জয়িতা দে সরকার

জয়িতা দে সরকার

নিজের কবরে এবার নিশ্চিন্তে ঘুমাবে আবদুল মিয়াঁ। খোলা চোখে যে পৃথিবী সে কোনওদিন দেখেনি মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আবদুল যেন সেই পৃথিবীর সবটুকু দেখতে পাচ্ছিল। বেঁচে থাকলে এই বসন্তে ওর বয়স হবে চুরাশি। দুচোখ বেয়ে শুধুই জল গড়িয়ে পড়ছিল আবদুলের। চোখ বন্ধ করে বুকের উপর দুটো হাত রেখে নিজের চৌকিটার উপরে শুয়ে আছে আবদুল। ডাক্তার ওইবেলায় দেখে গেছে। বিশেষ উন্নতি চোখে পড়েনি আবদুলের স্বাস্থ্যে। আবদুলের ঘরের দরজায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল সমর। আবদুলের সাথে সমরের সম্পর্ক কি এ বিষয়ে কারুরই তেমন কোনও মাথা ব্যথা আজ আর নেই। তবে একটা সময় ওদের সম্পর্কের দিকে অনেক আঙুল উঠেছিল বৈকি। তাতে অবশ্য আবদুলের কখনও কিছুই যায় আসে নি। সমরের এসেছিল কি? সেটাও আবদুল কখনও জানার চেষ্টা করেনি। ডাক্তার দরজার কাছে এলে সমর অসহায় চোখে তার দিকে তাকায়। 

-স্বাস্থ্যে তেমন কোনও উন্নতি নজরে পড়ল না আমার। কয়েক ঘণ্টাও যেতে পারে আবার হয়তো কয়েকদিন। এই অবস্থায় কিছু বলা যায় না। আমি সবরকম চেষ্টা করেছি। বাকিটুকু ওর অদৃষ্ট। এই অবধি বলে ডাক্তার সমরের কাঁধে হাত রাখে। এরপর ধীর পায়ে হেঁটে চলে যায় নিজের গন্তব্যের দিকে। 


শেষ পৌষের কুয়াসা ভেজা সন্ধ্যে শুরুর আকাশে এখন পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। দূরে মসজিদ থেকে ভেসে আসছে আজানের শব্দ। আবদুলের চোখ একইভাবে বন্ধ। এই বন্ধ চোখেই ও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে এখন থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগের সেই দিনটা। আবদুল স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ওর ভাঙা দালানের উঠোনে দাঁড়িয়ে ওর নাম ধরে ডাকছে বিষ্ণুপ্রিয়া। 

-এটা কি আবদুল মিয়াঁর বাড়ি? বাড়িতে কি কেউ আছে? 

অসময়ে মেয়েলী কণ্ঠে অবাক হয়েছিল আবদুল। নীচু স্বরে সাড়া দিয়েছিল গোয়ালের ওদিক থেকে।

-হ্যাঁ এটাই আবদুল মিয়াঁর বাড়ি। 

জন্মান্ধ হলেও কোনও কিছুর সাহায্য ছাড়াই আবদুল হেঁটে-চলে বেড়াতে পারে ওর এই ভাঙা দালানের সর্বত্র। গ্রামের পথঘাটেও খুব অনায়াসে মনের চোখে ঠাওর করে ঘুরে বেড়াতে পারে আবদুল। শুধুই তাই নয় জন্মান্ধ আবদুল মানুষের চেহারা চোখে না দেখেও তার গলার স্বর শুনে তার আবেগ,মানসিক অবস্থার কথা পড়ে নিতে পারে খুব অনায়াসেই। আবদুল কে এগিয়ে আসতে দ্যাখে বিষ্ণুপ্রিয়া। দেখে বেশ অবাকই হয় ও। মনে মনে ভাবে দেখে বোঝার উপায় নেই যে মানুষটা অন্ধ। তাহলে ওঁর সম্বন্ধে যা শুনেছে তা হয়তো ভুল নয়। অবাক হতে হতেই হঠাৎ প্রশ্ন করে বসে বিষ্ণুপ্রিয়া।

-তুমি কি ঢেঁকিতে পার দিতে পারো? 

