একুশ মাসের কৃষ্ণপ্রহর
সত্তরের দশকটা কিভাবে মৃত্যুর দশকের রূপ নিয়েছিল তার কিছুটা ছুঁয়ে গিয়েছি আগের পর্বে । একাত্তরের মধ্যেই প্রবল দমননীতির মুখে নকশাল আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু বন্দুকের নল, বোমা, আর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের আস্ফালন কিছুমাত্র কমেনি, কমেনি সামাজিক অস্থিরতা । একাত্তরে ওপারে জন্ম নিয়েছিল নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ । ওপারের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার সাফল্যে বলীয়ান শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বিপুল শক্তি নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে এলেন । অস্থির বাংলায়ও রাষ্ট্রপতি শাসনের অবসান ঘটিয়ে নির্বাচন হল । নির্বাচনে সিপিআই (এম) দল একক বৃহত্তম দল হয়েছিল, কিন্তু নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠিতা পায়নি । ফলে অজয় মুখার্জীর নেতৃত্বে সংখ্যালঘু সরকার গঠিত হল । কিন্তু মাত্র ৮৪ দিনের মাথায় সেই সরকার পড়ে গেলো, জারি হল তৃতীয় বারের জন্য রাষ্ট্রপতি শাসন।
তারপর বোমা, গুলি, গুপ্তহত্যা, সন্ত্রাস আর বারুদগন্ধের আবহে বাংলায় আবার নির্বাচন হল মার্চ বাহাত্তরে । কেমন ছিল সেই নির্বাচন সে সব বৃত্তান্ত আমি দেবো না । লেখা আছে সেই সময়কার সংবাদপত্র প্রতিবেদনগুলিতে । সত্তর দশকের কথা বলতে গেলে বাহাত্তরের নির্বাচনের কথা ছুঁয়ে যেতেই হবে, কারণ বন্দুকের নলের আস্ফালনে ভোট লুট করার সেটাই ছিল প্রথম সফল প্রয়োগ ।
ইতিহাস তার শরীরে সব বৃত্তান্তই ধরে রাখে । সত্তর তার শরীরে আরো দুটি তারিখ ধরে রেখেছে– চুয়াত্তরের ৮ই মে , শুরু হয়েছিল ১৯ দিনের সারা ভারত রেল ধর্মঘট আর পঁচাত্তরের ২৫শে জুন, জারি হয়েছিল আভ্যন্তরীন জরুরি অবস্থা - ২১ মাসের কৃষ্ণ প্রহরে কন্ঠনালি তাক করা বন্দুকের নল ।
চুয়াত্তরের গোড়ায় রেলকর্মীদের ‘স্ট্রাইক ব্যালট’ আহ্বান করলো রেলের ইউনিয়ন । সারা ভারতে নব্বই ভাগেরও বেশি রেলশ্রমিক লাগাতার ধর্মঘটের পক্ষে মত দিল । প্রধান দাবী ছিল ‘ওয়েজ প্যারিটি’ বা সমান কাজে সমান বেতন ও সকলের জন্য বোনাস । ৮ইমে ১৯৭৪ থেকে সারা ভারতে লাগাতার রেল ধর্মঘটের ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু হলো । বিভিন্ন রেল শ্রমিক সংগঠনগুলিকে একটা কেন্দ্রীয় কমিটির আওতায় নিয়ে এসে তৈরী হয়েছিল ‘ন্যাশানাল কোঅর্ডিনেশন কমিটি ফর রেলওয়ে মেনস স্ট্রাগল’ । প্রতিরক্ষা ও ডাক বিভাগ সহ অন্যান্য শ্রমিক-কর্মচারীরা রেলশ্রমিকদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিল । সম্ভাব্য দমন পীড়ন মোকাবিলার জন্য অর্থ সংগ্রহ, রেলকলোনিগুলোতে কর্মীদের, তাদের বাড়ির মহিলাদের মিছিল ইত্যাদি হতো । সে এক অগ্নিগর্ভ দিন ।
