সোমবার, আগস্ট ১৫, ২০১৬
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
সম্পাদক প্রিয়দীপ’এর আবদার বা নির্দেশ যাই বলি, এসেছে যে ‘শব্দের মিছিল’এ নিয়মিত কলম লিখতে হবে । আজব আবদার ! সংবাদ বা সাময়িকপত্রে কলম লেখার চল আছে বটে, কিন্তু আমি তো তেমন কেউকেটা নই ! প্রচুর গদ্য লিখে চলেছি, কিন্তু একটাও বই ছাপাইনি, মানে ছাপানোর জন্য দৌড়ঝাপ করিনি । এহেন উটকো গদ্য-লিখিয়ের কাছে নিয়মিত, মানে মাসে একবার কলম লিখতে হবে । তো যাইহোক, সুযোগ যখন এসেছে, নিয়েই নিলাম । ভণিতা সরিয়ে রেখে বরং শুরু করি । শুরু করি নিজের কথা দিয়ে । বলছি নিজের কথা বটে, কিন্তু সেই কথায় জড়িয়ে আছে সময়ের কথা । বলা ভালো, সময়কে ফিরে দেখা । ৭৫ বছর সময়টা তো কম নয় !
ফিরে দেখা সময়
জন্মেছিলাম ১৯৪২এর মার্চ’এ । মানে স্বাধীনতার দিন আমার বয়স ছিল পাঁচ বছর পাঁচ মাস এগারো দিন । স্বাধীনতার দিনটার কথা হালকা মনে আছে, কেননা আর কয়েকমাস পরেই স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। পরের বছর গান্ধীজির মৃত্যুদিনের কথাও একটু একটু মনে আছে । আর মনে আছে – কি করে মনে আছে কে জানে, যুদ্ধজনিত কারণে দোকানে চাল ডাল অমিলের কথা । বাবার কোলে চেপে রেশনের দোকানে অনেকক্ষণ ধরে লাইনে দাঁড়ানোর কথাও খুব হালকা করে মনে পড়ে । তেতাল্লিশের মন্বন্তরের সময় আমার বয়স একবছর মাত্র । ঐ বয়সের স্মৃতি মনে থাকার কথা নয় । তবে তেতাল্লিশের পরেই সব ঠিক হয়ে গেল এমন তো নয় । আকালের স্মৃতি হালকা হলেও মনে থেকে গেছে । খুব প্লেনের আওয়াজ শুনে ভয় পেতাম, মনে হতো এরোপ্লেনগুলো খুব নীচু দিয়ে যাচ্ছে । যুদ্ধ থেমে গেলেও এরোপ্লেনের আনাগোনা, সেনাদের প্যারেড এইসব ছিলই । প্লেন অবশ্য খুব কাছ থেকেই দেখেছি । আমাদের আড়িয়াদহের বাসা থেকে দক্ষিণেশ্বরে যাবার পথে একটা মিলিটারি আস্তানা এখনো আছে । ওটা আগে ছিল ব্রিটিশ সেনাদের ক্যাম্প । এরোপ্লেনের রানওয়েটা এখনো আছে । তখন ইস্কুলে ভর্তি হয়ে গেছি, অনেক কিছু দেখছি, বুঝতে শুরু করেছি । দেশ ভাগ, দাঙ্গা, এইসব উত্তেজনা তখন আমার গায়ে লাগার কথা নয়, কিন্তু মনে আছে পাড়ার দাদারা বলাবলি করতো কামারহাটি থেকে একদল মুসলমান নাকি আসবে । দাদারা লাঠি-সোটা নিয়ে পাড়া পাহারা দিতো । আমরা ঘরের মধ্যে সিটিয়ে থাকতাম দরজা জানালা বন্ধ করে । সাতচল্লিশ-আটচল্লিশে জিনিস-পত্রের দাম মনে নেই, কিন্তু ৫২/৫৩ সালের কথা মনে আছে , তখন অল্পসল্প দোকান বাজার করছি ১০ বছর বয়সে । মনে আছে একমন চালের দাম হয়েছিল ১৬টাকা । একমন