এবার অবাক হওয়ার পালা আবদুলের। মেয়েটি কে? কোথা থেকেই বা এলো? আর সবথেকে বড় প্রশ্ন ও জানলো কি করে আবদুল ঢেঁকিতে পার দেওয়ার কাজে বেশ পারদর্শী। এবং এটাই ওর রুজি রুটির যোগান দেওয়ার একমাত্র সম্বল। 

-তুমি কে গো মেয়ে? কোথা থেকে আসছো? গলা শুনে তো এ গাঁয়ের মনে হচ্ছে না তোমাকে? 

-আমার নাম বিষ্ণুপ্রিয়া। আমি পাশের গ্রামে থাকি। তোমার সাহায্য চাই মিয়াঁ সাহেব। 

আশ্চর্য হওয়ার অবকাশ আর নেই। পরপর কথা শুরু হয়ে গেছে এখন।

-বামুনের মেয়ে? কোন গাঁয়ে ঘর তোমার? কে হদিস দিল এই অন্ধের।

-আমি কায়েতের ঘরের বৌ। গত আষাঢ়ে স্বামী মারা গেছে। দুটি সন্তান নিয়ে বড়ই বিপদে পড়েছি। তোমার সাহায্য পেলে খিদের নাগাল থেকে বেঁচে যেত তিন তিনটে পেট। 

-আমি কি ভাবে? আমি তো নিজের পেটই রোজ ভরতে সক্ষম নই। কতদিন যে শুধুই জল খেয়ে দিন কাটে! আল্লার দয়ায় বেঁচে আছি আমি।

এতটা বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবদুল। এবার বিষ্ণুপ্রিয়া বলে।

-আমি সারা গ্রাম ঘুরে ঘুরে ধান জোগাড় করে আনবো। তুমি ঢেঁকিতে পার দিয়ে দেবে? মানুষেরা জানতে পারবে ধীরে ধীরে তখন হয়তো তারা নিজেরাই ধান পৌঁছে দিয়ে যাবে। যা পয়সা পাবো দিনের শেষে ভাগ করে নেবো। 

বিষ্ণুপ্রিয়ার কথা শুনে এবার হেসে ফেলে আবদুল মিয়াঁ। কিছু না বলে ঘরের দিকে পা বাড়ায়। সেই দেখে বিষ্ণুপ্রিয়ার মনটা খারাপ হয়ে যায়। ও ভাবে এবারেও হতাশা হাতে নিয়েই ফিরে যেতে হবে সেই নরকে। যেখানে একদিকে পেটের খিদে আর অন্য দিকে জোড়া জোড়া চোখেদের লালসার চাউনি। দিনরাত শুধু গিলতে আসছে বিষ্ণুপ্রিয়াকে। হোক না মুসলিমদের গ্রাম। তবুও যেন কি অদ্ভুত একটা শান্তি এ গ্রামের বয়ে যাওয়া প্রতিটা হাওয়ায়। আর এই দালানে? এখানে যেন অন্য গন্ধ পায় বিষ্ণুপ্রিয়া। ভরসার গন্ধ। সততার গন্ধ। নীরবতার গন্ধ। মুগ্ধ হচ্ছিল বিষ্ণুপ্রিয়া। ফিরে যেতে হবে ভেবেই পিছন ফিরছিল ও। হঠাৎই এক ঘটি জল হাতে ওর দিকে এগিয়ে এলো আবদুল। 

-মিয়াঁদের ঘরের জল। খাবে নাকি গো কায়েতের বৌ? মুখখানা যে একেবারে শুকিয়ে গেছে তোমার। 

