সোমবার, আগস্ট ১৫, ২০১৬
অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী
sobdermichil | আগস্ট ১৫, ২০১৬ |
গল্প
| মিছিলে স্বাগত
আমার অফিস ব্যান্ডেলে। অফিস টাইম নয়টা থেকে সাড়ে চারটে। আমি অবশ্য পুরো সময় থাকি না। চারটে কি চারটে পনের মধ্যে বেরিয়ে পড়ি। ডাউন ব্যান্ডেল লোকাল। ফাঁকা। পছন্দ মত জানালার ধারের সিটে বসে উল্টোদিকের সিটে পা তুলে দিই। আরামের জার্নি। কিন্তু সেদিন এমন একটা ঘটনা ঘটল যে তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না।
চন্দননগর স্টেশন আসতে দু’জন ভদ্রমহিলা উঠলেন। চেহেরা দেখে বয়স বোঝার উপায় নেই। একজন রোগা, শুকনো চেহেরার, চোখে অর্ডিনারি ফ্রেমের চশমা। পরনে স্লিভপ্লেস প্রায় রঙ হীন সালোয়ার। অন্যজনের স্বাস্থ্য ভালো। গায়ের রঙ ফর্সা। চেহেরা ভাল। এবং সুন্দরি। তার পরনে নীল চুরিদার। তাতে লাল ছোট ছোট ফুল। আমার উল্টোদিকে বসে তারা জনৈকা রিমি নামের এক মহিলাকে নিয়ে আলোচনা করছে। ফাঁকা ট্রেন। ফলে তাদের সব কথাই আমি শুনতে পাচ্ছি।
রিমি নামে যে মহিলার কথা তারা বলছে, পরে বুঝলাম সে এক কিশোরী। কোন এক পারিবারিক কারণে সে বালি ব্রিজ থেকে ঝাঁপ মেরেছে।
শুকনো মহিলার ফোনে বার বার ফোন আসছে। একবার শুনলাম ইনি বলছেন, কি রিমিকে পাওয়া গেছে পাওয়া গেছে? শুনে ভাবলাম বোধহয় মেয়েটিকে উদ্ধার করা হয়েছে। পরে বুঝলাম, তা নয়। আবার এক ফোন এল, আর তিনি বলছেন, কি? ডুবুরি নেমেছে, ডুবুরি নেমেছে ?
তারা রিমির সৌন্দর্য নিয়ে আলোচনা করছে। রিমি নাকি বিগড়ে গেছিল। রিমির মা তাকে যে মানুষ করতে পারেনি, আসছে সে কথাও। তার মায়ের মুন্ডপাত চলছে। কি কি করলে রিমিকে ঠিক মতো করে মানুষ করা যেত, সে কথাও তারা আলোচনা করছে।
তারা একটু থামলে আমি বলি, আপনাদের কি কোন বিপদ হয়েছে?
সুন্দরীর চোখে জল নেই। শুকনো মহিলার গলায় কোন তাপ উত্তাপ নেই। সেই বলল, আমাদের এক পরিচিত মেয়ে আজ গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছে বালি ব্রিজ থেকে।
আমি আর কিছু বললাম না। কারণ এরপর যে কথা আসে তা আমি আগেই শুনে ফেলেছি। মেয়েটি সম্ভবত বেঁচে নেই। সেটা জেনেও এরা কেবল ওর মায়ের সমালোচনা করে যাচ্ছে দেখে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়।
ট্রেন শ্রীরামপুর স্টেশনে। বললাম, আপনারা কি এখন গঙ্গায় যাচ্ছেন?
- হ্যাঁ।
- যদি কিছু মনে না করেন, আমি কি আপনাদের সঙ্গে যেতে পারি?
শুকনো মহিলা ও সুন্দরী পরস্পর চোখ চাওয়া চাওয়ি করল। সুন্দরী বলল, সে আপনার ইচ্ছে।
শুকনো মহিলা খর দৃষ্টিতে আমাকে অপাঙ্গ মেপে বললে, আপনি যেতে চাইছেন কেন?