মানে ৪০ সের, এখনকার সাড়ে সাইত্রিশ কেজি। মন্বন্তরের কথা অনেক পরে বইএ পড়ে ভেবেছি আমিও তবে ‘মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারি নিয়ে ঘর করি’র দলে ? ‘দমদম দাওয়াই’এর কথা খুব ভালো মনে আছে, সেটা বোধয় আরো পরে ৫৭/৫৮সাল হবে । কৃত্তিম ভাবে মজুত করে, জিনিসের দাম বাড়িয়ে দিতো মজুতদারেরা । মজুতদারদের বাধ্য করা হতো মজুত মাল বিলি করে দিতে । দমদমে প্রথম হয়েছিল বলে খবরের কাগজে বলতো ‘দমদম দাওয়াই’। তারপর অনেক যায়গায় এইরকম লুটপাট হতো ।
খুব মিছিল হ’ত । একটা স্লোগান খুব মনে আছে মুখে একটা চোঙ্গা লাগিয়ে, একজন বলতো ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’ আর বাকি লেকেরা একসঙ্গে বলতো ‘ভুলো মাত, ভুলো মাত’ । ৯/১০ বছর বয়সে আমিও দুএকটা এইরকম মিছিলে হেঁটেছিলাম, মনে আছে । বুঝতাম না কিছু, কিন্তু ভালো লাগতো, বেশ উত্তেজনা বোধ করতাম । এই উত্তেজনার মধ্যে চলে এলো ১৯৫২র প্রথম সাধারণ নির্বাচন । বলার মত কিছুই মনে নেই । শুধু মনে আছে মা ভোট দিতে গিয়েছিল । যে ইস্কুলে ভোট হচ্ছিল সেখানে যেতে, লোকেরা নাকি বলেছিল আপনার ভোট হয়ে গেছে । অবাক মা বাড়ি ফিরে বলেছিলো ‘আমি ভোট দিলাম না আর বলে দিল ভোট হয়ে গেছে’ ! তো তারপর মা’কে আর কখনো ভোট দেওয়ানো যায় নি । দশবছর বয়সের স্মৃতি চৌষট্টি বছর পরে এইটুকুই মনে আছে । বয়স বাড়ে,খবরের কাগজ পড়ি । দৈনিক বসুমতি নেওয়া হত বাড়িতে । খুব মিছিল মিটিং হতো । শুনতাম । একজনের নাম খুব শুনতাম । বুঝি না বুঝি তাঁর মিটিংগুলো আমাকে টানতো । জ্যোতি বসু । আমাদের এলাকারই এম এল এ । মিটিংএর ভাষণ তত বুঝতাম না । কিন্তু তার বলার আগে ছোট ছোট নাটক আর গান হত , বেশ উদ্দীপনা লাগতো । গান গাইতো গণনাট্য সঙ্ঘের লোকেরা । তারও আগে, মনে আছে একটা অনুষ্ঠানে শম্ভু মিত্রর নিজকন্ঠে ‘মধু বংশীর গলি’ আর শম্ভু ভট্টাচার্যর ‘রানার’ ব্যালে নাচ দেখেছিলাম । ছাড়া গরুর মতো ঘুরছি । অবশ্য স্কুলেও যেতাম । জলখাবারের পয়সা বাঁচিয়ে, বাজার করার টাকা থেকে হাতসাফাই করে ছ আনা পয়সা জমলেই সিনেমা দেখতে ছুটতাম । পাঁচ আনায় সবচেয়ে কম দামের টিকিট আর চার পয়সায় উত্তরপাড়ায় যাওয়া আসার নৌকার ভাড়া । কিংবা বালির ব্রীজ দিয়ে হেঁটে । বালির ব্রীজ (তখন নাম ছিল ওয়েলিংডন ব্রীজ) হেঁটে পেরনোর জন্য দু পয়সা টোল ট্যাকস লাগতো । ১২/১৩ বছর বয়স থেকেই সিনেমা দেখার খুব নেশা হয়েছিল আর নেশা ছিল গান শোনা । খুব গানের জলসা হতো, হেমন্ত মুখার্জী বোম্বাই থেকে গান গাইতে আসতেন । আর