শিবাজী সেন

স্পর্শ-কাতর


পড়াশুনোর প্রাথমিক পর্যায় থেকেই নিত্যানন্দ আমার কাছের বন্ধু। দেখে মেধাবী বলে মনে হয় না, একটু পাগলাটে ধরনের। তবে চোখ দু’টো বুদ্ধিদীপ্ত। মেধা যে ছিল না তা নয়। মাঝে মাঝে তার কথায় এবং চিন্তা-ভাবনায় ঝলক পাওয়া যেত। তার বিচারগুলো হতবাক করে দিত মাঝে মাঝে। 

বলতে দ্বিধা নেই, আমি রীতিমত গবেষণা চালিয়েছি ওর চিন্তার ধারা নিয়ে। এবং এখনও নিরন্তর চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু সত্যিই কোন কূল-কিনারা পাই না। ও যে কোথা থেকে চলতি এবং সর্বসম্মত নির্দোষ বিষয়গুলোর বিরুদ্ধেও যুক্তি খুঁজে পায় আর তারপর সেটাকে দোষী সাব্যস্ত করে কাঠগড়ায় তুলে দেয় ভেবেই পাই না। আমরা অনেকেই অনেক বার চেষ্টা করেছি ওর মত করে ভাবতে। পেরে উঠিনি। 

এক দিনকার একটা ঘটনা বলি। বছর পনের আগের কথা। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। ইতিহাসের শিক্ষক মুকূলবাবুর কাছে টিউশন পড়তাম। নিত্যানন্দের এই যুক্তিবাদিতার জন্য ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সকলেই তাকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলত। প্রত্যেকেরই ভয় ছিল পাছে তার সাথে কথা বলতে গেলে সে কোন ভুল ধরে ফেলে এবং যুক্তি খাড়া করে অপ্রস্তুতে ফেলে দেয়। 

লক্ষ করতাম, নিত্যানন্দ যতক্ষণ থাকে মুকূলবাবুর মধ্যেও যেন একটা অস্বস্তির ভাব চলে। এমনিতে লোকটি রাশভারী। তাঁকে ভয় তো পেতামই, যথেষ্ট সমীহও করতাম। নিত্যানন্দ সেখানেও সমান ঠোঁট কাটা। 

সেদিন সোমবার। রবিবার ছুটি ছিল। তাই আজ বাড়ির কাজের পরিমাণটাও বেশি। সবাই বেশ আতঙ্কে আছি। পড়া যে করিনি তা নয়। তবে স্যার ঘরে ঢুকলেই কেন জানি না মাথাটা একেবারে ফাঁকা হয়ে যায়। কি পড়েছি কিছুই আর মনে করতে পারি না। নিত্যানন্দের দেখলাম আনন্দের ঘাটতি নেই। সে যথারীতি দৌরাত্ম্য অব্যাহত রেখেছে। সকলকে নাজেহাল করে বেশ মজা পাচ্ছে। 

এমন সময় মুকূলবাবু ঢুকলেন। সকলে চুপ। থমথমে পরিবেশ। 

সামাজিক বর্ণবিভেদ এবং তার কুফল ও বর্তমান প্রজন্মে তার প্রতিকার সম্বন্ধে আজ পড়ে আসার কথা। পড়েও এসেছি। সকলেই কম বেশি এটা নিয়ে আলোচনা করেছে এখানে এসে। পড়া না পারলে অগাধ দুর্ভোগ। কিন্তু নিত্যানন্দকে এ নিয়ে একটা কথাও বলতে শোনা গেল না। সে তার কাজে ব্যস্ত আর অন্যরা তাকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। মনে মনে সকলেই ভাবলাম ব্যাটাকে আজ স্যার পড়া ধরুন, তারপর দেখি ওর এই হাসি কোথায় যায় ! 

সকলকে পড়া ধরার পর যথাসময়ে নিত্যানন্দের পালা এল। নিত্যানন্দ অনেক চেষ্টা করেও মুখ থেকে একটা শব্দও বার করতে পারল না। গোঁ গাঁ - ধরনের কিছু অস্ফুট ধ্বনি তুলে অবশেষে একেবারে চুপ করে গেল। 

মুকূলবাবু চোখ পাকিয়ে, দাঁত খিঁচিয়ে নিত্যানন্দের দিকে একটু ঝুঁকে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন --- ‘পড়া করিসনি কেন?’