হাত বাড়িয়ে ঘটিটা প্রায় টেনেই নেয় বিষ্ণুপ্রিয়া। গতরাতে আধপেটা খাওয়া জুটেছে কি জোটেনি। ঢকঢক করে সব জলটুকু নিমেষে শেষ করে ও। 

-শুধুই জল দিলাম তোমায়। ঘরে আর তেমন কিছু নেই যে। কবে থেকে ঢেঁকিতে পার দিতে হবে বলে দিয়ে যাও। 

খুশিতে মুখটা চকচকে হয়ে ওঠে বিষ্ণুপ্রিয়ার। 

-তুমি বললে কাল থেকেই আবদুল মিয়াঁ। আমার ছেলেমেয়েদুটো যে না খেয়ে মরছে গো। 


পর্ব-দুই 

এইখানটাতে এলে সারাদিনের খিদে,ক্লান্তি,মনের যা যা কষ্ট সবই ভুলে যায় আবদুল। অসম্ভব একটা শান্তি পায় যেন। জায়গাটা হল চুর্ণিনদীর ধারে। আবদুলদের গ্রামের শেষপ্রান্তে। যেখানে আপন মনে বয়ে চলে চুর্ণি নদীখানি। আর এই নদীর ঠিক পাশেই ওদের গ্রামের কবরখানা। কবরখানার ঠিক পাশেই একটা বহু পুরনো বট গাছ। সেই গাছের তলায় বসে থাকে আবদুল। সারাদিনে অন্তত দুইবার তো সে এখানে আসেই। যখন সূর্য ওঠে এবং যখন সূর্য বিদায় নেয়। এখানে এসে অনেকখানি সময় কাটায় আবদুল। ভোর বেলা এখানে এলে আবদুলের মনে হয় সদ্যজাত প্রতিটা দিনের কান্না শুনতে পায় সে। আবার সন্ধ্যার চলে যাওয়া তরুণ সূর্যটা যেন আবদুল কে ছুঁয়ে বলে যায় কাল আবার আমার জন্ম হবে অন্যকোনও দিনের সাজে। আবদুল খুব ছোটবেলা থেকেই বাঁশী বাজাতে পারে। আবদুলের আব্বাও ভালো বাঁশী বাজাতো। আম্মির চেহারাটা আবছা মনে পড়ে আবদুলের। আব্বু,আম্মি,আপা সবার ছবিগুলোই দিন দিন ভীষণ আবছা হয়ে যাচ্ছে। আব্বু,আম্মি,আপারা সবাই কেমন আছে? কোথায় আছে আবদুল জানে না। তবে ওর ধারনা ওরা ওর সাথেই আছে। আবদুল বহুবছর আগেই ওদের সকলকে হারিয়ে ফেলেছে। না সবাইকে বললে একটু ভুল বলা হয়। এক আপা এখনও আছে। তবে তার সাথে এখন প্রায় যোগাযোগ নেই বললেই চলে। গ্রামে সেবার মড়ক লেগেছিল। সেই মড়কেই সকলের প্রাণ যায়। শুধু আবদুলই বেঁচে যায়। আবদুলের তখন কতই বা বয়স হবে। বড়জোর আট কি দশ হবে। আবদুলের বড় আপার তখন নিকাহ্‌ হয়ে গিয়েছিল। তাই সেও বেঁচে গিয়েছিল। আবদুল কিভাবে এবং কেন বেঁচে গিয়েছিল তার উত্তর একমাত্র আল্লাহ্‌ জানে। এরপর থেকে আবদুল একা। জন্মান্ধ আবদুলের পড়ালেখা করা হয়নি। কোনও কাজও তার জোটেনি। অথবা সেভাবে চেষ্টাই হয়তো করেনি কখনও। একটা তো পেট। চলে যায় কোনরকমে। তবে ঢেঁকিতে পার দেওয়ার কাজটা খুব ছোট বেলায় আবদুল শিখেছিল আম্মির কাছে। সেইটাই এখন ওর দুবেলা ভাত জোগাড়ের একমাত্র অবলম্বন। আবদুল প্রতিদিন দুবেলা চুর্ণি নদীর ধারের এই জায়গাটায় এসে বটের ছায়ায় বসে অনেকক্ষণ বাঁশী বাজায়। ও পরের জন্মে বিশ্বাস করে না। কিন্তু ও জান্নতে বিশ্বাসী। ও জানে ওর পরিবারের সকলেই সেখানে আছে। আর সেখান থেকেই সকলে ওর বাঁশীর সুর শুনছে। 