ধর্মঘট শুরুর দিন এগিয়ে এলো। ধর্মঘট বে-আইনী ঘোষণা করলো সরকার, বিনা বিচারে জেলবন্দী রাখার জন্য জারি হয়েছিল কুখ্যাত ‘ভারত রক্ষা আইন’। রেল শ্রমিকদের বিরুদ্ধে যেন যুদ্ধ ঘোষণা করলো সরকার। পয়লা মে থেকে শুরু হল নেতৃস্থানীয়দের ব্যাপক গ্রেপ্তারি। আমি গ্রেপ্তার হলাম ক’দিন পরে। ৫ই মে বন্ধুদের সঙ্গে একসাথে অফিস যাচ্ছিলাম। অফিসের সামনে থেকে আমাকেও গ্রেপ্তার করলো পুলিশ। জেলখানার লাপসি খাওয়া অভ্যাস হয়ে গেলো । মনে আছে, আমাদের সঙ্গে একই সেল’এ ছিলেন এখনকার বেশ বড় মাপের রাজনৈতিক নেতা শরদ যাদব।ও তখন জব্বলপুরের ফায়ারব্রান্ড ছাত্রনেতা, স্যোশালিস্ট পার্টির। শরদকে আর রেলকর্মী বন্ধুদের রোজই শোনাতাম নাজিম হিকমতের জেলখানার চিঠি কবিতাটা, “মানুষের মুন্ডুটাতো বোঁটার ফুল নয় যে ইচ্ছা করলেই ছিঁড়ে নেবে”!জেলে থাকতেই শুনেছিলাম ভারত নাকি রাজস্থানের ‘পোখরান’এ তার প্রথম আনবিক পরীক্ষা করেছে। উনিশ দিন চলেছিল রেল ধর্মঘট। উনিশ দিনের মাথায় ভেঙ্গে গিয়েছিল। দেশের নানা প্রান্তে অভূতপূর্ব দমন-পীড়ন নেমে এসেছিল, ধর্মঘটী রেল শ্রমিক আর তাদের পরিবারের ওপর । এখনকার প্রজন্মের মানুষদের শিঊরে ওঠার মত উপাদান ছিলরাষ্ট্রশক্তির সেই পীড়নে । জানিনা তারা কতটুকুই বা জানেন নিজের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের সেই বে-আব্রু প্রতিহিংশার কথা । রেলের কারখানাগুলিতে ধর্মঘটের প্রভাব ছিল বেশি । দেশের অনেক যায়গায় রেলকলোনির ধর্মঘটী পরিবারের কোয়ার্টারে বিদ্যুৎ আর জল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল, তাদের সন্তানদের রেলের স্কুলে ভর্তি নেয়নি ।
২৭শে মে ধর্মঘট ভেঙ্গে গেলো । আমরা জেল থেকে ছাড়া পেলাম আরো দিন তিনেক পরে । চাকরিতে জয়েন করতে দিল না । জানলাম বে-আইনী ধর্মঘটে অংশ নেওয়ার জন্য চাকরি ‘ঘ্যাচাং’ হয়ে গেছে । সারা ভারতে হাজার হাজার রেল কর্মচারির চাকরি চলে গিয়েছিল । রাষ্ট্রের সে এক অভূতপূর্ব প্রতিহিংশামূলক পীড়ন তার কর্মচারীদের বিরুদ্ধে । তবুও নতজানু হয়নি তারা ।
দেশের প্রথম সারির আইনবিদরা রেলকর্মীদের পক্ষে আদালতে দাঁড়িয়ে ছিলেন কোন পারিশ্রমিক ছাড়াই । আমার মামলাটা কলকাতা হাইকোর্টে লড়েছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। দশ মিনিটের মধ্যে আমাকে বরখাস্ত করার রেলের হুকুমনামা খারিজ হয়ে যায় । ডিপার্টমেন্টাল অ্যাকশন না নিয়ে কারো চাকরি খেয়ে নেওয়া যায় না । সেই প্রথম আমার হাইকোর্ট দেখা । মামলা খারিজ হলেও চাকরি ফেরত পাইনি তখন । অবাস্তব সব অভিযোগ এনে