সত্তর : ‘সোনার টুকরো ছেলেরা সব অশ্বমেধের বলি’
ফিরে দেখা সময়ের দর্পনে আমার দেখা ষাট দশকের কথা লিখেছিলাম । শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পঞ্চাশ আর ষাটের দশকটা ছিল সৃজনের দশক । আবার এই সৃষ্টিপ্রাচুর্যের মধ্যে ষাট দশকের অন্তিমপর্বে ফুটে উঠলো সামাজিক অস্থিরতার লক্ষণ । ক্রমে সামাজিক অস্থিরতার তীব্রতা পরের সত্তর দশকটাকে করে দিয়েছিল মৃত্যুর দশক।সেই সামাজিক অস্থিরতা, সেই মৃত্যুর দশককে যেমন দেখেছি, যেমন স্পর্শ করেছিল আমাকে সেই আগুনে সময়, তার কথা এই পর্বে । সত্তর থেকে আশি নয়, ৬৭ থেকে সাতাত্তর ছিল সেই আগুনে সময় । সেইসব কথাই এই পর্বে ।
কবি বিমলচন্দ্র ঘোষের কবিতার কয়েকটি পংক্তিই সেই আগুনে সময়ের সত্যচিত্র –
স্কুল-কলেজে খিল, রাস্তায় মিছিল
ক্র্যাকারে কাঁপে রাজপথ । কিনু গোয়ালার গলি
সোনার টুকরো ছেলেরা সব অশ্বমেধের বলি ।
বারুদগন্ধ বুকে নিয়ে আকাশে ফোটে জোছনা
ময়লা হাতে ওকে তোরা ছুঁস না ।
ওরে মন , পৃথিবীর গভীর, গভীরতর অসুখ এখন ।
সত্তরের সেই তোলপাড় আগুনে সময়ের স্ফুলিঙ্গটা জ্বলেছিল তিনবছর আগে ১৯৬৭র ২৫শে মে ।
কুড়ি বছরের কংগ্রেসি শাসনের অবসান ঘটিয়ে কলকাতার মহাকরণে সবে বসেছে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার ২৫শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৭ তারিখে । ১৫ই মার্চ শপথ গ্রহণ করার পর ঘোষিত হয় ১৮দফা কর্মসূচি, যার একটি ছিল ভুমিসংস্কার কর্মসূচি । প্রাক্তন কংগ্রেসি অজয় মুখার্জী মুখ্যমন্ত্রী ও কম্যুনিস্ট নেতা জ্যোতি বসু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আর ভুমি রাজস্ব মন্ত্রী হরেকৃষ্ণ কোঙার ।
৯ই মে কৃষক সমিতির নেতৃত্বে আদিবাসী কৃষকরা সন্ন্যাসীস্থান নামে এক চা বাগান মালিকের দখলে থাকা জমির পুনরুদ্ধারের জন্য ঝাঁপায় । এই ঘটনার পর ভূমিহীন কৃষক, বর্গাদার, ক্ষেতমজুররা বৃহত্তর লড়াইএর প্রস্তুতি শুরু করে । কলকাতা থেকে ভূমি রাজস্ব মন্ত্রী হরেকৃষ্ণ কোঙার শিলিগুড়িতে আসেন, বৈঠক করেন কৃষকনেতা কানুসান্যাল ও চা বাগান মালিকদের সঙ্গে । শান্তিবৈঠক ফলপ্রসু হয় না । জোতদারদের বেআইনি জমি উদ্ধার, তাদের বাড়িতে হামলা সংগঠিত হতে থাকে । ২৪শে মে কৃষক-সভার ডাকে ভূমিহীন কৃষক ও ক্ষেতমজুররা প্রভাবশালী স্থানীয় জোতদার ঈশ্বর তিরকের জমি দখলের অভিযান চালায়, ঘেরাও করে রাখে তিরকের বাড়ি । তিরকেকে উদ্ধার করতে আসে বিশাল পুলিশ বাহিনী । পুলিশ আসার খবর পেয়ে আসে-পাশের গ্রামের আদিবাসী কৃষকরাও চলে আসেন । উত্তেজিত কৃষকরা গোটা বাহিনীকেই ঘেরাও করে রাখে । উত্তেজিত কৃষকদের দিক থেকে একটি তী্র এসে বিদ্ধ করে পুলিশ বাহিনীর ইনসপেক্টর সোনাম ওয়াংদিকে । ভূমিহীন কৃষকদের সসস্ত্র প্রতিরোধে পুলিশ পিছু হটতে বাধ্য হয় ।
