“অভি আজ দুদিন হয়ে গেল আমরা বাইরে, কিছু খেয়াল আছে কি”? বালির ওপর বসেই মিতা প্রশ্ন টা ছুঁড়ে দিল অভির দিকে।
-“কি হয়েছে তাতে? আমরা এখন মুক্ত বিহঙ্গ। ডানা মেলে দিয়েছি খোলা বাতাসের মাঝে। এই ছুটি তোমার আমার। আমরা মন প্রান ভরে শ্বাস নেবো মুক্ত বাতাসে। এই সাগরের ঢেউ-এর মতোনই আমাদের অনেক স্বপ্ন আছে যেগুলো মনের ভেতোর মাঝে মাঝেই উত্তাল হয়ে ওঠে। সবটা না হলেও কিছু তো পুরো করবই। কিছুটা আনন্দ ভরে নেবো আমাদের দু হাতের মাঝে”।
মিতা অবাক হয়ে কথাগুলো শুনছিল। অভি চুপ করতেই বলল, “না অভি, জীবন আমার শেষ। তোমার ভালোবাসা থেকে যেটুকু আনন্দ পাচ্ছি তা আমার বাড়তি ……….
অভির হাত মিতার বাকি কথাকে আর বাইরে আসতে দিল না। “এই ধরনের কথা আর বলবেনা, জীবনে কিছুই শেষ হয়না। আমরা শেষ থেকে শুরু করতে জানিনা তাই ভাবি শেষ হল”। দুহাত দিয়ে মিতাকে জড়িয়ে ওর মুখটা পূর্ণ চাঁদের দিকে তুলে বলল, “ওই দেখো, ওই চাঁদ শেষ হয়ে গিয়েছিল কিন্তু আবার নতুন করে নতুন রূপে শুরু করেছে চলার পথ। ওই চাঁদকে দেখে কি মনে হচ্ছে যে কিছুদিন আগে ও নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল”!
অভিজিত আর শুভমিতা সংসারের শাসনকে তুচ্ছ করে বেড়িয়ে পড়েছে নিজেদের স্বত্বাকে খুঁজতে। সংসারের দৈনন্দিনের বোঝা টেনে ওরা ক্লান্ত। কাল পুরীতে এসেছে। হৈ হুল্লোড় আনন্দের মাঝে সময়কে ওরা হারিয়ে ফেলেছে। বালির ওপরে বসে দুজনেই চুপ করে চাঁদকে দেখছে আর মিতা মিলিয়ে নিচ্ছে অভির কথা গুলো। দুটি নিস্তব্ধ মনের মাঝে বয়ে চলেছে ভালোলাগার এক সুক্ষ অনুভুতি।
-“মিতা, কি আশ্চর্য্য ভাবে আমাদের পরিচয়, তাই না! ভাবতেই পারিনি সেদিনের সামান্য পরিচয় আমাদের এইখানে এনে দাঁড় করাবে”। শুভমিতার হাতের ওপর আলতো ভাবে নিজের হাতটা রেখে দিল অভিজিৎ।
-“জানিনা, শুধু জানি তলিয়ে গিয়েছিলাম অন্ধকারের সমুদ্রে। আলোর সহস্র ধারা নিয়ে তুমি এসে দাঁড়ালে। তোমার হাত ধরে এসে উঠলাম আলোর তীরে। জীবন আমার ভরে উঠল আলোয়”।
-“শুধুই আমি ভরেছি, তুমি আমার জীবনটা আলোতে খুশিতে ভরিয়ে দাওনি”? জোছনা ধোয়া মিতার মুখের দিকে তাকিয়ে অভিজিতের প্রশ্ন।
-“হুমম— দুজনেই ভরেছি, না হলে আর এই বয়সে……….”
-“আবার তুমি বয়সের কথা বলছ, শরীরের বয়স বাড়ে বারুক কিন্তু মনের বয়সকে কখনোই বাড়তে দিওনা; মনের চাবিকাঠি তো আমাদের হাতে, আমরা আমাদের মনকে সবুজ রাখতে পারি নিজেদেরকে খুশি রেখে। কেন আমাদের কি বাঁচার অধিকার নেই? কারুর কোনো অসুবিধে তো আমরা করিনি। আমি আমার ছেলে মেয়ের কোনো দায়িত্বে তো অস্বীকার করিনি। ওদের সুখ সুবিধের পুরো খেয়াল রাখি। কিন্তু বলোতো আমার খেয়াল কে রাখে”?
