সারা বিশ্ব । কৈশোরে জাহাজের স্টুয়ার্ট থেকে সার্কাস কোম্পানীতে বাঘ-সিংহ’র খেলা দেখিয়ে বেড়ানোর পর থিতু হয়েছিলেন সুদূর ব্রাজিলে । অসীম সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দিয়ে ব্রাজিলের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে হয়েছিলেন কর্নেল সুরেশ বিশ্বাস । আড়াইশো বছর আগেকার এক ঘটনা ছুঁয়ে যাই । তখন দূর্গাপূজার আয়োজন করতেন জমিদাররা যেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার থাকতো না । হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়ায় এই রকম এক দূর্গাপূজায় কিছু তরুণকে ঢুকতে দিল না জমিদারের লোকজন। অপমানিত, উৎসবে প্রত্যাখ্যাত সেই বারো জন তরুণ ঠিক করলো, কুছ পরোয়া নেই, আমরাই করবো দূর্গাপুজা । পরের বছর ঐ বারোজন দামাল তরুণ উদ্যোগী হয়ে চাঁদা তুলে শুরু করলো দূর্গাপূজা । সেই দিন থেকে শুরু হরে গেলো বারোয়ারি দূর্গাপূজা । সেটা ১৭৬১ সালের কথা। এইসব দামালরা চিরকালই আমাদের সস্নেহ প্রশ্রয় পেয়েছে, প্রকাশ্যে না হলেও আড়ালে । এদের জন্য আমাদের বুকে কোথাও যেন একটা ভালোবাসার যায়গা ছিল । আর ছিল বলেই আজ খুঁজে বেড়াই, জানতে চাই দামালরা সব গেল কোথায় ?
ওদের আশ্রয় বদল হয়েছে, ওদের আবেগ এখন অন্য আশ্রয়ে । আমাদের সাহিত্য, কবিতা, চলচ্চিত্র, গানেও আর তারা নেই । এখন কোন পাগলা দাশুর দুরন্তপনা নেই, হর্ষবর্ধন- গোবর্ধন কিংবা টেনিদার বিচিত্র কান্ডকারখানা নেই, এখন কোন ঘনাদার আড্ডাঘরে দেশ-বিদেশের রাজা-উজির মারা নেই । এখনকার দামালরা স্বপনকুমার, নীহারগুপ্ত পড়ে সময় নষ্ট করে না, পাড়ায় মাচা বেঁধে থিয়েটার করে না, ফুটবল মাঠে মাউন্টপুলিসের ঘোড়ার লাথি খায় না । ।
হাহাকার নয় । আমিও তো একদিন দামাল-দুষ্টুর দলে ছিলাম, ছিলাম প্রবলভাবেই ! তবে সবটাই হতাশার তাই বা বলি কেন? সংখ্যায় কম হলেও এখনও তো দেখতে পাই তরতাজা কোন কিশোর বাসে কোন বৃদ্ধের জন্য উঠে বসার যায়গা করে দিচ্ছে, এটিএমএর লাইনে অসুস্থ প্রাণের কাছে একগ্লাস জল এগিয়ে দিচ্ছে । কে না চাই তাদের দিল ভারি হোক । চাইছি সময়ের চলমান স্রোতে কৈশোর ও তারুণ্য এলোমেলো করে দেওয়া সময়ে তারা আর ফিরবে না জেনেও বলতে ইচ্ছা করে ফিরে এসো, ফিরে এসো দুষ্টু-দামালরা ।