সে আজ থেকে বছর দুই আগের কথা - ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি । চলেছি শান্তিনিকেনের পথে - কমপার্টমেন্টে সব মিলিয়ে আট-দশ জন হব - সকালের বোলপুর এক্সপ্রেসে ।
আমার বরাবরই শখ একটু একা একা অচেনা জায়গা থেকে ঘুরে আসা। এই ধরুন বৃহস্পতিবার গাড়িতে উঠলাম আবার রোববার বাড়িতে চলে আসলাম। তিরচার মাস অন্তর সে সুযোগ মিলত সহজেই। তা সে বার পূজোর ছয় সাত দিন পরেই হঠাৎ ঠিক হয়ে গেল শান্তিনিকেতন। পিসতুতো দাদাও রাজি। ব্যাস ল্যাপটপ থেকে টিকিট সঙ্গে সঙ্গে কাটা হয়ে গেল। তারপর আমি ফোন করে ঘর বুক করলাম, হোটেল ছিল বোলপুর লজ ।
ট্রেনের মধ্যে চারিদিক চেয়ে দেখলাম আমার চারপাশে যাদের দেখছি যুবক আমরা দুজন ছাড়া আর মাত্র একজন- ঠিক আমাদের উল্টো দিকের সিটে বসে কাগজে মুখ গুঁজে ! সেও কি আমাদের মতো শান্তিনিকেতন যাচ্ছে ? খুবই কৌতূহল হল । তাই নিজে থেকেই তার সাথে আলাপ করলাম । জিজ্ঞেস করলাম -
- নমস্কার , আপনিও কি শান্তিনিকেতনে যাচ্ছেন ?
- না , আমি বর্ধমান নেবে যাব । ওখানেই আমার বাড়ি । ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ি । অনেক দিন পর...
কথা শেষ করার আগেই চা চাই কিনা প্রশ্ন পাশ থেকে - যুবকই দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন তা চলতেই পারে - তিন কাপ দিন দেখি ! ভালো বিস্কুট আমার সাথেই আছে -ভাই ব্যাগটা ধরো একটু - ভাই বললাম রাগ করলে ?
আমি মৃদু হেসে বললাম , তাতে কি - ভাই তো বটেই ।
যুবক হঠাৎ বললে -আমি যদি দু কাপ চা বেশি খাই আপনারা আশা করি কিছু মাইন্ড করবেন না - প্লিজ ...
আমি অবাক হয়ে তাকে দেখতে লাগলাম ... আমি যেখানে কাপ হাতে ধরে অনেক ফুঁ টুঁ দিয়ে ভয়ে ভয়ে ঠোঁটে লাগাচ্ছি, আর সেখানে ও চোঁ চোঁ করে খেতে লাগলো - তাও এক কাপ নয় , তিন কাপ!
যুবকই প্রশ্ন করলে - তোমরা প্রতিবাদের মূল্য বোঝ ?
দিনটি ছিল শরতের। খুব নীল আকাশ । মাঝে মধ্যে সাদা গোল গাল মেঘ হেসে খেলে বেড়াচ্ছে - ঝক্ঝকে রোদ্দুর - মাঠের পরে মাঠ ভেঙে ট্রেন ছুটছে - বিদ্রোহীর মতো হঠাৎ হঠাৎ ঢুকে পরা বাতাসে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে । মোট কথা যে পরিবেশে বিপ্লব - প্রতিবাদ ইত্যাদিকে কল্পনা বলেই মনে হয় সে পরিবেশে এমন প্রশ্ন শুনে আমরা দুজনই একটু নড়ে চড়ে বসলাম ।
দাদা বললে - খুব সম্ভাবত না। আমরা কোনদিন প্রতিবাদ করি নি, হয়তো আমারা তেমন বাধ্য হয়নি এখনো বা আমাদের কেউ শেখাই নি আবার আমাদের প্রতিবাদ করার যোগ্যতা নাও থাকতে পারে ...
যুবক বললে - বুঝলাম । আমাকে দেখুন আপনারা - আমি প্রতিবাদী।আমি ... হ্যাঁ আমি। প্রতিবাদ করেছি।করেছি কেন এখনো করছি - যতদিন বাঁচবো করে যাবো !
