রুমা অধিকারী

দ্বিতীয় শুভদৃষ্টির এই সময়






হাজার হাজার বছর আগের ক্ষয়ে যাওয়া সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ নিমেষেই কি ধুয়ে সাফ করে দিতে পারে এক শ্রাবণের বৃষ্টির জল! -- শৈবাল ঘর লাগোয়া বাথরুমে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে এমনই সব উদ্ভট ভাবনাই ভাবছিল। এই দশটা বছরে শাওয়ারের জল ওর মাথা থেকে রাইয়ের স্মৃতি ধুয়ে মুছে সাফ করে দিতে পারে নি। রোজই প্রায় রাইকে তার মনে পড়ে। শৈবাল শাওয়ারটার নবটা আর একটু ঘুরিয়ে দেবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে আবার ভাবতে শুরু করে। আজ যেন তার কি হয়েছে। সব মনকেমন করা স্মৃতিগুলো তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাকে।

দশ বছর ধরে একা থাকার দুঃসহ যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে বেড়াতে বেড়াতে কখন যে যৌবন পার করে ফেলেছে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে নি শৈবাল। আয়নায় চোখ রেখে টাইটা বাঁধতে বাঁধতে তার নজর পড়ল মাথার চুলে পাক ধরেছে। মা যতদিন ছিল পায়েস আর তারসাথে পঞ্চব্যঞ্জন রান্না করে জন্মদিন পালন করত। তখন বয়স বাড়ারও একটা হিসাব মনে গাঁথা থাকত কিন্তু এখন বয়সের হিসাব শুধু দরকারি ডকুমেন্টেই রাখা। রাই নিজের বাড়িতে চলে যাওয়ার পর ছেলের জন্য ও ছেলের বৌ এর কথা ভেবে ভেবে মা অসুস্থ হয়ে পড়ল। একবছরের মাথায় সেরিব্রাল অ্যাটাকে মা চলে গেল না ফেরার দেশে। সেই থেকে বাড়িতে একাই এই অখণ্ড অবসর কাটিয়ে এসেছে শৈবাল। অবশ্য এই একাকিত্বের যে ভাল ফল হয়নি সেকথা মোটেও বলা যাবে না। এই অখণ্ড অবসর ও একাকিত্ব ওকে একটা মেমোরেবল ডে উপহার দিল। নিজের লেখা উপন্যাস 'জীবন জিঘাংসু'-র জন্য ওকে আজ 'সাহিত্য একাডেমি' পুরষ্কার দেওয়া হবে। অফিসের কাজের চাপ আর এরই মধ্যে এরকম একটা সংবাদ, শৈবাল যে ছুটি নেবে তার উপায় নেই। রাই চলে যাওয়ার পর শৈবাল নিজেকে কাজে ফিরিয়ে আনতে দিল্লীর এই কর্পোরেট জব বেছে নেয়। যেটুকু সময় পেত ঘরে ফিরে সাহিত্যচর্চায় লেগে থাকত। কিন্তু ফোনে যখন খবর পায় এই পুরষ্কারের কথা শৈবাল ... কেমন যেন মনমরা হয়ে পড়ে। উথলে ওঠা উচ্ছাস আর আনন্দ ভাগ না করলে সবটাই মাটি হয়ে যায়। শৈবালের অবস্থাও ঠিক তাই হয়েছিল। আনন্দ ছিল, উচ্ছাস ছিল, কিন্তু আনন্দ শেয়ার করে নেবার মত ওর কেউ ছিল না। শৈবাল মনে মনে ভাবে এইটাই হয়ত কারণ যে স্নান করার সময় অমন উল্টোপাল্টা ভেবে যাচ্ছিল।