#
“সে আর কি করা যাবে। এইভাবেই চলতে হবে শেষ দিন পর্যন্ত, এ তো বিধাতার বিধান”।
-“রাখো তোমার বিধান, নিজের সুখ শান্তি ইচ্ছে করে দুরে ঠেলে দিলে কোনো বিধাতাই খুশি হবেন না”।
-“কি জানি, তবে তোমার ধৈর্য্য খুব। সব দিক যেভাবে মানিয়ে নিয়ে চলছ”!
-“তুমি নিজে চলছো না? ঠিক ভাবে যদি স্বীকার করো তাহলে হয়তো আমার থেকে অনেক বেশিই সহ্য করছ। কি ঠিক বলছি তো? মুখ বুজে ছেলে বউ-এর সাথে চলছ নিজের অস্তিত্ব কে মিটিয়ে দিয়ে। একটু খুশি ও তো নিজের জন্য রাখোনি”।
-“আচ্ছা বলোতো এতো বুদ্ধি এইটুকু মাথায় কি করে রাখো”, কথা পাল্টাবার জন্য হাসতে হাসতে শুভমিতা অভিজিতের মাথাটা নাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এই জন্যই তো এতো ভালো লাগে তোমায়”।
-“শুধুই ভালোলাগা! এতোদিনেও ভালোবাসা হয়নি”? আক্ষেপের সুরে বলেই উঠে দাঁড়িয়ে বালি ঝাড়তে লাগল। “কি আর করা যাবে, এখন ওঠো হোটেলে ফিরি”।
-“আর একটু বসো না গো, কি সুন্দর এই পরিবেশ। উঠতেই ইচ্ছে করছে না”।
-“হুমম, একটু প্রেম প্রেম গন্ধ পাচ্ছি যে। হতেই হবে, যা দুর্দান্ত পরিবেশ”।
-“না, তাহলে আর বসে কাজ নেই” শুভমিতা উঠে পড়ল।
-“দেখলে তো কেমন কায়দা করে তোমায় উঠিয়ে দিলাম। চলো এখন জমিয়ে কিছু খাওয়া যাক”।
খাওয়া সেরে যখন রুমে আসল তখন দশটা। অভিজিৎ রুমে এসে নিউজ খুলে বসল। শুভমিতা টিভিটা বন্ধ করে বলল, “না ঘরে না, চল ব্যালকনিতে। অন্ধকারের মাঝে সমুদ্র দেখতে দারুন লাগে”।
-“কিন্তু ম্যাডাম অন্ধকার যে বড় ভয়ানক জিনিষ – যদি মনটা অবাধ্য হয়ে ওঠে”।
-“ সে যখন অবাধ্য হবে তখন দেখো না আমি কি করি, বাজে না বকে এখন ওঠো” ।
দুজনে এসে বসল। সামনে সমুদ্র। দামাল ঢেউগুলো মাথায় লক্ষ মানিক নিয়ে উঠে আসছে সমুদ্র থেকে আর পরক্ষনেই তা আবার ছড়িয়ে দিচ্ছে সমুদ্রের বুকে। “ঢেউ এর এই খেলা ছেড়ে টিভি দেখতে কি ভালো লাগে”! আপনমনেই মিতা বলে উঠল।
-“তুমি তো তন্ময় হয়ে সমুদ্র দেখছ”। খুব আস্তে অভিজিৎ বলল।
-“চাঁদের আলোয় সমুদ্রের এই মোহিনি রূপ ছেড়ে কি ওঠা যায়! তুমিও বসনা”।
-“রাত করে শুলে ভোরে উঠতে পারবো না আর তুমি তো জানো ভোর আমি হারাতে চাইনা”।“তবে অন্ধকারের মাঝে সমুদ্রের এও একটা রুপ। শান্ত স্নিগ্ধ রুপ”। “সত্যি করে ম্যাডাম বলতো, একলা ঘরে ভয় করছে কি-- আমি কি আসব রাতে পাহারা দিতে” ?
