এ গল্প দ্বৈপায়ন চৌধুরীর। সেই দ্বৈপায়ন চৌধুরী যিনি সাহিত্য-আকাশে নক্ষত্র ছিলেন এবং একদিন হঠাৎ করেই খসে গেলেন; কেউ কিছু জানতেও পারল না। এটা অবশ্য ঠিক উল্কা খসার মত খসে যাওয়া নয়। স্বেচ্ছা নির্বাসন। ভিতরকার অভিমান তাঁকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
জ্বলন্ত উল্কা যেমন পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ে গভীর গহ্বর সৃষ্টি করে তেমনই দ্বৈপায়ন নামক উল্কাটির অকস্মাৎ অপসারণের ধাক্কা বিনায়কের হৃদয়ে যে ক্ষতর সৃষ্টি করেছিল তার গভীরতা কিছু কম ছিল না।
“আমায় ক্ষমা কোরো; আমি কাপুরুষ নই। পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে আমি চাইনি। শুধু একটু সম্মান চেয়েছিলাম।” ---- দ্বৈপায়ন চৌধুরীর শেষ উপন্যাসের শেষ লাইন ক’টা ছিল এরকমই। কলকাতার কোন এক অনামী বস্তির নোংরা স্যাঁৎসেঁতে এঁদো খুপরি থেকে যখন পান্ডুলিপিটা উদ্ধার হল দ্বৈপায়ন তখন মৃত।
বিনায়ক সে দিন খুব কেঁদেছিলেন। অভিমান বিনায়কেরও ছিল। আর গত বিশ বছর তাঁর সঙ্গী ছিল একটিমাত্র প্রশ্ন ---- ‘কি দোষ ছিল আমার ?’
উত্তর গত বিশ বছরে পাননি; আজও পেলেন না। উত্তর যে দেবে সে চলে গেল। চোখের সামনে দিয়ে। কোন উত্তর না দিয়ে।
বিনায়ক তাঁকে ধরে রাখতে চাননি। উত্তর চেয়েছিলেন ---- কি দোষ ছিল আমার . . .
বিশ বছরে বিনায়ক বর্মণের প্রকাশিত কবিতা সংকলনের সংখ্যা পাঁচ। এই পাঁচটি সংকোলন থেকে সেরা কবিতাগুলি বাছাই করে আবার একটি বৃহত্তর সংকলন প্রকাশ করার ইচ্ছা আছে আগামী পূজোতে। বাছাইয়ের কাজ শুরুও করেছেন। কিন্তু এসব কিছুর থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে যে কাজটি করেছেন তা হল সন্ধান। একটা জলজ্যান্ত মানুষ হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেল !
সেদিনের সে কথাটা যে বলেছিল বিনায়ক চেয়েও তাকে কোন শাস্তি দিতে পারেননি। সে ছিল কোন এক সংবাদপত্রের সাংবাদিক। ---- ‘বিনায়কবাবুর মত বিশিষ্ট কবির হাত আপনার কাঁধে থাকার জন্যেই কি আপনি লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পেয়েছেন ?’
দ্বৈপায়নের সেদিনকার মুখটা আজও বিনায়কের চোখের সামনে সজাগ হয়ে আছে। সদাজাগ্রত সে ফ্যাকাসে মুখটা বিনায়ককে আজও চোখ বন্ধ করতে দেয় না।
অনুষ্ঠানটা দ্বৈপায়ন সেদিন করতে চাননি। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দিশেহারা’-র আনুষ্ঠানিক প্রকাশ, প্রকাশকমশাই আগেই করেছিলেন। তবু বিনায়কের একান্ত অনুরোধ ছিল একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠান ঘরোয়া বন্ধুদের নিয়ে। আর কিছু সাংবাদিক।
বিনায়কের উচ্চতায় তখনও পৌছাননি দ্বৈপায়ন। পত্র-পত্রিকায় ছোটগল্প লেখেন। পূজো-সংখ্যাগুলোয় একটা করে উপন্যাস। কানাঘুষো আছে প্রথম দিককার পত্রিকাগুলো নাকি বিনায়ক বর্মণের কথা ফেলতে পারেনি বলেই দ্বৈপায়ন চৌধুরীর লেখাগুলো ছাপত। পিছনে বিনায়ক বর্মণ না থাকলে দ্বৈপায়নের কোন অস্তিত্বই থাকত না।
পরে অবশ্য দ্বৈপায়নের লেখা যে পাঠকের মন কেড়েছিল তা অস্বীকার করা যায় না।
সেদিন দ্বৈপায়নের রূপ দেখে বিনায়ক অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। ‘বেরিয়ে যান, বেরিয়ে যান বলছি, গেট আউট . . .’ ---- দ্বৈপায়ন ছুটে গিয়েছিলেন সাংবাদিকটির দিকে। হয়তো মেরেই বসতেন। সে কোন রকমে পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিল।
বিনায়ক অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেন দ্বৈপায়নকে ---- ‘আমার জন্যে তুমি আজ এ জায়গায় আসোনি, এসেছ নিজের মেধা, দক্ষতা আর পরিশ্রমের জোরে। আমি তো তোমাকে সাহায্য করেছিলাম মাত্র।’
কিন্তু সাংবাদিকটির কথা মনে গেঁথে গিয়েছিল দ্বৈপায়নের। সে কখনও এ ধারণা মুছে ফেলতে পারেনি। কুরে কুরে খেয়েছিল দিন-রাত।
‘তোমার মত মহান মানুষের বন্ধুত্ব আমার পোশাবে না বিনায়ক, আমার জন্য তুমি অনেক করেছ। আর না . . . ’ ---- দ্বৈপায়নের মুখ থেকে এই কথাটাই শেষ বারের মত শুনেছিলেন বিনায়ক।
দ্বৈপায়নের প্রথম উপন্যাসটাই যে কি পরিমাণ জনপ্রিয় হয়েছিল, এই একটা উপন্যাসে ভর করে তিনি যে পাঠকের মনে রাতারাতি কোথা থেকে কোথায় উঠে গিয়েছিলেন তা তিনি জানতে পেরেছেন কিনা কে জানে . . . এই সাফল্যটার পিছনে বিনায়কের তো কোন হাত ছিল না !
