ঝিলিমিলি

মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা!
বাংলা ভাষার গুরুত্ব ব্যাক্তি জীবন তথা সামাজিক স্তরে কেমন হওয়া বাঞ্ছনীয় আমার আলোচনার সূত্রে আমি ক্ষুদ্র জ্ঞানে কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। আমরা ব্যাক্তি জীবনে প্রত্যেকেই ভাষার কাছে দায়বদ্ধ, এই ভাষার কাছেই আমাদের অস্তিত্ব সংরক্ষণ করা আছে। ভাষার বিশাল ভাণ্ডারে আমাদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি মজুত আছে। সেখানে আমাদের বার্তার কথা ধুলার সাথে, জলের সাথে, ফুল ও ফলের সাথে মহা সমারোহে আকাশ তলের গান হয়ে মৃদঙ্গের তালে আমি হয়ে দোল দিয়ে যায়। কত স্মৃতি কাঁদন হয়ে ক্ষত জাগে, কত সংকল্পের জয়তরু পরান ভরে নৃত্য তোলে। নদী আর পাহাড় আমার চোখের ভেতর বয়ে বেড়ায়, কৈশোরের ডিঙাও ভিড়ে সুদূরের বেলার তীরে। আমি বসেই থাকি সেই দোয়েলের গান শুনব বলে, বসেই থাকি পাল তোলার ক্ষণে প্রেমে ভেসে যেতে। 

ওগো প্রভাত, শরত বেলার শিউলি তলার ছন্দে-গন্ধে মোহন বেলার নরম তুলি বুলিয়ে তুমি যাও। আমার দেশের মাটির গন্ধ খুঁজি শরীর খুঁড়ে।পাকা ধানের সৌরভে বাউল গায় কন্ঠ ছেড়ে। শ্রাবণের মুষলধারের অবিরাম জলধারার ঝমঝম ঝরঝরের, বা-দর, মা-হো ভা–দরো । শূন্য মন্দির মোর। দেবী নাই মন্দির তাই শূন্য। ডাকে ডাহুকি, মত্ত দাদুরি ফাটি যাওয়া ছাতিয়া। এ দাদুরী আমাদের আদুরী কোন কন্যা নয়, বর্ষার দিনে ব্যাং ডাকছে কাতর ধ্বনির দুঃখের ঘন্টা বাজিয়ে। আসলে ও আমদের ভালবাসার মানুষটির অভাব ব্যাক্ত করে আমাদের বুকের ভেতরে, আমরা দহনের শোকে ক্ষণকাল কিংকর্তব্য বিহীনের হয়ে পরি। আমরা বিশ্ব শক্তির চরণে কাতর ভাষায় শান্তি যাচি তখন। কান্না-হাসির দোলাচলের মানুষ আমরা। জ্যোৎস্নারাত্রের সৌন্দর্য পীরিত কবির প্রাণ মুগ্ধতায় প্রার্থনার সাথে মিলনের মালা গাঁথে। প্রকৃতির চঞ্চলছন্দে নিখিলের যে হৃদয়স্পন্দ অনুভব করা যায় তার মুকুলিত কলি ফোঁটে উঠে কবি প্রাণ যোগে। ঋতু বৈচিত্রের দেশের খোশ-কাহিনী জায়গায় জায়গায় ছড়িয়ে আছে। কাউকে ছেড়ে দেওয়া যায় না, আবার বহুকাল প্রাণে বেধে রাখাও যায় না। শূন্যতা আর পূর্ণতার এই দুইয়ের অনড় নাড়ায় বৈচিত্রের যেমন সীমাহীনতা তেমনি এক বুক হাহাকারের অশ্রুমালার সাগর, সেখানে ভালবাসার টুপটুপ জল রাতের আঁধারে নিঃশব্দে গড়িয়ে পরছে। মানুষ কেন এত দুঃখকে আলিঙ্গন করেও তবু ঘর সংসারে ডুবে আছেযাকিনাকবি বা সাধারণ মানুষের বোধগম্যের বাইরে। 

