অনন্যা ব্যানার্জি

অনন্যা ব্যানার্জি

আমরা আবারও হাজির শব্দের মিছিলের নতুন সংকলন নিয়ে । শুরুতেই শব্দের মিছিলের অজস্র পাঠক পাঠিকা, কবি ,লেখকদের জানাই গানঘরের পক্ষ থেকে নতুন বছরের অজস্র শুভকামনা । নতুন বছরের সকলের ভালো কাটুক এই কামনা করেই শুরু করি এবারের গানঘর । 

গত সংখ্যায় গানঘরের আলোচনায় উঠে এসেছিলো বাউলগান। বীরভূমের পৌষমেলার রেশ রেখে আমরা হারিয়ে ছিলাম লাল মাটির পথে । এই সংখ্যায় আমরা তারই রসাস্বাদনে পায়ে পায়ে পৌঁছে গেছি বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার আখড়ায় । হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন এবারের সংখ্যায় আমরা রসাস্বাদন করব লালন গীতির । কিন্তু তার আগে মহাত্মা লালনকে দু চার কথা আলোচনায় রাখি । ফকির লালন শাহ ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি একাধারে একজন আধ্যাত্মিক বাউল সাধক, মানবতাবাদী,সমাজ সংস্কারক এবং দার্শনিক। তিনি অসংখ্য গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক ছিলেন । তাঁকে বাউলগানের অগ্রদূতদের অন্যতম একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয় । তাঁকে বাউল সম্রাট হিসাবেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে । লালন ছিলেন একজন মানবতাবাদী। যিনি ধর্ম , বর্ণ ,গোত্রসহ সকল প্রকার জাতিগত বিভেদ থেকে সরে এসে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন,অসাম্প্রদায়িক এই মনোভাব থেকেই তিনি তার গান রচনা করেছেন। লালনের জীবন সম্পর্কে বিশদ কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না । তাঁর মৃত্যুর পনেরো দিন পর কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত হিতকরী পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়- ইহার জীবনী লিখিবার কোন উপকরণ পাওয়া কঠিন। নিজে কিছু বলিতেন না।শিষ্যরা তাহার নিষেধক্রমে বা অজ্ঞাতবশতঃ কিছুই বলিতে পারেনা ।" লালনের জন্ম কোথায় তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে । কিছু সূত্রে পাওয়া যায় লালন ১৭৭৪ খ্রীষ্টাব্দে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার অধুনা বাংলাদেশের যোর জেলার ফুলবাড়ী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । হিতকরী পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ নিবন্ধে বলা হয়েছে যে লালন তরুণ বয়সে একবার তীর্থভ্রমণে বের হয়ে পথিমধ্যে গুটিবসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। তখন তাঁর সাথীরা তাঁকে মৃত ভেবে পরিত্যাগ করে চলে যায় গন্তব্যে। কালিগঙ্গা নদীতে ভেসে আসা মুমূর্ষ লালনকে উদ্ধার করেন মলম শাহ। মলম শাহ ও তাঁর স্ত্রী মতিজান লালনকে সেবা শুশ্রষা করে সুস্থ করে তোলেন। ছেউড়িয়াতে তিনি দার্শনিক গায়ক সিরাজ সাঁইয়ের সাক্ষাতে আসেন এবং তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হন। লালনের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে গবেষকদের মাঝে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। যা তার জীবদ্দশায় ও বিদ্যমান ছিল। 

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় লালনের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিলনা।নিজ সাধনাবলে তিনি হিন্দু ধর্ম ও ইসলাম ধর্মউভয় শাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করেন । তাঁর রচিত গানে এর পরিচয় পাওয়া যায় । প্রবাসী পত্রিকার নিবন্ধে বলা হয়,লালনের সকল ধর্মের লোকের সাথেই সুসম্পর্ক ছিল । অনেকে তাকে মুসলমান বলে মনে করতেন । আবার বৈষ্ণব ধর্মের আলোচনা করতে দেখে হিন্দুরা তাঁকে বৈষ্ণব মনে করতেন । প্রকৃতপক্ষে লালন ছিলেন মানবতাবাদী এবং তিনি ধর্ম, জাত, কূল ,বর্ণ , লিঙ্গ ইত্যাদি অনুসারে মানুষের ভেদাভেদে বিশ্বাস করতেন না । লালন কুষ্টিয়ার কুমারখালি উপজেলার ছেউড়িয়াতে একটি আখড়া তৈরী করেন। সেখানে তিনি তার শিষ্যদের নীতি ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিতেন । ১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর লালন শাহ ১১৬ বছর বয়সে কুষ্টিয়ার কুমারখালির ছেউড়িয়াতে নিজের আখড়ায় মৃত্যুবরণ করেন । মৃত্যুর প্রায় একমাস পূর্ব থেকে তিনি পেটের সমস্যা ও হাতে পায়ের গ্রন্থির সমস্যায় ভুগছিলেন । মৃত্যুর দিন ভোর পাঁচটা পর্যন্ত তিনি গানবাজনা করেন এবং এক সময় তাঁর শিষ্যদের বলেন "আমি চলিলাম" । এর কিছু পরেই তাঁর মৃত্যু হয় । 

তাঁর নির্দেশ না থাকায় তাঁর মৃত্যুর পর হিন্দু বা মুসলমান কোনো ধর্মের রীতিই পালন করা হয় নি । তাঁরই উপদেশ অনুসারে ছেউড়িয়ায় তাঁর আখড়ার একটি ঘরে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় । শেষ হয় একটি অধ্যায়ের । তিনি তাঁর গানের মধ্যে দিয়ে যে মানব ধর্মের সাধনার বীজবপন করে গেছেন তা বহুদূর বিস্তৃত । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ,কাজী নজরুল প্রভৃতি বিখ্যাত কবিদের লেখাতেও লালন সাঁইয়ের প্রভাব দেখতে পাই । শেষে এসে আমরা লালন সুরে সুর মিলিয়ে গাই - " এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে / যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রীষ্টান জাতি গোত্র নাহি রবে।" দেখা হবে আবার আগামী সংখ্যায় ।



কে তোমার আর যাবে সাথে ...   



পাবে সামান্যে কি তার ...  


এ বড় আজব কুদরতি ...  


এবার মজা বুঝবি রে ক্ষ্যাপা ...  


কে তাহারে চিনতে পারে ...  


আমার হয় না রে সে ...  


সময় গেলে সাধন হবে না ...  


সমুদ্রের কুলেতে বসে ...  


সহজ মানুষ ...  






একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

নবীনতর পূর্বতন