বিভাগীয় তদন্ত শুরু করেছিল রেল । সে তদন্ত আর শেষ হয়নি । আমি চাকরীর বাইরেই ছিলাম । ততদিনে পঁচাত্তরের পদধ্বনি যেন শোনা যাচ্ছে – একুশ মাসের জরুরী অবস্থা । হরণ হয়ে গেলো সব রকম সাংবিধানিক অধিকার, সে প্রসঙ্গ বলবো । ১৯৭৭এর ২১শে মার্চ জরুরী অবস্থা প্রত্যাহৃত হ’ল । ১৬ থেকে ২০ মার্চ সাধারণ নির্বাচনের হ’ল । কেন্দ্রে জাতীয় কংগ্রেসের একদলীয় শাসনের অবসান হ’ল । মোরারজি দেশাইএর নেতৃত্বে জনতা পার্টির সরকার গঠিত হ’ল ২৪শে মার্চ । রেলমন্ত্রী হলেন মধু দন্ডবতে । রেলমন্ত্রী হয়ে প্রথম যে সরকারী কাগজে সই করেছিলেন তিনি, সেটি ছিল ভারতের সমস্ত বরখাস্ত ধর্মঘটী রেলকর্মীদের চাকুরিতে পুণর্বহালের আদেশনামা । রেলকর্মীরা মাথা উঁচু করে কর্মস্থলে ফিরে এলেন ।
১৯৬৭ থেকে ২৪শে মার্চ সাতাত্তর, মাঝের একুশ মাসের কৃষ্ণপ্রহরের কথা না বললে সত্তরের দশকটাকে ফিরে দেখাটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায় । এবার বলি নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার সেই মসিকৃষ্ণ একুশ মাসের কথা – যা ছিল দেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সবচেয়ে অনুজ্বল সময়কাল ।
১৯৭১এ ‘গরিবী হটাও’ স্লোগান দিয়ে বিপুল ভোটে ক্ষমতায় এসেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী । ক্ষমতায় আসার পর সমস্ত রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ঝোঁক প্রবল হয় । তাঁর স্তাবকতার অনন্য নমুনা পেশ করে তখনকার কংগ্রেস সভাপতি দেবকান্ত বড়ুয়া বলেছিলেন ‘ইন্দিরা দ্যাট ইস ইন্ডিয়া’ । ১৯৭৩ থেকে ইন্দিরা গান্ধীর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত সংগঠিত হতে থাকে, সাংবিধানিক ভাবে যার মোকাবিলা করা ইন্দিরার পক্ষে সম্ভব ছিল না । গুজরাটে ছাত্রদের ‘নবনির্মাণ আন্দোলন’ দিয়ে শুরু । ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এক নতুন চেহারা পেলো সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে এপ্রিল চুয়াত্তরে । পরের মাসে ৮ই মে ১৯৭৪এ ২২দিন দেশব্যাপি ঐতিহাসিক রেল ধর্মঘট । হাজার হাজার কর্মচারী গ্রেপ্তার, দৈহিক নির্যাতন, চাকুরী থেকে বরখাস্ত । এই উত্তাল রাজনৈতিক আবহে এলাহাবাদ হাইকোর্ট নির্বাচনে সরকারী ক্ষমতার অপব্যবহারের অভযোগে ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচন বাতিল করে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করলো এবং ছয় বছরের জন্য তাঁর নির্বাচনে দাঁড়াবার অধিকার খর্ব করে দিল । ইন্দিরা সুপ্রিম কোর্টে এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় চ্যালেঞ্জ করলেন, আর এই অবসরে সংসদের মেয়াদ দু বছর বাড়িয়ে