আপনাদের সব কথাই আমি এতক্ষণ শুনছিলাম। খুব খারাপ লাগল তাই—। আসলে আরও একটি কারণ আছে। এর সঙ্গে অবশ্য মেলে না। কিন্তু সেটাও খুবই শোকের। কাগজে খবরটা নিশ্চয় দেখেছিলেন, আসানসোলের ঘটনা। ছেলেদের কাছ থেকে ভাত না পেয়ে বাবা-মা পাঁউরুটি খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। যখন সেই পয়সাও ফুরিয়ে এল, শেষ পয়সায় বিষ কিনে—।
পড়েছি। শুকনো মহিলা বললেন।
দু’জনেই মারা গেছেন। একদিন আগে পরে।
জানি।
পড়ে মনটা খুব ভেঙ্গে গেছিল। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। তাদের পাশে দাঁড়াতে পারিনি, এখন যদি আপনাদের এই বিপদে—।
বেশ তো, যাবেন।
ধন্যবাদ। আমি কেবল জলের ধারে দাঁড়িয়ে থাকব।
এ কথার তারা কোন প্রত্যুত্তর করল না।
বালি ব্রিজ আমার বাড়ির পাশেই। ছাদে দাঁড়ালে ব্রিজের কাঠামো চোখে পড়ত। এখন আশপাশে বড় বড় ফ্ল্যাট উঠে যাওয়ায় তা আর সম্ভব হয় না। কিন্তু তবু আজও আমি মাঝ রাতে ছাদে যাই। ব্রিজের দিকে মুখ করে তাকিয়ে থাকি। জল থেকে কি পরি উঠে আসে? সে কি ব্রিজ ধরে দোল খায়? এক লাল বেনারসি নিয়ে চুপ করে গালে হাত দিয়ে বসে থাকে ব্রিজের ওপর?
বালি এসে গেল। আগে ওরা নামল, পিছনে আমি। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলেছে। আমি তেমনি পিছনে। ওরা আমাকে দেখছেও না কিছু বলছেও না। বুঝলাম, আমাকে আহ্বান কেবল মাত্র শুকনো ভদ্রতা ছাড়া আর কিছু নয়।
বালি হল্টের বড় রাস্তায় এসে অটো ধরলাম। বসলাম এক সাথেও। আর কোন কথা নেই। নামলাম ব্রিজের মাঝে। সেখানে এখন আর লোকজন নেই। ব্রিজে দাঁড়িয়ে জলের দিকে তাকালাম। বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠল সেদিনের মত। মনে হল অতটুকু মেয়ে, কি করে ঝাঁপ দিল? প্রেমে পড়লে কি মানুষ অন্ধ হয়ে যায়? বাবা-মা-ভাই-বোন কারও কথা মনে পড়ে না? সকলেই তখন পর? কিংবা বেঁচে থাকার ইচ্ছে? চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ—সব মিথ্যে হয়ে যায় এক লহমায়? তখন আত্মহননই হয়ে ওঠে একমাত্র পাথেয়?
জল থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। ঝুঁকে পড়ে জল দেখতে আমার বরাবরই ভয় করে। জলের স্রোত, ঘাত প্রতিঘাত, প্রবাহের ধ্বনি ও জলের চাপ, রঙ দেখে প্রাণ শুকিয়ে যায়। মনে হয়, এখুনি সরে না গেলে যেন জল ডেকে নেবে আমায়।
চোখে পড়ল জেটিঘাট। সেখানে কিছু অল্প বয়সী ছেলে ছোকরা আছে। কেউ বসে, বা কেউ দাঁড়িয়ে। গুলতানি করছে। বারমুড়া আর স্যান্ডো গেঞ্জি তাদের পোশাক। একবার ওদের কাছে যাব? পরে মনে হয়, না থাক। আজ নয়। ক’দিন পর আসব। এখন পুলিশ আছে। সেখানে গেলে নানা অপ্রিয় প্রশ্নের মুখোমুখি হতে পারে। আসব কদিন পর। ফিরে আসার সময় সেই দু’জন মহিলার কাউকেই চোখে পড়ল না। কখন যে আড়ালে চলে গেল কে জানে!
পরদিন খবরের কাগজে দেখি কালকের খবরটা ছেপেছে। রিমির নাম লেখা আছে। পদবি। ব্র্যাকেটে বয়স লেখা আছে ষোল। ছেলেটার সতের। তারও নাম, পদবি লেখা আছে। একমাস আগে সে ব্রিজের ওই একই জায়গা থেকে ঝাঁপ দেয়। মেয়েটা এরপর বিষাদে ডুবে যেতে থাকে। একসময় সে ওই একই স্থান থেকে আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
খবরটা পড়ে মন খারাপ হয়ে গেল। ঠিক করলাম আজই যাব। ফিরতি পথে। যেমন কাল গেছিলাম। আজ আর নিশ্চয় পুলিশের হাঙ্গামা নেই। সেই ভেবে ব্রিজের মুখে নামি। জেটিঘাটে যাই। সেদিনের কিছু ছেলে আজও আছে। ওদের পাশে দাঁড়াই।ওদের কাছাকাছি বসি। একসময় ওদের একজন বলে, কাউকে খুঁজছেন কাকু?
সেই যে কাল যে মেয়েটা ঝাঁপ দিল—
তাকে খুঁজছেন? সে ত ফিনিশ! কেন কাগজে দেখেননি?
কাগজে তো পুলিশ বলেছে নিখোঁজ!
ও পুলিশ অমন বলে। সে কি আর বেঁচে থাকতে পারে। কোন না কোন ঘাটে বডি আটকে থাকবে।
তবু আর কি, আশা রাখতে দোষ কি!