আমাদের দেশে অগণিত মানুষের বসবাস,অনেক শিশুর কলধ্বনিতে দেশ সবুজে ছেয়ে যাবার কথা। আমার দেশ ছেড়ে নিউজিল্যান্ডে চলে আসার পেছনের কাহিনী হচ্ছে ভাগ্যকে জোড়া দেওয়ার চেষ্টা করা। যা দেশে করতে পারিনি, বিদেশে এসে বাকীটা ঝালাই করে নেবার সংকল্প তো গোড়াতেই থাকে। তবে এ’দেশের নিয়ম আমাকে ত্বরান্বিত করে নিয়ে গেছে ন্যায়নীতির হাত ধরেই, সমস্যা এলেই সমাধানের পথ বিস্তৃত। কি করতে পেরেছি বা পারি নি সে অন্য কথা— টিকে আছি এটাই বড় কথা। দেশের ঢাকা শহরের আজিমপুর থেকে প্রকৌশল আবাসিক এলাকায় আসার পথে বিশেষত শীতকালে পথের শিশুদের দেখতাম আর কেঁদে আকুল হতাম ওদের এমন দুর্দশা দেখে দেখে। আবার মা বাবার আবাস ছেড়ে নিজের ঘরে ফিরে যাবার প্রাক্কালে প্রমিজ করতাম এই বলে যে ওই সকল শিশুদের কাতর দৃশ্য আর দেখব না, কিন্তু না দেখে উপায় ছিল না, গোপন কান্নাটা নিজের একান্তেই  সেরে নিতাম। কিছু কারো জন্যে ঠিক করতে পারিনি শুধু সেই সময়ের কম বয়সের কোমল পরানের মা হয়ে দুঃখ পেতাম। আজও অবিকল তেমনিতে দেশের সাজশয্যা, কোন ভারসাম্য নাই, শ্রেণী বিন্যাসের বিভেদ সেই একই কাতারে দাঁড়িয়ে আছে। আজ আমার শিশুরা বড় হয়েছে, শিক্ষা যা পেয়েছে নিজেদেরকে চালিয়ে নেবার পক্ষে যথেষ্ট আর এই কৃতজ্ঞতা এই দেশের শিক্ষা পদ্ধতিকে জানাতে হয়। কিন্তু আমি মনে করি বাংলাদেশের শিশুদের প্রতিনিধি স্বরূপে তাদেরকে ভূমিকা নিতে হবে। আমাকে এই গল্পগুলোকেও আমাদের সন্তানদেরকে বলতে হবে তাদের পথ চলার নির্দেশিকা হিসাবে। 

আমরা বাংলাদেশের নাগরিক, আমাদের পাসপোর্টে আমাদের চেহারা সাপটে দেওয়া আছে, রক্ত মানুষের মানুষ হয়ে আমরা আমাদের ভৌগোলিক ইতিহাসকে বহন করে আছি। বিদেশের ঘরে দেখা যাবে অনেকেই বাংলা ভাষাকে পারিবারিক পরিসরে স্থান দেনা না, তারা বাংলা কথা ভুলে যাবার জন্যেই ইংরেজিতে ছেলেমেয়েদের সাথে কথা বলে থাকেন। অনেক শিক্ষিত মানুষের মনমানসিকতা এমন মুঢ়তার পরিচয় কেন যে দেয় জানি না। তারা ভুল করছেন এবং এ ঘোর অন্যায়। ভাষাকে জীবন্ত কবর দেওয়া মানে নিজের জাতিসত্ত্বাকে দেওলিয়া করে দেবার নামান্তর। কিন্তু সচেতন করে দেবার জন্যে নিউজিল্যান্ডেই আমাদের বাংলাদেশী কমিউনিটি আছে যেখানে মায়েরা তাঁদের শিশুদেরকে বাংলা পড়াতে দেন,শিশুরা সেখানেই বাংলা গান শিখছে। তা ছাড়াও আমাদের দেশের মুক্তি যোদ্ধাদের কথা, ভাষা আন্দোলনের কথা শহিদ দিবসের মঞ্চে শিশুরাই সাবলীল কণ্ঠে উচ্চারণ করছে , কবি লেখকের অবদানের কথা নজরুল ও রবীন্দ্রনাথের জন্ম মৃত্যুর স্মরণ সভায় তারা জানতে পারছে। আমাদের দেশের মহান ব্যাক্তিত্বের কথা অনুজদেরকে জানানোর আগ্রহ গড়ে তোলার সদা চেষ্টা সর্বোপরি গড়ে উঠছে, পাঠাগারে বাংলা বইয়ের সংগ্রহ উল্লেখ যোগ্য নজীর রাখছে। দেখা যাচ্ছে এই প্রজন্মের ছেলে মেয়েরাই বাংলা কবিতা বা গল্প লিখতে হাতে খড়ি রাখছে। এরাও বড় হবে দেশের সকল শিশুদের প্রতিনিধি হয়ে, অনেকের বুকেই হয় তো সংকল্প বাধবে দেশ ও জাতিকে বিশ্বের দরবারে পরিচয় ঘটিয়ে দিতে।