-“থাক তোমাকে অতো কষ্ট করতে হবেনা, শুধু চুপ করে বস এখন”।
“এই বসলাম”। খানিকটা সময় চুপ করে থেকে অভি চেয়ারটা ঘুড়িয়ে মিতার সামনে এনে বসে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা আমাদের পরিচয়টা ঠিক এই ঢেউ-এর মতো, তাই না। যখন উঠছে তখন অচেনা কিন্তু যখন বালিতে আছড়ে পড়ছে তখন মিলেমিশে একাকার। তোমার মনে আছে সেই প্রথম দিনটা”?
#
“ওই দিনটা আমি কোনোদিনই ভুলতে পারবো না। ভীষন কষ্ট নিয়ে উদ্দেশ্য হীন হয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়েছিলাম। কোথায় যাব কি করব কিছুই মাথায় ছিলনা। সামনে যে বাস পেয়েছি তাতেই উঠে পরেছিলাম। বিশেষ কিছু টাকা পয়সাও সঙ্গে ছিল না। পার্সটা নিয়েছিলাম কিন্তু দেখিনি কত আছে। হুঁশ ফিরল, যখন কন্ডাক্টর টিকিটের জন্য হাত বাড়াল। ভেবে পাচ্ছিলাম না কি বলব”।
-“হুমম, তুমি যখন উঠলে তখনই তোমার দিকে আমার চোখ আটকে গিয়েছিল। তোমার হাবভাব কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগছিল। আজ বলতে দ্বিধা নেই সেদিন আমি তোমায় প্রথমে পাগল ভেবেছিলাম। তারপর তুমি যখন আমার পাশেই বসলে তখন ভালো করে লক্ষ করলাম তোমায়। বুঝলাম পাগল নও। কোনো কারনে বিক্ষিপ্ত। তবে তোমার মতোন একজন বয়স্ক মহিলার এইরকম অস্থির মনোভাব আমার মনের সমস্ত সন্দেহের দরজাগুলোকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল”।
-“জানি, বুঝতে পেরেছিলে বলেই কনাট্ প্লেসের দুটো টিকিট চাইলে, আর আমাকে প্রায় জোর করেই নামালে।”
“তুমি তো নামতেই চাইছিলে না। খুব আস্তে করে তোমায় বুঝিয়েছিলাম, ‘আমায় বিশ্বাস করতে পারেন। এই বিদেশে একজন বাঙালি হয়ে আর একজন বাঙালি মহিলা কে এই অবস্থায় আমি ছাড়তে পারবোনা’।
-“তোমার মধ্যে এমন একটা দৃঢ়তা দেখেছিলাম যে না বলতে পারিনি। তাছাড়া তখন মাথায় রিয়ার কথাগুলো আগুনের মতোন জ্বলছিল। দুরন্ত এক আক্রোশে নিজেকে তছনছ করে ফেলতে ইচ্ছে করছিল”।
-“হমম, তোমায় দেখেই বুঝেছিলাম যে কিছু একটা ভয়ানক ব্যাথা তোলপাড় করে চলেছে তোমার ভেতরে। যে ব্যাথায় ঘা দিলে অজস্র রক্তপাত হবে। তাই সেদিন কিছুই জিজ্ঞেস করিনি তোমায়”।
-“তুমি তোমার অফিসের কাজ সেরে আমায় নিয়ে একটা রেষ্টোরেন্টে এসে বসলে। মনে আছে চীজ্ ডোসা খাইয়েছিলে। ক-তো কথা বলছিলে। মনেই হচ্ছিলনা যে তুমি একজন অচেনা”।
-“ঐ ভাবেই তো তোমার মনের অন্ধকার দুর করেছিলাম। তারপর তোমার বাড়ির ঠিকানা জেনে তোমায় ছেড়ে আমি ফিরে গিয়েছিলাম নিজের বাড়ি এক ভরাক্রান্ত মন নিয়ে”।
-“সেদিন তুমি না আসলে কি হতো জানিনা”।
-“মিতা, কতোদিন হলো আমাদের এই পরিচয়”?
-“কেন তোমার মনে নেই”?
