অন্তর্লীনা দত্ত

বোঝার সঙ্গে বোঝাপড়া

লোকে বলে, ছোটদের নাকি স্কুলে যেতে ভালো লাগেনা ! কই, আমার তো তেমন কিছু মনে হয় না। আমি তো দেখি, শীতের, গ্রীস্মের, বর্ষার সকল কেজো দিনগুলোতেই শিশুরা দিব্যি হেঁটে, টোটো, অটো, স্কুটার, পুলকার- চেপে নানান আলোচনা করতে করতে স্কুলে যাচ্ছে। সময়টা সে সকাল ছ’টাই হোক বা আটটা অথবা বেলা দশটা। আর, আলোচনার বিষয়বস্তুও বেশ লাগসই। শাহরুখ-দেবের ডায়লগ থেকে শুরু করে অরিজিৎ সিং-এর গান, ডোরেমন, পোক্কেমন, ছোটভীম থেকে ভীমাকৃতি স্যার। ভালো ম্যাম, মন্দ অঙ্ক, পচা ইতিহাস, শক্ত ভূগোল; ‘ব্যাকডেটেড’ বাংলা আর ‘আপডেটেড’ ইংরাজী। ভালো ক্লাস, মন্দ স্যার – সহজ আঁকা এই সব কিছুই। আবৃত্তি করা, গান গাওয়া – এই সবের অনুশীলন ক্ষেত্রও যেন ঐ চলার পথটুকু। ওদের চলনে-বলনে-কথার ধরণে আমি অন্ততঃ কোথাও ‘চাপ’ বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারি না।

এই যে ‘চাপ’, এই যে ‘সিলেবাসের বোঝা’ তবে এই সবকিছুই কি মনগড়া? নিছকই অমূলক ভাবনা ! একান্তই তাত্ত্বিক না তথ্যভিত্তিক বাস্তব? এই চিন্তাটা তো প্রকৃত অর্থে বাচ্চাদের নয়; এটা বড়োদের ভাবনা। বাচ্চাকে ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠিত করার ভাবনা থেকে উঠে আসা দুশ্চিন্তা। তাই আজ থেকেই তাকে লড়াই করতে শিখতে হবে। পরীক্ষার নম্বর অনুযায়ী-ই তো তার ভবিষ্যতের ‘দাম’ ঠিক হবে। অন্ততঃ, তেমনটা ধারণা। আর এই ‘বদ্ধমূল’ ধারণার মূলে জলসেচন করে তাকে আজ থেকেই প্রতিযোগী করে তোলার এক চেষ্টা। সত্যিই তো, আজ থেকেই যদি সে প্রতিযোগী হতে না পারে, তবে জীবনযুদ্ধের প্রতিযোগীতায় সে টিকবে কি করে? আর নিছক টিকতেই যদি না পারে তবে সে বাঁচবে কি করে? মাঝে-মধ্যে ভয় হয়, এই টেকা-বাঁচা-প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির সম্মিলিত ‘গুঁতোয়’ বাচ্চাগুলো যেন ভবিষ্যতে একে-অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে না ওঠে; যাদের সহযোগী হবার কথা ছিল, তারা যেন অন্ততঃ প্রতিযোগী হয়ে থাকতে পারে। (অবশ্য, এই ভয়টা একান্তই আমার, অমূলকও হতে পারে)।

যাই হোক, আমার এইসব ‘বিষময় চিন্তাভাবনা’, তাদের অভিভাবকদের তথাকথিত সৎচেষ্টা বা অপচেষ্টা – এই কোনোকিছুরই প্রভাব তাদের স্কুলের দিনগুলোয় অন্ততঃ পড়ে না, পথের সময়টুকুতে তো নয়-ই। আনন্দ লুটেপুটে নেবার দিন-ক্ষণ বোধহয় ওই মুহূর্তগুলোই।

এই হুল্লোড়ের বিপরীত চিত্র দেখা যায়, দুপুরে বা সন্ধ্যায় পড়তে বসার সময়। ভোরে যদিও বা তাকে ঘুম থেকে তুলে স্কুলে পাঠানো গেল, সন্ধ্যায় বা ভরদুপুরে তার ঘুম যেন তাড়ানোই যায় না। এমনিতেই, পড়া ও ঘুম একে-অপরের সহোদর। এ চিরদিনের ঐতিহ্য। চিরকালের, চিরন্তন এই সম্পর্ক ভাঙার প্রয়াসটাও না বাবার মজ্জাগত, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। আচ্ছা, এমন নয়তো এই ঐতিহ্যের পুনরাবৃত্তি দেখেই আমাদের মনে হয়, ‘শিক্ষা’ বুঝি এক বোঝা।

আমি খুব সচেতনভাবেই এখানে ‘শিক্ষা’ কথাটা ব্যবহার করলাম। চিরায়ত ধারণায়, একশ্রেণী থেকে অন্যশ্রেণীতে বসা, উন্নতর থেকে উচ্চতর ডিগ্রী লাভই তো শিক্ষার প্রামাণ্য মাপকাঠি। ব্যবহারিক জীবনে এই ডিগ্রী’-র গুরুত্ব অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু, এই ডিগ্রীলাভের পদ্ধতি সম্বন্ধে ভাবনা-চিন্তা করার প্রয়োজনীয়তা নিশ্চয় আছে।

