" নাঃ স্যর , সেদিন বা চার পাঁচ দিন আগে পরেও কোলকাতা থেকে এই হোটেলে এসে ওঠা কাউকে দেখা যাচ্ছে না । আপনি রেজিস্টার টা দেখুন । " বলে রিসেপসনে বসে থাকা টাক মাথা আর গুঁফে পৌঢ় ভদ্রলোক আমার হাতে রেজিস্টার টা ধরিয়ে দিলেন । এই মানুষ টি প্রথম দর্শনে চমকে উঠে আমি লেখক কিনা জিঞ্জাসা করেছিলেন ।
আমি তন্ন তন্ন করে দেখেও কোলকাতা থেকে আসা কারুর নাম পেলাম না । রেজিস্টার টা ফেরত দিতে যাব , হঠাৎ পাতার তলার দিকের একটি নাম চোখে পড়ল । দেবাশীষ দাস , চার্চ রোড , ব্যান্ডেল , হুগলি । কোলকাতা বা তার কাছে পিঠের ঐ একজনই ঐ তারিখের আগে এসেছিলেন । আমি কি মনে কোরে ঠিকানাটা তুলে নিলাম পকেট নোট বুকে ।
ভদ্রলোক বিজয়ীর হাসি হেসে বললেন , " তাহলে পেলেন মিঃ ব্যানার্জ্জী আপনার কাজের লোকরু ? "
আমি হেসে মাথা নাড়তেই , উনি রেজিস্টার বন্ধ করে রেখে , হোটেল বয়ের রেখে যাওয়া কফি কাপটা আমার হাতে তুলে দিয়ে প্রসন্নের নিঃশ্বাস ফেললেন । আমার লেখার যে এমন ভক্ত আছেন জেনে চমৎকৃত হলুম । আমি স্মিত হেসে কাপে চুমুক দিলাম। রিসেপসনের বা দিকের জানালা দিয়ে দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘার সমান্তরালে থাকা পাহাড় শ্রেণী দেখা যাচ্ছে ক্যালেন্ডারের ছবির মত । সোনালী রোদ পড়ে তা স্বর্ণাভ দেখাচ্ছে ।
আমার মন বলছে , একা সোনালীর পক্ষে এরকম কাজ করা সম্ভব নয় ।
#
এর আগে আমার কাছে কোন বধূ হত্যার কেস এলেও বর হত্যার কেস আসেনি। অক্টোবরের শুরুতে হঠাৎই একদিন ডোরবেল বেজে উঠল । খুলতেই এক দম্পতি হাত জোর করে নমস্কার জানালেন । মুখ দুটো কোথও যেন দেখেছি ! কথাবার্তা শুরু হতেই বুঝলাম , দৈনিক সংবাদ পত্রে দুদিন আগে ' নবনীল কান্ড ' -এর সঙ্গে ছাপা তার দাদা বৌদির ছবিতে দেখেছি ।
গ্যাংটকে বেড়াতে গিয়ে বুকের ব্যথায় মৃত নবনীল সরকারের মৃত্যু কাহিনী কোলকাতা থেকে বেরানো বাংলা পত্রিকায় প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছিল । কিন্তু সেটা হত্যা বলে তেমন একটা স্ট্যান্ড করেনা । তাছাড়া বডি ও ছাড়া পেয়ে গিয়েছে ডাক্তার সার্টিফিকেটের জোরে । এখন কি বা করার থাকতে পারে ?
