সুশান্ত কুমার রায়

শ্মশানঘাট

গ্রামের উত্তর মাথায় হ্যাংলা মামার বাড়ির পাশে ঠিক গিট্টুর বাড়ি থেকে ছয় বাড়ি পর ডোংগার বাড়ি। সেই ডোংগার বাড়িতে তুমুল কাউ ক্যাঁচাল লেগেছে। জয়কালী গ্রামে ঝগড়া বিবাদ নিত্য নতুন কিছু নয়। বরঞ্চ একদিন যদি গ্রামে ঝগড়া-ঝাটি না হয় তাহলে সে দিনটাই সবার কাছে ব্যতিক্রম মনে হয়। আজ যদি ভগলুর বাড়িতে হয় - কাল হয়তো ছমিরন । কোনদিন বয়স্ক লোকের সাথে ছোকরার নতুবা ছোকরার সাথে বিধবার অথবা উঠতি বয়সী কোন মেয়ের। ঝগড়া লেগেই আছে । আর এ সকলের মূলে মানুষের অর্থনৈতিক টানাপোড়েন আর সুশিক্ষার দৈন্যতা। ঝগড়া হলেই নালিশ আর গ্রামের মাতব্বর ডেকে মিটিং । মিটিং এ শাস্তি স্বরূপ জরিমানা নতুবা ফতোয়ার সাথে বেত্রাঘাত। তবে ডোংগা কিভাবে যে বউয়ের গোপন কথা জেনে গেলো তা বুঝে উঠতে পারছে না মরিয়ম। যদিও ঘটনাটি ঘটার প্রায় মাস খানেক পার হয়ে গেছে। কিন্তু কথা ফাঁস করার ব্যাপারে মরিয়মের সন্দেহ জাগে ওই একজনের উপর। নাম তার ঝগড়ি বাতাসি। বাতাসির সাথে এর আগে মরিয়মের কয়েক দফা ঝগড়া হয় নানা কারণে। তবে এ কথা যে বাতাসিই আগে ডোংগাকে জানাবে তা নিশ্চিত হয় ভগলুর কাছে। ভগলু ভ্যার ভ্যার করে বলে দিয়েছে মরিয়মকে। আর তাই খাবার খেতে বসে বার বার পুরনো ভাত খাওয়া ক্ষয়ে যাওয়া ভাঙ্গা থালের কথা মরিয়মকে বলতেই মরিয়মের বুকটা ধুক করে উঠলো। যেদিন থালটি হারিয়েছে সেদিন থেকেই মরিয়মের মন ভালো নয়। যদিও বগলের ক্ষয়ে যাওয়া এক পাশ খসে গিয়েছে থালাটির। ডোংগার বিয়ের সময় এই কাঁসার থালটি উপহার দিয়েছিল তার দুলাভাই। পনের বিশ বছর আগের কথা। তখন মানুষ বিয়েতে সোনা, রূপা ও কাঁসা-পিতলের বাসন কোসনই বেশি উপহার দিতো। তখনকার দিনে জিনিসের খাঁটিত্ব আজ মানুষের মধ্যেও নেই। আর তখন মানুষের খাঁটিত্ব ছিলো দেবতুল্য। কথা দিয়ে কথা না রক্ষা করতে পারলে মানুষ বিসর্জন হলেও কথা ছিলো অটল-অনড়। প্রতিজ্ঞা প্রতিজ্ঞাই। মরিয়মের সবচেয়ে বড় কষ্ট হলো থালাটি ভাঙ্গা হলেও এই থালাটির সাথে জড়িয়ে আছে বিয়ের কিছু স্মৃতি ও ঘটনা। হয়তো কষ্ট করে টাকা যোগাড় করে এর চেয়ে ভালো থালা কেনা যাবে কিন্তু স্মৃতি আর ফিরে আসবে না। এই থালার সাথে জড়িয়ে আছে তার আরেক দুলাভাইয়ের ঘটনা। পাগল মানুষ না হলে কি এই কাজ করে। তার ছোট দুলাভাই ও বড় দুলাভাই দুজনে যুক্তি করে একজন কিনেছিল কাঁসার থাল আর একজন একটা বড় আকারের শিলপাটা। বড় দুলাভাই শিলপাটা উপহার দেয়াতে কতজনই না সেদিন ঠাট্টা ইয়ারকি করেছিল। তবে আইয়ো বরেতিরা বিয়ের অনুষ্ঠানে সেটি দিয়ে বর কনের কুর মাখানোর কাজ অতি আরাম আয়াসেই সেরেছিলো সেদিন এতো বড় শিলপাটা পেয়ে। বিয়ের পর রান্নার সময় মরিয়ম সেই শিলপাটায় যখন মসলা বাটতো তখন দুলাভাইয়ের কথা মনে পড়ে সেই সাথে মনে পড়ে যেতো বিয়ের স্মৃতি। এখনো রান্না ঘরে গেলে শিলপাটায় দুলাভাইয়ের অবয়ব দেখতে পায়। তিনি আজ অবধি বেঁচে থাকলে হয়তো আরও এরকম অনেক মজার কান্ড ঘটাতেন। মানুষকে হাসাতে তার কোন জুড়ি ছিলো না। মরিয়ম হামার ভাত খাওয়া পুরান থাল খেন কই ? ডোংগা খাবার খেতে বসে বলে উঠলে মরিয়মের চৈতন্য বোধদয় হয়। এতক্ষণ থালা হারানোর ব্যাথা ও থালার সাথে জড়িত স্মৃতি নিয়ে তন্ময় হয়ে থাকলেও ডোংগা তার থালার কথা জিঙ্গেস করায় কোন উত্তর দিতে পারছে না মরিয়ম। 