বাংলাভাষা বিস্তারের ক্ষেত্রে আমাদের জাতিগত কতগুলো ত্রুটি আছে যা আমাদেরকে আস্ট্রেপৃষ্ঠে বেধে রাখছে মানে বদ্ধ জলাশয়ের মত বাংলা ভাষা মুখ থুবড়ে পরে আছে। আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবিগণ ভালভাবেই জানেন সেই দুর্বলতার স্থান কিন্তু তারা স্পষ্ট ভাষায় জানান দিলেও নিজেরা তা বাস্তব জীবনে পালন করেননি। মনের কথা মনে রয়েই গেল, দেখা তো হল না তার! কারণ আমরা তাকে আধঘাট বেধে আসলে দেখতে চাই না। আমরা ত্রুটিটাকে জানি কিন্তু সংশোধনের জন্যে বাড়তি ঝামেলা পোহাতে চাই না। কারণ এই সমস্যা সমষ্টিগতের জন্যে তোলা থাকল, বৃহৎ আমির সমস্যা দূর করে ক্ষুদ্র আমির স্বার্থ তাৎক্ষণিকভাবে পূরণ হবার নয়। কোন এক বইয়ে পড়েছিলাম বাংলা অক্ষরে প্রথম স্বাক্ষর রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা শিক্ষক মরহুম মুনির চৌধুরী। স্বাধীন দেশে মুনির চৌধুরীর নজীর ধরে আরও অনেক নামিদামী বুদ্ধিজীবী বাংলার মাধ্যমে পড়াশুনা করার ব্যাপারে বাঙালি মনপ্রাণকে উৎসাহিত করেন। বিধবা বিবাহ তখনি সমাজে জনপ্রিয় হতে পেরেছিল যখন স্বয়ং বিদ্যাসাগর নিজে সেই সাথে ঘটনাকে মোকাবেলা করলেন মানে নিজের ছেলের সাথেইএকজন বিধবাকে বিবাহ করিয়ে সকল কু-সংস্কারকে ভেঙে দিলেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে মুনির চৌধুরী সহ তাঁর সমসাময়িক সকল বুদ্ধিজীবী তাঁদের সন্তানদেরকে ইংরেজি মাধ্যমেই লেখাপড়া করিয়ে সমাজের উচু স্তরে তাঁদেরকে উত্তরণ করিয়েছিলেন। সমাজে ভাষার নতুন কোন দিগন্ত আর খুলল না। দেশের শিক্ষা পদ্ধতির মর্যাদা কোন ভাবেই উত্তরণ হল না এই বাংলা ভাষাকে কাজে লাগিয়ে , কাজেই জীবনের সকল অধ্যায়ে আমাদের ভাষা বাস্তব সম্মত হয়ে উপযোগিতা পেল না। তদুপরি নানান রকম তঞ্চকতা বাংলা ভাষাকে দিনে দিনে এমনি গ্রাস করছে তা থেকে ভাষার মুক্তির কোন অবকাশই মিলছে না। 

বাংলার মাটিই ভাষার জনম দিয়েছে, চারিদিকের জল হাওয়া তাকে পুষ্ট করেছে মা ডাক শুনার জন্যে। জন্ম হয় অসহায় মানুষের, চোখ মেলে দেখে বাংলা ভাষা তাকে স্বাগত জানাচ্ছে হাসি হাসি মুখে। আর ঠিক তার পূর্বেই সূর্যটা পর্যাপ্ত আলো ফেলছে সস্নেহে শিশুর মুখে যেন ভাষাটার সাথে আত্মস্থ হতে পারে সে। শিশু মগ্ন হয়, ডানা নারে ভালবাসার গভীর পেয়ে, এক সময় মা ডেকে উঠে চিৎকার দিয়ে, আনন্দের জয়টিকা তার কপালে পরিয়ে দেয় তার মা। সবই ভাল চ্লছিল কিন্তু হঠাৎ কালো কালো মেঘের ঝড় হল। দানব কুড়িয়ে নিল শিশুকে । কিন্তু ফিরিয়ে দিল মস্তিস্ককে বদলে দিয়ে, তাই তার সব কিছুকে অচেনার মনে হয়, বিদ্রুপের ভঙ্গিমায় সে চতুর্দিকটা কে দেখে, তার মায়ের এত সাদামাটা রঙ কে সহজে মেনে নিতে পারে না। এক নিমেষে সে সহোদর ভাইকে অবজ্ঞা করে। মাকে তারা কেটে ফেলতে চায় বিভক্ত করে, সে মোতাবেক১৯ ৪৭ এর ঘটনা ঘটে, মাটির সাথে বেইমানি করা হয় । মাকে নিয়ে টানা হিঁচড়া চলে না, সত্যের যে কোন বিকল্প হয় না সে কথাকে তারা আমলে আনছে না। তারা সাম্প্রদায়িকতার নিরিখে মাকে দাবী করছে, মা বলছেন আমার হাতে আশীর্বাদ ছাড়া অন্য কোন বিভেদের রঙ নাই । তোমরা ভাতৃদ্বয় মিথ্যা মারামারিতে রক্তাক্ত হও না। আমাদের ভাষাই তো মা, ওকে কাঁদিয়ে আমাদের কি কোন উপকার হবে, আমরা আমাদের মাকে সাজাতে পারছি না- ভাষাকে রক্তাক্ত করা হচ্ছে ।

