রুমকি রায় দত্ত

 গর্ত

ট্রেনটা ধীরে ধীরে গতি হারিয়ে থেমে যেতেই ঋদ্ধিমান ঝুপ করে নেমে পড়ল। নির্জন স্টেশন,ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। মেঘ যতটা ঘন কালো, বৃষ্টির জোড় ততটা নয়। ঋদ্ধিমান প্ল্যাটফর্মের সেডের নিচেই একটা ভাঙা বেঞ্চে বসে পড়লো। চারিদিকে তাকিয়ে একবার দেখে নিল, নাহ্‌, কেউ কোথাও নেই। কব্জিতে বাঁধা সস্তার হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে একবার দেখে নিল সময়টা। মনে মনে ভাবলো হিসাব মতো লোকটার এতক্ষণে চলে আসার কথা। ওকে কি করতে হবে,এই নির্জন স্টেশনে বসেই সব বুঝিয়ে দেবে বলেছিল লোকটা। আরেকবার চারপাশে ভালো করে তাকালো,সেই একই রকম ফাঁকা। প্রতিক্ষার সময় যেন কাটতেই চায় না। আবার ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে চারপাশে চোখ বোলালো।একই রকম পরিবেশ,শুধু সময়ের সাথে পার্থক্য বলতে এই ঘন্টা খানেকের মধ্যে ওর থেকে হাত দুয়েক দূরে এসে বসেছে একটা ঘেয়ো কুকুর। গা দিয়ে বিকট গন্ধ ছড়াচ্ছে। সারা গায়ে মাঝে মাঝেই বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে গোল গোল লোম ওঠা। গা টা গুলিয়ে উঠলো ঋদ্ধিমানের। নেশা করার জন্য মনটা ছটফট করে উঠলো।পকেট হাঁৎরে বার করে আনলো আধভেজা একটা বিড়ি। ভেজা দেশলাই কাঠি ঠুকে ঠুকে অনেক কষ্টে বিড়িতে আগুন ধরিয়ে একটা সুখটান দিয়ে কুকুরটার দিকে তাকালো। তর্জনি আর বুড়ো আঙুলের মাঝে ধরে জ্বলন্ত বিড়িটা, কুকুরটার দিকে তাক করে ছোড়ার ভঙ্গি করতেই, কুকুরটা ভয় পেয়ে একবার ছোটার ভঙ্গি করে আবার বসে পড়লো। ঋদ্ধিমান আবার তাড়াতেই যাচ্ছিল কুকুরটাকে,থেমে গেল। যদিও দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা আসতে অনেক দেরি, তবুও ঘন মেঘ যেন অকাল সন্ধ্যার আরাধনায় মেতেছে। কুকুরটাকে তাড়াতে গিয়েই ঋদ্ধিমানের মনে হলো –যদি লোকটা না আসে!---আর ঠিক সেই কারণেই এই নির্জনতার একমাত্র সঙ্গীকে তাড়িয়ে আর একা হতে চায়লো না।হোক না কুকুর,তবুতো একটা প্রাণী।এই নির্জন অচেনা পরিবেশে যদি রাতেও থাকতে হয়,তবে কুকুরটার সঙ্গ বেশ লাভ জনক হবে। একা একা চুপচাপ কাহাতক আর বসে থাকা যায়,প্রয়োজনে ওর সাথে কথা বলে জিভের আড়ষ্ঠতা তো কাটানো যায়।

পা দুটোকে টানটান করে সামনের দিকে ছড়িয়ে পিছনের দিকে পিঠটা ঠেলে দিল,তারপর মুষ্ঠিবদ্ধ হাত দুটো দু’পাশে প্রসারিত করে আড়মোড়া ভাঙলো। কিছুক্ষণ এইভাবে থাকার পর আবার সোজা হয়ে বসে পায়ের উপর পা তুলে, মাথার পিছনে দু’হাতের আঙুলের জাল বুনে মাথাটা এলিয়ে দিল। মনে মনে কি একটা চিন্তা করতে লাগলো আর মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। আবার বেশ কিছুক্ষণ একই ভঙ্গিমায় থাকার পর পট করে চোখ খুলে কুকুরটার দিকে তাকিয়ে বললো---‘তোর হাসি পাচ্ছে? ---আমাকে দেখে তোর হাসি পাচ্ছে?’