আমার কথায় প্রায় কান্না ভরা স্বরে নবনীলের দাদা বললেন, " ব্যানার্জ্জী স্যর , আমাদের সত্যটাও তো জানাতে পারবেন । আমরা বিশ্বাস করি না ওর হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল । ও , সুস্থ ও সবল ছিল । আপনার সব খরচা আমাদের , আপনি শুধু সত্য টা খুঁজে বের করুন । "
ভদ্রলোকের কথায় চিন্তায় পড়ে গেলুম । তিনটি রাজ্য জুড়ে ব্যাপ্তি কেসটার । নবনীলের শ্বশুর বাড়ি কোলকাতায় । সেখান থেকেই সিকিম বেড়াতে গিয়েছিল তারা । স্ত্রী সোনালী এখন কোলকাতায় । খানিক চোখ বুজে থেকে বললাম , " ঠিক আছে । তবে কতটা কী বেরোবে বলতে পারছিনা । আমায় সোনালী ও নবনীলের সম্পর্ক ও কি কারণে আপনারা এটাকে হত্যা বলে মনে করেছেন পরিস্কার করে বলুন । "
নবনীল শান্ত ও অন্তর্মুখী মানুষ । বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই অতি আধুনিকা সোনালীর সঙ্গে তার মতান্তর শুরু হয় । সোনালী ব্যাপারটাকে মানসিক নির্যাতনে নিয়ে গিয়েছিল । বৈবাহিক সম্পর্ক নিয়ে এই ঝামেলা চলা কালীন গত সপ্তাহের রবিবারে তারা দুজন কোলকাতায় যায় হলিডে কাটতে । সেখান থেকে হঠাৎ তারা চলে যায় গ্যাংটক ঘুরতে । হোটেলে গত বুধবার হঠাৎ নবনীলের বুকে ব্যাথা ওঠে এবং তিনি মারা যান । সোনালী তাদের জামশেদপুরের বাড়িতে এমন খবরই গ্যাংটক থেকে জানায় । তার দাদা বৌদির আরো অভিযোগ যে , এটা হত্যা । সোনালীর উদ্দেশ্য নবনীলের পুরো সম্পত্তি হস্তগত করে আরামের জীবন কাটাবে সে !
উনারা যাবার পরই আমি ফোনে যোগাযোগ করি সিটি পুলিশের ডিড. ডি ডি সি চারুচন্দ্র চাটার্জ্জীর সঙ্গে । উনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন কিছু করার । বিকেল তিনটেয় ফোন পাই । উনার অফিসে পৌঁছাতেই শুনি , এর মধ্যেই পুলিশ কমিশনার হয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে ও খবর গিয়েছে । তাছাড়া দুই রাজ্যের ডিডেকটিভ ডিপার্টমেন্টেকেই অনুরোধ করা হয়েছে আমাকে যেন সহায়তা করা হয় । আর ব্যাপার টা যেন গোপনে থাকে ।
#
হোটেল মালিক এসে উপস্থিত হলেন । তার কাছে গ্যাংটক পুলিশ থেকে ফোন করা হয়েছে । উনি শঙ্কিত কন্ঠে প্রশ্ন করলেন , " মিঃ ব্যানার্জ্জী আমাদের হোটেলের বদনাম হবে না তো ? " আমি মাথা নাড়তেই উনার উদ্বেগ কিছুটা কম হল । আমি ম্যানেজার কে ও হোটেলের সমস্ত লোকজন কে প্রশ্ন করে জানতে পারলাম , সেদিন মারা যাবার আগে চা খেয়েছিলেন নবনীল ।
হোটেলের একটা ছেলে বলল , " লাউঞ্জের টেবিলে দেবাশীষ বাবুও ছিলেন চা খাবার সময় । তিনি আগে থেকেই বসে ছিলেন । হঠাৎ ঐ মারা যাওয়া স্যারের হাত কেঁপে চা প্যান্টে পড়ে যাওয়ায় , তারা চায়ের কাপ টেবিলে রেখে স্যার কে ধরে ফেলেন । তারপর বুকে ব্যাথা অনুভব ও বমি পেতে থাকায় তাকে রুমে পৌঁছে দিয়ে আসেন । ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসতে আসতে... । "
