রাষ্ট্র ও জনগণ। কে কার জন্যে? রাষ্ট্রের জন্যে জনগণ না জনগণের জন্যে রাস্ট্র? জনগণের জন্যেই রাস্ট্র-এমনটাই তো ভাবতে ভালো লাগে। কিন্তু রাস্ট্র তো একটা বিমূর্ত ধারণা। রাস্ট্রের মালিকানা কখন কার হাতে সেটাই আসল। তাই রাষ্ট্রও নয় রাস্ট্রের মালিক ও জনগণ। রাস্ট্রের মালিকের জন্যে জনগণ না জনগণের জন্যে রাস্ট্র? এই প্রশ্নের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম বিষয়ও ওতোপ্রতো ভাবে জড়িয়ে। সেটি হল রাস্ট্র ব্যবস্থা। সেটি কিন্তু বিমূর্ত নয়। তাকে প্রত্যক্ষ করা যায় প্রতি পদে পদে। তাই সেই রাস্ট্রব্যবস্থা ও জনগণ। এই দুয়ের মধ্যে সমন্বয় ও সম্পর্কের সূত্রটিই মূল বিষয় বর্তমান আলোচনার। রাষ্ট্র ব্যবস্থা কারা সৃষ্টি করে? জনগণ না ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা শক্তি সমূহ? রাস্ট্র কি সমাজের অভ্যন্তরের প্রয়োজন থেকে সমাজিক বিবর্তনের মাধ্যমে গড়ে ওঠে, না কি বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া একটি ব্যবস্থা? আসলে যে কোন স্বাধীন দেশেই সে দেশের সমাজ বিবর্তনের মাধ্যেমেই রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে ওঠে। আমরা বলছি আধুনিক বিশ্বের রাস্ট্র ব্যবস্থার কথা। আগে সামন্ততান্ত্রিক সমাজে বা রাজতন্ত্রের আমলে আধুনিক রাস্ট্র ব্যবস্থার ধারণাই ছিল না। যে যখন রাজা, তারই রাজত্ব, তারই দেশ। সেখানে জনগণের কোন ভুমিকাই ছিল না। কিন্তু আধুনিক রাস্ট্র ব্যবস্থায় জনগণের ভুমিকা স্বীকৃত হল। স্বীকৃত হলো ভোটাধিকারের মাধ্যমে। আমাদের আলোচনার বিষয় তাই আধুনিক এই রাস্ট্র ব্যবস্থা ও জনগণের সম্পর্ক সূত্র ও সমন্বয়ের যোগসূত্র নিয়েই।
ইউরোপের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় সমাজবিবর্তনের হাত ধরেই গড়ে উঠেছে আধুনিক রাস্ট্রব্যবস্থা। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে আড়াইশো বছরের পরাধীনতার কারণে, বৃটিশের হাত ধরেই আধুনিক এই রাস্ট্র ব্যবস্থা আমাদের সমাজের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের সমাজবিবর্তনের হাত ধরে এই ব্যবস্থা তৈরী হয় নি আদৌ। বরং এই ব্যবস্থার হাত ধরেই ঘটে গিয়েছে সমাজবিবর্তন। ফলে ইউরোপ আমেরিকার সাথে ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলির রাস্ট্রব্যবস্থায় একটি মূলগত পার্থক্য রয়ে গিয়েছে আগাগোড়া। ওখানে রাস্ট্র ব্যবস্থার মূলে রয়েছে সমাজবিবর্তন। অর্থাৎ সমাজ। এখানে রাস্ট্র ব্যবস্থার মূলে রয়েছে একসময়ের বৃটিশের শাসন। অর্থাৎ বৃটিশের কাছে আমাদের পরাধীনতা। বৃটিশের দ্বারা চাপিয়ে দেওয়া এক ব্যবস্থা, যার হাত ধরে ঘটে গিয়েছে আমাদের সমাজ বিবর্তন। আর স্বাধীনতার বকলমে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়ে সেই রাস্ট্র ব্যবস্থাই এই উপমহাদেশের দেশগুলির সমজবিবর্তনের নিয়ামক হয়ে উঠেছে। ফলত আমাদের দেশের রাস্ট্র ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে তারা সেই ক্ষমতার মানদণ্ডটি হস্তগত করেছে বৃটিশ প্রভুর পাদদোক খেয়ে, সমাজের অভ্যন্তরীন বিবর্তনের শক্তিতে অর্জন করে নয়। এই বিষয়টি আমরা সাধারণত খেয়াল করি না। করি না বলেই আমাদের অধিকাংশ আলোচনাই রয়ে যায় কার্যত অসম্পূর্ণ ফলত ব্যর্থ।