এমনিতেই মুকূলবাবুর অনেক দিনের রাগ নিত্যানন্দের উপর। বাগে পাচ্ছিলেন না। আজ পেয়ে গেছেন। বুঝলাম সহজে ছাড় নেই। সপ্ সপ্ করে কয়েকটা শব্দ হল, তার সাথে আঃ উঃ - কাতর আর্তনাদ। সপ্ সপ্ থামলে আমরা ধীরে ধীরে নিত্যানন্দের ব্যথাতুর মুখটার দিকে তাকালাম। চোখে মুখে ভাঁজ পড়েছে। দুই হাত দিয়ে সজোরে দুই ঊরু ঘষে চলেছে। 

আদেশ হল --- ‘যা, বাইরে গিয়ে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাক। যতক্ষণ পড়া চলবে ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবি।’

নিত্যানন্দের কিন্তু জায়গা ছাড়ার কোন আগ্রহ দেখা গেল না। তার নির্লিপ্ততা দেখে মুকূলবাবু আরও রেগে গেলেন --- ‘কি রে, কথা কানে গেল না ?’

আমরা একটা অজানা উদ্বেগ অনুভব করলাম। কান লাল হয়ে উঠল। সারা শরীর কাঁপতে লাগল। নিশ্বাস অত্যন্ত ভারী। কি হয়-কি হয় --- একটা আতঙ্ক সবার মনে। কিন্তু কি আশ্চর্য, এই পরিস্থিতিতেও সবাইকে অবাক করে সে মুখ খুলল --- ‘স্যার একটা কথা জিজ্ঞেস করব, সত্যি বলবেন ? যে বিষয়টা আজ আপনি পড়াচ্ছেন, মানে এই সামাজিক বর্ণভেদ- ছুৎ অচ্ছুৎ- স্পৃশ্য অস্পৃশ্য এর যে কুফল, সেটা কি আপনি সত্যিই মন থেকে মানেন, নাকি নিছক পড়ানোর জন্যেই পড়ান ?’

সপ্তম শ্রেণির একটা ছেলের মুখে এই ধরনের উচ্চমার্গের কথা শুনলে মানুষ অবাক হয়। কিন্তু যখন একজন মারমুখী হিংস্র শিক্ষকের সামনে একটি সদ্য-আক্রান্ত শিশুর মুখ থেকে এমন কথা বেরোয় এবং তাতে ভয়ের লেশমাত্র থাকে না তখন আক্রমণকারী বিস্মিত হওয়ার থেকে বেশি দিশেহারা হয়ে পড়ে। আমাদের মুকূলবাবুরও একই অবস্থা হল। 

তিনি হঠাৎ কি বলবেন বুঝে উঠতে পারলেন না। আম্তা আম্তা করে কোন রকমে বললেন --- ‘মানে, কিক্-কি বলতে চচ্-চাস তুই ...’

দেখলাম তাঁর কথা আটকে যাচ্ছে। 

নিত্যানন্দের ভাবান্তর নেই --- ‘বলছি আপনি এগুলো সত্যিই মানেন কিনা। মানে, আমাদেরও বর্ণশ্রমের বিরুদ্ধে ভাবা উচিৎ কিনা। মানে, সবাইকে সমান ভাবা উচিৎ কিনা আর কি ...’

মুকূলবাবু নিজেকে সামলে নিয়ে সংযত হওয়ার চেষ্টা করে গম্ভীর গলায় বললেন --- ‘নিশ্চয়ই মানি। কিন্তু হঠাৎ একথা কেন ?’

সারা মুখে একটা কৃত্রিম চিন্তার ছাপ ফেলে নিত্যানন্দ বলল --- ‘আসলে স্যার, আমি একটা ব্যাপার কিছুতেই বুঝতে পারছি না। এই ক’দিন সেটা নিয়েই চিন্তা করে যাচ্ছি। পড়াশুনো কিছুই করা হয়ে উঠছে না। তাই ভাবলাম আপনাকে জিজ্ঞেস করি।’

সেই চিন্তার ছাপ এবার দেখা গেল মুকূলবাবুর মুখে। তবে এটা কৃত্রিম নয়। একটু অনিশ্চয়তা নিয়ে তিনি বললেন --- ‘কি ব্যাপার ...’