আজ আম্মিকে খুব মনে পড়ছে। পৌষের শীতল নরম রোদেলা বিকালে বটের ঝুরির গা ঘেঁষে বসে বাঁশী বাজাচ্ছিল আবদুল। চোখ বন্ধ করলেই আম্মিকে দেখতে পাচ্ছে যেন। সূর্যটাও যাবো যাবো করছে তখন। প্রতিদিনের মতই আজও সূর্যটা আবদুলের কানে কানে বলতে এলো-কাল আবার আসবো নতুন দিনের সাজে। আজ সূর্যের কথার সাথে সাথেই আবদুলের মনে পড়ে যায় বিষ্ণুপ্রিয়াকে। হঠাত করেই কোথা থেকে এলো মেয়েটি। কি চায় তা তো স্পষ্ট করেই বলল। কিন্তু আবদুল সত্যিই কি পারবে? আজ বিষ্ণুপ্রিয়ার কথাগুলো শুনতে শুনতে আবদুলের অন্ধ চোখে ভেসে যাচ্ছিল আম্মির একটা ফ্যাকাসে ছবি। আম্মি হলেও এভাবেই ছুটে যেত হয়তো। আবদুল একবার ‘খিদে পেয়েছে’ বললে আম্মিও খুব অস্থির হয়ে পড়ত। ছোটবেলার আবদুল,আম্মির আদর,আব্বার বাঁশীর শব্দ সব যেন খুব স্পষ্ট আজও। আবদুল চোখ মোছে। এবার ওর ঘরে ফেরার সময় হয়েছে।

আবদুলের মাথায় আলতো করে হাত রাখে সমর। আবদুলের মনটা ফিরে আসে পৌষের সন্ধ্যায় পড়ে থাকা রুগ্ন বিছানাটায়। যেখানে আবদুলের জীর্ণ দেহটা পড়ে রয়েছে। আবদুল চোখ খোলে না। সমরের স্পর্শে একটা সুখ অনুভব করে আবদুল। সেই সুখ বোঝাতেই কি না জানা নেই ওর চোখ থেকে ঝরে পড়ে ফোঁটা ফোঁটা কান্নারা। সমর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আবদুলের মনে পড়ে যায়। একবার সমরের প্রচণ্ড জ্বর হয়েছিল। এত জ্বর যে রাতভর ওর জ্ঞানই ছিল না। সারারাত আবদুল আর বিষ্ণুপ্রিয়া ওর মাথার কাছে বসেছিল। জলপট্টি দিচ্ছিল বিষ্ণুপ্রিয়া। তালপাতার পাখায় হাওয়া করে দিচ্ছিল আবদুল। সমর বরাবরই খুব মা নেওটা ছেলে ছিল। মা ছাড়া সারা পৃথিবীতে ও আর কিছু ভাবতেই পারত না। আর ঠিক একইভাবে বিষ্ণুপ্রিয়ারও কলিজার টুকরো ছিল সমর। শিউলি মানে সমরের বোন ছোট থেকেই একটু ছটফটে। সমস্ত বিষয়েই ছিল ওর ভীষণরকমের জেদ,রাগ। নিজের অজান্তেই নিজেকে,মাকে,দাদাকে কষ্ট দিয়ে ফেলত শিউলি। শিউলি সর্বক্ষণ তার নিজের আশেপাশে একটা শক্ত খোলসে নিজেকে বন্দী করে রাখত। সে খোলস এতটাই শক্ত ছিল যে সেই খোলস ভেদ করে শিউলির মা এবং দাদা কেউই শিউলির মনের নাগাল পেত না। গ্রামের সহজসরল জীবনযাপনে ঐটুকু বয়সেই শিউলি ছিল বড্ড বেমানান। মা এবং দাদার হাত ধরে শিউলি মাঝেমাঝে আবদুলের বাড়িতে আসত। কিন্তু আবদুল শিউলির তেমন পছন্দের মানুষ ছিল না সেটা প্রথম থেকেই বোঝা যেত। সেবার গ্রামের মেলা থেকে আবদুল শিউলির জন্য একজোড়া মাটির পুতুল এনেছিল। কিছুতেই সেই পুতুল শিউলি নেয়নি। বিষ্ণুপ্রিয়া মেয়েকে বোঝাতে পারে নি যে কেউ কিছু দিলে তা নিতে হয়। 

