টেন্ডার বার্ড স্কুলের পাশেই ছোট্ট পথচলতি কাঠের দোকান। বাইরে মেনু লিস্ট।
থাইপো-১০,
মোমো- ২০,
ফালে-১০,
আলু থুকপা-১০,
চাউমিন-২৫,
ফ্রায়েড মোমো-২৫।
এটা টেন্ডার বার্ড স্কুলের ক্যান্টিন। আজ রোদ বেশ কড়া। পাহাড়ের ধার দিয়ে ছায়ায় ছায়ায় হাঁটছি। কি সুন্দর সুন্দর সব কাঠের বাড়ি আর লতানো আইপোমীয়ার গোলাপী-বেগুনী ফুলের শোভা। কাঠবারান্দায় শুকোচ্ছে বয়াম ভর্তি লাল লংকার আঁচার,শুকনো মুলো আর চমরীগাইয়ের চীজ।
পাহাড় মানেই একটা চেনা গন্ধ। পাইনের রস, আধপোড়া পেট্রলের ধোওয়া, সোদা মাটি, কাঠ পোড়ানোর ধোঁয়া আর নদী থেকে উঠে আসা জলীয় বাতাস। সব মিলেমিশে গন্ধটা বড়ই অদ্ভুত কোন এক নির্জ্ঞান চেতনার স্তরে গন্ধটা নাড়া দিয়ে যায়.... ইন্দ্রজালের মত মোহগ্রস্থ করে ফেলে মনকে। শ্লথ হয় আসে শরীর। কোন এক অজানায় ছুটতে ছুটতে নিজেকে বিমূর্ত করে ফেলি, প্রকৃতির রাজ্যে।


খুবই আটপৌরে ভাবে সাজানো। কোত্থাও নেই অহমিকার জৌলুস। আমরা ভেতরে ঢুকতেই হাতের কাজ ফেলে এগিয়ে এলেন রবার্ট রাই। সপ্রতিভ মানুষটির চোখে মুখে চঞ্চলতা। দোকানের একটা ধারে জানালা খুলে থাইপো আর ফালে বানাচ্ছিলেন রবার্ট আর তার এক বন্ধু, দুজনে মিলে। জানালা দিয়ে হালকা আলো এসেছে ঘরে। টেবিলের উপর সার করে রাখা থাইপো। আমাদের দেওয়া খাওয়ার অর্ডার টেবিলে দিয়ে আবার চলে গেলো রবার্ট। টেবিলে বসে খাচ্ছি আর এক মনে চেয়ে আছি রবার্টের দিকে। রবার্টের সুনিপুন তৎপর আঙ্গুল গুলি ছন্দবদ্ধ ভাবে "ফালে" গুলিকে পেঁচিয়ে যাচ্ছে---- আবহমান কাল ধরে এভাবেই বয়ে চলে পাহাড়ের প্রাত্যহিকি, পাহাড়ের ঘর গৃহস্থালী। দূরে পাহাড়ের গায়ে ফ্রেম বন্দী বাড়িঘর, কাঠের ধোঁয়া কুন্ডলি পাকিয়ে পাকিয়ে উপরে উঠছে, অসীম আকাশের নীল সামিয়ানায়। রাস্তার বাঁকে পথ আগলে একটা প্রকান্ড পানিসাঁস গাছ। গাছের গায়ে লতানো লাইকেন আর মসের সংসার। সারিবদ্ধ পিঁপড়ের দল আর রঙিন প্রজাপতির ডানায় চলার আনন্দ। প্রকৃতি যেন আদীম অকৃত্তিম ভাবে সাজিয়েছে তার আপন ঘর সংসার।
উত্তরের হিমেল বাতাস লাগে চোখে মুখে। শীতের শুরু। কাঁপন লাগায় পাইনের বনে। পেডং শহর ছাড়িয়ে ঢালু যে পথ রেশিখোলার দিকে এগিয়েছে, সেদিকে অল্প এগোলেই পূর্ন তামাং এর কাঠের দোতালা। গতকাল এখানেই আমরা হোম স্টে (রাত্রিযাপন) করেছি। সুন্দর গোছানো ঘর বারান্দা। সামনেই ছোট একটা ফুলের বাগান। বাগানে ফুটে আছে অর্কিড( সিমবিডিয়াম আলোফোলিয়াম), স্ট্যাগ হর্ণ (প্লাটি সিরিয়াম), বিগনোনিয়া ভেনুস্টা, কসমস আর আইপোমিয়া। ফুটফুটে দুটো বিড়ালের বাচ্চা সারাদিন আমাদের পায়ে পায়ে...। ডাইনিং রুমের দরজা খুলে লাঞ্চের জন্য ডাক দিলেন পূর্ণ তামাং-এর বউ।