-“মনে আছে, তবে নির্দিষ্ট তারিখটা ঠিক মনে করতে পারছিনা”।
-“১৫ই সেপ্টেমবর, আজ একবছর তিন মাস”।
-“তোমার সাথে আলাপ হবার পর থেকে আমিও যেন জীবনের নতুন মানে খুঁজে পেয়েছিলাম”।
-“আর তোমার সঙ্গ পেয়ে আমিও অন্ধকার কাটিয়ে আলোর দিকে মুখ ফিরিয়েছিলাম। প্রায় প্রতি রবিবার-ই তোমার ডাকে সাড়া দিয়ে বেড়িয়ে পড়তাম”।
-“আর আমিও তোমার সাথে সাথে ফুচকা খাওয়া শুরু করেছিলাম, যা আজও খেয়ে চলেছি” কথাটা শেষ করেই হো হো করে হেসে উঠল অভি।
-“তাইতো, আমরা কি সুন্দর একে অন্যের পছন্দ অপছন্দকে নিজেদের সাথে মিলিয়ে নিয়েছি। কিন্তু আর দেরি নয় এখন শুতে চল নাহলে তোমার ভোর কিন্তু কাল পালিয়ে যাবে” বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো শুভমিতা ।
-“হুম, রাত হয়েছে। পূরোনো দিনের কথাগুলো সুখ দুঃখ আনন্দে ভর্তি হয়ে আছে। ছাড়তে যে মন চায়না। তবে কথা দাও কাল তোমার সব কথা আমায় বলবে। আমি চাই তোমায় সব রোগ শোক থেকে মুক্ত করতে। সুস্থ জীবন নিয়ে তুমি বাঁচবে”। দুহাত দিয়ে মিতার মুখটা তুলে ফিসফিস করে বলল অভি, “তোমার সব দায়িত্ব আমার, জীবনের শেষ দিনটা পর্যন্ত আমি দরজা খুলে তোমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকব”।
-“কেন এতো ভালোবাসলে আমায়” অভির হাত দুটো জড়িয়ে মিতার আকুল প্রশ্ন।
-“তুমি যে আমার। জীবনের ভীড়ের মাঝে হারিয়ে গিয়েছিলে”। মিতার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে একটু হেসে অভি বলল, “দুটো ভুত কিন্তু আছে, সাবধান”।
-“থাকুক, গল্প করে রাত কাটাব”।
অভি হাসতে হাসতে নিজের ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গেই হারিয়ে গেল ঘুমের রাজ্যে।
#
ভোরেই ওরা চলে এসেছিল সূর্যোদয় দেখতে। অভি ক্রমাগতই ফটো তুলে চলেছে নানাভাবের নানাদিক থেকে। মিতা অবশ্য খানিকটা হাঁটার পর বসে পড়েছিল। ফটো তুলে যখন হাত ক্লান্ত আর মন তৃপ্ত তখন অভিও এসে বসে পড়ল মিতার পাশে।
-“পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর সৃষ্টি এই সমুদ্র। মানুষ চিরজীবন বসে দেখলেও ক্লান্ত হবেনা” অন্যমনস্ক ভাবে মিতা বলল ।
-“কাল সকালে ফিরছি আমরা। তাই আজ এই সমুদ্র ছেড়ে কোথাও যাব না। তোমার কি মত”?
-“অন্য মতের তো কোনো সম্ভবনাই নেই” হাসতে হাসতে মিতার উত্তর।
বিরাট গোল সোনার থালাটা এখন অল্প রঙ পরিবর্তন করেছে। তাই বালুকা বেলার জন অরন্যেও চঞ্চলতার লক্ষন। ধীর পায়ে সবাই যে যার হোটেলের দিকে। অভিজিৎ আর শুভমিতাও পায়ে পায়ে এগিয়ে চলল।
চা-এর কাপ নিয়ে দুজনে ব্যালকনিতে এসে বসল। সামনে নীল সমুদ্রের ঢেউ বিরাম হীন নিজের খেলায় মত্ত।
-“পুরী আমি বাবা মা-এর সাথে এসেছিলাম, তারপর আর আসা হয়নি। যেটুকু বেরিয়েছি তা পাহাড়ের দিকেই। রুমা পাহাড় ভালোবাসত।
-“কত বছর হল তোমার মিসেস মারা গেছেন”?