তখনকার সব ছোট বা বড় জলসায় জহর রায়,ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, শীতল বন্দ্যোপাধ্যায়দের হাস্যকৌতুক হ’ত । আট আনা বা একটাকার টিকিট কাটার পয়সা পাবো কোথায় ? চট ঘেরা প্যান্ডালের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতাম । অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরে মাথায় একটা চাঁটি মেরে ভেতরে ঢুকিয়ে দিতো গেটে ঠাকা দাদাটা । দুপয়সা পেতাম জল খাবারের জন্য । এক পসার মুড়ি আর এক পয়সার মুড়কি । বাজার করার খুব উৎসাহ ছিল কারণ দু এক পয়সা বাঁচিয়ে নিজের পকেটে ঢোকাতে পারতাম । সেইজন্যই বোধয় মনে আছে, একটাকা দিতো বাজার করতে । ছ’আনায় মাছ নিতাম, দেড়পোয়ার মত মাছ কিনতাম মনে হয় । বাকি দশ আনায় অন্য সবজি কিনে চা্র পাচ পয়সা ফেরত দিতাম ।
১৯৫৭র এপ্রিল থেকে টাকা পয়সা, ওজন এইসবের জন্য দশমিক পদ্ধতি চালু হল। মানে, এক,দুই পয়সা, এক আনা, চার আনা, আট আনা, আর ষোল আনায় এক টাকার বদলে একশ’ পয়সায় এক টাকা,আর ছটাক, পোয়া, সের উঠে গিয়ে কিলোগ্রাম চালু হ’ল । চালু হওয়ার পর অনেক দিন বলতাম নয়া পয়সা ।
পড়াশুনায় খুব আহামরি ছাত্র ছিলাম না । নাটক, আবৃত্তি , দেওয়াল পত্রিকা এইসব করছি, গর্কির ‘মা’ পড়ে নিয়েছি ক্লাস এইটএ, উৎপল দত্তর ‘অঙ্গার’ দেখা হয়ে গেছ, প্রথাগত পড়াশুনায় আর কতটা ভালো হওয়া যায় ! সাতান্ন-আঠান্ন সালের মধ্যেই নাটক আমাকে গিলতে শুরু করলো । প্রথাগত পড়াশুনায় মামুলি ছিলাম । কিন্তু স্কুল ফাইনাল পরীক্ষাটা পাশ করে গেলাম । পরীক্ষার দিন পনেরো আগে পক্স বেরোলো, আমি বিছানা নিলাম । পরীক্ষা কি করে দেবো ভেবে কান্নাকাটি করলাম । সাগর দত্ত হাসপাতালে সিক বেডে পরীক্ষার ব্যবস্থা হ’ল । ব্লিচ করা খাতায় পেন্সিলে লিখতে হল । পাশ করে প্রি-ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম সুরেন্দ্রনাথ কলেজে । তখন উচ্চ মাধ্যমিক চালু হয় নি । দশ ক্লাস পাশ করেই কলেজ । স্কুল ফাইনাল পাশ করার পর থেকেই চাকরির চেষ্টা চালাতে লাগলাম । তখন সরকারি চাকরী পাওয়ার বয়স সীমা ছিল ২৩ বছর । একদিন দেখলাম খবরের কাগজে রেলে প্রচুর লোক নেওয়ার বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে । দুটাকা দিয়ে একটা ফর্ম কিনে ভর্তি করে বসে থাকলাম । পরীক্ষার ডাক এলো । কিন্তু পরীক্ষা বাতিল হয়ে গেলো। পরীক্ষা ছিল মির্জাপুর স্ট্রীটের সিটি কলেজে । মনে আছে সেদিন খুব দাঙ্গা হয়েছিল । সিটি কলেজ থেকে শিয়ালদহ আসার পথে দেখেছিলাম হ্যারিশন রোডের