পরের দিন ২৫শে মে, ওয়াংদির মৃত্যু হয় । আর সেইদিনই নকশালবাড়ি বাজারের কাছে আদিবাসী কৃষক রমণীদের এক জমায়েত আয়োজিত হয়েছিল । ঐ সভাকে ছত্রভঙ্গ করতে কোন প্ররোচনা ছাড়াই পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালায় । পুলিশের গুলিতে প্রথমে লুটিয়ে পড়েন ঐ সভার প্রধান উদ্যোক্তা পিঠে আটমাসের শিশুসন্তান সহ সোনামতি সিং । শিশুসন্তানটিও নিহত হয় একই গুলিতে । নিহত হয় সাতজন আদিবাসী রমণী ও দুই শিশু সহ মোট ১১জন । জমায়েত ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় । ১৯৪৬এর তেভাগা আন্দোলনে কাকদ্বীপের শহিদ কৃষক রমণীর রক্ত আর উত্তরবঙ্গের প্রান্তিক গ্রাম নকশালবাড়ির প্রসাত জোতের মাটিতে নিহত এগারো শহিদের রক্ত যেন একাকার হয়ে গেলো, তৈরি হল এক রক্তাক্ত ইতিহাস ।
২৫শে মে ৬৭র সেই স্ফুলিঙ্গ দাবানল হয়ে গেলো । ওরা বললো ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’ । তারপর উথাল-পাথাল একটা দশক । তোলপাড় সত্তর দশক । চারু মজুমদার, কানু সান্যালদের ডাকে হাজার হাজার তরুণ সকলেই কলকাতার প্রথম শ্রেণির কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি পড়ুয়া, ঝাঁপিয়ে পড়লো, ওরা আকাশে তুললো ঝড় । ইতিহাসের সেইসব বৃত্তান্ত আমি দেবো না । কি আশা করেছিলাম,কি পেলাম সেকথাও না হয় থাক । চিনের কম্যুনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘পিপলস ডেইলি’ কেন সাতসট্টির সেই স্ফুলিঙ্গকে বলেছিল ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’, কতটা হঠকারী ছিল সেই ঘোষণা সে বিতর্কেও আমি ঢুকবো না । আমি শুধু ফিরে দেখতে চাইছি, যে সত্তরের মুক্তির দশক হওয়ার কথা ছিল তা হয়ে গেল মৃত্যুর দশকে ।
বাংলায় সত্তর এসেছিল এক তীব্র ও অভুতপূর্ব সামাজিক অস্থিরতা ও রাজনৈতিক সংকট ও অস্থিরতার পথ ধরে । ফেব্রুয়ারি ১৯৬৭তে কুড়ি বছরের কংগ্রেসী শাসনের অবসান ঘটিয়ে কলকাতার মহাকরণে ক্ষমতায় এসেছিল প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার । ১৩মাস স্থায়ী সেই সরকারকে খারিজ করে দিল কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার । প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষকে মুখ্যমন্ত্রী করে একটি সংখ্যালঘু সরকার ক্ষমতায় আসে বটে, কিন্তু মাত্র নব্বই দিনের মধ্যে সেই সরকারেরও পতন হয় । অভুতপূর্ব সাংবিধানিক সংকটে জারি হয় রাষ্ট্রপতি শাসন । ১৯৬৯এর নির্বাচনে আবার ক্ষমতায় আসে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার । কিন্তু সতেরো মাস পরে সেই সরকারও ভেঙ্গে যায়, জারি হয় দ্বিতীয়বারের রাষ্ট্রপতি শাসন । এই তীব্র সামাজিক অস্থিরতা ও রাজনৈতিক সংকটের পথ বেয়ে এসেছিল ‘সত্তর’ । ১৯৭০এর দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয় । এই