নিত্যানন্দ বোকা বোকা ভাব করে বলল --- ‘চার দিন আগে টুসি ঘর ঝাঁট দিয়ে বেরোনোর সময় যখন অজান্তে আপনার গায়ে ওর পা ছুঁয়ে গেল তখন আপনি ওকে অত বকলেন। আপনাকে প্রনাম করে ওকে ভুল শোধরাতে হল। তারপর আবার হাতে ঝাঁটা ধরেছে বলে এই প্রচন্ড ঠান্ডায় বেচারিকে কাঁপতে কাঁপতে সাত সকালে স্নান করে তবে ঘরে উঠতে হল। এর কারণ আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না স্যার।’

মনে পড়ল দিন চারেক আগে এক দিন সকালে আমরা যখন পড়ছিলাম তখন এই ঘরটা ঝাঁট দিয়ে ছাত্রদের ভিড় কাটিয়ে বেরোনোর সময় মুকূলবাবুর গায়ে তাঁর ছোট্ট কাজের মেয়ে টুসির পা টা ছুঁয়ে গেছিল। সে বিষয়টা খেয়াল না করে চলে যাচ্ছিল। এটা মুকূলবাবুর দম্ভে আঘাত করে। এত ছাত্রের সামনে তাঁকে অপমান ! তিনি তৎক্ষনাৎ তাকে ডেকে বকাবকি জুড়ে দেন। অবশেষে মুকূলবাবুকে সর্বসমক্ষে প্রনাম করে এবং কান মলা খেয়ে অব্যাহতি পায়। তারপরেই মুকূলবাবুর নজরে পড়ে, মেয়েটির হাতে ঝাঁটা। মনিবের রোষে পড়ে সেই শীতের সকালে স্নান করে তাকে ঘরে উঠতে হয়। ঠান্ডায় মেয়েটা ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছিল আর সমানে কেঁদে যাচ্ছিল। আমরা ব্যাপারটা সেভাবে আমল দিইনি। ভুলেই গিয়েছিলাম। নিত্যানন্দ ঠিক মনে রেখেছে।

মুকূলবাবু আবার পুরানো রূপে ফিরে এলেন। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে গলা চড়ালেন --- ‘বড়দের গায়ে পা লাগলে প্রনাম করতে হয় জান না ? তোমায় এটা কেউ শেখায়নি ? আর ঝাঁটা যে একটা অপবিত্র জিনিস, তাকে ছুঁলে যে স্নান করে ঘরে উঠতে হয় এটাও কি তোমায় বলে বোঝাতে হবে। এর সাথে সামাজিক ছুৎ-অচ্ছুতের কি সম্বন্ধ ? ফাজলামি করার জায়গা পাচ্ছ না ! আর দু’ঘা কষালেই সব মাথায় ঢুকে যাবে।’

নিত্যানন্দ খুব স্বাভাবিক স্বরেই বলল --- ‘স্যার, কি করতে হয়, কি করতে নেই এগুলো অনেকেই শিখিয়েছে। কিন্তু যেগুলো করতে হয় সেগুলো কেন করতে হয় আর যেগুলো করতে নেই সেগুলো কেন করতে নেই তা কেউ শেখায়নি। আমি সেটাই আপনার কাছে শুনতে চাইছি।’

মুকূলবাবু উত্তেজিত হয়ে বললেন --- ‘হতভাগা, কেন-র কোন উত্তর নেই। এটাই নিয়ম, এটাই চলে আসছে।’

নিত্যানন্দ নাছোড়বান্দা --- ‘তাহলে স্যার পায়ের পরিবর্তে কারও হাত যদি বড়দের গায়ে লাগে তাহলেও তো তার প্রনাম করা উচিৎ। আর যদি ধরুন কেউ ঝাঁটার পরিবর্তে বেল পাতায় হাত দেয় তাহলেও তো তাকে স্নান করে ঘরে উঠতে হবে !’ 