-ওই লোকটা আমাদের কেউ হয় না। ওর দেওয়া পুতুল আমি নেবো কেন? ঠাকুমা,কাকিমা যখন জিজ্ঞাসা করবে কোথায় পেলি? তখন আমি কি বলব?

বিষ্ণুপ্রিয়া জানত ওর শ্বশুরকূলের সকলেই ওর এই কাজ করাটাকে অপছন্দ করে। তারপর আবার আবদুল মিয়াঁ মুসলমান। এই জন্য অনেক অশান্তি,অনেক কটু কথা রোজই বিষ্ণুপ্রিয়াকে শুনতে হত। বিষ্ণুপ্রিয়া মনে মনে কষ্ট পেলেও মুখে তা প্রকাশ করত না। ওর ছেলেমেয়ের ভালোর জন্য এতটুকু কষ্ট ও হাসিমুখে মেনে নিতে পারে। তবে শিউলিটাকে বিষ্ণুপ্রিয়া কিছুতেই নিজের মনের মত করে কিছু শেখাতে পারত না। দিনের অনেকখানি সময় ওরা মাকে ছেড়ে থাকে। আর সেই সময়েই বাড়ির বাকি সদস্যরা শিউলির মাথায় যত রাজ্যের বাজে কথা ভরে দেয় ওর মায়ের বিরুদ্ধে। সমর সবটা বোঝে। ওরা ওর মায়ের বিরুদ্ধে সমরের কানভাঙানি দিতে পারে না। ও জানে মা ওদের জন্যই এত কষ্ট করে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ধান জোগাড় করা। সেই ধান থেকে চাল করা। ঝেড়ে সাফ করে আবার সেই ধান তাদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসা। এই সম্পূর্ণ কাজে মাকে সাহায্য করে আবদুল মিয়াঁ। সমর কখনও কখনও ওদের সঙ্গে থেকে ওদের কাজে সাহায্য করত। ঝড়জলের দিনে ভিজে ভিজেও মা এবং আবদুল মিয়াকে কাজ করতে দেখেছে সমর। ছোট্ট সমরের মনে মনে রোজ একটা ভাবনা আসত। লোকটা কি ভগবান! কেন এত করে আমাদের জন্য। সমর মনে মনে কৃতজ্ঞ হত। ওরা আরও কষ্টে থাকত যদি না মা এই কাজটা করত। সমররা এখন স্কুলে যায়। ছেঁড়া জামা খুব একটা পড়তে হয় না ওদের। সবথেকে ভালো ব্যাপার হল রোজ দুবেলা পেট ভরে ভাত খায় এখন ওরা। হঠাৎ করেই একটা ঝাঁঝাল কাশিতে হুঁশ ফেরে সমরের। 

-কষ্ট হচ্ছে? জল খাবে? 