বৃটিশের কাছ থেকে ক্ষমতা পেয়ে এদেশীয় নেতৃবৃন্দ বৃটিশ প্রবর্তীত রাস্ট্র ব্যবস্থার ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হয়ে গেল। এটাই আমাদের এই উপমহাদেশের রাস্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তিভূমি। মূল বাস্তবতা। সেখানে জনসমাজের ভূমিকা কার্যত শূন্য। আর আমাদের রাস্ট্র ব্যবস্থার সেটাই মূল দূর্বলতা। তাই আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা মূলত ক্ষমতাধর শ্রেণীর স্বার্থকেই সুরক্ষিত রাখার বিষয়ে অধিকতর যত্নবান।
বৃটিশ প্র্রভুর জায়গায় দেশীয় প্রভুর হাতে ক্ষমতা গিয়ে পৌঁছিয়েছে মাত্র। ফলে জনগণের হাতে পড়ে রইল পাঁচ বছর অন্তর একটি মাত্র ভোট। অনেকেই বলবেন, নির্বাচনমুখী এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের রায়ই তো শেষ কথা। ঠিক। সাংবিধানিক ভাবে কাগজে কলমে সেটাই। কিন্তু বাস্তবতার নিরীক্ষে স্বাধীনতার পর অতিক্রান্ত সাতটি দশক ব্যাপি সময়সীমার পরিসরে আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাস পর্যালচনা করলে দেখা যায় জনগণের এই রায় অধিকাংশ সময়েই ক্ষমতাধর শ্রেণীর হাতের নিয়ন্ত্রণাধীন রয়ে যায়। তার প্রধানতম কারণ সারা দেশ ব্যাপি সার্বিক শিক্ষার অভাব ও দারিদ্র্য। একথা আমরা সবাই জানি। ক্ষমতার কেন্দ্রে যারাই থাকুক না কেন, তাদের মূল উদ্দেশ্যই থাকে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের উপর নিয়ন্ত্রণ। আর সেই নিয়ন্ত্রণকে নিরঙ্কুশ করে রাখতেই দেশের বৃহত্তর জনসাধারণকে শিক্ষার থেকে সুস্বাস্থের থেকে দূরবর্তী রেখে দারিদ্র্যের মধ্যে আবদ্ধ রাখতে পারাটাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। তাই জনগণের জন্যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা নয়। রাষ্টব্যবস্থার মাধ্যমে একটি শ্রেণীর ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত থাকার জন্যেই এই রাষ্ট্রব্যবস্থা। যার গালভরা পোশাকী নাম গণতন্ত্র। যার তলায় চাপা পরে যায় প্রান্তিক মানুষের নাভিশ্বাস।
ভারতীয় উপমহাদেশের এই গণতান্তিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার অলিন্দে পরস্পর লড়াই করা গোষ্ঠীগুলির প্রকৃতি মূলগত একই। তাদের মধ্যে তফাৎ শুধু নামের। কাজের নয়। তাই জনগণের রায়ই শেষ কথা বলে যারা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকেন তারা ভেবেও দেখেন না জনগণের হাতে আসল ক্ষমতা কতটুকু মাত্র। পাঁচ বছর অন্তর তারা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে যাদেরকেই ক্ষমতাচর্চার মসনদে বসাক না কেন, তাতে জনগণের কপাল ফেরে না আদৌ। রাজা আসে রাজা যায় মাত্র। প্রজার নুন আনতে পান্তা ফুরানো বন্ধ হয় না কোনদিনই। এটাই সেই ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থার ফলশ্রুতি। গণতন্ত্র আমদানী করে সার্থক করা যায় না কখনোই। তাতে সংখ্যালঘু ক্ষমতাধর শ্রেণীর স্বার্থই পূরণ হয় মাত্র। যে কোন তন্ত্র বা ব্যবস্থাই হোক না কেন, তা যদি সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে সমাজের অভ্যন্তরীন ঘাত প্রতিঘাত থেকে উঠে না আসে, তবে তা কখনই বৃহত্তর জনসাধারণের স্বার্থকে সুরক্ষিত করতে পারে না কিছুতেই। আর এটাই ঘটে চলেছে সমগ্র উপমহাদেশ জুড়েই।