‘তোমার খাবার তুমি খাবে – বন্ধুকে বিস্কুট ভাগ দেবে না। মাত্র পাঁচটা বিস্কুট দিয়েছি, বাড়িতে যেন ফিরে না আসে – আচ্ছা, একবার গুনে দেখে নাও-তো ঠিক পাঁচটা বিস্কুটই দিয়েছি তো?’ – ‘বাধ্য শিশু’ আরও বেশি বাধ্য হয়ে গুনে নিল টিফিন বক্সে থাকা বিস্কুটগুলো। গুনে দেখল পাঁচটা নয়, বিস্কুটের সংখ্যা ছয়টা। ‘মা বাক্সে তো ছ’টা বিস্কুট’ – মায়ের সস্নেহ চুমু শিশুর গালে। তাঁর ‘ভেরি গুড শিশু’ দারুণ গুনতে শিখেছে। নিছক ‘সিলি মিস্‌টেক’ করে না এলে এবারের পরীক্ষায় অঙ্কে গতবারের চেয়ে বেশী নম্বর নিশ্চয় পাবে।

শিশু শিক্ষা পেল। কোনো কিছু ভাগ করে না নেবার শিক্ষা। শিশু শিখে গেছে সঠিক গুনতে। কজেই কয়েক বছর পরে ‘লাভ-ক্ষতির’ হিসেবটা সে সহজেই শিখবে। কিন্তু ‘স্বশিক্ষিত’ হবে কিনা তা নিয়ে একটা প্রশ্ন কিন্তু সচেতন মনে থেকেই যায়।

একটা কথা ঠিকই মা এখানে শিশুকে শিক্ষা দিতে বিস্কুটের T.L.M (Teaching Learning Material বা শিক্ষা সহায়ক প্রদীপন) ব্যবহার করেছেন। যার ফলে, শিশুর শেখা অনেকাংশেই নির্ভুল হয়েছে। নির্ভুল শিক্ষা তাকে আনন্দও দিয়েছে। কিন্তু এই T.L.M ব্যবহার বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে করা হল না – অন্ততঃ আমার মতে। তাহলে, হয়তো শিশুটি সু’শিক্ষিত এক মানুষ হতে পারত।

এবার একটা অন্য উদাহরণ দিই। এক মা তার বাচ্চাকে আপেল এনে বলেন, ‘অ্যাপেল (Apple)’, গোলাপ ফুল এনে বলেন, ‘রোজ’। এখানে, মা যে প্রদীপনগুলো ব্যবহার করছেন, তাতে শিশুর শিক্ষণ পদ্ধতি শুধু সহজই হচ্ছে না, উপরন্ত, তার সাথে প্রকৃতির একটা তাৎক্ষণিক সহযোগ গড়ে উঠছে। প্রকৃতঅর্থেই, তার শিক্ষা হয়ে উঠছে ‘Joyful’ – আনন্দজনক।

এই ‘Joyful learning’ –এর আরও ব্যাপ্তি ঘটে যখন তার শিক্ষা হয়, একেবারে সমাজ পরিবেশে, ব্যবহারিক জগতের মাঝে। ধরা যাক একজন শিশু তার পরিবারের কারোর সঙ্গে আইসক্রিম খেতে গেছে। তার মা যদি তার সাথে আরও দু’টি পথশিশুকে আইসক্রিম কিনে দেন; তাহলে তিনি তাকে একই সঙ্গে যোগ, বিয়োগ এবং এক উন্নততর মন গড়ে তোলার শিক্ষা দিতে পারবেন। আর এই ‘Joyful learning’ শেষ অব্দি সবকিছু ‘ভাগ’ করে নেবার যে শিক্ষাটা শিশুকে দেবে, তা শিশুটিকে ভবিষ্যতে প্রকৃত শিক্ষিত হবার এবং যথার্থ আনন্দ লাভেরই পথ তৈরি করে দেবে। বাস্তব পৃথিবীর কঠিন প্রতিযোগিতায় সে সহযোগী হয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে অনায়াসে।

কাজেই, গলদটা বোধহয় শিক্ষাপ্রদানের পদ্ধতিতে; - আমাদের ‘সিলেবাসে’ নয়। শিক্ষাকে ঘরে বাইরে আনন্দজনক করে তুলতে চাইলে, আগের মতো শিক্ষকের হাতে ‘ছিপটি’ থাকলে আর চলবে না। এরা পোক্কেমন প্রজন্ম। এদের অনায়াস আব্দার ‘আজকের পড়াটা শেষ হয়ে গেলেই, মা, তুমি কিন্তু নেট টা রিচার্জ করে দেবে – গেম খেলব’। যারা জন্ম থেকেই মোবাইলে ‘অ্যাংরি বার্ড’, ‘কার রেসিং’, ‘গান শুটিং’ –এর মতো খেলায় অভ্যস্ত তারা শিক্ষক-অভিভাবকের মাত্রাহীন চোখ-রাঙ্গানিতে রেগে যেতেই পারে। কাজেই এই ‘টেকনোলজি’ প্রজন্মকে ‘ট্যাক্টফুলি’ (Tactfully) ম্যানেজ করাটাই বোধহয় বুদ্ধিমানের কাজ। এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কও হয়ে উঠবে সহজ আর শিক্ষণও হয়ে উঠবে আনন্দদায়ক।