আমরা দুজনেই খুব অবাক হলাম - শুধু বললাম কি ভাবে ? যুবক সিগারেট ধরালো - তারপর পর পর দুটো লম্বা টান .. তারপর বললেন ...
- খুব সোজা গল্প প্রথমটা। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের একটা মেয়েকে এক রাতে শ্লীলতাহানি করলো দশ যুবক। মেয়েটির বাবা অভিযোগ করলো কলেজ কতৃপক্ষকে। তারা স্টেপ নেওয়া তো দূরে থাকুক উল্টে ব্যাপারটাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করলো। প্রথমে প্রমান করার চেষ্টা করলো যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা কেউই ওদিন ছিল না। তারপর টাকা ও অন্যান্য সুযোগের লোভ !
- তারপর পুলিশ !
- হুমম , তারা ! কিছুই করলো না । উল্টে এ খবর রাষ্ট্র হল। মেয়েটি দুঃশ্চরিত্র। মদ্যপ অবস্থায় কাটায় বেশিরভাগ সময়। জানেন , মেয়েটির এসব আর সইল না। আত্মহত্যার পথ অনেক সোজা। এক্কেবারে সবার ঝুটঝামেলাও মিটে যায়। মেয়েটি সেই পথ বেছে নিল ! সব থেকে দুঃখের মেয়েটির পাশে একটাও জনপ্রাণী দাঁড়ায়নি। অন্তত একটু সহানুভূতি একটু ....
আমিও মেয়েটির জীবন থাকতে আর দাঁড়াতে পারলাম না। একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল জানেন ! তবুও আমি থেমে থাকিনি। একদিন গেলাম কলেজে। সব ছেলে মেয়েকে বোঝালাম। কেউ আমার কথা একটুও শুনলো না । পরদিন সরাসরি গেলাম কতৃপক্ষের সাথে কথা বলতে। আমাকে পাত্তা দিল না। অশ্রাব্য গালি দিয়ে তাড়িয়ে দিল। চার পাঁচ যুবককে সাথে পেলাম তারপর দিন, আবার কলেজে গিয়ে প্রতিবাদ করলাম তীব্র ভাষায় , ওরা আমাকে খুব পিটালো। তারপর থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে লকআপে ঢুকিয়ে দিল, অপরাধ একজন বহিরাগত হয়ে আমি কলেজে উত্তেজনা ছড়াচ্ছি !
এরপরেও রাত্রে খুব পিটালো আমাকে। বললো আর যেন না হয়, একসময় তারপর ছেড়েও দিল ! আমি আর মেসে ফিরলাম না। সারারাত কলেজের গেটের সামনে পড়ে রইলাম। সকালে সবাই যখন আসতে শুরু করেছে সবাই কে আবার বোঝালাম। কেউ কেউ পাগল ভেবে ফিরে গেল জানেন। কিন্তু কেউ কেউ রয়ে গেল - তাদের নিয়ে আবার বিক্ষোভ শুরু করলাম ।
হটাৎ দশ পনেরোটা ছেলে আমাকে ঘিরে ধরলো। আমি আমার তৈরি স্লোগান দিয়ে চলছিলাম। আমাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল কলেজের বাইরে, বেধরক পিটালো। আমার জ্ঞান লোপ পাচ্ছিল , তবুও বুঝতে পারছিলাম আমাকে থানায় নিয়ে এসেছে ওরা। পরদিন সকালে দেখি আমি হসপিটালের বেডে - শরীর ব্যাথায় অবশ প্রায় - পনেরো দিন পর ছুটি পেলাম । আমি ভাবলাম কলকাতা শহরের নাগরিক - তারা অন্তত আমার আবেদন শুনবে - একটু সুবিচারের জন্য সহানুভূতি প্রার্থনা করবে ।
কালো পোশাকে গা ঢেকে সারা দেহে পোষ্টর এঁটে - রাজপথে হাঁটলাম, হ্যাঁ নীরব প্রতিবাদ ! হ্যাঁ অনেক তাকালো বটে কিন্তু একটা মানুষও কাছে আসেনি , তাদের কি ইন্টারেস্ট বলুন এতে ? যাই হোক আবার লকআপে ঢুকলাম - আবার মার খেলাম।
আমার তখন মনে হচ্ছিল , কি লাভ এসবের ? কেন আমি কোথাকার কার জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করছি । নানাবিধ চিন্তায় জর্জরিত ঘুম রাতে বুঝলাম - স্বপ্ন কি ? না না স্বপ্ন হতে পারে না - একটা মেয়ে আমাকে বলছে , তার জামা কাপড় কে ছিঁড়ে দিয়েছে - চোখ ফুলে গেছে - গালে একটু নখের আঁচড়। দাদা একটু সহনাভুতি , প্রার্থনা কি অপরাধ ? আমি যদি তোমার বোন হতাম - কিম্বা প্রেমিকা - পারতে কি আমাকে ফেলে দিতে এমন ?