উদ্ভিদপ্রেমী পূর্ণ আজ সকালের প্রাতরাশের পর আমাদের নিয়ে গেলেন ক্রস হিলের দিকে। এক এক করে চিনিয়ে দিল - জেপ্রিটা পেন্ডুলেটা, ক্যালিয়েন্ড্রা, কুরো, অসবিকিয়া, আলিসাম, টেরেনিয়া, বুর্গম্যানসিয়া, সাইক্লোমন, আইরিস, প্যাসিফ্লোরা ইনকারনেটা আর আরবোরিয়া(পাহাড়ি লম্বা ধুতুরা).... আরো কত জাতের ফুল ও ফুলের গাছ। কথা বলতে বলতে অনেকটাই চলে এসেছি আমরা তখন। ক্রস হিলের রাস্তা টা যেখানে ৯০ ডিগ্রি কোনে বাঁক ঘুরেছে। সেখানে দু-হাত তোলা যীশু তাকিয়ে আছে সোজা উত্তরে। মিশনারিরা সুদূর অতীতে নাকি তিব্বতে খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের অনেক চেষ্টা করেছিলেন অতীতের সিল্ক রুট ধরে... কিন্তু এ অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্ম খ্রীষ্টের জয়যাত্রা স্তব্ধ করে দেয়। উঁচু বেদীটাতে বসে পূর্ণ বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন কেন তিব্বতে তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্ম(বজ্রযান) প্রসার লাভ করল। পদ্মসম্ভব, অতীশ দীপঙ্কর প্রমুখ বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নিরলস প্রচেষ্টায় তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসার লাভ করলেও তিব্বতীদের প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস (যা মূলত কালা যাদু ) -এর সাথে মিলেমিশে সৃষ্টি হলো তিব্বতের বজ্রযান। পরবর্তী কালে গুরু রিমপোচির হাত ধরে পুনরায় এই ধর্ম হিমালয়ের দক্ষিনে ছড়িয়ে পড়ে। পূর্ণর গল্প শুনতে শুনতে হারিয়ে যাই ---- সময় গুলো যেন ইতিহাসের ফ্রেমে স্থবির হয়ে আসে। চোখ চলে যায় বহুদূরে। লম্বা বাঁশের লাঠিতে বুদ্ধের বানী লেখা প্রার্থনা পতাকা গুলোর উপদেশ ছড়িয়ে পড়ে উপত্যকা থেকে উপত্যকায়....... নির্মল আকাশ। দিগন্ত বিস্তৃত শৈলশ্রেণী। বামদিকে নেপাল, ডান দিকে ভূটান। আর সোজা উত্তর দিক টা সিকিম। হাততুলে দূরে পাকিওং (সিকিমের নতুন হ্যেলিপ্যাড) শহরটা দেখিয়ে দিল পূর্ণ। খুব শিঘ্রই এখান থেকে শুরু হবে গ্যাংটক বাগডোগরা ফ্লাইট সার্ভিস। কথায় কথায় জানতে পারলাম পেডং এর দামাসাং ফরেস্টে নাকি এসেছিলেন বিখ্যাত উদ্ভিদ বিজ্ঞানী স্যার জোসেফ ডাল্টন হুকার। চারিদিক শুনশান গল্পে গল্পে ফিরে চলি ক্রস হিল থেকে পেডং এর দিকে।

