- স্বাধীনতার মানে জানিস বিলু?
- জানিনা আবার? রাস্তায় দেদার কাগজের তেরঙ্গা ঝোলে যেদিন গো , হুই হোতায় মাইকে গান টান হয় ,কত লোক চেঁচিয়ে মেচিয়ে কত কটা বলে ,বিনিমাগনা বোঁদে জিলিপি ও দেয় আর হি হি হি ,আর জোরে জোরে বলে কি " বোঁদে না খেয়ে মাতা গরম" ।
- আজ কি পুজো গো সারিদিদি?
- কি ব্যাপার দাদুভাইরা? এখনই চাঁদার বই নিয়ে ঘুরছ? পুজোর তো ঢের দেরী ...
- গল্প বলো দিদুন , রাজারাণী পক্ষীরাজ ।
- দিলু , আজ কাগজ কুডাতে যাবি না?
- এই শুনছ ,মজা দেখবে এসোনা ,কি পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছ তখন থেকে ।
কেন যে ছাতার পনেরোই আগস্টটা ওয়ার্কি. ডে তে পড়ে!! উনি তো বেলা এগারোটা অব্ধি বিছানায় গড়িয়ে ছুটি কাটাবেন আর আমার হবে ওভারটাইম দে , খালি এটা রাঁধো আর ওটা রাঁধো , তার ওপর বাচাচাদের ছুটি , তাল মেটাও , ননদ নন্দাই দুজনের ছুটি বলে আবার বিকেলটাও ঘরে আটকে থাকো , ধুত্তেরি ,স্বাধীনতার দিনেও দেখি আমার আর স্বাধীনতা নেই!! ।
- ও কেদারকাকু আজ হাপপেলেট ঘুগনি আর পাউরুটির সাতে একটা মামলেটও দিও গো ।একদম গরমাগরম ।
সকালবেলা বাজার যাচ্ছি দেখি মোড়ের মাথার মিউনিসিপালিটির স্কুলমাঠে কিকাঁাদের ভীড়। কি ব্যাপার? ও হরি, আজ তো ১৫ই আগস্ট! এ তাহলে তেরঙ্গা পতাকা তোলার ভীড়, ধরে একটা টান, তারপর ফুলের পাপড়ীগুলো ঝরঝর ঝরলেই, কচিকাঁচাদের গলা ছাপিয়ে মাইকে তারস্বরে দেশভক্তির গান, একটা কলা, দুটো লজেন্স, কি একমুঠো বোঁদে, সাথে ফ্রী ভাষণ। আমাদের আমাদের সময়েও ছিলো তো। তারপর ঐ স্কুলঘরে ভিতরে দেওয়ালে টাঙানো নেতাজী, গান্ধী, জহরলালের ছবিতে টাটকা ফুলের মালা চড়বে। আজ দেদার বিকোচ্ছে তিনরঙ্গা ফেস্টুন,টুপি,পতাকা,রিস্টব্যান্ড। স্কুলফেরতা কে যেন শার্টের বুকপকেটে একটা কাগজের তেরঙ্গা আটকে দিয়ে গেল সেফটিপিন দিয়ে , আজ আকাশটা তিনরঙা না হলেও অনেক তিরঙ্গা আকাশের পটভূমিকায় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে দেখছি।
এবার ১৫ই আগস্ট সোমবার। শপিং মলে আর ক্রেডিট কার্ডে আত্মহারা আমি ভাবছি যাক বাবা,, আরেকটা দিন এক্সট্রা ছুটী তো পেলাম । তবে আর কি, গা ভাসাও দেশপ্রেমের জোয়ারে, ‘লেট আস সেলিব্রেট’ আজ তবে পিকনিক হয়ে যাক, নাকি থিয়েটার,কি সিনেমা দেখা? বাড়ীতেই একটা জম্পেশ গেট টুগেদার, অথবা, দুপুরে মাংসভাত শেষে বিকেল অবধি বেশ জমাটি ঘুম, আপাতত ফেসবুক খুলে সেলিব্রেশন নিয়ে বন্ধুরা কে কি বলে শুনে নিই। মা নলেনগুড়ের পায়েস বানাচ্ছেন বোধহয়, গন্ধটা হাওয়ায় ভাসছে,রন্নাঘর থেকে যাতে শোনা যায় তাই টিভির ভল্যুমটা বাড়ানো আছে,গানটা বেশ ভালো লাগছে শুনতে তো,‘ভারত আমার ভারত বর্ষ,স্বদেশ আমার স্বপ্ন হে,’রবীন্দ্রসঙ্গীত? নাকি আধুনিক? আমার বস বাংলা গান টান অত আসে না,তবে বেশ দেশভক্তির স্মেল আছে, আজকের মত ফেসবুক স্ট্যাটাস হয়ে যাক! ওয়াও! পোস্ট করতে না করতে এতো লাইক, কমেন্ট!
সাতসকাল থেকেই পাড়ার মোড়ে দেশাত্মবোধক গান চলছে। গান গাওয়া আর শোনা ছাড়া আজ কিই বা আর করার আছে সারেগামাপা আর ডান্স বাংলা ডান্সের লোগোধারী বাঙালীর?! বিরক্ত মুখে বেরিয়ে এলাম বাড়ীর বাইরে। ভীড় সর্বত্র, দেশসুদ্ধ সবাই প্রানপনে দেশের সেবা করছে,বিনামূল্যের চিকিৎসা শিবির, বস্ত্র বিতরন কেন্দ্রে, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ঝলকাচ্ছে স্থানীয় অমুকবাবু, তমুকবাবু'দের সুখীসুখী গর্বিত মুখে। অনাথআশ্রম, হাসপাতাল কি বৃদ্ধাশ্রমে, ত্রাণশিবিরে, মিডিয়ার ভীড় সাইরেন বাজিয়ে যাচ্ছে মন্ত্রী আমলাদের সরকারী গাড়ী।
আজো ঘরে নেই বাড়ীর একমাত্র রোজগেরে ছেলেটা। আশেপাশের সব বাডীতে সবাই মিলে কেমন একটা ছুটির দিনের মেজাজে রয়েছে। পাঁচবছরের সবেধন নীলমনি নাতনির হাত ধরে প্রভাতফেরী ফেরত রামানন্দবাবুর মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায়। ওদের বি এস এফ ক্যাম্পেও আজ স্বাধীনতাদিবসের প্রভাতফেরী হয়েছে নিশ্চয়ই। রামানন্দবাবুর ছেলে আনন্দমোহন আমার ছোটবেলার বন্ধু। আপাতত আসামের করিমগঞ্জে পোস্টেড। সীমান্তে কোথাও মাইনাস কুড়ি, কোথাও চল্লিশ ছুচ্ছে পারদ,অতন্দ্র পাহারায় আনন্দের মত খাকি পোশাকের ক‘টি মানুষের মত মানুষ,বাড়ী ছেড়ে, পরিবার ফেলে যাদের রোজ মৃত্যুর সাথে লুকোচুরী, আপনার আমার স্বার্থে দেশের সীমানার সুরক্ষায় জেগে ভারতীয় সেনা, ওরা আছে বলেই নিশ্চিন্ত আমার দেশে ধর্মের বোলবালা, ডাস্টবিনে কন্যাভ্রূণ,নারী নির্য্যাতন, ধর্ষন,ডাইনি হত্যা, আরো কত কি, ওরা আছে বলেই পুরো দেশ উৎসবে মগ্ন আর কাগজকলম নিয়ে প্রলাপ লিখছি আমি।