-“আট বছর হয়ে গেল, ছেলে মেয়ে তখন স্কুলে। তারও আগে প্রায় বছর তিনেক অসুস্থ থেকেছে। অফিস সংসার ছেলে মেয়ে সব সামলিয়েছি একলা। সংসার জীবন আমার সুখের নয়। মিতা, বড় ক্লান্ত আমি। একটু বিশ্রাম চাই তোমার ভালোবাসার ছায়াতে, দেবে তো একটু ছায়া”?
-“আমার সমস্ত ভালোবাসা তোমার জন্য অভি। তুমি নিজেকে একলা মনে করোনা কখনো”।
-“অসুস্থ হয়ে থাকার সময়টা রুমা আমায় ভীষন কষ্ট দিয়েছে। অতিরিক্ত সন্দেহপ্রবন হয়ে পড়েছিল। অফিস থেকে ফিরতে দেরি হলেই অশান্তি। ফোনে কারও সাথে কথা বলতে হলে ওর সামনেই বলতে হতো। না হলেই সন্দেহ, চিৎকার। বদ্ধ ধারনা হয়ে গিয়েছিল যে আমি কারও সাথে প্রেম করছি”।
-“মানুষের জীবনটা স্বর্গ অথবা নরক বানাতে পারে একমাত্র তার জীবন সাথী। ওইখানটা যদি বিগরে যায় তাহলে জীবন নরকের সমান হয়ে যায়, লক্ষ টাকা থাকলেও স্বর্গ বানানো যায়না। ছেলে মেয়েদের ওপর খুব কি একটা অধিকার থাকে? না, কারন তাদর নিজেদের সংসারে তারা ব্যাস্ত। বিশেষ করে ছেলে, বিয়ের আগে পর্যন্ত মা বাবা তার আদর্শ থাকে। বিয়ের পর ধিরে ধিরে জানতে পারে তার বাবা মা-এর মতোন এতো দোষ হয়তো আর কারও নেই”।
-“তুমি বিয়ের পরের কথা বলছ! আমার ছেলে ঋতম রুমা মারা যাবার পর থেকেই আমায় সহ্য করতে পারেনা। ওর বদ্ধ ধারনা আমি ইচ্ছে করলে আরও ভলো মতোন চিকিৎসা করাতে পারতাম”।
-“তুমি বোঝাও নি ওকে”?
-“লাভ হয়নি, মেয়েটাকেও ও আমার বিরুদ্ধে নিয়ে যাচ্ছে। রুমা নিজের ভেতরের বীষটা ওর শিশু মনে ঢুকিয়ে দিয়ে গিয়েছে”, অভিজিতের গলা ধরে এলো কথা গুলো শেষ করতে গিয়ে।
-“এতো ব্যাথা তোমার মনের মাঝে! এতো ব্যাথা কি করে তুমি চেপে রেখেছো হাসির আড়াল দিয়ে? আমার তো আঘাত সহ্য করার ক্ষমতাই নেই। কোনোদিন আমি এতটুকু আঘাত পাইনি। তাই কেউ কিছু বললে আমার ভীষন কান্না পায়, মন অস্থির হয়ে ওঠে”।
-“তাইতো তুমি অস্থির হয়ে বেড়িয়ে পড়েছিলে প্রচন্ড আক্রোশে নিজের জীবনটা কে শেষ করতে। কিন্তু একটাবারও ভাবলেনা তুমি চলে গেলে কারও কোনো অসুবিধে হবেনা বরঞ্চ তোমার ছেলে বৌ-এর সুবিধে। একজনের ঝামেলা কমে গেল আর বাড়তি পাওনা হল একটা ঘর। যেটাকে তোমার বৌমা সাজিয়ে গুছিয়ে বানিয়ে তুলবে কিটি পার্টির আসর”।
-“হয়তো তাই, জীবনের পাতায় যে অঙ্কটা আছে তা সবটা বুঝতে পারিনা। স্বপন আমায় বলত সবসময় ‘তুমি বইয়ের অঙ্ক যতোটা ভালো করতে পারো জীবনের অঙ্কে অতোটাই ডাল’। জানো তখন খুব রাগ হতো। আজ বুঝতে পারি আমার সম্বন্ধে তার কতোটা অনুভব ছিল”। আঁচলের কোনটা দিয়ে চোখটা মুছে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চলো এখন ওঠো, কতো বেলা হয়েছে খেয়াল আছে কি”?