আমার কানে বাজল বুকে ব্যাথা সহ বমি । কিছু না বলে ডাক্তারের ঠিকানাটা সংগ্রহ করে সোজা বেরিয়ে পড়লাম হোটেলে ছেড়ে । ডাক্তার ভদ্রলোক কে পাওয়া গেল না । কলে বাইরে গিয়েছেন । আমার মনে হল নিশ্চই এমন কোন বিষ যা ঐ ধরণের সিম্পটম দেখায় । তবে কে দিলে ! সোনালী ? হতে পারে । কিন্তু কোথায় পেল ? কে যোগান দিলে ? আমি স্থানীয় থানায় এসে পৌঁছালাম । এখানে কথাবার্তা বলে উপকার হল । শোনা গেল এখানে এমন কিছু লোক আছেন যারা কেবল জড়ি বুটি বেঁচেন । চারিদিকে জঙ্গল হয়ে আছে নানা ঔষধি গাছ গাছড়ার । মনে মনে বললুম তারই স্ট্রং ডোজ দেওয়া হয়নি তো নবনীল কে ? সমস্ত জড়িবুটি বেঁচিয়েদের খুঁজলেও পাব না , যদি না সোনালী কিনে থাকে । মেয়ে মানুষ , মনে থাকতে ও পারে । তবু যতটা পারি চেষ্টা করতে নামলাম ।
#
এখন রাত আটটা । সামনের সোফায় ডিডেকটিভ ডিপার্টমেন্টের মিঃ ডিনজাগাপ্পা বসে। হোটেল ফিরে দুটো ভাইটাল ইনফরমেশন পাই । এক , রুম নম্বর আটত্রিশে ছিলেন ব্যান্ডেল থেকে আসা দেবাশীষ দাস । দুই , রুম নম্বর পঁচিশের কোনো কিছু তখনও পর্যন্ত সাফাই করা হয়নি । আমি থানার ও.সি কে ফোন করি । কিছু ক্ষণের মধ্যে সার্চে বেরিয়ে পড়ে একটা কাঁচের গ্লাস । হোটেল বয়ের থেকে জানা যায় নবনীল মারা যাবার আগে বার দুয়েক বমি করেন । যা ঐ গ্লাস দিয়ে সামলান সোনালী । বমির কন্টেন্ট ফেলে দিলেও তা ধুয়ে রাখবার কথা ভুলে গিয়েছিলেন সোনালী ।
পরের দিন গ্যাংটক ছেড়ে যখন বেরোচ্ছি , তখন হঠাৎ আমার ফোনে একটা কল এল । উঠাতেই চারুদার কন্ঠস্বর ভেসে এল , " আপনি তো মশাই হইচই ফেলে দিলেন দেখছি ! " আমি অপ্রস্তুতের মত বললাম , " সে কি , কি করলাম ! " " আজকের বাংলা কাগজ পড়েছেন ? " বলে উনি চাপা হেসে ফোন ছাড়লেন । একটা বাংলা খবর কাগজ কিনেছিলাম , কিন্তু খুলবার সময় পাইনি । বসে বসে খুলতেই নিউজটা চোখে পড়ল, হৃৎপিন্ড রুদ্ধ নয় হত্যা ... তারপর সংবাদ দাতা জানাচ্ছেন , সিকিম ও পশ্চিবঙ্গ পুলিশের যৌথ উদ্যোগে অবশেষে ব্যান্ডেলে ধরা পড়ল সোনালীর প্রেমিক দেবাশীষ দাস । সোনালী সরকার ও পুলিশের কাস্টডিতে ।
সাতদিন পরে জনশতাব্দীর থেকে টাটানগর স্টেশনে পা রাখলাম । বাঁচা গেল । দু পা এগোতেই হঠাৎ দেখি নবনীলের দাদা বৌদি দাঁড়িয়ে । ওর দাদার চোখে কোণে জলের আঁচড় । মুখে একটা কৃতজ্ঞতা মাখা হাসি ঝুলে আছে । নবনীলের বৌদি বা হাতে পিছনে লুকিয়ে রাখা ফুলের তোড়াটা এগিয়ে দিলেন । হঠাৎ একটা ফ্ল্যাশ আলোয় চমকে উঠে তাকাতে দেখতে পেলুম স্থানীয় এক পত্রিকার চেনা চিত্র সাংবাদিক কে । মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল , " থ্যাঙ্ক য়ূ । " কার উদ্দেশ্যে কে জানে !
Tags:
অণুগল্প