মুকূলবাবু এবার চিৎকার করে উঠলেন --- ‘হতচ্ছাড়া গাধা কোথাকার, পা আর হাত, ঝাঁটা আর বেল পাতা কি এক হল ? তোর মাথায় গোবর পোরা আছে ছাগল ?’

নিত্যানন্দ শান্ত। কোন উত্তেজনা নেই --- ‘স্যার, এবার বলি সামাজিক ছুঁতমার্গের সাথে পা বা ঝাঁটার কথা আমি কেন তুললাম। চার দিন ধরে ভেবে এটাই আমার গোবর ভর্তি মাথায় এসেছে স্যার। ভুল হলে শুধরে দেবেন।’

নিত্যানন্দ বলতে আরম্ভ করল। আমরা রুদ্ধশ্বাসে তার কথা শুনছি আর মনে মনে ভাবছি সাহস আছে বটে ছেলেটার ! 

--- ‘গায়ে ছোটদের পা লাগা এবং ঝাঁটার স্পর্শ লাগাকে মানুষ অপমানজনক এবং অমঙ্গলজনক বলে মনে করে থাকে। কারণটা নিয়ে কেউই বিশেষ চিন্তা করেনি কখনও। এটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আসলে মানুষের শরীরটাকে যদি সমাজের সাথে তুলনা করেন স্যার তাহলে দেখা যাবে সমাজের নিচু শ্রেণির প্রতিনিধি হল পা। সে সারা দিন ধুলোর মধ্যে হাঁটা-চলা করে, নোংরা মাখে। তাই বড়দের স্পর্শ করার কোন অধিকার তার নেই। কিন্তু সারা শরীরের ভার তো বহন করে সে-ই। সব থেকে বেশি পরিশ্রম করে। সে চলে বলেই তো পুরো শরীর চলে। না হলে আমরা অচল।’

আর ঝাঁটা কেন অপবিত্র জিনিস স্যার ? সে যখন অপবিত্রই তখন তার ব্যবহার না করলেই হয়। কিন্তু বাড়ীর ভিতর এবং বাইরে পরিষ্কার রাখতে সেই ঝাঁটা ছাড়া গতি নেই।’

সে এবার একটু থেমে বলল --- ‘বিভিন্ন ছোট ছোট সংস্কারের মধ্যে বর্ণাশ্রম এখনও বেঁচে আছে স্যার। আমরা খেয়াল করি না।’

মুকূলবাবুর চোখ গোল গোল হয়ে গেছে। মুখ হাঁ। আমরা নির্বাক। এ বলে কি এসব ! ভাবলাম পিঠের চামড়া এর আজ আর আস্ত থাকবে না। কিন্তু কি হল বুঝলাম না। মুকূলবাবু খানিক্ষণ চুপচাপ নিত্যানিন্দের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে চোখ নামিয়ে নিয়ে বললেন --- ‘তোমাদের আজকে ছুটি। আবার কাল এসো।’

শুনেছি এরপর আর তিনি কারও কাছ থেকে কোন দিন প্রনাম নেননি। টুসিকেও আর কখনও বকাবকি করতে দেখা যায়নি তাঁকে।

বর্তমানে আমি এক জন স্কুল-শিক্ষক। আজ আমি নিত্যানন্দের সেদিনকার কথাগুলোর মানে বুঝেছি। যেটা আমরা আজ বুঝছি সেটা সে সেদিনই বুঝে গিয়েছিল এবং এক জন পোড় খাওয়া বয়স্ক রাগী শিক্ষককে বোঝাতেও পেরেছিল। টুসি নামের একটা গুরুত্বহীন ছোট্ট অযাচিত কাজের মেয়ের প্রতি অন্যায় তার বুকে গভীর দাগ কেটেছিল বলেই কথাগুলো তার মুখ দিয়ে সেদিন নির্ভয়ে বেরিয়ে এসেছিল। 

নরম মন, দুষ্ট বুদ্ধি, ছক ভেঙে চিন্তা করার ক্ষমতা আর সাহস এই চারটিই যে ছেলের আছে সে কোন্ উচ্চতায় উঠতে পারে তা আর নাইই বা বললাম ...



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

নবীনতর পূর্বতন