ডোংগা আবার জিঙ্গেস করে- শোনো নাই তোমাক কি কইলাম। মরিয়ম মিনতির সুরে বলে- থাল কি তোমাক এল্যায় আনি দেওয়া নাইগবে ? ভাত খাও আগোত। থাল আনেক- মুই থালোত ভাত খাইম। এক মাস থাকি তুই ওই থালোত ভাত দেইস নে মোক। ক্যা কি হইছে থালের ? থাল কোন ভাতারোক দিছিস ! এল্যায় থাল আনি দে। থাল আনি দিব্যার না পাইরলে আজক্যা জবো করিম। মোক চিনিস নাই। দুপুর বেলা খাওয়ার টাইমে ডোংগা বাড়িতে আসার সময় ঝগড়ি বাতাসি রাস্তায় দেখা পেয়ে ঘটনাটি ডোংগাকে জানায়। আর তাই বাড়িতে খাবার এসে স্বামী-স্ত্রীতে কাউ-ক্যাঁচাল শুরু হয়। তবে এই ঘটনার স্বীকার গ্রামের আরো অনেকে। আশ্বিন- কার্তিক মাস। মানুষের কাজ কর্ম একটু কম। আর এই সময়ে জয়কালী গ্রামে এক ভাংড়ি ঢুকে পড়ে। যিনি মানুষের ভাঙ্গা জিনিস নিয়ে তা মেরামত করে ভালো জিনিস তৈরি করে দেন। বিনিময়ে অল্প কিছু টাকা পয়সা নেন। শ্যামাকান্ত ভাংড়ি কোনদিন এ গ্রামে ঢুকেনি আর এ গ্রামের মানুষ এর আগে কখনো তাকে দেখেনি। ভাংড়ি শ্যামাকান্ত পনের-বিশ মাইল দূরে শহরে অস্থায়ীভাবে বসবাস করছে। আর এক এক দিন বিভিন্ন গ্রামে ঢুকে মানুষকে নতুন জিনিস দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের নিকট থেকে ভাঙ্গাচূড়া কাঁসা-পিতলের জিনিস হাতিয়ে নিয়ে আসছে। শ্যামাকান্ত কোন এলাকায় দ্বিতীয় বারের বেশি তৃতীয়বার যান না। প্রথমবার গিয়ে অল্প কিছু লোকের কাছ থেকে ভাঙ্গা জিনিসপত্র নিয়ে এসে ভালো জিনিস তৈরি করে দেন। আর এই কাজটি করেন অতি চতুরতার সাথে। যাতে করে গ্রামের সবাই জানতে পারে যে ভাংড়ি শ্যামাকান্ত এসেছিল। কিন্তু প্রথমবার ভাঙ্গাচূড়া জিনিস নেয়ার ব্যাপারে তিনি খুব সতর্কতা অবলম্বন করেন। পুরো গ্রাম মিলে মাত্র কয়েক জনের বাড়ি থেকে অল্প কিছু জিনিস নেন। আর সেটি করেন বেশ কিছু বাড়ি পর পর। যাতে করে পুরো গ্রামের মানুষজন যেন জানতে পারে যে শ্যামাকান্ত ভাংড়ি এসেছিলো। দ্বিতীয়বার যখন তিনি ভাঙ্গা জিনিস ভালো করে নতুন জিনিস গ্রামের গুটি কয়েক জনকে দেয়ার জন্য নিয়ে যান তখন সাথে একটা ঘন্টা নিয়ে আসেন। গ্রামের এক মাথায় ঢুকতেই ঘন্টা বাজানো শুরু করলেন। ঘন্টাটির প্রচুর আওয়াজ। পুজোর ঘন্টার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি শব্দ। আর এই শব্দ শুনে প্রথমে ছোট ছোট ছেলে ময়ে আসতে শুরু করলো। তাঁরা ভেবেছিলো হাওয়াই মিটাই ওয়ালা এসেছে। কিন্তু হাওয়াই মিটাই নয়- সেটি শ্যামাকান্ত ভাংড়ির ঘন্টা। রান্নাঘর থেকে আরতি ঘন্টার শব্দ শুনে কান পেতে থাকায় ভাংড়ির কথা শুনে তড়িঘড়ি