পৃথা ব্যানার্জী

অতিতের পাতা থেকে






আমি প্রতিদিনের মতোই আজও এগারো তলার ব্যালকনিতে বসে পড়েছি বড় চেয়ারটায় গা হেলিয়ে আরাম করে। উদ্দেশ্য সেই এক— অস্তগামী সূর্য্য। কেমন একটু একটু করে সে ডুবে যায়। পেছনে ছড়িয়ে দিয়ে যায় তার চিন্হ। কারও জন্যই সে অধীর নয়, কেউ না থাকলেও সে থামে না। জীবনের চলার উৎস টাকে খুঁজতেই আমিও রোজ এসে বসি। আমার পাশে একটা চেয়ার আছে, সন্দীপের চেয়ার। কতো বছর হল সন্দীপ আমাকে রেখে একলাই চলে গেছে। আগে সন্দীপ আর আমি দুজনে একসাথে বসতাম। আমাদের কথা, গল্প, শুনতে কখন যে চারপাশে ধীরে ধীরে অন্ধকার তার আঁচলটা ছড়িয়ে বসে পড়ত তা টেরও পেতাম না। এখন একলাই শুন্য চেয়ারটার সাথে গল্প করি আর অস্তমিত সূর্য্যকে দেখি। ভীড় করে আসা স্মৃতিগুলোকে মাঝে মাঝেই তাড়া দিই। ওরা শুধু কষ্ট নিয়ে আসে। না না ভুল বললাম, হাসি নিয়েও আসে কেউ কেউ। একবার বেশ মজা হয়েছিল একটা হার নিয়ে। এখনো মনে আছে— আমার হার হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা।

সেদিন কাজের মাঝে সারাদিনই খুঁজে চলেছি হারটা। মনেই করতে পারছিনা কোথায় খুলে রেখেছি। অফিস থেকে ফিরে সন্দীপ লক্ষ করেছে খোঁজাখুঁজি কিন্তু কিছুই বলেনি। রাতের খাওয়ার পর না বলে থাকতে পারলনা।

“কি ব্যাপার বলতো তখন থেকে কি যেন খুঁজে বেরাচ্ছ তুমি” সন্দীপ বেসিনে হাত ধুতে ধুতে জিজ্ঞেস করল। “খেতেও বসলে না, কি হারিয়েছো বলতো, টাকা”?

“না না তেমন কিছু না। তুমি একটু মাম্পির পড়াটা দেখে দাও ততক্ষনে আমি কাজগুলো সেরে আসি” বলেই আমি রান্নাঘরে ঢুকে গেলাম। ভেবে পাচ্ছি না হারটা গেল কোথায়। ভীষন বদ অভ্যাস চান করতে গিয়ে হারটা খুলে রাখা। রোজ ড্রেসিং টেবিলে রেখেই চান করতে যাই। সেই দুপুর থেকেই খুঁজে মরছি। যা-তা হার নয় হারের লকেটে একটা দারুন ছবি আছে। সন্দীপের গভীর চুম্বন দৃশ্য। দশ বর্ষীয় বিবাহ বার্ষিকীর এক অনুপম উপহার। প্রায় বছর পাঁচেক হয়ে গেল লকেটটা আমার গলায় দুলছে। সন্দেহ হচ্ছে কাজের মেয়েটার ওপর। কিন্তু ও তো স্বীকার করতেই চাইছেনা। কতো ভাবেইতো ওকে জিজ্ঞস করলাম, টাকার লোভ ও দেখালাম। কি আর করি আর একবার তন্ন তন্ন করে চারিদিক খুঁজে শুতে এলাম। সন্দীপ বুঝেছিল কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে। তাই বিছানায় বসতেই জিজ্ঞেস করল, “এখন বলতো কি হারিয়েছো, হয়তো আমি কিছু সাহায্য করতেও পারি”।

ওর কথায় কেঁদে ফেললাম আমি। সব কথা বেড়িয়ে এলো চোখের জলের সাথে। সব শুনে বলল, “নো ডাউট, ওই রুপোই নিয়েছে। দেখছি কাল কিছু বুদ্ধি করতেই হবে, এখন শুয়ে পড়ো”। 

পরদিন রুপো কাজে আসার একটু পরেই সন্দীপ রুপোর সাথে কথা বলে নিল একটু আড়াল করে। তারপর ওর পরিকল্পনা অনুযায়ী বিকেলে বেড়িয়ে পড়ল। রুপো বছর খানেক হল আমাদের বাড়ি কাজে ঢুকেছে ওর মাসির জায়গায়। হালকা চাপা রঙে বেশ ধারালো চোখ মুখ। প্রথম দিন থেকেই দেখেছি সন্দীপের দিকে একটু ঢলা। তা নিয়ে মাথা ঘামাইনি বরঞ্চ মজাই করেছি সন্দীপকে রাগিয়ে। ভালোবাসতাম মেয়েটাকে, তবে হারটা চুরি করে আমার মাথা গরম করে দিয়েছে। এদিকে সন্ধে ঘন হতেই আমার চিন্তা হতে লাগল, কেন এখনও ফিরছে না! যদি রুপো হার না নিয়ে থাকে। হয়তো আমি অন্য কোথাও ফেলেছি। এইরকম হাজার চিন্তা নিয়ে বার বার গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি।

প্রায় সাড়ে আটটা নাগাদ হাসি মুখে বীর পুরুষের আগমন। “এই নাও তোমার হার” আমার হাতে হারটা দিয়ে সোফায় বসল।

“সত্যিই তাহলে রুপোর কাজ” আমি দু হাতের মাঝে হারটা কে ধরে জিজ্ঞেস করলাম। “কি কায়দায় বার করলে হারটা”?

“সকালেই আমি ওকে বলেছিলাম বিকেলে দেখা করব, ও যেন ভাঙা মন্দিরটার পেছনে আসে। খুশিতে ডগমগ হয়ে যেই এসেছে সঙ্গে সঙ্গে স্কুটারে বসিয়ে দুজনে ডিনাই নালার মাঠে। বললাম, ‘তোর মতন সুন্দর মেয়ের নাম রুপো না হয়ে সোনা হওয়া উচিৎ ছিল। যেদিন তোকে প্রথম দেখেছি সেদিন থেকেই তুই রয়ে গেছিস আমার বুকের মাঝে। বলতে পারিনি কারন সমাজ বলতে দেয়নি। জয়া জানে হার তুই নিয়েছিস। তোকে পুলিসে ধরাতো। কিন্তু আমি মাঝখান থেকে সব জানতে পেরে আটকেছি। আমার প্রাণ থাকতে আমি কি দেখতে পারব তুই পুলিশের হাজতে। এখন হারটা দে, এর থেকে অনেক ভালো হার তোকে বানিয়ে দেব। তুই শুধু আমার হয়ে থাকবি’। এইটুকু বলতেই ও ভেসে গেল প্রেমের সাগরে। বলল হার ওর ঘরে আছে। ব্যাস, তরপর ওর ঘর থেকে হার নিয়ে চলে এলাম”।

“তা না হয় হল, কিন্তু ও যদি কথা উল্টপাল্টা করে তোমার বদনাম করে তাহলে--?

“কাঁচা কাজ আমি করিনি, সব কথা রেকর্ড আছে” ফোনটা দেখিয়ে বলল। তারপর একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “যা টাইট দেবার ওকে দিয়েছি। খুব সম্ভব ও হয়তো ওর বাড়ি ফিরে যাবে”।

সত্যিই তাই হল। রুপো আর কোনোদিন আসেনি।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

নবীনতর পূর্বতন