আবার জ্বলে উঠলাম, ভোরের অনেক আগেই সেই কালো পোষাকে বেড়িয়ে পড়লাম। মানুষের গুলোর এতো উপেক্ষা আর সহ্য হল না একদিন - গায়ে আগুন দিতে গেলাম প্রকাশ্য রাজপথে - না না না , আমি এখানেও ব্যার্থ .... পুলিশ ধরে ফেলে দিল - তারপর অত্যাচার ছাড়া আর কি । অনেকদিন পর কাল ছাড়া পেলাম - বাড়ি ফিরছি তাই। বাড়ির মানুষ গুলোকে দেখার জন্য বুকটা হু হু করছে - তবে কে জানে সেখানে আমার জন্য আর ঠাঁই আছে কিনা ! "
অনেকক্ষণ চুপ , আমি কি যে বলি বুঝতেই পারছি না । বললাম , কেমন নীরবে একটা প্রাণ শেষ হয়ে গেল - কিন্তু কারো শাস্তি হল না !
- "কে বলেছে ! আমি আবার ফিরবো কোলকাতা। বর্ধমানে আমার বন্ধুদের একত্রিত করে আবার শুরু করবো। আমি হয়তো শেষ হবো কিন্তু আমার প্রতিবাদের মশাল অন্যদের হাতে তুলে দিয়ে তারপর... । এই দেখ - বর্ধমান চলে আসলো - নামতে হবে এবার, উঠি ! এই দেখ আপনাদের নামটাই জানা হল না !"
বললাম নাম - যুবক নিজে থেকেই বললে আমার নাম রামপ্রসাদ কুন্ডু ! এর পর আমরা দুজনই বোলপুর পর্যন্ত কোনো কথা বলেনি । তারপর থেকে বর্ধমান নামটা শুনলেই যুবকের কথা মনে আসে - মাঝে মধ্যে খোঁজও করি রাজপথে কেউ কি এমন প্রতিবাদ আজও করছে ? কেউই কিছু বলতে পারে নি , আমিও কয়েক মাসের ভীতর একেবারে ভুলে গেলাম !
#
আজ এসে ছিলাম হোক কলরবে । ছাতা আনতে ভুলে গেছি , বৃষ্টিতে ভিজছি। ভালোই লাগছিল। খুব উত্তেজনা অনুভব করতে করতে চলছি পায়ে পায়ে। সমাজের অনেক বড় বড় মানুষরাও আছেন তাদের সাথেও একটু কথা বলে নিচ্ছি। হঠাৎ একটা ছেলেকে দেখে চমকে উঠলাম - খুব চেনা ... খুব চেনা ... কাছে গেলাম , বললাম তোমাকে খুব চেনা লাগছে ...
- তুমি কি আমার পরিচিত কেউ ? তোমার নাম কি ?
ছেলেটি বলল - শ্যামপ্রসাদ কুন্ডু !
আমি রিতিমত চমকে বললাম - আচ্ছা তুমি রামপ্রসাদ কুন্ডু কে চেনো ?
ছেলেটি বলল - আমার দাদার নাম । আমাদের বাড়ি বর্ধমানে !
আমি এবার দু হাতে ওকে ধরে বললাম - তার কি খবর ! কেমন আছে সে ?
-" ছয় মাস হলো দাদা মারা গেছে ! পুলিশের মারে কোমরের হাড় ভেঙে যায় - সেখানে ক্ষত হয়ে ক্যানসার হয় - সাত মাস মতো যন্ত্রনা সইতে হল আর কি ! মৃত্যুর একটু আগে দাদা একটা ছোট্ট কাগজে প্রায় না বোঝা বাঁকা বাঁকা অক্ষরে কি লিখে গিয়েছিল জানেন ?