নিলেন । সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ভি আর কৃষ্ণ আয়ার ২৪শে জুন তাঁর রায়ে, এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়কেই বহাল রাখলেন । পরদিন ২৫শে জুন মধ্যরাত্রে ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘর ছোঁয়ার কয়েক মিনিট আগে রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দীন আলিকে দিয়ে সই করালেন জরুরী অবস্থার ঘোষণা । বিয়াল্লিশ বছর পরেও সেই কৃষ্ণ-প্রহরকে ভোলা সম্ভব নয় । আমিও যে সেই মসিকৃষ্ণ একুশ মাসের শিকার ছিলাম ! কেমন ছিল সেই একুশ মাসের কৃষ্ণপ্রহর ? নিজের অভিজ্ঞতার আলোতেই লিখছি সেদিনের বৃত্তান্ত ।
সমস্ত রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ হলো, বিরোধী সব রাজনৈতিক নেতাদের কারান্তরালে পাঠালেন ভারত রক্ষা আইন, আভ্যন্তরীন নিরাপত্তা আইন বা সংক্ষেপে ‘মিসা’য়, বিনা পরোয়ানায়, বিনা বিচারে বিরোধীদের কারান্তরালে পাঠানোর অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হলো পুলিশকে । মত প্রকাশের অধিকার, সংবাদ প্রকাশের অধিকার, বিচার প্রার্থনার মৌলিক অধিকার লোপ করা হলো, সংবাদ পত্র সহ পত্র-পত্রিকায় সেন্সর বিধি লাগু করা হলো । পরের দিন সমস্ত সংবাদপত্র প্রকাশিত হল তাদের সম্পাদকীয় স্তম্ভ ঘন কালো বর্ডার ঘেরা একটিও অক্ষর না লিখে । আমার মত অর্বাচিনেরও নির্বিষ একটা লেখা সেন্সরের ছাড়পত্র পেলো না । একটা ছোট পত্রিকার জন্য, সুকান্ত ভট্টাচার্যকে নিয়ে লেখা লাল কালিতে ‘নট গ্রান্টেড’ লেখা পান্ডুলিপিটি আজও আমার সংগ্রহে আছে । পাড়ায় পাড়ায় ইতিহাসে পড়া ‘গেস্টাপো বাহিনী’র মত হামলা অন্য মতের প্রতি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা । আর ছিল গ্রেপ্তারি আর খুন । নাটকের মঞ্চে হামলা, নাট্যকর্মী খুন – সে এক বৃহন্নলা সময় – আমাদের কন্ঠনালী তাক করা বন্দুকের নল ।
দিনটা ছিল ২৭শে জুন ১৯৭৫ । কারো মুখ থেকে শুনলাম আগের দিন গভীর রাতে নাকি ইমার্জেন্সি ঘোষণা করা হয়েছে । আমল দিইনি, হয়েছে তো হয়েছে, ১৯৬২তে চিন-ভারত সীমান্ত যুদ্ধের সময়ওতো ইমার্জেন্সি জারি করা হয়েছিল শুনেছি । ভেবেছিলাম সেইরকমই কিছু হবে । চাকরী না থাকলেও প্রতি দিনের মত সেদিনও অফিসের ক্যানটিনে আমাদের চাকরীহীন কয়েকজনের চাএর আড্ডা চলছিল । আর্থার হাইড নামে একজন নামি হকি কেলোয়াড় ছিল । গুন্ডামি করতো, জুয়ার তোলাবাজি করতো, কিন্তু আমাদের খুব ভালোবাসতো । হাইডকে থানায় নিয়ে গিয়েছিল । ওখান থেকেই ওর কোন চেলাকে দিয়ে আমাদের খবর পাঠিয়েছিল ‘ভাগো, ‘মিসা’ যা রহা হায়’ ইতিমধ্যে খবরের কাগজে আগের দিন রাত্রে লোকসভার প্রায় সব বিরোধী নেতাদের গ্রেফতারের খবর জেনেছি । ‘মিসা’ বা ‘মেইনটেন্যান্স অফ ইনটারনাল সিকিউরিটি এক্ট’এর মহিমার কথাও জেনে গিয়েছিলাম । আমরা তিনজন ছিলাম ‘হিট লিষ্ট’। যে যার ছিটকে গেলাম ।
