রাবেয়া রাহীম

অদিতি কথা

প্রথম পর্ব

বড় দুটি পাখা মেলে আকশযানটি যখন অ্যাটলান্টিক মহাসাগরের উপরে ভেসে থাকে, তাঁর পেটের ভেতরে বসে থাকা আমার শরীরে কেমন যেন একটা শির শিরে অনুভুতি অনুভব হয়। তবে সেই সাড়ে তিন ঘন্টা সময় আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টায় থাকি। সে যাইহোক বিমান ভীতি আমার সব সময়ের ছিল। তাই হয়ত ভীতি কাটানোর জন্যই নিজের দেশ ছেড়ে দশ হাজার মাইল দুরের ভিন একটি দেশে থিতু হতে হয়েছে। নিজ দেশের মাটির মায়া মাঝে মাঝে খুব বেশী কাছে টানে। তাই ছুটে যেতে হয় প্রিয় জন্মভুমিতে। সে কারনেই এই আকশযানে চড়া। তবে নিজ জন্মভুমির মাটির গন্ধ আলো বাতাস সব কিছুই অন্য রকম ভাল লাগায় মুগ্ধ করে রাখে সবসময়। যাত্রা পথের নানা ঝঞ্ঝাট সামাল দিয়ে বিমানটির চাকা যখন বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করে চোখে পানি চলে আসে। মনে হয় মায়ের কোলে ফিরে এলাম সারাদিনের খেলা শেষে। 

বেশ কয়েক মাস ধরে মাঝরাতে ঘুম ভাঙাটা এখন যেন রুটিন হয়ে গেছে। অস্বস্তি লাগে খুব। তারপরেও এই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আমাকে প্রায় প্রতিদিনই পড়তে হচ্ছে। ঘুম ভাঙ্গার পর পর বুঝতে পারি, এই ঘুম সহজে আসবেনা, তখনই বিছানা ছেড়ে উঠে আসি। 

তিন তলার উপর আমার এই ফ্ল্যাটের মোটা কাঁচের ঘেরা বারান্দায় দাঁড়ালেই মন ভালো হয়ে যায়। মাঝরাতে ম্যানহাটানের আলোকোজ্জ্বল বাতি গুলো অপূর্ব সুন্দর দ্যুতি ছড়িয়ে জল জল করে, কোথাও তেমন রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকার দেখা যায় না।

হ্যাঁ মন ভালো হয়। তারমানে মন খারাপ নিয়েই আমার ঘুম ভাঙ্গে। মন খারাপের নানাবিধ কারন। ঘুম ভাঙ্গার পর খুব চায়ের পিপাসা পায়। চায়ের তেষ্টা মেটাতে সোজা কিচেনে চলে যাই। আমার চা বানানো টাও অন্য রকম। হাড়িতে পানি গরম করে তার ভেতর চা পাতা দিয়ে ফুটিয়ে ছাকনি দিয়ে ছেকে নেওয়া তেমন করে আমি আবার চা পান করি না। চায়ের জন্য আমি খুব সহজ পন্থা বেছে নিয়েছি। ইলেকট্রিক কেটলিতে পানি ফুটে উঠার পর এক ধরনের বিশেষ ধরনের ছাকনি পাওয়া যায় যেটা কাচের কেটলির ভেতর থাকে (এটা সাধারনত চীন দেশের মানুষ কে আমি ব্যবিহার করতে দেখেছি। তাদের কাছ থেকেই শেখা), ছাকনিতে চা পাতা দিয়ে ফুটন্ত পানি ঢেলে দেই। চায়ের গাড় সতেজ লিকার বের হয়ে অসাধারন গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চায়ের তৃষ্ণা আরও পেয়ে বসে। রাতের নিস্তব্ধতায় ইলেক্ট্রিক কেটলিতে ফুটন্ত এই পানির গুড় গুড় শব্দটাও কেমন যেন অন্যরকম ভাল লাগে। 

এই এখন মাঝরাতে অর্ণব কে ফোন করতে খুব ইচ্ছে হয়। ওর ভরাট কণ্ঠটা আজো কানে বাজে। যে সম্পর্ক রাখতে চায় না, তাকে মাঝরাতে ফোন করা হাস্যকর ব্যাপার। তাই ইচ্ছেটাকে মনের ভেতর কবর দিয়ে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। 

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ভাবনার অতলে ডুবে যাই। ভাবি এই যে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো এরকম কি অর্ণবেরও হয়? তখন সে কি করে? আমার মতই চা বানায়? নাকি বই পড়ে? রাত জেগে বই পড়া তার খুব পছন্দের ছিল, এখনো কি আছে এই অভ্যাসটি? কি যেন, আছে হয়ত! অর্ণবের সাথে সম্পর্কের ব্যর্থতাগুলো খুব ভাবায়। আচমকা ভেসে উঠে অর্ণবের সহজ সরল মুখটা।

তাকে ভেবে মন খারাপ হয়, অনেক রাত নির্ঘুম কাটে। কিন্তু যখন বুঝতে পারি সেও নিজেকে একাকীত্বের শৃঙ্খলে বেঁধে নিয়েছে তখন সুক্ষ মমত্ব বোধ মনের গভিরে জেগে উঠে । মায়াটা বড় অদ্ভুত একটা জিনিস, চাইলেই কাটিয়ে ওঠা যায়না, এর রেশ ঠিকই থেকে যায়। যাই হোক আজকে এতো সব কথা কেন ভাবছি ? একবার একটা মানুষকে চিনলে তাকে তো ভুলে যাওয়া সম্ভব না ... হটাৎ বুকের ভেতর কেঁপে উঠে অর্ণব এর জন্য ...

ক্রমশ - 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

নবীনতর পূর্বতন