- কি ...!
-'''আমি প্রতিবাদী' ... "
আমার বরাবরই শখ একটু একা একা অচেনা জায়গা থেকে ঘুরে আসা। এই ধরুন বৃহস্পতিবার গাড়িতে উঠলাম আবার রোববার বাড়িতে চলে আসলাম। তিরচার মাস অন্তর সে সুযোগ মিলত সহজেই। তা সে বার পূজোর ছয় সাত দিন পরেই হঠাৎ ঠিক হয়ে গেল শান্তিনিকেতন। পিসতুতো দাদাও রাজি। ব্যাস ল্যাপটপ থেকে টিকিট সঙ্গে সঙ্গে কাটা হয়ে গেল। তারপর আমি ফোন করে ঘর বুক করলাম, হোটেল ছিল বোলপুর লজ ।
ট্রেনের মধ্যে চারিদিক চেয়ে দেখলাম আমার চারপাশে যাদের দেখছি যুবক আমরা দুজন ছাড়া আর মাত্র একজন- ঠিক আমাদের উল্টো দিকের সিটে বসে কাগজে মুখ গুঁজে ! সেও কি আমাদের মতো শান্তিনিকেতন যাচ্ছে ? খুবই কৌতূহল হল । তাই নিজে থেকেই তার সাথে আলাপ করলাম । জিজ্ঞেস করলাম -
- নমস্কার , আপনিও কি শান্তিনিকেতনে যাচ্ছেন ?
- না , আমি বর্ধমান নেবে যাব । ওখানেই আমার বাড়ি । ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ি । অনেক দিন পর...
কথা শেষ করার আগেই চা চাই কিনা প্রশ্ন পাশ থেকে - যুবকই দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন তা চলতেই পারে - তিন কাপ দিন দেখি ! ভালো বিস্কুট আমার সাথেই আছে -ভাই ব্যাগটা ধরো একটু - ভাই বললাম রাগ করলে ?
আমি মৃদু হেসে বললাম , তাতে কি - ভাই তো বটেই ।
যুবক হঠাৎ বললে -আমি যদি দু কাপ চা বেশি খাই আপনারা আশা করি কিছু মাইন্ড করবেন না - প্লিজ ...
আমি অবাক হয়ে তাকে দেখতে লাগলাম ... আমি যেখানে কাপ হাতে ধরে অনেক ফুঁ টুঁ দিয়ে ভয়ে ভয়ে ঠোঁটে লাগাচ্ছি, আর সেখানে ও চোঁ চোঁ করে খেতে লাগলো - তাও এক কাপ নয় , তিন কাপ!
যুবকই প্রশ্ন করলে - তোমরা প্রতিবাদের মূল্য বোঝ ?
দিনটি ছিল শরতের। খুব নীল আকাশ । মাঝে মধ্যে সাদা গোল গাল মেঘ হেসে খেলে বেড়াচ্ছে - ঝক্ঝকে রোদ্দুর - মাঠের পরে মাঠ ভেঙে ট্রেন ছুটছে - বিদ্রোহীর মতো হঠাৎ হঠাৎ ঢুকে পরা বাতাসে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে । মোট কথা যে পরিবেশে বিপ্লব - প্রতিবাদ ইত্যাদিকে কল্পনা বলেই মনে হয় সে পরিবেশে এমন প্রশ্ন শুনে আমরা দুজনই একটু নড়ে চড়ে বসলাম ।
দাদা বললে - খুব সম্ভাবত না। আমরা কোনদিন প্রতিবাদ করি নি, হয়তো আমারা তেমন বাধ্য হয়নি এখনো বা আমাদের কেউ শেখাই নি আবার আমাদের প্রতিবাদ করার যোগ্যতা নাও থাকতে পারে ...
যুবক বললে - বুঝলাম । আমাকে দেখুন আপনারা - আমি প্রতিবাদী।আমি ... হ্যাঁ আমি। প্রতিবাদ করেছি।করেছি কেন এখনো করছি - যতদিন বাঁচবো করে যাবো !
আমরা দুজনেই খুব অবাক হলাম - শুধু বললাম কি ভাবে ? যুবক সিগারেট ধরালো - তারপর পর পর দুটো লম্বা টান .. তারপর বললেন ...