সময় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় (১) নকশাল দমনে পুলিশকে তাদের যেমন খুশি পদ্ধতি নেওয়ার ছাড় দেওয়া হয় অর্থাৎ খুন করারও অবাধ অধিকার (২) পুলিশের গুলি চালনার ক্ষেত্রে আবশ্যিক প্রশাসনিক তদন্ত হবে না (৩) নকশাল দমনের দায়িত্ব চলে যায় ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের হাতে যাদের কাজ রাজনৈতিক কর্মকান্ড মোকাবিলা নয়, যাদের কাজ অপরাধী দমন । অর্থাৎ নকশালরা চিহ্নিত হ’ল সমাজবিরোধী হিসাবে । সীমাহীন ক্রুরতায় শুরু হয়েছিল পুলিশ আর তাদের পোষা, চিহ্নিত দুস্কৃতিদের নিয়ে গড়া প্রতিরোধ বাহিনীর ‘নকশাল সাফাই’ অভিযান । পুরো সত্তর সালটা জুড়ে চলেছিল পুলিশ আর তার পোষা সাহায্যকারী বাহিনীর নকশাল সাফাই বন্দোবস্ত । কলকাতার রাস্তায়, গলিতে তাজা তরুণের রক্তভেজা লাশ ডিঙিয়ে হাঁটা-চলা ছিল নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা । এমন একটা দিন ছিলনা যেদিন কোথাও না কোথাও পুলিশের গুলিতে খুন হওয়া তরুণের লাশ পড়ে থাকতো না । গোপন ডেরা থেকে তুলে এনে কিংবা গভীর রাতে বাড়ি থেকে টেনে এনে রাস্তায় দেওয়ালের সামনে দাঁড় করিয়ে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিত তাদের বুক । গ্রেফতার করে ‘যা তোদের ছেড়ে দিলাম বলে, খানিকটা গেলেই ঝাঁকে ঝাঁকে পুলিশের গুলি ছুটে আসতো । প্রতিটি খুনের পেছনেই একটা গল্প সাজাতো পুলিশ এনকাউন্টার বা পুলিশের সঙ্গে সঙ্ঘর্ষে মৃত্যু’র গল্প । যেমন জেলখানায় ঠান্ডা মাথায় নকশাল বন্দীদের হত্যার পরে ‘জেল পালানোর চেষ্টা’র গল্প সাজানো হত ।
সত্তরের এক সকাল শিউরে উঠেছিল, দেখেছিল চটের বস্তায় ভরা, দুটি হাত পিছমোড়া করে বাঁধা আটটি তরুণের লাশ ছড়ানো ছিটানো বারাসাতের রাজপথে । ময়দানে এক গোপন সভা থেকে ধরে এক এক করে খুন করে, চটের বস্তায় ভরে বারাসাতের রাস্তায় ছড়িয়ে দিয়েছিল লাশগুলি পুলিশের সাহায্যকারী বাহিনী । লাশগুলি ছিল আমার খুব কাছ থেকে দেখা আড়িয়াদহ অঞ্চলের আট তরুণের ।
রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হওয়ার ছয় সপ্তাহের মধ্যে ১২ই অগস্ট ১৯৭১ প্রজাতন্ত্রী ভারতের ক্রুরতম গণহত্যার ঘটনাটি ঘটে বা ঘটানো হয় । কাশীপুর বরানগরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে তুলে দেওয়া হয় বাহুবলী-দুস্কৃতিদের দিয়ে গড়া সসস্ত্র প্রতিরোধ বাহিনীর (রেজিসস্টান্স গ্রুপ) দখলে । ১২ ঘন্টা ধরে চলেছিল সেই তান্ডব । পুলিশ আসেনি বা সাদা পোষাকে ছিল । ১৮-২৫ বয়ঃক্রমের তরুণদের বাড়ি থেকে টেনে এনে খুন করেছিল তারা । কত জন শিকার হয়েছিল এই গণহত্যায় ? প্রকৃত সংখ্যা জানা যায়নি, যাবেও না কোনদিন । সংখ্যাটা ছিল ১৫০ থেকে ২০০ । এর থেকে বেশিও হতে পারে । পঞ্চাশ বছর পরে