-“আরে তাইতো খেয়ালই করিনি। আসলে জীবন খাতার পেছনের পাতাগুলো ওল্টাতে গেলেই মনটা ক্লান্ত হয়ে পড়ে দুঃখ কষ্টের বোঝা টানতে টানতে। তাই ওদের ওল্টাতে চাইনা”।
-“আজ বুঝলাম তুমি খুব স্বার্থপর”।
-“হঠাৎ এই কথা”!
-“এতো ব্যাথা কেন একলা বয়ে বেড়াচ্ছ? কেন আমায় বলে মন হাল্কা করনি? আমরা দুজন দুজনের সুখ দুঃখকে ভাগ করে নিয়েছি দুঃখকে জয় করব বলে তো”?
-“মানছি, ভুল করেছি”।
-“যাকগে, এর পর থেকে মনে রেখো তোমার মনের সব মুহর্ত গুলিও আমার। এখন শিগগির চলো”।
-“খেয়ে এসে শোবেনা কিন্তু, আমার ঘরে আসবে, আজ জমিয়ে আড্ডা হবে”।
“তারপরে তো ছুটি আমাদের ফুরোলো, নটেগাছটা মুরোলো”।
#
আজ দাদা-বৌদির হোটেলে খাওয়া তাই খেয়ে ফিরতে একটু দেরি হল। রাস্তায় মিষ্টি পান কিনে নিল মিতা।
-“এই এক পেট খেয়ে আমি কিন্তু বসতে পারবোনা, চললাম শুতে”।
-“মোটেই না, এখন গান শুনবো আর গল্প করব। বল কি শুনবে রবীন্দ্র না নজরুল”?
-“গীটারে রবীন্দ্র সঙ্গীত”।
-“বা! আমার মন ও ঠিক এইটাই চেয়েছে”।
সুরের মূর্ছনা আধো অন্ধকার ঘরের এক দেয়াল থেকে আর এক দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরতে লাগল। স্বপ্নময় পরিবেশের মাঝে দুজনেই কিছুক্ষনের জন্য ভাষা হারিয়ে চুপ হয়ে গেল।
-“মিতা, সব সুখ সবার ভগ্যে থাকেনা। কিন্তু তাই বলে সব ছেড়ে নিজেকে দুঃখের জালে আটকে রাখবে তা তো ঠিক না” নিরবতাকে ছিঁড়ে অভি বলে উঠল।
-“কি করি বল, রিয়ার কথাগুলো যে বুকের ভেতরে গিয়ে বিঁধে যায়”।
-“সেদিন কি এমন বলেছিল যে তুমি ওই ভাবে বেরিয়ে পরেছিলে”?
-“রিয়া বলেছিল আমার জন্যেই নাকি ওদের মাঝখানে ঝামেলা হয়। রিয়ার প্রশ্ন আমি বই পড়তে পারি, কম্পুটরে বসে থাকতে পারি, বেড়াতে পারি, সাজগোজ করতে পারি তাহলে রান্না, ঘরের কাজ কেন পারিনা। ক্রমাগত শুনতে শুনতে সেদিন কেমন যেন মাথার ভেতর আগুন জ্বলে উঠল। বেড়িয়ে পড়লাম নিজেকে শেষ করার জন্য”।
-“আর কখনো এমন ভুল করবেনা। মনে রেখো তুমি আমার। আমাকে একলা রেখে তুমি যেতে পারোনা”।
-“আমার যে জীবনের প্রতি কোনো টান নেই আর”।
-“আমি এতোদিন এটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। কোনো একটা কাজের মধ্যে তোমায় ঢোকাতে চাই। আপাতত একটা এন জি ওতে তোমার কথা বলে রেখেছি, তোমার বাড়ির কাছেই কালকাজির ‘এ’ ব্লকে। দিন চারেকের মধ্যেই ওরা জানাবে”।
-“মন্দ নয়, কিছু একটা কাজ পেলে ভালই হয়, শরীর আর মনটা সুস্থ থাকলেই বাঁচি”।
-“আমি তো চাই এইসব কোনো ঝামেলায় না গিয়ে তুমি ঘোমটা দিয়ে আমার ঘরে এসো। তুমি আমি দুজনেই সুখে থাকব”।