- খুব সোজা গল্প প্রথমটা। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের একটা মেয়েকে এক রাতে শ্লীলতাহানি করলো দশ যুবক। মেয়েটির বাবা অভিযোগ করলো কলেজ কতৃপক্ষকে। তারা স্টেপ নেওয়া তো দূরে থাকুক উল্টে ব্যাপারটাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করলো। প্রথমে প্রমান করার চেষ্টা করলো যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা কেউই ওদিন ছিল না। তারপর টাকা ও অন্যান্য সুযোগের লোভ !
- তারপর পুলিশ !
- হুমম , তারা ! কিছুই করলো না । উল্টে এ খবর রাষ্ট্র হল। মেয়েটি দুঃশ্চরিত্র। মদ্যপ অবস্থায় কাটায় বেশিরভাগ সময়। জানেন , মেয়েটির এসব আর সইল না। আত্মহত্যার পথ অনেক সোজা। এক্কেবারে সবার ঝুটঝামেলাও মিটে যায়। মেয়েটি সেই পথ বেছে নিল ! সব থেকে দুঃখের মেয়েটির পাশে একটাও জনপ্রাণী দাঁড়ায়নি। অন্তত একটু সহানুভূতি একটু ....
আমিও মেয়েটির জীবন থাকতে আর দাঁড়াতে পারলাম না। একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল জানেন ! তবুও আমি থেমে থাকিনি। একদিন গেলাম কলেজে। সব ছেলে মেয়েকে বোঝালাম। কেউ আমার কথা একটুও শুনলো না । পরদিন সরাসরি গেলাম কতৃপক্ষের সাথে কথা বলতে। আমাকে পাত্তা দিল না। অশ্রাব্য গালি দিয়ে তাড়িয়ে দিল। চার পাঁচ যুবককে সাথে পেলাম তারপর দিন, আবার কলেজে গিয়ে প্রতিবাদ করলাম তীব্র ভাষায় , ওরা আমাকে খুব পিটালো। তারপর থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে লকআপে ঢুকিয়ে দিল, অপরাধ একজন বহিরাগত হয়ে আমি কলেজে উত্তেজনা ছড়াচ্ছি !
এরপরেও রাত্রে খুব পিটালো আমাকে। বললো আর যেন না হয়, একসময় তারপর ছেড়েও দিল ! আমি আর মেসে ফিরলাম না। সারারাত কলেজের গেটের সামনে পড়ে রইলাম। সকালে সবাই যখন আসতে শুরু করেছে সবাই কে আবার বোঝালাম। কেউ কেউ পাগল ভেবে ফিরে গেল জানেন। কিন্তু কেউ কেউ রয়ে গেল - তাদের নিয়ে আবার বিক্ষোভ শুরু করলাম ।
হটাৎ দশ পনেরোটা ছেলে আমাকে ঘিরে ধরলো। আমি আমার তৈরি স্লোগান দিয়ে চলছিলাম। আমাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল কলেজের বাইরে, বেধরক পিটালো। আমার জ্ঞান লোপ পাচ্ছিল , তবুও বুঝতে পারছিলাম আমাকে থানায় নিয়ে এসেছে ওরা। পরদিন সকালে দেখি আমি হসপিটালের বেডে - শরীর ব্যাথায় অবশ প্রায় - পনেরো দিন পর ছুটি পেলাম । আমি ভাবলাম কলকাতা শহরের নাগরিক - তারা অন্তত আমার আবেদন শুনবে - একটু সুবিচারের জন্য সহানুভূতি প্রার্থনা করবে ।
কালো পোশাকে গা ঢেকে সারা দেহে পোষ্টর এঁটে - রাজপথে হাঁটলাম, হ্যাঁ নীরব প্রতিবাদ ! হ্যাঁ অনেক তাকালো বটে কিন্তু একটা মানুষও কাছে আসেনি , তাদের কি ইন্টারেস্ট বলুন এতে ? যাই হোক আবার লকআপে ঢুকলাম - আবার মার খেলাম।
আমার তখন মনে হচ্ছিল , কি লাভ এসবের ? কেন আমি কোথাকার কার জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করছি । নানাবিধ চিন্তায় জর্জরিত ঘুম রাতে বুঝলাম - স্বপ্ন কি ? না না স্বপ্ন হতে পারে না - একটা মেয়ে আমাকে বলছে , তার জামা কাপড় কে ছিঁড়ে দিয়েছে - চোখ ফুলে গেছে - গালে একটু নখের আঁচড়। দাদা একটু সহনাভুতি , প্রার্থনা কি অপরাধ ? আমি যদি তোমার বোন হতাম - কিম্বা প্রেমিকা - পারতে কি আমাকে ফেলে দিতে এমন ?