সারা দিতে পারে না আবদুল। সমর জলের ঘটিটা থেকে অল্প অল্প করে জল দেয় আবদুলের মুখে। কিছুটা শান্ত হয় আবদুল। প্রচণ্ড হাঁপাচ্ছে হঠাৎ করেই। ডাক্তারের কথা মত সমর অসহায়। কিই বা করতে পারে ও। প্রহর গোনা ছাড়া আর সত্যিই কি কিছুই করার নেই। মনে মনে বিড়বিড় করে সমর-“ভগবান মানুষটাকে আর কত কষ্ট দেবে তুমি!” কথাগুলো পৌঁছে যায় আবদুলের কান পর্যন্ত। হাতটা অনেক কষ্ট করেই সমরের মাথার দিকে নিয়ে যেতে চায় আবদুল পারে না। 

-তুমি একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো। আমি এখানেই আছি। 

সমরের কথা শুনে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করে আবদুল। মন চলে যায় আবার সেইসব বসন্তের দিনগুলোয়। ভাবতে ভাবতে ঘুম নেমে আসে আবদুলের চোখে। 


পর্ব-তিন

রাত বেশী হয়ে গেলে বিষ্ণুপ্রিয়াকে অনেকখানি পথ একা ফিরতে হয়। আজকাল সমরও কমই আসে। পড়াশোনায় ছেলেটার বেশ মন। এতে খুব খুশি হয় বিষ্ণুপ্রিয়া। তাই বেশী রাত হয়ে গেলে আবদুল মিয়াঁ বিষ্ণুপ্রিয়ার সাথে কিছুটা পথ যায়। ওকে এগিয়ে দিয়ে আসে। আজও যাচ্ছিল। যেতে যেতেই কথা হচ্ছিল। বিষ্ণুপ্রিয়া বলে, 

-ওদের জন্যই তো এত কষ্ট করি আমি। ওরা ভালো করে মানুষ হলেই আমার সুখ।

আবদুল হেসে ফেলে। বিষ্ণুপ্রিয়ার মত সৎ,সাহসী এবং নিঃস্বার্থ মেয়েমানুষ খুব কমই দেখেছে আবদুল। 

-নিজের জন্য কখনও কিছু চাইতে শেখনি তুমি তাইনা প্রিয়া?

হ্যাঁ আজকাল প্রিয়া বলেই ডাকে ওকে আবদুল মিয়াঁ। আবদুল মিয়াঁর সঙ্গে বিষ্ণুপ্রিয়ার কি সম্পর্ক এসব নিয়ে পাড়াসুদ্ধ লোকের অনেক চিন্তা। অনেক নিন্দে-মন্দ। শুধু এই নিয়ে কখনও কোনও চিন্তাই করে না ওরা দুজনের কেউই। তবে বিষ্ণুপ্রিয়া বোঝে এই সম্পর্ক শুধু কাজের বা প্রয়োজনের নয়। এই সম্পর্ক তার থেকেও অনেক বেশী। বিষ্ণুপ্রিয়ার ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয় এই মানুষটা না থাকলে আজ ওদের না খেয়ে মরতে হত। আবদুল মিয়াঁ বিষ্ণুপ্রিয়ার পরিবারের জন্য সেই বটবৃক্ষের মত। যে গাছ ঝড়,বৃষ্টি,সূর্যরশ্মি সব থেকে এদের পরিবারকে বাঁচায়। এতেই গাছের সুখ। ওদের হাসিমুখ দেখেই আবদুল মিয়াঁর শান্তি। এইটুকু এতদিনে বুঝে গেছে বিষ্ণুপ্রিয়া। 

-আমার জন্য আমি ভাবিনা কখনও। আর এছাড়া তুমি তো আছোই মিয়াঁ আমার কথা ভাবার জন্য। 

আবদুলের বুকে বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে যায়। লজ্জা পেয়ে যায় আবদুল। তাহলে কি প্রিয়া আবদুলের মনের কথাটা পড়ে নিয়েছে? 