শিক্ষাকে আনন্দদায়ক (Joyful) করতে আমরা যতই তাত্ত্বিক ভাবনা চিন্তা করি, যতই আধুনিক কৌশল ব্যবহার করি; - শিক্ষার আসল ভিত্তি কিন্তু একটাই। শিক্ষা প্রদানের মূল কায়দাই হল – শিশুর মনকে বোঝা, তার চাহিদাকে গুরুত্ব দেওয়া। এক্ষেত্রে, প্রয়োজনে শিশুকে অনৈতিক-অবাঞ্ছিত বা অনভিপ্রেত চাহিদাকে সংশোধিত করে তাকে যথাযথ মূল্যবোধের শিক্ষ দেওয়া। যেমন – কুকুরকে সে খাবার দিতে চাইলে আমরা তাকে উৎসাহ দেব। আর, এর মধ্যে দিয়েই তাকে ‘মানুষ’ করে তোলার বাসনা পূরণের দিকে আমরা এক ধাপ এগোব। অন্যদিকে, কুকুরটিকে যদি সে আঘাত করতে চায়? নিশ্চয় আমরা তাকে নিরস্ত্র করব। এক্ষেত্রে আমাদের অসহযোগিতাই (শিশুর সঙ্গে) তাকে ভবিষ্যতে ‘ভালো মানুষ’ করে তুলবে।

তবে শিশুর স্বাভাবিক চাহিদাগুলো যদি পূর্নতা না পায়, তাহলে তার মধ্যে অনেককিছু হবার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সে একজন ‘খুব সাধারণ মানুষ’ হয়েই থেকে যেতে পারে।

আমার ছেলেবালায় এক বন্ধু ছিল। দিনে সে দশ – বারো ঘন্টা পড়ত। আমার অন্য বন্ধুরাও পর্বত, তবে তারা নাইন টেনে। তারা প্রথম হত। আর, এই বিশেষ বন্ধুটি ক্লাস ফাইভ-সিক্স থেকেই এতটা পড়ত। তবুও মাধ্যমিকে টেনেটুনে দ্বিতীয় বিভাগ। কেন? কারণ তার জীবনে পড়া ছিল একটা বাধ্যতা। তার জীবনের নিয়মই ছিল – এতটা পড়া না হলে, সে খেলতে যেতে পারবে না। অথচ, তাকে যদি তার চাহিদা অনুযায়ী সহযোগিতা করা যেত; তবে সেও আজ প্রতিষ্ঠিত হতে পারত, - সব বাবা-মা-ই যেটা চান।

আমার মতে তাই, Joyful learning বিষয়টি শিক্ষাদানের নতুন পরিভাষা তথা প্রক্রিয়া হলেও বিষয়টি কিন্তু চিরদিনের। বলা ভাল, শিক্ষাদানের গোড়ার কথা – শিক্ষাপদ্ধতির মূল ভিত। শিশুরা নাচে, গানে, বাজনায়, কবিতা বলায়, গল্প শোনায়, খেলা করায় ঠিক যতটা আনন্দ খুঁজে পায়; ঠিক ততটাই আনন্দ যদি তারা আমাদের দেওয়া শিক্ষার মধ্যে খুঁজে নিতে পারে, - তাহলেই সে বইয়ের সঙ্গে নিজের থেকেই থাকতে চাইবে। এরজন্য প্রয়োজন তার মনকে বোঝা, তার চাহিদাকে অনুভব করা, চাহিদা অনুযায়ী কিছু ভালোলাগার বই তাকে কিনে দেওয়া, সেগুলো পড়তে তাকে আগ্রহী করে তোলা। আর এই সব কিছুর জন্য প্রয়োজন আমাদের মনে বড়দের অপরিসীম ধৈর্য্য। এইভাবেই গড়ে উঠবে, শিক্ষার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত ভাব – ভালোবাসা, এক আন্তরিক বোঝাপড়া।

এই পন্থাতেই চরিতার্থ হবে, আমাদের বাসনাও। শিশুকে একজন মূল্যবোধ সম্পন্ন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিতে পরিণত করার কামনা। কেননা, সব ভালো বই-ই শেষ অব্দি আমদের মানুষ হয়ে উঠার শিক্ষা দেয়। মূল্যবোধের শিক্ষা দেয়। এক্ষেত্রে শুধু খেয়াল রাখার – শিক্ষণ পদ্ধতিটি যেন মূল্যবোধ গড়ে তোলার অনুকূল হয়। তবেই তো, শিশু ভবিষ্যতে একজন যথাযোগ্য ‘মানুষ’ হবে। শিক্ষার ও মানুষ তৈরির কারিগরদের এটাই মুখ্য উদ্দেশ্য – তাই না?





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

নবীনতর পূর্বতন