আবার জ্বলে উঠলাম, ভোরের অনেক আগেই সেই কালো পোষাকে বেড়িয়ে পড়লাম। মানুষের গুলোর এতো উপেক্ষা আর সহ্য হল না একদিন - গায়ে আগুন দিতে গেলাম প্রকাশ্য রাজপথে - না না না , আমি এখানেও ব্যার্থ .... পুলিশ ধরে ফেলে দিল - তারপর অত্যাচার ছাড়া আর কি । অনেকদিন পর কাল ছাড়া পেলাম - বাড়ি ফিরছি তাই। বাড়ির মানুষ গুলোকে দেখার জন্য বুকটা হু হু করছে - তবে কে জানে সেখানে আমার জন্য আর ঠাঁই আছে কিনা ! "
অনেকক্ষণ চুপ , আমি কি যে বলি বুঝতেই পারছি না । বললাম , কেমন নীরবে একটা প্রাণ শেষ হয়ে গেল - কিন্তু কারো শাস্তি হল না !
- "কে বলেছে ! আমি আবার ফিরবো কোলকাতা। বর্ধমানে আমার বন্ধুদের একত্রিত করে আবার শুরু করবো। আমি হয়তো শেষ হবো কিন্তু আমার প্রতিবাদের মশাল অন্যদের হাতে তুলে দিয়ে তারপর... । এই দেখ - বর্ধমান চলে আসলো - নামতে হবে এবার, উঠি ! এই দেখ আপনাদের নামটাই জানা হল না !"
বললাম নাম - যুবক নিজে থেকেই বললে আমার নাম রামপ্রসাদ কুন্ডু ! এর পর আমরা দুজনই বোলপুর পর্যন্ত কোনো কথা বলেনি । তারপর থেকে বর্ধমান নামটা শুনলেই যুবকের কথা মনে আসে - মাঝে মধ্যে খোঁজও করি রাজপথে কেউ কি এমন প্রতিবাদ আজও করছে ? কেউই কিছু বলতে পারে নি , আমিও কয়েক মাসের ভীতর একেবারে ভুলে গেলাম !
#
আজ এসে ছিলাম হোক কলরবে । ছাতা আনতে ভুলে গেছি , বৃষ্টিতে ভিজছি। ভালোই লাগছিল। খুব উত্তেজনা অনুভব করতে করতে চলছি পায়ে পায়ে। সমাজের অনেক বড় বড় মানুষরাও আছেন তাদের সাথেও একটু কথা বলে নিচ্ছি। হঠাৎ একটা ছেলেকে দেখে চমকে উঠলাম - খুব চেনা ... খুব চেনা ... কাছে গেলাম , বললাম তোমাকে খুব চেনা লাগছে ...
- তুমি কি আমার পরিচিত কেউ ? তোমার নাম কি ?
ছেলেটি বলল - শ্যামপ্রসাদ কুন্ডু !
আমি রিতিমত চমকে বললাম - আচ্ছা তুমি রামপ্রসাদ কুন্ডু কে চেনো ?
ছেলেটি বলল - আমার দাদার নাম । আমাদের বাড়ি বর্ধমানে !
আমি এবার দু হাতে ওকে ধরে বললাম - তার কি খবর ! কেমন আছে সে ?
-" ছয় মাস হলো দাদা মারা গেছে ! পুলিশের মারে কোমরের হাড় ভেঙে যায় - সেখানে ক্ষত হয়ে ক্যানসার হয় - সাত মাস মতো যন্ত্রনা সইতে হল আর কি ! মৃত্যুর একটু আগে দাদা একটা ছোট্ট কাগজে প্রায় না বোঝা বাঁকা বাঁকা অক্ষরে কি লিখে গিয়েছিল জানেন ?
- কি ...!
-'''আমি প্রতিবাদী' ... "
Tags:
গল্প