তারপর গুটানো জামার হাতার ভাঁজ খুলে ছিঁড়ে যাওয়া অংশটা দেখিয়ে বললো—‘ এটা দেখে হাসি পাচ্ছে?’

পা তুলে গোঁড়ালির কাছে ক্ষয়ে যাওয়া জুতো জোড়া দেখিয়ে বললো—‘ এটা দেখে তোর হাসি পাচ্ছে?’

কুকুরটা সামনের দিকে পা দুটো ছড়িয়ে তার উপর মুখটা রেখে জুলু জুলু চোখে তাকিয়ে রইলো ঋদ্ধিমানের দিকে। ঋদ্ধিমান ডান হাতের তর্জনি তুলে একটা বিশেষ ভঙ্গি করে বললো---‘ একটা সুযোগ, শুধু একটা সুযোগের অপেক্ষায় আছি’। তারপর আবার মাথার পিছনে হাত রেখে জ্বলজ্বলে চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো—‘ শুধু একটা সুযোগ, এরপর আর ঋদ্ধিমান চৌধুরীকে কেউ ছুঁতে পারবে না। একটা খাদানের মালিক,--না না—একটা নয়,অসংখ্য খাদানের মালিক, আরও আরও কত কি!-----একটা সুন্দরী’---বলেই থেমে গেল। কুকুরটার দিকে তাকিয়ে বললো---‘ থাক্‌ এর বেশি আর তোকে জানতে হবে না--- তুই আর সুন্দরের কি বুঝবি’।

ঝুঁকে এসে কুকুরটার কাছে গিয়ে মুখটা বিকৃত করে বললো—‘ রুচি রুচি—রুচি থাকা দরকার’। এগিয়ে গিয়ে কুকুরটার পেটে একটা লাথি মারতেই কুকুরটা ক্যাঁ ক্যাঁ করে চিৎকার করলো,কিন্তু ঐ খানেই গ্যাঁট হয়ে বসে রইলো। ঋদ্ধিমান কুকুরটার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো—‘ হবে বস, তোর হবে। ---এভাবেই ধৈর্য্য ধরে লেগে থাকতে হবে’—বলেই পকেট হাঁৎরে দুটো বিস্কুট বের করে ছুঁড়ে দিল কুকুরটার দিকে। আবার ঘড়ি দেখলো। প্ল্যাটফর্মের সেডের ফুটো দিয়ে অবিরাম জল ঝরে চলেছে। ঋদ্ধিমান ঐ ছিদ্র গুলোর দিকে তাকিয় প্যান্টের পকেটে হাত চালিয়ে আপনমনে হাসলো একবার।তারপর প্ল্যাটফর্মের জমা জলের কাছে এসে নিজের মুখটা দেখার চেষ্টা করলো।ঘোলাটে জলে অস্পষ্ট একটা অবয়ব ফুটে উঠলো মাত্র। ঝপাং করে পা ফেলে কিছুটা জমা জল ছড়িয়ে দিয়ে এসে বসলো ভাঙা বেঞ্চিটাতে।


[২]

ঋদ্ধিমানের সামনে বিস্তির্ণ পরিত্যাক্ত কয়লা খাদান। কোনো এক সময় এখানে মানুষের ভিড় ছিল এখন নির্জন। শনশন হাওয়া ছোটার শব্দে ঋদ্ধিমানের গা ছমছম করে উঠলো। এখানে সেখানে কাঁটা ঝোপে ভরে আছে। এই ঝোঁপ-ঝারের নিচেই কোথাও কোথাও লুকানো আছে মৃত্যুফাঁদ। কোনো একসময় এখানে ‘ইনক্লাইন মাইনস’ ছিল। লিফ্‌টে করে শ্রমিকদের ভূগর্ভে নামিয়ে দিয়ে, খনি গর্ভ থেকে কয়লা ট্রলি করে লিফ্‌ট পর্যন্ত এনে লিফ্‌টে করে উপরে পাঠানো হয় কয়লা এইসব খাদানে। ঋদ্ধিমান মেপে মেপে পা ফেলে এগিয়ে চলেছে। ও যে এই পথই বেঁছে নিয়েছে। দ্রুত পৌঁছাতে হবে ওকে।

