কমলাকান্তপুরের মেলা রাত বাড়ার সাথে সাথে জমে উঠছে। আলকাপের গান হচ্ছে, ঢাক -ঢোল কাসঁরের বাজনায় মুখরিত চারপাশ। সোনার চোখের সামনে মৃত মায়ের মুখটা ভেসে উঠে। মায়ের কথা মনে করে ডুকরে কেঁদে উঠল।
শুক্রবার, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৬
আব্দুল আজিজ
sobdermichil | সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৬ |
অণুগল্প
| মিছিলে স্বাগত
ছেলেটি আলকাপ গানের দলে নতুন এসেছে। নাম শংকরী। দল প্রধান ইদ্রিস সরকার ছেলেটির নতুন নাম দিয়েছে। শংকরীর পুরাতন নাম সোনা মিয়া, দল প্রধানের কড়া বারন শংকরীকে যেন পুরাতন নাম ধরে না ডাকা হয়। ছেলেটিকে ইদ্রিস সরকারই জুটিয়েছে, গত পৌষের মেলায় কমলাকান্তপুরে। শংকরীর নাম তখন সোনা মিয়া তার বাপ বিয়ে করেছে তার মা মারা যাওয়ার পর। সৎ মার সংসারে সোনা বোঝা, মদ গিলে তার বাপ জালু মিয়া রাতে আসলে ইনিয়েবিনিয়ে মিথ্যা কথা বলে নিত্য সোনাকে মার খাওয়াত সে।
কমলাকান্তপুর বাজারে সোনার বাপের ছোট একটি পানের দোকান ছিল। ছেলেকে দোকানে বসিয়ে পান বিক্রি করার তালিম দিত, স্কুল যাওয়া বন্ধ। সোনা মুখে পান গুঁজে ঠোট রাঙিয়ে দোকানের সামনে ঘুরে ঘুরে নাচত, তখন তার বয়স মাত্র দশ বছর।
সোনার মধ্যে মেয়েলী ভাব ছিল, মেয়েদের মত কানে নকল দুল পড়ত লুকিয়ে, গামছা দিয়ে মাথায় ঘোমটা দিত আর ঘুরে ঘুরে নাচত। তার মা মারা গেল, বাপের ব্যবসায় দিল ভাঙ্গন। সোনার মেয়েলীপনার অশুভ ছায়া পড়েছে এমন গুজবে সোনা হল তার বাপের চোখে ঘৃনিত।
একদিন পৌষের রাতে হঠাৎ জালু মিয়া মাতাল হয়ে বাড়ির বারান্দায় এসে পড়ে গেল, চক্ষু লাল। হেসেঁল থেকে কাঠের লাকড়ি এনে বেদম পিটিয়ে সোনাকে বাড়ি ছাড়া করল। সোনা কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায় ...
কমলাকান্তপুরের মেলা রাত বাড়ার সাথে সাথে জমে উঠছে। আলকাপের গান হচ্ছে, ঢাক -ঢোল কাসঁরের বাজনায় মুখরিত চারপাশ। সোনার চোখের সামনে মৃত মায়ের মুখটা ভেসে উঠে। মায়ের কথা মনে করে ডুকরে কেঁদে উঠল।
কমলাকান্তপুরের মেলা রাত বাড়ার সাথে সাথে জমে উঠছে। আলকাপের গান হচ্ছে, ঢাক -ঢোল কাসঁরের বাজনায় মুখরিত চারপাশ। সোনার চোখের সামনে মৃত মায়ের মুখটা ভেসে উঠে। মায়ের কথা মনে করে ডুকরে কেঁদে উঠল।
আজ আলকাপ গানের শেষ দিন, শেষ দিনে জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে আলকাপ গানের ইতি টানা হয়। মেলা আছে আর মাত্র তিন দিন। আলকাপ গানের আসরে আজ অনেক ভীড়। ভীড় ঠেলে সোনা আলকাপ গান দেখে। আলকাপ গানের রসিক পর্ব জমে উঠেছে। একটি মেয়ে যার নাম কুসুমকলি বেশ কোমড় দুলিয়ে নাচছে। রঙিন বাতি জ্বলছে। কুসুমকলি তার রসের নাগরকে উদ্দেশ্য করে গান ধরে -
ঐ হামার কালাচান
ধরফর করে হামার প্রাণ
কত কান্দি তোমার লাগি
ব্যান্ধ্যাছি একখান গান।।
দ্বিতীয় দলের রসের নাগর কুসুমকলি কলিকে এবার উদ্দেশ্য করে বলে -
কত দেখনু হামি নারী
নরের লাগি ধরফরাই
তোর মত কুসুম মাগি
কত আছে এ ধরায়।।
তোর কান্দায় ধান্দা আছে
বুঝি হামি বুঝিরে
প্রেমের ছলে খেলিস খেলা
যৌবন তোর আর নাইরে----।।
হো হো শব্দ করে মাতাল সব মাটিয়ে গড়িয়ে পড়ে।