-ওভাবে বলছ কেন? আমি আর কিই বা করতে পারি? তুমি একা হাতেই তো সমস্ত সামলাও। 

আজ কথা এড়িয়ে যায় না বিষ্ণুপ্রিয়া। এরআগেও বহুবার এইধরনের নানা প্রসঙ্গ সামনে এলে সযত্নে তাকে আঁচলের খুঁটে বেঁধে সরিয়ে রেখে কাজে মন দিয়েছে বিষ্ণুপ্রিয়া। 

-আমি সব বুঝি মিয়াঁ। আর এও বুঝি তুমি না থাকলে আমদের কি হাল হত। 

সন্ধ্যার আকাশে সেদিনও ছিল একটা চকচকে পূর্ণিমার চাঁদ। চুর্ণি নদীর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ওরা। রোজ এই পথেই বাড়ি ফেরে বিষ্ণুপ্রিয়া। বটগাছের তলায় অল্প সময় বসেও কখনও কখনও। আজও বসল ওরা। আবদুল বাঁশিতে সুর তুলল। কি ভীষণ মনোরম ছিল সেই সন্ধ্যাটা। 

“প্রিয়া” “প্রিয়া” বলে ওঠে আবদুল। রোগশয্যায় শুয়ে অস্থির হয়ে ওঠে আবদুল। কাঁপা কাঁপা হাতে কাকে যেন খুঁজছে আবদুল। সমর জানে আবদুল কাকে খুঁজছে। আবদুলের খোঁজার মানুষ একজনই এ সংসারে। সে হল ওদের মা। এখন রাত গড়িয়ে ভোর হওয়ার সময় এসেছে। হ্যারিকেনের আলোটাকে আরও একটু উসকে দেয় সমর। এবার সমর বুঝতে পারে আবদুলের শেষ সময় হাজির। 

-আব্বা! আব্বা! খুব কষ্ট হচ্ছে? 

এই প্রথমবার সমর আবদুলকে ‘আব্বা’ বলে ডাকল। সন্তান স্নেহেই সমর এবং শিউলির জন্য আজীবন সবটুকু করে এসেছে আবদুল মিয়াঁ। শিউলি মেনে না নিলেও সমর অনেকদিন আগেই আবদুলকে মন থেকে ‘আব্বা’ হিসাবে মেনে নিয়েছিল। শুধু তাকে এই নামে এর আগে ডাকেনি কখনও। আজ আবদুলের মৃত্যুশয্যায় সমর নিজের অবচেতনেই আবদুলকে ‘আব্বা’ বলে ডেকে ওঠে। আবদুলের কানে সেই ডাক পৌঁছালো। শেষ সময়ে সবটুকু পাওয়া হয়ে গেল আবদুলের। সারাজীবনের যত কষ্ট সব যেন এক নিমেষে শেষ হয়ে গেল। এবার চলে যেতে হবে ওকে। সমরের হাতে শেষ পানি পেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ল আবদুল। ভোর হতে এখনও আরও কিছুটা দেরি আছে। সমর বাঁশিটা হাতে তুলে নিল। বুকের সমস্ত কান্নাকে ঢেলে দিল বাঁশির সুরে। অনেক দূরে মাকে দেখতে পাচ্ছে সমর। ওই তো মা। আবদুলের উঠোনের এক কোণে মায়ের হাতে লাগানো তুলসী তলায় দাঁড়িয়ে আছে মা। সমর খুব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে আব্বা মায়ের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। সমর জানত মা মনে মনে অনেক শ্রদ্ধা করত আব্বাকে। আর আব্বা? আব্বা যে মাকে খুবই ভালোবাসতো সেটাও সমরের কাছে খুব স্পষ্ট ছিল। 