অনেক দোকান আগুনে জ্বলছিল । কিছু দোকানের সাটারে খড়ি দিয়ে লেখা ছিল হিন্দুর দোকান । সেগুলোয় আগুন লাগে নি । পরীক্ষা পিছিয়ে পরের রবিবার হয়েছিল । দিলাম । ইনটারভিউএ ডাকলো, দিলাম । তারপর তিনবছর পরে চাকরির চিঠিটাও এসে গেলো । মধ্যপ্রদেশের বিলাসপুরে রেলের একাউন্টস ক্লার্কের পদে চাকরির ডাক পেলাম ১৯৬৪র নভেম্বরে । তখন বিকম পার্ট ওয়ানটা পাশ করেছি, পার্ট টু দিয়ে গ্রাজুয়েশনটা শেষ করা গেলোনা (পরে চাকরী করতে করতে পরীক্ষা দিয়েছিলাম)। একটা তেরো টাকা দামের রেক্সিনের স্যুটকেশ, একটা সতরঞ্চি সঙ্গি করে রওনা দিলাম নতুন জীবনের ডাকে সাড়া দিয়ে ।
স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছিল মনে আছে, ৪ঠা আগস্ট । পাশ তো করলাম,কিন্তু বই কেনা কলেজের মাইনে, ট্রেনের মাসিক টিকিট এসবের টাকা পাবো কোথায় ? একটা টিউসানি পেয়ে গেলাম । ক্লাস সিক্সএর ছেলে। সেই ছিল আমার প্রথম টিউসানি, সেই প্রথম একদম নিজের আয় হাতে পাওয়া । দশটাকা মাসে । সঙ্গে ক্লাস টুএর একজন ফাউ । প্রি-ইউনিভার্সিটি পড়তে পড়তে একটা লাইব্রেরীতে লাইব্রেরিয়ানের কাজ পেলাম । মামুলি লাইব্রেরী নয় । আড়িয়াদহ এসোসিয়েশন লাইব্রেরী এখন ১৪৬ বছর বয়স । মাসে কুড়ি টাকার সান্মানিক, তখন তাইই অনেক । লাইব্রেরিয়ানের কাজটা যে আমাকে কি আনন্দ দিল ! বইএর জগতে না ঢুকলে তো বোঝা যায় না । মুফতে বই পড়ছি, বই ঘাঁটছি । সে কি মজা ! সাহিত্য আর ইতিহাস পড়ার নেশাটা যেন রক্তের মধ্যে মিশে গেলো ।
১৯৬১ হবে । বেশ কয়েকটা টিউসানি পেয়ে গেলাম। উজ্বল সব তরুণ। সত্তরের দশকে নকশাল আন্দোলনের সময়, অনেকেরই মনে আছে বারাসাতের রাস্তায় আটজন তরুণের বস্তাবন্দি লাশ ছড়িয়ে দিয়েছিল কারা যেন । তার মধ্যে একজন ছিল আমার ছাত্র । তখন আমি ছত্তিশগড়ে চাকরি করি । সেই উত্তাল সময়টা নিরাপদ দূরত্ব থেকে দেখেছিলাম বটে, কিন্তু সেই সময়ের আঁচ থেকে বাঁচতে পারিনি, কেইই বা পেরেছিল ! তখন বাংলায় ‘সোনার টুকরো ছেলেরা সব অশ্বমেধের বলি’, নুনের চেয়েও খুন সস্তা। নিজ সন্তানের ছিন্নশির সোনার থালায় সাজিয়ে কাকে ভেট দিয়েছিলাম আমরা ? ১৯৭১এর ২৫শে জুলাই হাজারিবাগ সেন্ট্রাল জেলে ১৬জন নকশাল বন্দি তরুণের হত্যা হয়েছিল । সেই ষোল জনের একজন ছিল আমার সহোদর ছোটভাই । সংবাদপত্রে দেখেছিলাম পুলিশের গুলিতে মারা গেছে। অন্য বন্দিদের লেখা নানান পত্রিকায় পড়ে জেনেছিলাম জেলের মধ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। মৃতদেহ ফিরিয়ে দেয়নি,হাতে পায়ে বেড়িপরা জেলের