ট্রেন ছুটছে । পেরিয়ে গেল মাল স্টেশন । নর্থ বেঙ্গল এর এই ছোট্ট স্টেশন মাল মউলির বড় প্রিয় । কতবার কত স্মৃতি রয়ে গেছে এখানে। অমিত আর একমাত্র মেয়ে মিশেল কে নিয়ে এসেছে তো বটেই-- অনেক বন্ধুদের সঙ্গে ও অনেকবার --- চালসা হয়ে কতো বেড়ানো । মূর্তি নদীর ভালবাসা ছুঁয়ে আছে মন-প্রান এখনো ।
সেবার নাটকের দল নিয়ে জলপাইগুড়ির শো শেষে সবাই মিলে মউলিরা গিয়েছিল দমনপুর । আহা !! দমনপুরের বাংলো টা কি যে অসাধারণ ছিল । সঙ্গে কেয়ারটেকার বাহাদুরের আতিথ্য, চিলাপাতার জঙ্গলে বেড়ানোর স্মৃতি আর রাতে বার বি কিউ চিকেন এর স্বাদ এখনও বড় সতেজ । ওখানেই বার বি কিউ র সাথে মদ খাবে বলে কি বায়না টাই না ধরেছিল নাটকের গ্রুপ এর শ্রেয়া !!!
মাঝে মাঝে বিভিন্ন টানেলের মধ্যে দিয়ে চলেছে ট্রেন । শরতের রোদ্দুর মাখা আকাশ আর দুপাশে মায়াময় অসংখ্য গাছের সারি । ঘড়ি দেখল মউলি । ১১.৪৫ । অর্থাৎ আলিপুরদুয়ার পৌছতে আর কুড়ি মিনিট বাকি । পিঠের ব্যাথা টা আবার কিছুদিন হল বেড়েছে । আগের বারের স্মৃতি না দগদগে ঘা উঁকি দিছে এখনো ।
একটা কামরা জুড়েই তখন হুল্লোড় চলছে ।
- এই মউলিদি চা খাব
- দ্যাখ কিশোর , একটু আগেই তো কেক খেলি, ঝুরিভাজা খেলি, কফি খেলি আবার চা । বলেছি না আমাদের গরিব নাটকের দল ।
- মউলিদি জিবনে কি পাব না ভুলেছি সে ভাবনা -- সামনে জা দেখি জানি না সে কি আসল কি নকল সোনা আ আ ---
ব্যাস শুরু হয়ে গেল গান । যোগ দিয়েছে পলাশ , তমাল, ইমন, মিষ্টি আর কারা যেন-- ---- জীবনে কি পাবনা -- আ আ আ আ আ আ ---
এইরকম ই একটা উইন্ডো সিট এ বসেছিল মউলি । পাশে এসে বসল শ্রেয়া । মউলির ১৮ বছরের বন্ধু । বহু দুর্যোগে পাশাপাশি পথ হেঁটেছে দুজনে। " হাতের উপর হাত রাখা খুব সহজ নয়, সারা জীবন বইতে পারা সহজ নয় " --- ওমা হটাত শঙ্খ ঘোষ কে মনে পড়ল কেন? স্রেয়ার চোখে চোখ রাখল মউলি ।
- অ্যাই মউলি আমার সদ্য প্রসুত কবিতা টা একবার দেখবি ?