কলেজের পড়া শেষ করার পর দ্বৈপায়ন যখন পাড়ায় তাঁর বাবার বন্ধুর মনোহারি দোকানে কাজ করেন তখন বিনায়ক তাঁর লেখা একটা গল্পের কয়েকটি অংশ সংশোধন করে দিয়েছিলেন। তাতে পুরো গল্পটার চেহারাই বদলে গিয়েছিল। বিনায়কের উদ্যোগেই গল্পটা পাঠানো হয়েছিল কলকাতার একটি পত্রিকায়। কয়েক মাসের মধ্যে ছাপাও হয়েছিল। বিনায়কই কিনে এনেছিলেন কলেজস্ট্রিট থেকে পনের টাকা দিয়ে। বিনামূল্যে লেখকদের জন্য যে কপিটা পত্রিকা দেয় তা বিনায়ক নেননি।
সেই থেকেই দ্বৈপায়নের সাহিত্যে স্বপ্ন দেখা শুরু। বিনায়ক অবশ্য কবিতায় তখন মোটামুটি পরিচিত নাম। কলকাতার এই অঞ্চলটায় নতুন বাড়িতে ভাড়া এসেছেন। দ্বৈপায়নদের দোকানের বাঁধা খরিদ্দার।
গত বিশ বছরে বিনায়ক অনেক খুঁজছেন দ্বৈপায়নকে। ভুল ভাঙাতে চেয়েছেন। আর দেখা হলে একটাই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইবেন বলে ঠিক করে রেখেছেন ----‘কি দোষ ছিল আমার ?’
শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি। আকাশের মুখ গম্ভীর। কি এক দুশ্চিন্তায় যেন মুখ কালো করে বসে আছে। থেকে থেকে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলছে। মাঝে মাঝেই আবার কেঁদে ফেলছে ঝর ঝর করে। বৃষ্টি আর দমকা হাওয়ার বারংবার উচ্ছাসে দিনটা কেমন যেন আবছা হয়ে আসছে।
কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য সংঘের একটা সম্বর্ধনাসভা থেকে ফিরছিলেন বিনায়ক। একটি বস্তির পাশ কাটিয়ে ফুলপ্যান্ট যতটা সম্ভব গুটিয়ে এবং রাস্তার জমা জল বাঁচিয়ে গাড়িতে ওঠার সময় দেখলেন টালি ছাওয়া এক জীর্ণ খুপরির সামনে অনেক মানুষের ভিড়। কৌতুহল নিয়ে এগিয়ে গেলেন। এ এলাকাটায় আগে আসা হয়নি। অপেক্ষাকৃত নিম্নবিত্ত মানুষের বাস এদিকটায়। কখনও প্রয়োজন পড়েনি। উঁকি দিয়ে দেখলেন ভিতরের ঘন অন্ধকারে শতছিন্ন বিছানায় একটি কঙ্কালসার দেহ পড়ে আছে। গত রাতেই সে গত হয়েছে। দরজা হাট করে খোলাই ছিল। উৎসাহী ও কৌতুহলী জনতা বাইরে থেকে দেখছে, কিন্তু কেউ এগিয়ে যাচ্ছে না। কারণ তারা কেউই লোকটির সাথে পরিচিত নয়। মাত্র কয়েক দিন নাকি সে অসুস্থ্য শরীর নিয়ে এখানে এসে ছিল।
বিনায়ক মানবতার খাতিরে ভিতরে ঢুকলেন। অন্ধকারে মুখটা ভালো দেখা যাচ্ছে না। বাইরের লোকেদের তিনি আলো আনতে বললেন। ‘বাবু যাবেন না, কি রোগে মরেছে তার ঠিক নেই . . . !’ ---- এক জন সাবধান করল বাইরে থেকে।
কিন্তু ততক্ষণে বিনায়কের কেমন যেন সন্দেহ জেগেছে মনে। টর্চ এল। তিনি ভালো করে পরীক্ষা করলেন। কোন ভুল নেই ---- এ দ্বৈপায়ন ছাড়া আর কেউ নয়। খালি গা, শরীরে মাংস বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। শুধু কঙ্কালটা চামড়া দিয়ে ঢাকা। মুখ তোবড়ানো; ইষৎ হাঁ করা। পরনে কেবল একটা বহু ব্যবহৃত মলিন লুঙ্গি। সারা শরীরে অনাহারের কঠিন ছাপ। আগের মুখের সঙ্গে এ মুখের কোন মিল নেই। বন্ধুর চোখ তবু চিনে নিল বন্ধুকে।
অন্য মৃতদেহের সঙ্গে শুধু একটাই পার্থক্য, যেটা এই দেহটাকে দ্বৈপায়ন করে তুলেছে ---- ডান হাতে শক্ত করে এক তাড়া কাগজ বুকের সাথে আঁকড়ে ধরে রাখা। বিনায়ক সযত্নে সেটি বার করে নিলেন। যেন সেটি বিনায়কের জন্যই রাখা ছিল।
দ্বৈপায়নের প্রথম গল্পটার দিনে দৈব তাদের মিলিয়েছিলেন . . . দ্বৈপায়নের শেষ উপন্যাসের দিনেও দৈবই তাদের মেলালেন।
Tags:
অণুগল্প