এই কারণেই দেখা যায়, উপমহাদেশের প্রেক্ষিতে গণতান্ত্রিক এই প্রক্রিয়ায় রাস্ট্রব্যবস্থা কখনোই বৃহত্তর জনসাধারণের স্বার্থকে সুরক্ষা দিতে সফল হয় না। হয় না কেননা এই রাষ্ট্র ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্যই তো সেটা নয়। তাই পাঁচ বছর অন্তর সরকার বদলাতে পারে, কিন্তু জনগণের জীবনযাপনের মানের কোন পরিবর্তন ঘটে না। সার্বিক অশিক্ষা অস্বাস্থ্য ও সীমাহীন দারিদ্র্যের হাত থেকে কোন পরিত্রাণ নাই বৃহত্তর জনসাধারণের। ক্ষমতাচর্চার গোষ্ঠীগুলি জানে বৃহত্তর জনসাধারণকে সার্বিক শিক্ষা সুস্বাস্থ ও আর্থিক স্বচ্ছলতা থেকে যত দূরে রাখা যাবে ততই রাস্ট্রীয় কোষাগারের উপর নিরঙ্কুশ অধিকার কায়েম থাকবে। আর এই দূরে রাখারই আর একটি কার্যকর উপায় হিসাবেই সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় উন্মাদনাকে সবসময়ে তরতাজা রাখার বন্দোবস্ত করা হয়। যার পেছনে ছলেবলে সরাসরি মদত দিতে থাকে ক্ষমতাচর্চার প্রতিটি গোষ্ঠী। দেশের মানুষকে যতই সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় উন্মাদনায় আবদ্ধ করে রাখা যাবে ততই সহজ হবে তাদেরকে অশিক্ষিত করে রেখে দূর্বল করে রাখা। দূ্র্বল জনসাধারণ কখনোই এই রাস্ট্রব্যবস্থার অনৈতিক ভিতকে নড়িয়ে দিতে পারবে না। তাদেরকে স্বনিয়ন্ত্রণে রাখাও সহজ হবে। আর তাই নিশ্চিন্তে থাকবে ক্ষমতাচর্চাকারী গোষ্ঠীগুলি। এটাই এই উপমহাদেশের প্রতিটি দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থার মূল সরূপ।
তাই কোন রাজনৈতিক আন্দোলনই জনগণের স্বার্থকে সুরক্ষিত করতে পারে নি আজ অব্দি। আর সেই কারণেই দরকার সমাজের সর্বস্তরে সার্বিক শিক্ষার বিস্তার। শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে হবে দুই ভাবে। এক দিক দিয়ে কারিগরী শিক্ষার বিস্তার ও অন্য দিক দিয়ে চেতনার বিকাশ ঘটানোর শিক্ষার বিস্তার। এই দুই ভাবে আপামর জনসাধারণকে শিক্ষার আলোতে নিয়ে আসতে পারলে গড়ে উঠবে জনশক্তি। অতি দূর্ভাগ্যের বিষয় হলো এই উপমহাদেশে এই জনশক্তিই আজও গড়ে ওঠে নি। সেই জনশক্তিই তখন স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে উঠে দারিদ্র্যের সাথে প্রকৃত লড়াই করার পথ খুঁজতে থাকবে আপন গরজে ও আপন শক্তিতে। সেই শক্তিই পারে একমাত্র এমন একটা রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে যে রাষ্ট্র জনগণের সার্বিক স্বার্থের রক্ষাকবচ হয়ে উঠতে পারবে। যখন বলা যাবে জনগণের জন্যেই রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের জন্যে জনগন নয়।
কিন্তু। আসল কথা হলো উপমহাদেশের রাজনীতির অলিন্দে ঘোরা ফেরা করা বুদ্ধিমান মাথারা ও তাদের পেটোয়া বুদ্ধিজীবীরা কখনোই সেই জনশক্তিকে গড়ে উঠতে দেবে না। দানা বাঁধতে দেবে না একটি শক্তিশালী সমাজ তৈরীতে। সুযোগ দেবে না, বৃটিশের চাপিয়ে দেওয়া এই করে কম্মে খাওয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিতকে টলিয়ে দেওয়ার। কারণ তখন টলে যাবে ক্ষমতাচর্চার কেন্দ্রীয় গদিগুলি। ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলি স্বাভাবিক ভাবেই সেটা চাইবে না কখনোই। বরং এই জনশক্তি গড়ে ওঠার ক্ষীণতম সম্ভাবনাও যাতে দানা না বাঁধে, তার জন্যেই নানান ভাবে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করে রাখার নানবিধ কার্যক্রমকে সচল রাখতে স্বচেষ্ট থাকবে চব্বিশ ঘন্টা। আর সেইটাই হল এই উপমহাদেশের সার্বিক রাজনীতির মূলগত চালচিত্র। যার দুই বিপরীত পাশে রাষ্ট্র ব্যবস্থা আর বৃহত্তর জনগোষ্ঠী। আর মধ্যবর্তীতে বিরাজমান ক্ষমতাচর্চাকারী গোষ্ঠীগুলি।
Tags:
প্রবন্ধ