অন্ধকারে লেখা তার কবিতা-গল্প লেখার খাতাটাও ফেরত দেয়নি। এমনকি পরের দিন আমার হাজারিবাগ যাওয়া পর্যন্তও অপেক্ষা করেনি । শুধু একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিল । একবার চাইবাসা জেলএ দেখতে গিয়েছিলাম,পকেটের চারমিনারের প্যাকেটটাও খুলে দেখেছিল কারারক্ষী । তখনতো মানবাধিকার ইত্যাদি শব্দগুলো হিব্রুভাষার অচেনা শব্দ ছিল ! এইটুকুই থাক। হৃদয় খোঁড়া বেদনা আমারই থাক, শুধু আমারই । আমি শুধু আমার গায়ে এখনও লেগে থাকা সময় বা দুঃসময়টাকে ছুঁয়ে গেলাম ।
চৌষট্টির ডিসেম্বর থেকে জন্মস্থান ছেড়ে দূরে চলে যাই চাকরি নিয়ে । বছরে এক দুবার কয়েকদিনের জন্য আসতাম । স্থায়ী ভাবে আর ফিরে আসিনি । ১৯৭৫এর পর থেকে আমাদের নিজস্ব কোন ছাদ ছিলনা যে !
একটা তেরো টাকা দামের রেক্সিনের স্যুটকেশ, পকেটে তিরিশটা টাকা আর একটা সতরঞ্চি সঙ্গি করে হাওড়া স্টেশন থেকে রওনা দিয়েছিলাম । রেল একটা পাশ পাঠিয়ে দিয়েছিল এপয়েন্টমেন্ট লেটারের সঙ্গে। দুজন খুব কাছের বন্ধু হাওড়া স্টেশনে এসেছিল তুলে দিতে । তাদের একজনের বাবার ট্যাক্সি ভাড়া খাটতো । সেদিন রাস্তায় বেরোয় নি, আমাকে নিয়ে এলো তাদের গাড়ি করে । আর একজন দুপ্যাকেট পানামা সিগারেট কিনে দিল । রাত্রি আড়াইটা নাগাদ বোম্বাই এক্সপ্রেস বিলাসপুর পৌছালো । প্ল্যাটফর্মে সতরঞ্চিটা বিছানোর একটা যায়গা পেয়ে গেলাম। দেখলাম আরো দুএকটা সতরঞ্চি বিছানো হচ্ছে । ব্যস ওখান থেকেই নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ শুরু হ’ল । একই পথের পথিক তো । আর একা থাকলাম না। তিনজনে মিলে ‘আমরা’ হয়ে গেলাম ।
রেলের বাজারে একটা বাঙালি হোটেলে ৬০ পয়সায় মাছভাত খেয়ে অফিসে রিপোর্ট করলাম । পুরানো লোকেরা অনেক ভালোবাসা দিলেন । বড় ডিভিসনাল অফিস, অনেক লোক কাজ করেন সত্তর ভাগ বাঙালি আর তিরিশ ভাগ দক্ষিণ ভারতীয়, সবাই কলকাতা বা খড়গপুর থেকে বদলি হয়ে গেছেন ওখানে । বাঙ্গালিদের দল ভারি হল – আদরতো পাবোই । মেডিক্যাল হতে দিন তিনেক লাগলো । প্রথমে সপ্তাখানেক শোয়ার ব্যবস্থা হ’ল যাযাবরের মতো – মানে কেউ ছুটিতে গেছেন তার কোয়ার্টারে শুয়ে ঘর পাহারা দেওয়া । পরে একটা মেসে ঢুকে গেলাম । একটা রেল কোয়ার্টারে আরো ৪/৫ জনের সঙ্গে ভাগ করে থাকা, দশটাকাকা দিয়ে কেনা একটা দড়ির চারপাইএ শোয়া, আর অন্য একটা মেস’এ খাওয়া কুড়ি জনের মত একসঙ্গে । ২৩ বছর বয়স – ছাড়া গরুর মতো । তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার কথা বলার মত কেউ নেই, ওটা কোরনা বলার মত কেঊ নেই, শুধু নিজের জন্য কিছু ভাবার মত মনটাও তৈরী হয় নি ।