হঠাৎ যেন শরীরটা হাল্কা হয়ে গেল ঋদ্ধিমানের, ঠিক শূন্যে ভাসলে যেমন হয়। যেন উঁচু ইলেকট্রিক নাগরদোলা থেকে নিচে নামছে। ছেলেবেলায় মেলা দেখতে গিয়ে কতবার নাগরদোলা চেপেছে। শূন্যে ভাসার অনুভূতি ওর চেনা। না ঠিক নাগরদোলা নয়,যেন কেউ ওকে পাহাড় থেকে ঠেলে ফেলে দিল। ঋদ্ধিমান শূন্যে ভাসছে আর হাত-পা ছুঁড়ছে। চোখটা যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়ছে। চোখটা সামান্য বুঁজে বড় বড় করে সামনে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলো। নাহ্‌, ঘন কালো থোকা থোকা অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়লো না, যেন রাশি রাশি কয়লা ওর গায়ে কেউ ঢেলে দিচ্ছে। ঋদ্ধিমান গভীর থেকে আরও গভীরে প্রবেশ করতে লাগলো। হঠাৎ পায়ের তলায় জলের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলো, তারপরই পা টা গিয়ে ঠেকলো কঠিন তলে। আচমকা মাটিতে পড়ে ওর গোটা শরীর কেমন যেন ঝনঝন করে উঠলো।ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে আবার পড়ে গেল। কেমন একটা ঘোরে থাকা ঋদ্ধিমান উঠে দাঁড়িয়ে স্তম্ভের মত দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। পা ডোবা জলে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অনুভব করলো পায়ের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া কীটপতঙ্গদের আনাগোনা। ঘন অন্ধকারে জায়গাটা সম্পর্কে কিছু ঠাহর করতে না পেরে দুপাশে হাত প্রসারিত করতেই হাত ঠেকে গেল দেওয়ালে। দেওয়ালের গায়ে হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে অনুভব করার চেষ্টা করলো সে ঠিক কোথায় আছে। হাত প্রসারিত রেখেই গোল করে একবার ঘুরে নিল। সামনে এগোতে যেতেই ঠোকা খেল মাথায়। আঃ! বলে একটা আর্ত চিৎকার করতেই দেওয়ালের গায়ে ধাক্কা লেগে সেই শব্দ প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এসে ধাক্কা মারলো ওর কানের পর্দায়। বুকের ভিতরে একটা গমগমে আওয়াজ দুমদুম করতে লাগলো। একটা দম বন্ধ করা ভ্যাপসা গন্ধে চারপাশের বায়ু ভারি হয়ে উঠলো। ভয়ে বুকের ভিতরটা ধুপধুপ করে উঠতেই ঋদ্ধিমানের মনে পড়লো কুকুরটার কথা। চোখের মণি বিস্ফারিত করে একফোঁটা আলোর রেখা খুঁজতে লাগলো ঋদ্ধিমান। এত নিকষ ঘন কালো এর আগে ঋদ্ধিমান কখনও দেখেনি। ছেলেবেলায় আলো জ্বলতে জ্বলতে হঠাৎ কারেন্ট বন্ধ হয়ে গেলে এমনি করে চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসতো। সেই অন্ধকারের সুযোগে ওরা তখন একে অপরের গায়ে চিমটি কাটতো, চুল ধরে টানতো। কিন্তু সেই অন্ধকারের একটা স্নিগ্ধ রূপ ছিল। অন্ধকারে আকাশের দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর চোখ সয়ে গেলে যেন একটা হাল্কা আলোর রেখা দেখা যেত। সেই অন্ধকার অনুভব করা যেত। কিন্তু এই কালো অন্ধকার যেন কলঙ্কের কালির মতো কালো। হঠাৎ ঋদ্ধিমানের মনে হলো সে অন্ধ হয়ে যায়নি তো? ----দু’হাতে চোখ কচলালো,তারপর পিটপিট করে চারিদিক একবার দেখার চেষ্টা করলো। আবার চোখ কচলালো। আঙুলের চাপে চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে এলো। মাথাটা উপরে তুলে আরেকবার আলো দেখার বৃথা চেষ্টা করলো। উপরে চায়তেই ঝিরঝির করে জল ওর চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়লো। হঠাৎ বুকটা ভারি হয়ে আসাতে জোড়ে জোড়ে শ্বাস টেনে একবুক শ্বাসবায়ু ভরে নিল ফুসফুসে। ভিতরের বিষাক্ত বায়ুর প্রভাবে ওর শরীরের ভিতরটা কেমন যেন অস্থির করে উঠলো। শরীরটা বিষাক্ত বায়ুতে ক্রমশ ভারি হয়ে এলো। মাথার ভিতরটা ঝিমঝম করতে শুরু করলো। ঋদ্ধিমান চিৎকার করে বলে উঠলো---‘কুকুরটা,---কুকুরটা কোথায় গেল?’ গলার আওয়াজ আরেকটু বাড়িয়ে চিৎকার করে বললো---‘কুকুরটা—আ—আ—আ?’ ক্রমাগত আ—আ—ধ্বনি ফিরে ফিরে আসতে লাগলো। ঋদ্ধিমান চোখ বুঁজলো, দেখলো---‘ কুকুরটা একটা ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে। মুখ থেকে একটা কি যেন ঝুলে আছে। ঋদ্ধিমান এগিয়ে গেল দু’পা। ভালো করে বোঝার চেষ্টা করলো কুকুরটার মুখে ধরা বস্তুটাকে। আরেকটু এগিয়ে যেতেই দেখলো কুকুরটা মুখে একটা সুন্দরী মেয়ের শাড়ির আঁচল ধরে টানতে টানতে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে।ঋদ্ধিমান মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো মেয়েটির দিকে।---অপূর্ব! অপূর্ব সুন্দরী মেয়েটি,যেন ঋদ্ধিমানের চোখ ঝলসে দিচ্ছে। মেয়েটি নিজের আঁচল ধরে টান দিতেই কুকুরটা থেমে গেল। স্পষ্ট শুনতে পেল মেয়েটি রিনরিনে গলায় বলছে—‘ ছাড়্‌, ছাড়্‌ ---ছাড় বলছি হতভাগা। সেই সুদূর পথ তুই এর জন্য আমাকে টানে আনলি?’ 