হ্যাঁ, আমাদের মনিষীরা ছিলেন কিছু আগের যুগেও, কিন্তু আমাদের রাজনীতির দুষ্ট প্রহরে তারা পিষ্ট হয়ে গেছেন। মুসলিম সমাজের মাতাল প্রায় আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে যে মিথ্যা ধর্ম কর্মের মধ্য দিয়া মানুষ আবর্তিত হচ্ছে সে পথ থেকে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে দর্শন, যুক্তিবাদী বা বিভিন্ন চিন্তার আলোকে ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ নিরূপণের চেষ্টা করেও প্রতিহত হন মনিষী বর্গ। সৈয়দ আমির আলি জীবন্ত ধর্ম বিশ্বাসকে ফিরিয়ে আনার উপলক্ষ্যে সংস্কার আন্দোলন বাঞ্ছনীয় বিবেচনা করেছিলেন। আর তাই প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে মাতৃ ভাষায় নামাজ পড়া ও অন্যান্য এবাদত বন্দেগি করার কথা অপকপটে আহ্বান করেন। না বুঝে এবাদত করার মধ্যে কোন সাফল্য নাই , তিনি তার স্পিরিট অব ইসলামের দার্শনিকতত্ব প্রসঙ্গে যুক্তিবাদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। স্রষ্টার স্বরূপ এবং জগৎ ও জীবনের যুক্তি সঙ্গত ব্যাখ্যার প্রয়াসে সাধারণ মানুষকে চেতনাবিদ্ধ করার অভিপ্রায় ছিল । তাঁর দর্শনের মূল কথা ছিল বিশ্বাস নয়, যুক্তিবাদঃ বস্তুত সব দর্শনের মূল কথাটা তাই।-

মাতৃ ভাষার চর্চার অভাবে ইসলামেও স্বাধীন চিন্তার পথে অন্তরায় রয়ে গেছে। বিখ্যাত মনিষী মওলানা আকরাম খাঁ ছিলেন যুক্তিবাদী ধর্মচিন্তাবিদ । তিনি এক কথায় বলেছেন “মুসলিম জাতির সংস্কার করিতে হইলে তাহার মস্তিস্কের সংস্কার আগে করিতে হইবে”। যা হোক আমার ধর্ম নিয়ে আলকপাত করার উদ্দেশ্যে নয় বরং ভাষার একটা মস্ত বড় সুযোগ রয়ে গেছে, সে হল মুক্ত চিন্তা করার বিরাট মাঠ। আমরা মাতৃ ভাষাকে সূর্যের দীপ্তির্র সাথে তুলনা করতে পারি সেখানে পরের ভাষা একটি ল্যান্ঠনের আলো মাত্র। আমরা আমাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করতে না পারার ফলে ধর্মকে আমরা খন্ডিত চিত্র হিসাবে পাই ফলত জাতির উন্নতিতে এর কোন সুরাহা হয় নাই। আকরাম খাঁর মতে ধর্ম বিশ্বাস কখনও অন্ধবিশ্বাস বা অলৌকিকতার নির্যাস নয়। প্রকৃত ধর্মচিন্তার ইতিহাস এখানে লুপ্ত বরং সামাজিক ইতিহাস ক্রমবর্ধমান যার উৎপত্তি অন্ধ বিশ্বাস আর অলৌকিক কাহিনীতে পর্যবেষিত। আমরা তাই সাম্প্রদায়িকের কুপোমন্ডিতে নিজেদের চাষাবাস করি, আমরা লাঞ্ছিত হই নিজেদের হাতেই। 