সেই বিভৎসতম গণহত্যাকে বর্ণনা করার ভাষা আমার আয়ত্বে নেই । আমি ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১এর ‘ফ্রন্টিয়ার’ পত্রিকার প্রতিবেদনের একাংশ উদ্ধার করছি । “হোয়াট মার্কডআউট কাশীপুর-বরানগর ফ্রম দি রেস্ট ওয়াস ইটস ব্রুটালিটি আন্ড এনর্মিটি । ইট ওয়াস এ ব্লাডি, স্যাডিস্টিক সেটলিং অফ একাউন্টস । এ করেসপন্ডেন্স রিপোর্টেড ডেড বডিস ওয়ের এভরিহোয়ার – বডিস উইথ হেডস কাটঅফ,লিম্বস লস্ট, আইস গাজড আউট, এনট্রেইলস রিপড ওপেন । দে ওয়ের দেয়ার ইন দি স্ট্রীটস ইন দি ব্রড ডে লাইট । লেটার দে ওয়ার ক্যারেড ইন রিক্সাস এন্ড হ্যান্ডকার্টস এন্ড থ্রোন ইনটু দি হুগলী রিভার” ।
মৃত্যু আর মৃত্যু ! গুপ্ত হত্যা, রাজপথে দাঁড় করিয়ে খুন, জেলখানায় দলবদ্ধ বন্দী-হত্যা । – হত্যা আর হত্যা ছিল সত্তর - একাত্তরের চেনা ছবি । কত তরতাজা প্রাণের হত্যা হয়েছিল তার কিছু পরিসংখ্যান হয়তো পাওয়া যাবে সেই সময়ের সংবাদপত্র প্রতিবেদনে । বেশিটাই পাওয়া যাবে না । সময়কে ফিরে দেখতে চেয়ে সেই সময়টাকে সামান্যই ছুঁয়ে গেলাম । যে রাজনৈতিক আদর্শকে আঁকড়ে ধরে আত্মদানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তারা, তারসঙ্গে আমার বিশ্বাসের মিল ছিল না সত্য । হয়তো হঠকারিতা ছিল, রাষ্ট্রশক্তির ক্ষমতার মূল্যায়নে ভুল ছিল । কিন্তু, একটা বৈপ্লবিক আদর্শে তারা দিক্ষিত ছিল, একটা অন্যরকম সামাজিক বন্দোবস্তের স্বপ্ন তারা দেখেছিল, আমাদের দেখিয়েছিল তাতে তো কোন মিথ্যা নেই !
আজ পঞ্চাশ বছর পরে জীবনের উপান্তে পৌছে, সেই আগুনে সময়টাকে ফিরে দেখতে গিয়ে নিজের হৃদয়খোঁড়া বেদনাটুকুকেও জাগিয়ে তুলি । হাজারিবাগ সেন্ট্রাল জেলে ১৯৭১এর ২৫শে জুলাই ১৬জন নকশাল বন্দীকে হত্যা করা হয়েছিল, যাদের একজন ছিল আমারই সহোদর, কবি মুরারী মুখোপাধ্যায় । তারা ছিল ডেবরা-গোপীবল্লভপুরের নকশাল স্কোয়াডের সদস্য । বিহার-বাংলা সীমান্তে ধরা পড়ায় তাদের রাখা হয়েছিল চাইবাসা, টাটা হয়ে হাজারিবাগ সেন্ট্রাল জেলে । রেডিওতে প্রচারিত সংঘর্ষের সংবাদ শুনে পরের দিন আমি হাজারিবাগ জেল ও জেল হাসপাতালে গিয়েছিলাম ভাইয়ের মৃতদেহ খুঁজতে । পাইনি । কারান্তরালে তার লেখার খাতাটাও পাইনি । বাড়িতে একটা টেলিগ্রাম পেয়েছিলাম । জেল ভেঙে পালাতে গিয়ে কারা রক্ষীদের সঙ্গে সংঘর্ষে নাকি মৃত্যু হয়েছে ।
১৯৭১ সালের মধ্যেই সরকার নকশাল সাফাই অভিযান শেষ করে ফেলেছিল । কিন্তু সামাজিক, রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান হয়নি, শেষ হয়নি মৃত্যুর মিছিল । তারপর তীব্র রাজনৈতিক অস্থিরতা আর ভারতজোড়া প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার পথ বেয়ে জুন পঁচাত্তরে এসেছিল একুশ মাসের কৃষ্ণপ্রহর জরুরি অবস্থা । সে কথা পরের পর্বে ।