কুকুরটা মেয়েটির আঁচল ছেড়ে ছুটে এলো ঋদ্ধিমানের কাছে। ওর ছেঁড়া চটিতে নাক ঘষে ফস্‌ফস্‌ করে গন্ধ শুঁকলো,তারপর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আউ—উ—উ করে একটা আদুরে আওয়াজ করলো আবার ফিরে গেল মেয়েটির কাছে। শাড়ির আঁচল ধরে টেনে আনতে চায়লো ঋদ্ধিমানের কাছে।

মেয়েটি আঁচলে টান মেরে বিস্ফারিত চোখে চিৎকার করে বলল—‘ এরই জন্য তুই আমাকে এতটা পথ টেনে আনলি?—ঐ লোকটা?—ঐ লোকটা আমাকে কি দেবে, ওর ছেঁড়া চটি?—ছেঁড়া শার্ট?---ঐ পড়িয়ে রাখবে আমায়?---কুঁড়ে ঘরে চাঁদ আটকানোর সখ?—বলেই মেয়েটা হা হা করে হাসতে হাসতে পিছন ফিরলো।

মেয়েটিকে পিছন ফিরতে দেখে ঋদ্ধিমান চিৎকার করলো---‘ যেও না, ---যেও না তুমি, আমি তোমাকে প্রাসাদ দেব। টাকার গদি দেব, হীরে দিয়ে তোমায় সাজাবো।---আমি এতকিছু পাবার লোভেই তো এখানে এসেছি’।

মেয়েটি কুকুরটার মুখ থেকে আঁচলটা ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত পিছনের পথে হাঁটতে লাগলো।