আলমারি থেকে রুমালটা নিতে যাবে হঠাৎ একটা গন্ধ টের পায় শৈবাল। খুব চেনা কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছে না কিসের গন্ধ আর আসছেই বা কোথা থেকে। শৈবাল ঘরের মরুভূমিতে যেন মরীচিকা দেখার মত হাতড়াল কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছে না এক্স্যাক্ট কি গন্ধ আর তার উৎস কোথায়। কোনকিছু যেন হাতছানি দিয়ে ওকে ডাকছে, যেন কিছু মনে করাতে চাইছে। একবার ভাবল- "তবে কি কাজের মাসীমার কাছ থেকে আসছে! " তারপরেই মনে পড়ল কাজের মাসীমা এসে রান্না করে রেখে দিয়ে চলে গেছে। "তাহলে গন্ধটা আসছে কোথা থেকে।" ওকে ঘিরেই যেন গন্ধটা ঘুরপাক খাচ্ছে। শৈবাল বিরক্ত হয়ে বলল- ধুর! কিসব হচ্ছে আজ! এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ দিনে সে কিসব উল্টোপাল্টা ভেবে যাচ্ছে। সেই কবে থেকে চাতকের মত করে চেয়ে এসেছে আজকের দিনটা। স্বপ্ন বুনেছিল ছোট থেকে। ঘড়ির দিকে তাকাতেই শৈবাল খেয়াল করল দশটা বেজে গেছে। ওকে আজ অফিস করে অনুষ্ঠানে যেতে হবে বিকেল চারটের মধ্যে। মাথা থেকে উদ্ভট চিন্তা ঝেড়ে ফেলে তড়িঘড়ি জুতো পরে নেমে এল গ্রাউণ্ড ফ্লোরে। চেরি কালারের গাড়ির দরজাটা খুলতেই আবার সেই একই সুবাস টের পেল শৈবাল। এবার আর মাথা না ঘামিয়ে ড্রাইভ করে অফিসে পৌঁছাল। 


(২)

অফিস থেকে একঘন্টা আগে বেরিয়েও রবীন্দ্র ভবনে পৌঁছতে পৌঁছতে শৈবালের একঘন্টা লেগে গেল। হলঘরের গেটের সামনে যখন দাঁড়াল তখন হলঘরে লোকে লোকারণ্য। অনুষ্ঠান আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। শৈবাল তার উপস্থিতি কর্তৃপক্ষকে জানান দিয়ে কোনক্রমে পিছনের দিকে একটা সিট জোগাড় করে বসে পড়ল। আধ ঘন্টা পর পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শুরু হল। এই আধঘন্টায় শৈবাল রাইয়ের কথা ভেবে যাচ্ছিল। দশ বছর আগে রাই ছিল তার অন্তর জুড়ানো একচিলতে সুখ, ভরসা, যার কোলে মাথা রেখে সে কত না গল্পের প্লট ভেবে চলত, কবিতার লাইন মনে আসত। রাইও সেসব লাইন, গল্পের প্লটের সমালোচনা করত। সেসব বুঝতও ভাল। আবার কোনদিন বলত, - " তোমার আজকের গল্পরা বলে তুমি একদিন সম্মানিত হবে। সময় না দেওয়ার জন্য আমি অভিমান করে থাকলেও তোমার হাতে পুরষ্কার দেখে ছুটে যাব তোমার কাছে, তুমি দেখো।" 

রাই ছিল পুরোদস্তুর সংসারী। সংসারটাকে বেশ গুছিয়ে সামাল দিত। চাকরি আর লেখালিখির কারনে শৈবাল মাথা ঘামাতে পারত না সংসারের ব্যাপারে। মাও রাইয়ের হাতে সবকিছু সঁপে নিশ্চিন্ত ছিল। রাই একাই সব সামলে নিত। বিয়ের পর থেকে রাইকে যত কাছ থেকে দেখেছে ততই মুগ্ধ হয়েছে। অন্তর বাহির সবটাতেই তার একটা মাধুর্য ছিল। মাঝে মাঝে অবশ্য ওকে সময় না দেওয়ার কারণে রেগে গিয়ে বলত -" যেদিন আমি থাকব না সেদিন তুমি আমাকে সময় দেওয়া থেকে মুক্তি পাবে, তখন সারাদিন ওই নিয়ে পড়ে থেকো, এখন তো একটু সময় রাখো আমার জন্য!" শৈবাল যখন হাত ধরে টেনে আলিঙ্গন করে বুকের কাছে নিয়ে আসত রাই ছোট্ট মেয়ের মত আহ্লাদী হয়ে শৈবালের বুকে মাথা রেখে বায়না করত - " আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দাও একটু!" এইভাবে নিত্যদিনের দুষ্টুমিষ্টি খুনসুটি আর ভালবাসা নিয়ে চার বছর কেটে গেল। এই চার বছরে মাও ছেলেকে ছেড়ে সব ব্যাপারে রাইকেই সাপোর্ট দিত আর বলত -" আগের জন্মে নির্ঘাত রাই আমার পেটের মেয়ে ছিল।" রাইও ছোটবেলায় হারানোর কষ্ট ভুলে দিব্যি আপন করে নিয়েছিল তার শাশুড়িমাকে। ভাগ্যের ওপর কার আর জোর চলেছে! সুখও বেশিদিন টিকসই হয় না। বিয়ের পাঁচ বছরে রাই অন্তঃসত্ত্বা হল। 