নিজের কোয়ার্টারেতো থাকা যাবে না, এক সহকর্মীর কোয়ার্টারে একটা ঘরে বাইরে থেকে তালাবন্ধ অবস্থায় থাকলাম দুটোদিন । কলোনির শুকনো রাস্তায় ধুলো ওড়ানো পুলিশ জীপের হন্যেদৌড় । আমার কোয়ার্টারে পুলিশ পরোয়ানা সেঁটে দিয়েছিল আর অফিসে জানিয়ে দিয়েছিল ‘সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হ’ল’ বলে । তখন আমার সম্পত্তি বলতে ছিল তো প্রভিডেন্ড ফান্ডে পড়ে থাকা শ’ আড়াই টাকা ! পরে সেই পরোয়ানার কপি আদালত থেকে তুলেছিলাম, লেখাছিল ‘দেশ বিরোধী নাটক করি, আর রেলওয়ে মার্কেটটা নাকি জ্বালিয়ে দেবার ছক কষেছিলাম’ । বোঝ কান্ড ! সেই পরোয়ানার কপিটা এখনো আমার কাছে আছে ।
বন্ধুরা বাইরে বিকল্প রাস্তা খুজছিলেন আমাদের পালানোর ব্যবস্থা করার । পরদিন দুপুরে লুঙ্গি পরে মাথায় একটা গামছা জড়িয়ে গ্রামীণ রাস্তা ধরে টাঙ্গা করে একটু দূরের একটা স্টেশন থেকে একটা মালগাড়িতে গার্ডের সঙ্গে টাটানগর পৌছালাম । সেখান থেকে প্যাসেঞ্জার ট্রেনে কলকাতা । কলকাতা তো এলাম থাকবো কোথায় ? নিজের বাড়ি যাওয়া চলবে না । বন্ধুরা খিদিরপুরের একটা মেস’এ একবন্ধুর অতিথি হয়ে শোয়ার ব্যবস্থা করল । খাওয়া, বাবু বাজারের একটা হোটেলে । খিদিরপুরের মেস’এ নানা সন্দেহের চোখ, কোথায় থাকতাম, এখানে থাকছি কেন এই সব । তিনদিন পরে অন্য ব্যবস্থা হল বেহালায় ইস্টার্ণ রেলের চাকরি যাওয়া এক সহকর্মীর নির্মীয়মান বাড়ির একটা ঘরে শোয়া আর অন্য এক (এখন প্রয়াত) বন্ধুর বাড়িতে খাওয়া । সে তখন চাকরি হারিয়ে ফুটপাথে জামা কাপড় বিক্রি করতো । ফাঁকা বাড়িতে একাএকা থাকা নিরাপদ ছিল না । পরের দিন থেকে বন্ধুর বাড়িতেই থাকারও ব্যবস্থা হ’ল । রোজ বিকালে কার্জন পার্কে এসে মিলতাম । রোজই কেউনা কেউ বিলাসপুর থেকে আসত । দেখা হ’ত, খবরের আদান-প্রদান হ’ত । দিনপনেরো এইভাবে চললো । জানতে পারলাম মধ্য প্রদেশের ‘মিসা’ কলকাতায় প্রযোজ্য নয় । আড়িয়াদহে বাড়ি ফিরে গেলাম ।
অন্ধকার চিরন্তন হয় না, সেই কৃষ্ণ-প্রহরও হয়নি । ১৯৭৭এর ২১শে মার্চ জরুরি অবস্থার প্রত্যাহারে মানুষ তার সাংবিধানিক অধিকার ফিরে পেয়েছিল । এখন যাদের বয়স পঞ্চাশ ছুঁয়েছে কিংবা প্রৌঢ়ত্বের সীমা ছুঁয়েছেন, তাদের কাছে সত্তর দশকের দশকের সেই দিনগুলির কথা অজানা । জীবনের উপান্তে পৌছে, সত্তর দশকের উত্তাল সময়ের তাপে নিজেকে পরিশুদ্ধ হওয়ার কিছু বৃত্তান্ত লিখে রাখলাম তাদের জন্য, দুটি পর্বে । আর ক’বছর পরে সেইসব কথা লেখার জন্য ক’জনই বেঁচে থাকবেন !