আমাদের সাথে ছিল ড্রাইভার নরদিং ভুটিয়া আর তার গার্লফ্রেন্ড স্মিতা প্রধান। অনুমতি নিয়েই নরদিং, স্মিতাকে নিয়েছে গাড়িতে। আমরাও কোন আপত্তি না করে চটপট উঠে বসলাম WB74AF6152 নম্বরের মারুতি সুজুকি তে। পাইনের জংগল, পাথুরে রাস্তা, হেয়ার পিন বাঁক ঘুরে ঘুরে সুজুকিটা ছুটছে সামনে। সামনের সিটে নরদিং আর স্মিতা গল্পে মশগুল... পেছনের সিটে আমরা দুজন। কালিম্পং থেকে ২১ কিমি দুরে পেডিং, আর ক্রস হিল২৩ কিমি। ভুটিয়া ভাষায় পেদং শব্দের অর্থ সুগন্ধী গাছের এলাকা। জুনিপার- পাইন গাছের ছাল, পাতা, ডাল পোড়ালে সুগন্ধ বের হয়। সেই থেকেই এই নামের উৎপত্তি। হিমালয়ের ৪০০০ ফিটের অধিক উচ্চতায় এই গাছ দেখা যায়।
রেশি খোলা আসতেই রাস্তার একধারে গাড়িটা পার্ক করায় নরদিং। সামনেই ব্রীজ, নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে রেশি খোলা। মুদুং আর দিপ্রুং নদী দুটোর সংগমস্থলেই রেশি খোলার ব্রীজ টা। শুনশান পাহাড়ি রাস্তা, বাতাসের সোঁ সোঁ, বাঁশগাছের মড়মড় আর পাহাড়ি ঝোরার কলতানের সাথে মিশে থাকে নাম না জানা কোন থ্রাস বা বুলবুলের আওয়াজ।
একদিনের মধ্যে ঘুরে নেওয়া যায় পেডং এর আসপাশ। এখানে দেখার মত পেডং গুম্ফা, পেডং মনস্ট্রি, পিস চার্চ, সেন্ট জর্জেস স্কুল, সিলেরু গাঁও, দামাসাং ফরেস্ট আর ক্রস হিল। হাতে আরো সময় থাকলে এক দিনের জন্য গাড়ি রিজার্ভ করে দেখে নেওয়া যায় রিশপ-লাভা-লোলেগাঁও। কালিম্পং হয়ে পেডং থেকে শিলিগুড়ির দূরত্ব ৯০ কিমি। শেয়ারে আসতে চাইলেও আসা যায়। কালিম্পং বাস স্টপে ৩০ মি: অন্তর অন্তর বাস পাওয়া যায়।
২রা নভেম্বর ২০১৫। রাত ১০:৩০ মি:। চারিদিকে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। কান পাতলেই ঝিঝি আর পাহাড়ি কুকুরের ডাক। আড্ডা দিতে দিতে অনেক রাত হয়ে গেল দুজনের। পাহাড়ের নিস্তব্ধতা কে খান খান করে আমাদের কথাবার্তার শব্দগুলো ভাঙ্গা কাঁচের টুকরোর মত ছড়িয়ে পড়ছে এদিকে ওদিকে। ঘরময় ধোঁয়া আর সিগারেটের গন্ধ। দরজা খুলে ব্যালকনিতে এলাম। ঠান্ডা বাতাস আর মেঘ জাপটে ধরলো আমায়।
উদ্দেশ্যবিহীন আমাদের এই যাত্রা পথে সে রাতেই গল্পে গল্পে ঠিক করে ফেললাম - " সিল্ক রুট"। যাবার কথা ছিল রেনক থেকে মুলপোখারী হয়ে " নেওড়া ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক"। পাল্টে গিয়ে হয়ে গেল-
Tags:
ভ্রমন
....এ স্বাদের ভাগ হবে না!!!