-" শৈবালবাবু, আপনি একবার সামনে গিয়ে দেখা করবেন অমলদার সাথে।" - মাঝারি বয়সের শ্যামবর্ণ একজন এসে ডাকতে শৈবালের হুঁশ ফিরল। সামনে গিয়ে দেখা করে একজায়গায় বসল।

যখন সম্মানিত সাহিত্যিক, কবি, লেখকদের নাম ঘোষণা হওয়ার পর পুরষ্কার নিয়ে দুচারকথা বলা হচ্ছে তখন সে আনমনা হয়ে ভাবতে লাগল নার্সিংহোমে ভর্তি করানোর পরের দিন সকাল সকাল ফোন এল ছেলে হয়েছে। তড়িঘড়ি শৈবাল নার্সিংহোমে পৌঁছাতে নার্সের মুখে শুনল " আপনার বেবিটা মারা গেছে, নিশ্বাস নিতে পারছিল না। আমরা অনেক চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারি নি।" জন্মাবার একঘন্টার মধ্যেই এরকম একটা খবর পাবে শৈবাল আশা করে নি। রাইকে যে কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না তবুও শৈবাল বেডের ধারে বসে রাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। রাই চোখ খুলে শৈবালকে দেখে বলল - "আমি জানি ওরা আমার ছেলেকে সরিয়ে দিয়েছে। নাহলে দুবার দেখার মধ্যে পার্থক্য থাকে কি করে! " শৈবাল কিছু বুঝতে না পেরে বলেছিল -" এসব তুমি কি বলছ, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।" রাই বলল- " অপারেশন টেবিলে আমাকে আমার ছেলেকে দেখান হয়েছিল আমি দেখেছিলাম ছেলের মুখ, ঠিক তোমার মত দেখতে ছিল। মারা যাওয়ার পর ছেলেকে একবার দেখাতে বলি নার্সকে। তুমি জানো শৈবাল, দেখলাম ও ছেলে আমাদের নয়! মুখটা পুরো অন্য। আমি নার্সকে জানিয়েছিলাম ওরা বিশ্বাস করছে না বলছে এটাই তোমার ছেলে অচেতন অবস্থায় কি থেকে কি দেখেছ এই দেখো নাম্বার দেওয়া আছে।" শৈবাল সুপার ভাইজারের সাথে দেখা করে সব বলে কিন্তু কোন লাভ হয় নি। শৈবাল সেসব নিয়ে আর কথা না বাড়ালেও রাই কিছুতে ভুলতে পারল না। এরপর থেকে রাই কেমন একটা হয়ে গেল। কথায় কথায় খুব রেগে যেত। বারবার বলত " তুমি আমার কথা বিশ্বাস করলে না কেন? তোমরা সবাই আমার ছেলেকে কেড়ে নিয়েছ।" প্রথম প্রথম শৈবাল বোঝাবার চেষ্টা করত, কিন্তু তেমন একটা লাভ হত না। ধীরে ধীরে দুজনের দূরত্ব বাড়তে লাগল। বিষিয়ে গেল সম্পর্ক। একদিন নিজেই জানাল সে বাবার কাছে চলে যেতে চায়। সেদিন রাইয়ের মুখে কথাটা শুনে শৈবাল চুপ করে থেকেছিল। ও নিজেও যেন কিছুটা মুক্তি চেয়েছিল সেইদিনকার পরিস্থিতি থেকে, কিছুটা একা থাকতে চাইত। এই দমবন্ধ করা অবস্থা থেকে সে যেন কিছুদিন ছুটি চাইছিল। তাছাড়া সেদিন মনে মনে ভেবেছিল যে বাবার কাছে গিয়ে রাইয়ের যদি কিছুটা পরিবর্তন হয় অথবা কয়েকদিন আলাদা থাকলে যদি মন বা শরীর ভাল থাকে। মাঝে মাঝে শৈবাল ফোন করে খবর নিত, বুঝতে চাইত রাইয়ের মনের খবর, ওর শরীরের খবর, সবটা জানতে চাইত। রাইয়ের তখনও বেশ অভিমান ছিল শৈবালের প্রতি, বিন্দুমাত্রও ভোলেনি ছেলের হারানোর দুঃখ। প্রথম প্রথম দু একটা কথা বলত কিন্তু তারপর আর ফোন ধরতে চাইত না। সেটা শৈবাল বুঝতে পেরে ধীরে ধীরে সরে এসেছে। মাঝে মাঝে রাইয়ের কাছে যেত যখন গিয়ে রাইয়ের দেখা পেত না বা দেখা পেলেও আগ্রহ দেখা যেত না কথা বলার তখন তাও শৈবাল বন্ধ করে দিল। একমাত্র আশা ছিল যে যদি কোনদিন রাই সব ভুলে শৈবালের কাছে ফিরে আসে।