-“তুমি তো জানো সমাজ নামে এক ভয়ঙ্কর জীব আছে, তাকে নিয়ে আমাদের চলতে হবে। সে আমাদের খাওয়া পরা সুখ অসুখ কিছুই দেখেনা কিন্তু আমরা ভুল করলেই সে শাসনের লাঠি তুলে ছুটে আসবে”।
-“আমি সমাজ মানিনা। তবে তোমার সম্মানের হানি হয় এমন কিছু আমি করবনা। আমরা মাইল কিলোমিটারের দুরত্বে থাকব কিন্তু মনটা থাকবে পাশাপাশি”।
-“তোমার ছেলে তো চাকরি করছে বিয়ে দিয়ে দাও। ঘরে বৌ আসবে সকলের সুবিধে হবে”।
-“ছেলে আমার সাথে থাকবেনা, চাকরি করার পর থেকে আমার টাকা নেয়না। চেষ্টা করে বোনের খরচাটাও চালাতে। কথা বলতে গেলে অসন্তুষ্ট হয় তাই বলি না। কোনো অন্যায় না করেই নিজের ছেলেমেয়ের থেকে দুরে চলে গেলাম” নিজের ভেতরের দুঃখকে চাপতে অভি এসে দাঁড়িয়ে পড়ল জানলার পর্দাটা সরিয়ে।
- “মন খারাপ করো না, তোমার সততা একদিন তোমার ছেলেমেয়েকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দেবেই” মিতা উঠে এসে অভিকে জড়িয়ে বুকে মাথা রেখে কান্না ভেজা গলায় বলে উঠল। “এই একরাশ ব্যাথা নিয়ে তোমায় যে একলা কি করে ছারবো---! সারাদিন তো কাজের মাঝে কেটে যাবে কিন্তু বাড়ি ফিরে তো তুমি একলা হয়ে যাবে। তখন এই সব কথা নিয়ে চিন্তা করে শরীর খারাপ করবে”।
-“তাইতো তোমায় পাশে চাইছি মিতা”।
-“আছি আমি, শেষ দিন পর্যন্ত আছি। মরনকেও ফিরিয়ে দেব অভি। যেদিন বুঝবো আমাকে তোমার একান্ত দরকার সেদিন সব বাধা ঠেলে চলে আসব। আমি থাকতে কোনো কষ্ট তোমায় ছুঁতে পা র---বে--না”, অভিকে জড়িয়ে ছেলেমানুষের মতোন কেঁদে ফেলল মিতা। অভির চোখ ও শুকনো ছিলনা। অভি কিছু না বলে শুধুই আদরে ও চুমুতে মিতাকে ভরিয়ে তুলল। কিছুক্ষন দুজনেই মুখের কথা হারিয়ে চুপ করে একে অন্যের হৃদয়ের স্পন্দন শুনেই সময় কে পেছনে ফেলল।
একসময় অভি বলল, “মিতা ওঠো, চল আজ শেষ সূর্যাস্ত দেখবো। কাল তো চলে যাবো ভোরে”।
দুজনে যখন বালির ওপর এসে দাঁড়ালো তখন অস্ত সূর্যের রাঙা আলো রঙ ছড়িয়ছে চারিদিকে। অভি, মিতার শাড়ির আঁচলটা তুলে খুব আস্তে করে ওর মাথায় ঘোমটা টেনে দিল। মিতার অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, “কিছুনা শুধু বেঁধে দিলাম আঁচলের ডোরে। অস্ত সূর্যের সিঁদুর তো ভগবান ছড়িয়ে দিয়েছেন তোমার মাথায়”।
দুজনে হাত জোড় করে প্রণাম জানালো মহা সমুদ্রকে। সমুদ্র শুভ শঙ্খ ধ্বনি বাজিয়ে দিল তার গর্জনের ভেতর দিয়ে। লক্ষ হাতের তালি বেজে উঠল তীরে আছড়ে পড়া ঢেউ-এর সাথে।
Tags:
গল্প