- ও রে বাবা , আবার তর খেরোর খাতা বার করলি ? এখন না না শ্রেয়া । একটু বাইরেটা দ্যাখ । কলকাতায় এমন সবুজ পাবি না রে।
- ধুর, কাল রাত জেগে লিখলাম --- একটা নতুন কবিতা -- গঙ্গা কে নিয়ে । দ্যাখ না ।
- উফ -- , জ্বালাতন , দে দেখি । সত্যি ই কি লিখেছিস রে । অনেকদিন পর একটা ভালো কবিতা । দীনবন্ধু মঞ্ছের শো তে এটাই বলব ।
মউলির হাত শ্রেয়ার হাতে --- নিস্তব্ধতার মাঝে একজন কবিতা বলছে আর একজন শুনছে । কিন্তু সবটাই মনে মনে ।
আলিপুরদুয়ার এসে গেল । এবারের ট্যুর এ মউলি একা । নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি তে একটা সেমিনার এ এসেছিল - তারপর হটাত ই মনস্থির করে দমনপুর । ট্রেন থেকে নেমে দাড়াতে হল না । গাড়ি নিয়ে হাজির রানাদা । দমনপুর বাংলোর মালিক ।
- আসুন আসুন দিদি , এবার অনেক দিন পর ।
বাংলো তে পৌঁছে একটু ফ্রেশ হয়ে নিইয়ে খাওয়া দাওওা আর মন-বাহাদুরের সঙ্গে গল্পে গল্পে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। কাঠের তৈরি ইজি চেয়ার টায় আরাম করে এবার বস্ল মউলি একটু পড়েই হইত চা আর ভাজা ভুজি দিয়ে জাবে বাহাদুর । চারিদিক কেমন যেন ধোঁয়া ধোঁয়া । অতীত টাও যেন ধোঁয়ায় ভরে গেছে। ত্নাতক টা যেন মউলি কে বেঁধে রেখেছে আজীবন -- নাটকের জন্য কতদুর পথ হাটা যায় জানে না মউলি। নইলে অকাল দুর্যোগে যখন ভেঙ্গে গিয়েছিল তার নাটকের দল , সহ অভিনেতারা অনেকেই বেড়িয়ে গিয়েছিল নাটকের দল " সমিধ " ছেড়ে । অনেকে তখন ফিরেও তাকায় নি এতদিনের দল টির দিকে -- যে তাদের ফুল দিয়েছে , ফল দিয়েছে , আল বাতাস আর কতকিছু --- ভাবেনি অনেকেই --।
এখন মউলি ও আর ভাবে না এসব --- আসা যাওয়ার পথের ধারে সে এক গতিহিন পথিক । একদল যায় আবার একদল আসে -- শীতের পাতা ঝরার শেষে বসন্তের আসার মতই এই বছরে আবার একঝাক সদ্য তরুন তরুণী যোগ দিয়েছে -- আবার তাদের জোর উদ্যমে মউলি শেখাছহে তাদের হাতে ধরে-- নাটকের অ আ ক খ । শরীরচর্চা , বকুনি--- আহ্লাদ --সব দিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রেখেছে নাটকের কুশিলব দের। অনেকটা কাকের মতই । জানেও না কবে তাদের কুহু কুহু ডাক শুনতে পাবে। জানেও না কবে দূরে আকাশে দানা মেলে উড়ে জাবে কোকিলের দল । মউলি ভাবে -- তখন আবার তৈরি করব --- ভেঙ্গে যাওয়া --টা কিছু না। গড়াটাই তো সব। ওই মঞ্চ, আল সামনে একরাশ কালো মাথা, উচ্ছসিত প্রেখহাগ্রহ , করতালি তে ফেটে পড়ছে । কিছু ভেসে আসা সংলাপ --" দেখলে কি অভিনয় "!! এই তো সব --- এর জন্য হাজার বছর বাঁচতে পারে মউলি । নানা রঙের দিন গুলি নাটকে অজিতেশ বলেছিলেন -- শিল্পকে যে মানুষ ভালো বেসেছে তার বার্ধক্য নেই একাকীত্ব নেই, রোগ নেই, মৃত্যুভয়ের উপর তো সে হাসতে হাসতে ডাকাতি করতে পারে -------
বাহাদুর এল আলো নিয়ে বাইরে টা অন্ধকার ।
- একটা কথা কথা ছিল দিদি
- বল
- আমার নাতি টার বড় শখ অভিনয় করবে । এখন ছোট্টটি আছে। কলকাতায় তুমার বাড়ি তে থাকতে দেবে । একটু কাজকর্ম করে দেবে । আর নাটক শিখবে । হবে দিদি ?
- মউলি বুকের ভিতর শিরশিরানি । --- ডাকো তোমার নাতি কে ।
- নমস্তে মেমসাব ।
- অ্যাই তুই আমার হবি ? শুধু আমার ? কখনও আমায় ছেড়ে জাবি না বল !!! শিখবি নাটক?
বাহাদুর এর চোখে জল। মউলির চোখেও । দুজনেই পেয়ে গেছে নজরানা ।