মঞ্চের ওপর তখন শৈবালের নাম ঘোষণা হল। পাশের একজন ঠেলা দিয়ে বলে উঠল-" আরে দাদা দুবার নাম ডাকল, কোথায় আছেন আপনি, যান তাড়াতাড়ি, আজব মানুষ বটে আপনি" শৈবালের তখন হুঁশ ফেরে। মঞ্চের দিকে পা বাড়াতেই আবার সেই সুবাস টের পায় শৈবাল। এবার যেন গন্ধটা বেশ জোরালোভাবেই শৈবালের নাকে এসে ঠেকে। শৈবালের মনে পড়ে যায় এ গন্ধ তার অনেক চেনা। রাই এই ফ্লেভারের ডিও ব্যবহার করে। চারপাশটা ভাল করে দেখতে চেষ্টা করল। ভাবল এখানে আর রাই কেমনভাবে আসবে ওর যত সব উদ্ভট ভাবনা। এই ভেবে বাঁদিকটায় তাকাতেই একটা পরিচিত মুখ নজরে এল শৈবালের, কিন্তু ভিড় আর ক্ষীণ আলো থাকায় বোঝা যায় নি ঠিক কার মুখ দেখেছে শৈবাল। 

অনুষ্ঠান শেষ হলে হলঘরের বিরাট দরজা দিয়ে ভিড় ঠেলে শৈবাল সবেমাত্র বাইরে পা দিয়েছে, একটা পরিচিত কন্ঠস্বর কানে এল। "কনগ্রাচুলেশন শৈবাল"। শৈবালের সারা শরীর জুড়ে যেন এক তরঙ্গ বয়ে গেল। " এ তো রাইয়ের গলা, কিন্তু রাই তো কলকাতায়, এখানে আসবেই বা কেন, তাহলে বোধ হয় ভুল শুনেছি, বা হতে পারে ওর মতো গলার অন্য কেউ বলেছে। " গুরুত্ব না দিয়ে সামনে দুপা এগিয়ে রাস্তায় নামল শৈবাল। গাড়ির দরজায় চাবিটা ঠেকাতেই পেছন থেকে আবার সেই কন্ঠস্বর শুনতে পেল " কেমন আছ? আমায় তোমার সাথে নিয়ে যাবে! " পেছন ফিরতেই শৈবালের স্ট্যাচুর পজিশনিং। লাল শাড়ি, লাল টিপ। শৈবাল টাইমমেশিনে উঠে পড়ল আর এক লাফে শুভদৃষ্টির ছাতনা তলায় দুজনে দাঁড়িয়ে। হিল্লোল জাগানো স্মিতহাস্য। শৈবাল হাত বাড়াল ওপাশ থেকেও কোমল হাত শৈবালের হাতে রাখল। ড্রাইভারের পাশে তার সহযাত্রীর চোখও চিকচিক করে উঠল প্রথম দেখার লাজুক হাসি নিয়ে। একের পাশে আরও এক জুড়ে দুই হল তিনের সম্ভাবনায়। 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

নবীনতর পূর্বতন