নাটকের দল করা, রেলকলোনির রিক্রিয়েশন ক্লাব লাইব্রেরী, সাংস্কৃতিক সামাজিক কাজকর্ম, মৃতদেহ সৎকার, হাসপাতালে রাত জাগা , কাজের বাড়িতে পরিবেশন করা এইসব কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তাম আর এইসব করার সুবাদে প্রচুর মানুষের ভালোবাসা পেয়েছিলাম । মায়ের মত, নিজের বড় দাদার মত ভালোবাসা । মানুষের ওষ্ঠ থেকে তার বিষাদ-বিন্দু শুষে নিতে চাওয়ার মধ্যে, আর একজনের চকচকে চোখ দেখতে পাওয়ার মধ্যে যে কি আনন্দ, কি সুখ তার তো কোন লিখিত শব্দ হয় না ! মা ভাই বোন ছেড়ে দূরে থাকার কোন কষ্টই সেইসব মানুষেরা আমাকে পেতে দেননি । সামান্য যা লেখালেখির চর্চা করতাম তা গদ্য । কবিতা লেখার চেষ্টা করিনি কোন দিন, ইচ্ছেও হতো না । হাংরি জেনারেশন না কিসব বলতো নিজেদের, ওদের কবিতা কয়েকটা পড়ে আধুনিক কবিতার ওপরই একটা বিতৃষ্ণা এসেছিল, ওগুলোকে ‘অন্ধকারের জীবন বেদ’ মনে হতো ।
১৯৬৭ তে সারা ভারতে প্রবল প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া । জাতীয় কংগ্রেসের সারা ভারতে একচ্ছত্র শাসনের টালমাটাল অবস্থা, পশ্চিম বাংলাতেও প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার করলো অজয় মুখার্জীর মুখ্যমন্ত্রীত্বে, বছর না পেরোতেই রাষ্ট্রপতি শাসন । জাতীয় কংগ্রেসের একচ্ছত্র শাসন অবসানের সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল ১৯৬৭ থেকেই । সেই উত্তাপে শরীর সেঁকেছিলাম আমরা অনেকেই, দূরে থেকেও ।
১৯৬৮র ১৯শে সেপ্টেম্বর রেল সহ কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারিদের সংগঠনগুলি একদিনের টোকেন স্ট্রাইক ডাকলো । স্ট্রাইক বে-আইনী ঘোষণা করলো সরকার । তো কর্মচারীদের স্ট্রাইক আবার কবে আইনী হয় ! আমার চাকরির বয়স তখন সবেমাত্র তিন বছর সাত মাস । দাবি ছিল প্রয়োজন ভিত্তিক ন্যুনতম বেতন । ‘চল পানসি বেলঘরিয়া’, ‘যো হোগা দেখা যায়গা’ বলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম ধর্মঘটে । ‘ব্রেক ইন সার্ভিস’ হ’ল , মানে আমার চাকরি জীবনের একটা দিন মাইনে সহ বাদ হয়ে গেলো । সেই একটা দিন এবং একদিনের বেতন আর ফিরে পেলাম না । বার্ষিক মাইনে বাড়ার বা ইনক্রিমেন্ট’এর দিনটাও পিছিয়ে গেলো একদিন । সার্ভিস বুকে প্রথম লালকালির দাগ পড়ল, তা পড়ুক । চাকরির তিন বছরের মাথায় এই শাস্তি যে আমাকে দমিয়ে দিয়েছিল তা নয় বরং আরো কঠিন করেছিল মানসিক ভাবে ।
( আগামী সংখ্যায় সত্তর দশকের কথা )