ভাষার বৃহৎ পরিমন্ডল যা আমাদেরকে দিতে পারত তা থেকে আমরা বঞ্চিত, সমাজের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতগত অবস্থানে আজ আমরা নাজুক । আমাদের মধ্য ঐক্য গড়ে উঠছে না , কারণ নিজেদেরকে নিজেদের কাছে থেকে বিভক্তিকরণে আমরা লিপ্ত। বাংলা ভাষাকে মাসির মত ভালোবাসা , আরবি আর ইংরেজিকে নিজের মা করে দেখতে পারলে যেন বর্তে যাই। কিন্তু আসলে আমরা কিন্তু এই আরবি বা ইংরেজীর সন্তান নই কখনও। আমাদের মা ছেঁড়া কাপড়ে দাঁড়িয়ে আছেন, শীর্ণ তাঁর দেহ যার প্রতি আমরা আমাদের দৃষ্টি সরিয়ে রেখেছি সযতনেই। 

আমাদের হিন্দু ধর্মে একই গলদ রয়ে গেছে মানে লোকাচারের কাছে তাঁদের সমগ্র ধ্যান ধারণার সহজ প্রবেশ আর এর বাইরে গিয়ে মানব সমাজকে নিরীক্ষণ করার উদার মানসিকতা তাদেরও গড়ে উঠছে না। 

আমরা ইবাদত আর পূজা দেই স্রষ্টার বিভিন্ন নাম দিয়ে, ভাই ভাইয়ের হাত বলিষ্ঠ ভাবে না ধরেই। তাই আমাদের সকল আয়োজন আর অনুষ্ঠানাদি মার খায়, আমরা বলি আমাদের ভাগ্যের এই দৈনতাকে মেনে নিতেই হবে। কিন্তু আসলে আমাদের চিন্তা সূত্র মার খায় আমাদের প্রতিটি কাজের ফল হিসাবে যা আসে তাই ভাগ্যের নির্মাতা। আমরা সুদূর প্রসারি চিন্তা ভাবনা থেকে বিমুখের হয়েই থাকছি । কারণ আমাদের পুরানো ব্যাধি আছে যাকে আমরা পোষণ করে রাখি, তার ঘর হল সাম্প্রদায়িকতা, আমরা পুজা বা আরোধনা সেই ঘরের বেদিকেই করি। স্রষ্টা সেখানে উপবেশন করেন না, তাই হাতে নাতে কোন সোনার পাত্র জাতির কাছে আসে না। সব কিছু তাই উপহাসে পরিণত হয়। আমাদের নজরুল ছিলেন সাম্প্রদায়িকের উর্ধে একজন মানুষ। বিশ্ব মানবের তীর্থে মিলনের কল্পনা আমাদের বিশ্বকবির ছিল, বাংলার বাউল সম্প্রদায়গণ চন্ডী দাসের ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ সেই নীতির অনুসারী হয়েই তাঁদের আধ্যাত্মিকতার গোড়াপত্তন করেন।-

এক সময় আমাদের গোলা ভরা ধান ছিল, পুকুর ভরা মাছ ছিল, মানুষের সাথে মানুষের হরিহর আত্মা ছিল। দেশকে পুনরুদ্ধার করার একটাই উপায় -- যে জিনিষ থেকে বিষ ক্রিয়া হয় তাকে বর্জন করাই শ্রেয় কারণ তা থেকে আমাদের কোন কালে কিছু অর্জন হয় নি – তা হল সাম্প্রদায়িকতা। -

আমরা আশাবাদী, আমাদের অনুজেরা শিক্ষার ধ্বজা জ্বালিয়ে একদিন আমাদের নিজেদের স্বরূপকে আবিস্কার করবে । মাইকেল মধুসূদন কবিতাতে আক্ষেপ করে বলেছিলেন তাঁর পরধন লোভ করার মত বোকামি দ্বিতীয়টা যেন না হয় । আমাদের ভাষা সচল হবে বাড়ির ভেতর পেরিয়ে সকল দপ্তরে । প্রকৃত শিক্ষায় দীক্ষিত হতে পারলে আমাদের দৃষ্টি খুলবে , ভাষার প্রতি যে অনাচার ঘটেছে উপলব্ধি যোগে দেশের মানুষ অচিরেই জানতে পারবে এবং ভাষার সাধনার উত্তর পত্রে আমরা আমাদের জাতিসত্তাকে পুনরুদ্ধার করতে পারব আর বিশ্বের দরবারে বাংলাভাষা নিজেই সবাকে দাঁড়িয়ে থাকার প্রাণ পাবে।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

নবীনতর পূর্বতন