কেউ কুসুমকলির দলে, কেউ রসের নাগরের দলে। মাটিয়ে খড় বিছিয়ে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সারা রাত ধরে চলল আলকাপ দলের গান। দুরের একটি মসজিদ থেকে ফজরের আজান শোনা যাচ্ছে। আকাশে তারা জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। শেষ প্রহরে শীত আরো জেকে বসেছে। আলকাপ গানের মঞ্চের পাশে ছোট ছোট দুটি চাটায়ের ঘর করা হয়েছে, সেখানে আলকাপ গানের সদস্যরা থাকে। একটি ঘরে দলপ্রধান ইদ্রিস সরকার থাকে ও বাকিরা আরেকটি ঘরে শীতের দিন জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকে। দলপ্রধানের ঘরে সকলবাদ্য যন্ত্র রাখা হয়।
আর একজন একটি মেয়ে গোলাপি দল প্রধানের ঘরে থাকে, গোলাপি দলপ্রধানের নাগর, তাদের নাকি নিকা হয়েছে এ কথা আলকাপ দলের সদস্যরা বলাবলি করে।
কুসুমকলি খুব ভোরে উঠে কয়লা দিয়ে দাঁত মাজছে। মুখে মেকাপ লাগানোই আছে, পরনে লুঙ্গি ও গেঞ্জি। কুসুমকলি একটি ছেলে আলকাপ গানের দলের ছোকরা। চেহারা অবিকল মেয়েদের মত গঠন পাতলা ছিমছাম। গায়ের রং হালকা ফর্সা। বয়স একুশ কি বাইশ এর মত হবে।দাঁত মাজতে মাজতে কুসুমকলি মাতালদের পাশে দাড়িয়ে কি যেন বিড়বিড় করে বলল। পেছনে আসতেই সোনার সাথে ধাক্কা খেল সে। বলল কোন মাতাল রে হামার পার তলে পইড়া মরে।
ওমা এ যে কচি ছেলে ছোড়া গো।
এই কুসুমকলি ছেলে হয়েও মেয়েত্ব টা বেশ আয়ত্ত করেছে। আলকাপ গানের মুল উপাদান হল ছেলেরা মেয়ে ছোকরা সেজে মান অভিমানে সমাজের ভাল মন্দ দিক গুলো হাসি রসের মধ্য দিয়ে তুলে ধরবে।
কি রং ছোড়াটার রাজপুত্তুরের মত চেহারা কুসুমকলি বলল। একে একে মাতালের পরিবার থেকে মাতাল গুলোকে নিয়ে যেতে লাগল। সোনাকে নেওয়ার জন্য এখন পর্যন্ত কেউ আসেনি। সোনার বাপ মাতাল হয়ে ঘুমুচ্ছে, আর সৎ মা তাকে বিদেয় করে নিশ্চিত হয়েছে।
সোনার ঘুম ভাংগে ভোর বেলাতেই, তখন পর্যন্ত সবার গোসল হয়ে গেছে, রান্না চলছে সবজি খিচুড়ি খুশবু ছুটছে। সোনাকে ঘীরে বসেছে আলকাপ দলের সকল সদস্যরা, একটু পরে দলপ্রধান ইদ্রিস সরকার আসে। সোনা নিচ দিকে মুখ করে বসে আছে, খিদে পেয়েছে তার কাল দুপুরের খাওয়াতে আছে, তারপর থেকে খাওয়া হয়নি। ভাত খায়নি মার খেয়েছে।
-তা ছোড়া তোর নাম কি?
- সোনা মিয়া।
- বাড়ি?
- কমলাকান্তপুর।
- সারারাত আলকাপের গান দেখেছিস? বাড়ি যাসনি?
- না যাইনি। আলকাপ হামার ভাল লাগে। আর কোন দিন বাড়ি যাবনা।
- কেনে রে?
- হাকে হার বাপ ধইরা মারে, হার লাইগ্যা নাকি হার মা মইরাছে বাপের ব্যবসা নষ্ট হয়াছে। বাড়িতে সৎ মা হামি নাকি অশুভ মেয়েলীপনা ছেলেদের ভিতরে নাকি অশুভ জ্বিন থাকে। তারা অমঙ্গল ডাইক্যা আনে। বলে সোনা কাঁদতে লাগল।
দলপ্রধান বলল আরে কান্দিস ন্যা। একনজর সোনার দিকে তাকিয়ে বলল।
হ্যা ছোড়াটা হার পসন্দ হয়াছে একে বারে শিবের বহু শংকরীর মত রং ঢং চেহারা সুরত।আলকাপে কাম করবি?
একবাক্যে সোনা উত্তর দিল হ্যাঁ করব। আমি ছোড়াটাকে দলে লিতে চাহাছি তোমরা কি কহো -
সবাই সোনার কষ্টের কথা শুনে বলল হ্যাঁ এ ছোড়া থাকুক দলে। সোনাকে দলপ্রধান বলল আজ থেকে তোর নাম শংকরী সোনা মিয়া না। সোনাকে দলপ্রধানের বেশ পছন্দ হয়েছে এ ছোড়া তার দলের নাম করবে তার পূর্ন বিশ্বাস। সোনাকে শিখিয়ে পড়িয়ে আলকাপ গানের ছোকরা শংকরী করে তোলার দায়িত্ব নিজেই নিয়েছে দলপ্রধান ইদ্রিস সরকার। সামনে তার সুদিন।
সেদিন বিকেলে কমলাকান্তপুর ছেড়ে আলকাপ গানের দল চলল অন্য নতুন এক গন্তব্যস্থানে। গরুরগাড়ী চলছে সেই পথের দিকে, সূর্য অস্তমিত হয়েছে আবছা অন্ধকারে কমলাকান্তপুরের গাছ গুলো দেখা যাচ্ছে। অন্ধকারে শংকরীর চোখের জলে ধুয়ে যাচ্ছে সোনা মিয়ার পুরাতন স্মৃতির সকল অস্তিত্ব।