ঋদ্ধিমান দৌড়াতে শুরু করলো। ছুটতে ছুটতে জুতোর শুকতলাটা আরো ক্ষয়ে যেতে লাগলো। কাঁটা ঝোঁপে আটকে যত ছট্‌ফট্‌ করতে লাগলো তত জড়িয়ে যেতে লাগলো কাঁটার ঝোঁপে।

অবসন্ন শরীরে ভিতরে জমা পঁচা জলের মধ্যেই বসে পড়লো ঋদ্ধিমান। জলে জন্মানো অসংখ্য পোকা ওর শরীরকে আশ্রয় করে ওর গায়ে ওঠার চেষ্টা করতেই, ঋদ্ধিমান দু’হাতে পোকাগুলোকে সরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো। শরীরের ভিতরটা যেন ক্রমশ শুষ্ক হতে শুরু করেছে।ঋদ্ধিমান এক আঁজলা জল নিয়ে মুখে চোখে ছেটাতেই ওর গা টা ঘিনঘিন করে উঠলো,---পঁচা জলের উৎকট গন্ধে।

সময়ের হিসাব সব যেন ওলোটপালোট হয়ে গেছে। মাস, দিন কি বছর, চোখের সামনে একরাশ ঘন অন্ধকারই এখন একমাত্র সত্য ঋদ্ধিমানের কাছে। গলাটা শুকিয়ে জিভ যেন বের হবার উপক্রম। অস্ফুটে ঋদ্ধিমানের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো –‘জল—জল’। ঋদ্ধিমান জানে বৃথা আস্ফালন, তবুও ‘যতক্ষন শ্বাস, ততক্ষন আশ’। আবার এক আঁজলা জল নিয়ে জিভে ঠেকিয়ে ওয়াক শব্দে ছুঁড়ে ফেললো জলটা। ভিতর থেকে নাড়িভুঁড়ি সব যেন বেরিয়ে আসতে চায়লো। ঋদ্ধিমান জোড়ে চিৎকার করে উঠলো –‘কে আছ বাঁচাও—ও—ও’। দেওয়াল আঁচড়ে উপরে ওঠার বৃথা চেষ্টা করতে লাগলো। ছিটকে পড়লো পঁচা জলে। এক ছাটাক জল ঢুকে গেল ওর মুখে। থু—থু—করে এক দলা থুঁতু ছড়িয়ে দিল দেওয়ালে। গলা শুকিয়ে তীব্র কাশির চোটে চোখ যেন বেরিয়ে আসতে চায়ছে। গা থেকে জামাটা খুলে ফেললো ঋদ্ধিমান,জলের উপর তলে জামাটা ভিজিয়ে নিংড়ে বার করা জলের তলায় জিভ পাতলো,ফোঁটা ফোঁটা জল ওর জিভ গড়িয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে লাগলো। ঋদ্ধিমান মরুভূমির হাহাকার নিয়ে চোঁ চোঁ করে গিলে নিতে লাগলো সেই বিষাক্ত,স্বাদহীন জল।

