পায়রাটা সদ্য সদ্য বোধহয় উড়তে শিখেছে। কিছুটা দূরে গিয়েই আবার ফিরে আসছে মাটিতে। ব্যালকনিতে বসেছিলেন অবনীশ বাবু। অবনীশ রায়। একদা দাপুটে ভারতীয় নৌ সেনাবাহিনীর একজন প্রথম সারির অফিসার। এহেন, এমন একটা পোস্টে চাকরীর সূত্রে ওনার মধ্যে স্বাভাবিক ভাবেই দমে না যাওয়ার মনোভাবটা বরাবরই আছে। আর তাই হয়তো তিনি উঠে গিয়ে পায়রাটিকে লনের পশ্চিমপ্রান্তের আম গাছটায় বসিয়ে দিয়ে আসতে পারতেন হয়তো, কিন্তু, ওই যে, ওনার এক জেদী মনোভাব, পারতেই হবে যেকোনো উপায়ে…।
‘’ আরে বাবা , এ তো এক সামান্য অবলা প্রাণী, ক্ষুদ্র একটা পায়রা… ওঠো না মশাই আরাম-কেদারাটা ছেড়ে! কি দেখছো কি ওদিকে তাকিয়ে, দিয়ে এসো না তুলে গাছটার ওপর’’!
ঢুকতে ঢুকতে নিচ থেকেই লক্ষ্য করছিলো স্নেহা, ওর দাদুর কাণ্ডকারখানা। এই বুড়োটা না আর জীবনেও বদলাবেনা মনে হয়।এসো দাদু, চলো ওকে বসিয়ে আসি গাছে, তারপর তোমার সাথে আজ অনেক আড্ডা দেওয়া যাবে।
- আর মনে আছে তো আজকের লুডো উৎসবের কথা? যে হারবে সেই আজ কালুর দোকানের গরম গরম ঘুগনী খাওয়াবে। উফ! এই বৃষ্টিতে যা জমবে না!!
বলতে বলতেই দু কাপ চা আর লুডোর বোর্ড নিয়ে হাজির স্নেহা। খেলাটা বেশ জমেই উঠেছে।
- দ্যাখ দ্যাখ, পেঁচি, ভালো করে দ্যাখ, আজ তুই আমার একটাও গুটি কাটতে পারবিনা।
- ধুর! কি যে বলো না ডার্লিং! তোমার মতো এমন একটা জড়ভরত মার্কা মিলিটারীকে এক ফুঁ-তেই হারিয়ে দেওয়া যায়। হা, হা, হা, হা, এই দ্যাখো তোমার চোখের সামনেই পড়ল পাঁচ, আর তোমার পাকা গুটি গেলো সোজা ঘরে।
- ধুর, তুমি হারাবে আমাকে?’ বরং ঘুগনীর জন্য রেডি হও ডার্লিং।
স্নেহা , অবনীশ বাবুর কেয়ার গিভার। প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে রাত আটটা অবধি সে এই বাড়ির একমাত্র আদরের নাতনি। এইতো সেদিন কি সুন্দর করেই না মাছের মাথা দিয়ে মুড়োরঘন্ট রেঁধে খাওয়ালো দাদুকে, পেটুক দাদুর আর আহ্লাদ দেখে কে? নাতনির হাতের এমন সুখাদ্য পেয়ে। আর কিই বা থাকতে পারে এইটুকু ছাড়া স্ত্রী , সন্তান হারা একদা ডাকসাইটের জাদরেল অফিসার মানুষটার কাছে! একমাত্র পুত্র রণবীরের মৃত্যুর পর বৌমা সোহা ও একমাত্র নাতনি রাই সেই থেকেই কানাডায় সেটল। ফেরেনি আর দেশে। আগে তাও মাঝে মাঝে সপ্তাহে দু-একবার স্কাইপে কথা হতো, এখন আর হয়না বললেই চলে। আসলে, এই ব্যস্ত দুনিয়ায় এতো কারই বা কথা বলার বা পরিজনদের সাথে যোগাযোগ করার মতো সময় থাকে। এসব ভাবতে ভাবতে ক্খন যে চোখটা বন্ধ হয়ে এসেছিলো তার……চোখের কোণে এখনোও ঈষৎ জলের দাগ লেগে আছে। একটা ঝড় বিধ্বস্ত নীড় হারা পাখি যেমন আশ্রয় খোঁজে ফেরে, অথচ সবই ভাঙা গাছপালা, ডালহারা , কোথায় আর আশ্রয় তার ! তবুও খুঁজে চলে সে, একটা আকাশ, একটা বাসা আর এত্তোটুকু আশ্রয়।
- বাবু , ফোনটারে তোলেন এবার। ওটা যে মাটিতেই পড়ে আছে। চলেন ওঘরে, শুনলেন না স্নেহা দিদিমণির আপিসের লোকেরা কি বলে গেল? … কি সব টাকা- পয়সার হিসাব করতে আসবে।
বলরাম বলে চলে গেলো নিজের কাজে, ও এ বাড়ির রান্নার কাজটা দ্যাখে। কাল থেকে সকাল আটটায় সদর দরজার বেলটা আর বাজবে না । গতকাল বাড়ি ফেরার পথে একটা পথ দূর্ঘটনায় স্নেহার মৃত্যু হয় । অবনীশ বাবু আবার সেই নীড়হারা , ছায়াহারা এক পাখি……।