করে বের হয়ে এসে ভাংড়ির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো- ক্যা গো, তোমরা যে মোর ভাঙ্গা কাঁসার জগটা নয়া করি দিব্যার চায়া নিয়্যা গেইলেন তাক আনেন নাই। ইতোমধ্যে ছোট বড় অনেক লোক সেখানে জড়ো হয়েছে তবে মহিলা মানুষই বেশি। ভাংড়ি শ্যামাকান্ত তখন আরতির চকচকে নতুন জগটি বের করলেন। এই যে নেও তোমার জগ। আরতি খুশিদে গদগদ। তখন উপস্থিত অনেকেই বলাবলি শুরু করলো । এমরা কোনদিন আসিল গ্রামোত। হামরা তো কবারে পাই নে। জানলে তো হামরাও দিলোং হয়। তখন কৃষ্ণা বলে উঠে- ক্যা রই মোক একনা কইস নাই। তুই মোক যদি একনা কলু হয় মোরো তো একটা ভাংগা বইগনে আছিল। তখন আরো অনেকেই আরতির চকচকে জগ দেখে আপসোস এবং আরতির প্রতি হিংসাত্বক মনোভাব পোষণ করতে থাকলে শ্যামাকান্ত ভাংড়ি বলতে লাগলো। আমি ভাঙ্গা জিনিস নিয়া যাই আর ভালো জিনিস দিয়া যাই। এই শ্যামাকান্ত ভাংড়ি মানুষের শুধু ভাঙ্গা নিয়া ভালো ও চকচকাই দেয়। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। আমি আইজ কিছু ভাঙ্গা নিয়া যাইবো। সেগুল্যা ভালো করতে আমার মাস খানেক লাইগবো। তার পর সেগুলো নিয়া আবার আইসবো। যারা দিবেন দিব্যার পারেন। তবে সময় কম আমার আরেক গ্রামে যাইতে হবে। তখন জগাই বলে উঠে- ও কাহা তোমরা থাকেন কোনঠেয়। আমারে কুড়িগ্রামে সবাই চেনে। শ্যামাকান্ত ভাংড়ি। আর শ্যামাকান্ত ভাংড়ি বললেই বলে দিবে। দেশের বাড়ি কোনটেয় তোমার ? এ কথা বললে শ্যামাকান্ত বলে- বাড়ি টারি দিয়া কি করবু। ভাঙ্গা দিয়া চাঙ্গা নেও। বাড়ি তো ওই একটাই- শ্মশানঘাট । এ বলে মুচকি হাসি দিয়ে বলে আমাকে উঠতে হবে। গ্রামের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত যার যার ভাঙ্গা জিনিস ছিলো সবাই সর্বস্ব দিয়ে দিলো। কিন্তু শ্যামাকান্ত ভাংড়ি ওই যে সেদিন গিয়েছে আজ অবধি আর এ গ্রামে আসেনি। অনেকে কুড়িগ্রামে গিয়ে খোঁজ নিয়ে এসেছেন । যারা ভাঙ্গা জিনিস চাঙ্গা করার দলে ছিলেন। ভাংড়ি কিছুদিন আগে ছিলো ঠিকই কিন্তু আশে পাশের সমস্ত কাজ কর্ম গুটিয়ে নেয়ার পরই শ্মশানঘাটের দিকে রওয়ানা হয়েছেন। অনেকে হয়তো আশায় বুক বেধে আছেন ভাংড়ি আবার আসবে। তবে কবে যে আসবে তা বলতে পারছে না। আর এই ঘটনার স্বীকার মরিয়ম। যার জন্য এতো কাউ-ক্যাঁচাল। ডোংগা যখন পুরো বিষয়টি জানতে পারে তখন মনে মনে ভাবে শ্যমাকান্ত ভাংড়ি যেন কোন অসুখ বিসুখে মরে তাড়াতাড়ি শ্মশান ঘাটে যায়। কিন্তু শকুনের শাওয়ে কি গরু মরে ?



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

নবীনতর পূর্বতন