আবদুল,বিষ্ণুপ্রিয়ার কোনও সংসার ছিল না। কোনও সম্পর্কের গণ্ডিতে বাঁধা ছিল না ওরা চারজন। তবুও যেন কোনও অদৃশ্য সুতোর ডোর ওদের বেঁধে রেখেছিল। কিন্তু আত্মার এই বাঁধনে কোনোদিনই ধরা পড়েনি শিউলি। সমস্ত বিষয়টাকে ঘিরেই ছোটবেলা থেকে শিউলির একটা বিতৃষ্ণা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। অন্যান্য সকলের মতই শিউলিও ওর মাকে,দাদাকে এবিষয়ে নানান কটু কথা শোনাতো। একবার সমরকে শিউলি বলেছিল, 

-তুই মাকে কেন কিছু বলিস না রে দাদা? আর কতদিন আমরা ওই লোকটার সাহায্য নিয়ে বেঁচে থাকবো? 

-যতদিন আমরা বেঁচে থাকবো ততদিনই। কারণ এখন শুধু আমরা ওনার উপর নির্ভরশীল নই। উনিও আমাদের অবলম্বন করেই বেঁচে আছেন। সেটা আশা করি তুই বুঝতে শিখেছিস? 

খুব স্পষ্ট করেই শিউলিকে সেদিন এই জবাব দিয়েছিল সমর। শিউলির এই উত্তর একেবারেই মন মত হয়নি তা বুঝতে একটুও বাকি ছিল না সমরের। কিন্তু সমর নিরুপায়। ওদের অসময়ে যে মানুষটা ওদের পাশে দাঁড়িয়েছিল তার হাত ছাড়িয়ে যখনতখন যে চলে যাওয়া যায় না এইটুকু বোঝার ক্ষমতা সমরের ছিল। সমরের তখন কতই বা বয়স? এই উনিশ-কুড়ি হবে মাত্র তিনদিনের জ্বরে হঠাৎ করেই একদিন মা চলে গেল। আরও একবার আকাশ ভেঙ্গে পড়ল সমরের মাথার উপর। শিউলির তখন বিয়ে হয়ে গেছে। সমরের সাহারা বলতে তখন এই আবদুল মিয়াই। আর আবদুল মিয়াঁর সাহারা ছিল সমর। সারা গ্রামের কটু কথা শুনেও যে মানুষটা কখনও ওদের হাত ছেড়ে কোথাও যায়নি। দিনের পর দিন ওদের মাথার উপর ছাদ হয়ে রয়ে গেছে মানুষটা। মা ঠিকই করেছে এই মানুষকে শ্রদ্ধা না করে পারা যায়? নিজের বাবাকে খুব কমই মনে আছে সমরের কিন্তু এই মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে।

ভোর হয়ে গেছে। মসজিদ থেকে ভেসে আসছে ভোরের আজানের শব্দ। সমর কাঁধে তুলে নিল তার আব্বার জনাজা। কবরের দিকে এগিয়ে চলল ওরা। চুর্ণি নদীর ধারে কবরে এবার ঘুমাবে আবদুল মিয়াঁ। শান্তির ঘুম। নিশ্চিন্তের ঘুম। পরিপূর্ণ ভালোবাসার ঘুম নেমে আসবে আবদুল মিয়াঁর কবরে। আবদুল মিয়াঁর কবরের ঠিক পাশ দিয়ে কুলকুল শব্দে বয়ে চলছিল চুর্ণি নদীখানি। নদীর ওপাড়ে বিষ্ণুপ্রিয়াদের গ্রামের শ্মশান। সেখানের মাটিতে মিশে আছে আবদুলের প্রিয়ার দেহ। সমরের বাঁশির সুরে এখনও জেগে থাকে ওর আব্বার বাঁশীর সুরেরা। চুর্ণি নদীর জলে আজও ছায়া পড়ে এক নিঃস্বার্থ,নির্বাক,পবিত্র প্রেম কাহিনীর। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

নবীনতর পূর্বতন