পিয়ালী বসু / সঞ্জীব কুমার

প্রতিপক্ষ

বৃষ্টি আসবে বোধহয়। সুকান্ত খুশীই হলো। বৃষ্টি তার খুব প্রিয়। আর কোথাও বেরোতে না হলে তো কথাই নেই। চা খেয়ে সোজা চলে গেল মেসের ছাতে। সারা আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। ঠান্ডা হাওয়া বইছে।

অনন্ত চরাচর জুড়ে গ্রহণের কালো ছায়া
যাপিত আবহাওয়ার নেপথ্যে দীর্ঘ তল্লাশি
বেকসুর বিশ্বাস নিয়ে বেড়ে ওঠা মুহূর্তে
এখন বৃষ্টির স্বগত-কথন

কাছেপিঠে কি কোথাও বৃষ্টি হলো? ঝড় উঠবে? হাতদুটো দুদিকে ছড়িয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো সুকান্ত।
ক্রমে বৃষ্টি এলো ঝেঁপে। ঝাপসা হয়ে গেলো চারিদিক। কাছেপিঠে দুএকটা গাছ উপড়ে গেল। মেঘের গর্জনে বারবার কেঁপে উঠলো চারদিক। কিছুই কানে গেল না সুকান্তের। তখন ভৈরবী ভিজে যাচ্ছে মেঘমল্লারে। ঢেউ এর পর ঢেউ উঠছে শরীর জুড়ে ...

ধীরে ধীরে ঠোঁট সরিয়ে নিল শ্রেয়া। সুকান্তের শরীরে লেপ্টে যাওয়া শরীর ছাড়িয়ে নিল আলগোছে। কপালে চুলের মেঘ সরিয়ে প্রশ্ন করলো "সুকান্তদা! ফিরবে না? বৃষ্টি আসছে যে!"

"বৃষ্টি! আসুক না শ্রেয়া! তোমার ঠোঁট জুড়ে বসুক না একটা প্রজাপতি! তোমার বন্ধ চোখের আগল ঠেলে গড়িয়ে পড়ুক না একের পর এক কালবৈশাখীর বিকেল! সে বিকেলে হঠাৎ উঠুক অভিমানের দমকা হাওয়া। প্রজাপতি উড়ে যাক পরাগ টুকু রেখে। উথালপাথাল বুকের মাঝে জ্ঞান হারাক সভ্যতার ইতিহাস। নিভে যাক সব আলো। শুধু তুমি জেগে থাকো এ বুকে শেষ না হওয়া উপন্যাসের মতো। আমি আলো চাই না। আমি দেখতে চাই না পৃথিবীর রঙ। আমি শুধু তোমায় চেয়েছিলাম শ্রেয়া। শুধু ...." বলতে বলতে জ্ঞান হারালো সুকান্ত।

কিছু ঘড়ির কিছু কাঁটা ইদানীং যথেচ্ছ ঘোরে
ভেজা ক্যালেন্ডার থেকে উবে যায় প্রথাসিদ্ধ মাস
সমস্ত প্রাচীন প্রেম কবে যেন ফিরে গেছে লাস্ট ক্যারাভানে
মনে পড়েনা আর সেসব

প্রকান্ড ছাত জুড়ে অন্ধকার নেমে আসছে। বৃষ্টি জুড়িয়েছে বেশ কিছুক্ষণ। পরিস্কার আকাশে সন্ধ্যেতারা পথ দেখাচ্ছে রাত্রির। অনেকদূরের প্রদীপের আলোয় আর শঙ্খধ্বনিতে আরাধনা সাঙ্গ হচ্ছে দেবতার। জ্ঞান ফিরলো সুকান্তের। টলতে টলতে নেমে এলো ছাত থেকে।গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। অভিমান মুচড়ে উঠলো। শ্রেয়া চলে গেল? তাকে ছেড়ে ? চিরদিনের মতো?

বিষাদ কতটা মর্মভেদী হলে
বাকসিদ্ধ দুপুরে ঘনিয়ে আসে আচম্বিত রাত্রি ?
ফিরে যেতে ইচ্ছে হয় স্মৃতির ঋষভ চূড়োয়...
ফেলে আসা সম্পর্কের ঘন মধুমাসে

ঠিক তখনই একটা রিক্সা থামলো নীচের রাস্তায়। শ্রেয়া নেমে দরোয়ানকে শুধোলো "আচ্ছা এটা কি বারো নম্বর রজনী সরকার লেন? সুকান্ত বসু এখানে থাকেন? একবার ডেকে দিতে পারেন?"

ক্ষয়িষ্ণু রাত দুলছে স্মৃতিনগরীর মায়াবী পর্দায়
লঘুচালে বলা কথাগুলো – দেখো কেমন সত্যি হয়ে উঠেছে
কেজো শহরের সিঁড়ি বেয়ে এখন গল্পকথার জ্যোৎস্না -স্নান

অফিস থেকে ফিরে শ্রেয়া ম্যাগাজিনটা ছুঁড়ে ফেললো পড়ার টেবিলে। কল্লোল মনোযোগ দিয়ে কি একটা পড়ছিল, চমকে উঠলো।
"কি লিখেছ এটা?" ঝাঁঝিয়ে ওঠে শ্রেয়া।
" কেন? গল্প!" জবাব দেয় কল্লোল।
"গল্প? একেবারে জীবন থেকে উঠে আসা গল্প! তাই না? তাই সুকান্ত আজও ঘোরে তোমার মাথায়! আজও সে আমায় চুমু খায় তোমার কল্পনায় তাই না? অকৃতজ্ঞ! সারাটা জীবন তোমায় ভালবেসে এলাম! আর আমার পাওনা হোল কিনা রাস্তার ঐ লোকটা যার সাথে বন্ধুত্ব ছাড়া আর কোন সম্পর্কই ছিল না? ছিঃ।"

আর এক পেগ হাতে নিয়ে ফিরে এলো সুকান্ত বোস। জড়ানো গলায় বলে উঠলো "কাম্ অন্ শ্রেয়া! এই স্ক্রীপটা তুমি অ্যাপ্রুভ না করলে...। আচ্ছা ঠিক আছে। ইওর হাসব্যান্ডস্ নেম উইল বি চেজ্ঞড্।"
অ্যান্ড দ্য অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট স্ক্রিনপ্লে অফ দ্য ইয়ার গোস টু রীতা ভিমানী। সিট্ ছেড়ে ওঠার আগে শ্রেয়ার গালে গাল ঠেকিয়ে রীতা কানে কানে বললো " কাম অন ডিয়ার! কাম উইথ মি! আই হ্যাভ ওনলি রিটন ইউ বাট ইটস্ ইওর স্টোরী!"

ঘুমের আড়াল থেকে একে একে উঠে আসছে একাগ্র অক্ষর, ভ্রূকুটি
নিঃশব্দ পায়ের চলা, ভেঙে যাচ্ছে বনিবনা, কাচ
স্পষ্টতর হচ্ছে মেঘভর্তি স্মৃতি-রুম --
আর ভালবাসা মরছে ... স্মৃতিঘরে ... প্রতিদিন মাপবুঝে

শ্রেয়ার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে মূহুর্তে। কলিগ হিসেবে রীতা আজও অপ্রতিরোধ্য। স্বামী হিসেবেও।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সুচিন্তিত মতামত দিন

নবীনতর পূর্বতন