বুকটা ক্রমশ ভারি হয়ে আসছে। শ্বাস নিতে একটা চাপা কষ্ট অনুভব হচ্ছে ঋদ্ধিমানের। জোড়ে জোড়ে শ্বাস টানাতে বুকের খাঁচাটা হাপরের মতো উঠানামা করতে লাগলো। ক্রমশ ঝাঁপসা হতে থাকা দৃষ্টির সামনে ভেসে উঠলো সেই সুন্দরীর মুখ,টাকার পাহাড়ে বসে টাকা গুনছে আর হা হা করে হাসতে হাসতে ঋদ্ধিমানের দিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে সেই টাকা। ঋদ্ধিমান কুকুরের মতো সেই টাকা কুড়িয়ে বুকের কাছে জড়ো করে ধরে আছে। পেটের ভিতর অসম্ভব যন্ত্রণায় মোচড় দিতেই ঋদ্ধিমানের মনে পড়লো খাওয়ার কথা। যেন তীব্র নখের আঁচড়ে কেউ ভিতরে খামচাচ্ছে। দু’হাত দিয়ে পাগলের মত পকেট হাঁৎরে খাবার খুঁজতে লাগলো। মনে পড়ে গেল দুখানা বিস্কুটই কুকুরটাকে দিয়ে দিয়েছে। অগ্নাশয়ের তীব্র ক্ষরণে পাগলপ্রায় ঋদ্ধিমান পা থেকে জুতোটা খুলে চিবাতে লাগলো, জুতো শেষে হাত থেকে ধাতব ঘড়িটা খুলে চিবাতে লাগলো।ধাতব পাতের আঘাতে মুখ ঠোঁট কেটে গড়ানো রক্ত জিভ দিয়ে চেঁটে নিতে লাগলো ঋদ্ধিমান। লোলুব্ধ দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলোকে। সেগুলি যেন অঙ্গ নয়, মাংসের পিন্ড। দুহাতে পেট চেপে ধরে চিৎকার করতে চেষ্টা করলো, কিন্তু গলা দিয়ে কিনকিনে আওয়াজ বেরোলো শুধু।বাঁচার তীব্র আকুতিতে হাঁউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো। ডুবন্ত মানুষের খড়কুটো আঁকড়ে বাঁচার চেষ্টার মত হাঁচড়ে পাঁচড়ে দেওয়াল ধরে উপরে ওঠার চেষ্টায় সমস্ত শরীর ছড়ে গিয়ে রক্ত ঝড়তে লাগলো। ক্ষীণ আওয়াজে বলতে লাগলো—‘ আমি বাঁচতে চাই-ই-ই’। ----হঠাৎ যেন অন্ধকারের বুক চিঁড়ে আলোর একটা রেখা ঠিকরে পড়লো ওর চোখে মুখে।

[৩]

প্ল্যাট ফর্মের ভাঙা বেঞ্চে বসে থাকা ঋদ্ধিমানের বন্ধ চোখ আর ভ্রু দুটো আলোতে সামান্য কুঁচকে গেল। বাইরের আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। আগের দিন দুপুরে যেখান দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল, সেখান দিয়েই আলোর রশ্মি এসে পড়েছে ঋদ্ধিমানের চোখে মুখে। ঋদ্ধিমান ধীরে ধীরে শ্বাস টানলো। একরাশ টাটকা বাতাস ওর ফুসফুসে প্রবেশ করে ওর শরীরটা ঝরঝরে করে দিল। সামনে তাকিয়ে দেখলো কুকুরটা তখনো বসে ঋদ্ধিমানের দিকে তাকিয়ে সামনের পা দুটো টানটান করে আড়মোড়া ভাঙলো তারপর গা ঝাড়তেই ভ্যাক্‌ করে ওর গায়ের পঁচা গন্ধ ঋদ্ধিমানের নাকে প্রবেশ করলো। ঋদ্ধিমান উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙতেই দেখতে পেলে দূর থেকে একটা বেঁটে মতো লোক হাত নাড়তে নাড়তে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। ঋদ্ধিমান পিছন ঘুরলো, দেখলো সিগ্‌ন্যালটা হলুদ থেকে সবুজ হয়ে যাচ্ছে। ঝ্যাক্‌ ঝ্যাক আওয়াজ তুলে এই স্টেশনের একমাত্র ডাউনট্রেন এসে দাঁড়ালো। ঋদ্ধিমান লাফিয়ে ট্রেনে উঠেই পা থেকে জুতো জোড়া খুলে ছুঁড়ে দিল কুকুরটাকে। ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে ধীরে ধীরে এগোতে লাগলো। কুকুরটা জুতোটা পেয়ে প্রথমে খানিক চেবালো, তারপর ওটা নিয়ে খেলা শুরু করলো। ঋদ্ধিমান ট্রেনে পাশে বসা লোকটার দামি ঘড়ির ডায়ালে লেখা তারিখ দেখে মনে মনে হাসলো। হঠাৎ ওর ভাঙা স্ক্রিণের মোবাইলটা কেঁপে উঠলো। স্পিকারের কাছে মুখ ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বললো—“একটা গর্ত”। জানালা দিয়ে টুকি মেরে দেখলো লোকটা মোবাইল কানে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

নবীনতর পূর্বতন