আপনার কে হয় কাকু?
কেউ না।
তবে?
ওই আর কি—
বুঝছি। আপনার পাড়ার লোক। তাকে কি আর ওই ভাবে পাবেন খুঁজে, পাবেন না। মানুষ যেখানে ঝাঁপ দেয়, সেখানে কি আর থাকে, মা গঙ্গা তাকে কোথায় টেনে নিয়ে যাবে, তার ঠিক কি।
সে তো ঠিক কথা ভাই। আসলে যে জায়গায় সে ঝাঁপ দিল, সেই জায়গাই তার কাছের লোকেদের কাছে মনে রাখার জায়গা হয়ে ওঠে।
তা ঠিক।
তোমরা কি ঝাঁপাতে দেখেছিলে?
না কাকু। আমরা তখন এখানে কেউ ছিলাম না। থাকলে আমরাই আগে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ি। এমনি করে আমরা একজনকে বাঁচিয়েছিও। নৌকায় তুলে দিয়েছি। কাগজে যে কথা লিখেছে, ছেলেটা এক মাস আগে ঝাঁপিয়ে পড়ে, সেও আর উঠতে পারেনি। সবই প্রেমের খেলা কাকু, আপনি বয়স্ক লোক, কি আর বলব আপনাকে! ছেলেটা এখুনি মেয়েটাকে বিয়ে করে নিতে চায়, কিন্তু মেয়েটা আসতে পারে না। ছেলেটা কিন্তু কথা রেখেছে, জলে ঝাঁপ দিয়েছে।
আর একটি ছেলে বলল, শুধু ছেলেটা কেন, মেয়েটাও ঝাঁপ দিয়েছে, সেও কথা রেখেছে—এটাও বল কাকুকে।
প্রথম ছেলেটা তখন বলে ওঠে, হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক ঠিক।
তব্বে! দ্বিতীয় ছেলেটা বলে।
তোমাদের সামনে তবে অনেকেই ঝাঁপিয়ে পড়ে?
তা পড়ে। আমরা তো এখানেই থাকি। কত দেখেছি।
এমন কতজনকে দেখেছ তোমরা?
তিনজন হবে। কিরে?
দ্বিতীয় ছেলেটা বলে, তা হবে।
আমরা এদিকে আড্ডা মারতে আসি কাজের ফাঁকে ফাঁকে। ওই বুড়োটা কিন্তু রোজ দুপুরে এসে বসে থাকে। রোজ মানে প্রায় দিন আর কি! ও অনেক দেখেছে। কাউকে বাঁচাতে পেরেছে কিনা জানি না, কিন্তু দেখেছে অনেক।
মেয়েটাকেও ঝাঁপাতে দেখে থাকতে পারে?
তা পারে।
আর ছেলেটাকে?
সেও দেখতে পারে।
তাকাই। জেটিঘাটের একদম কোনায় সে বসে। ওদিকে গাছপালা আছে। তার ছায়া। ছায়ায় সে চুপ করে বসে আছে। কখনও জল দেখে, কখনও ব্রিজ। এমন করে সে তাকিয়ে আছে যেন এখুনি কেউ ঝাঁপিয়ে পরবে ব্রিজ থেকে! তার দিকে গুটিগুটি পায়ে এগোই।
বয়স্ক লোক। পরণে মলিন পাজামা পাঞ্জাবি। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। ভাবলেশহীন। আমি তার পাশে বসি। কিছু পর সে আমার দিকে তাকায়। আমিও। সে চোখ ফিরিয়ে নেয়। আমিও। খানিক পর আবার চোখাচোখি। সে বলে, কিছু বলবেন?
সেদিন যে এক মেয়ে ঝাঁপ দিল—
হ্যাঁ?
তার কথাই জানতে চাইছি আর কি।
আপনি কি পুলিশ?
না না।
তবে?
তার এক কাছের লোক বলতে পারেন।
ও। তা কি জানতে চান? অনেকেই তো এখানে ঝাঁপাতে আসে। ক’জন আর বাঁচে বলুন! অত উঁচু থেকে লাফিয়ে পড়ে আর জলের ভেতর চলে যায়।
আচ্ছা!
প্রথমেই ডুবে যায় না। একবার ভেসে ওঠে। তখন যদি নৌকা থাকলে বাঁচে, নইলে নয়। আচ্ছা আপনি বলুন তো, আত্মহননের জন্য মানুষ কেন জল বেছে নেয়?
আপনিই বলুন।
কারণ এখানে ঝাঁপালে ফেলিওর হবার চান্স প্রায় থাকে না। আমি এখানে প্রথম মৃত্যু দেখি কুড়ি বছর আগে। সেও ছিল একজন মেয়ে। তার বয়স কুড়ি বছর। সে কলেজে পড়ত। উত্তরপাড়া কলেজে। প্রেম ঘটিত কারণে সেই মৃত্যু ঘটে।
আপনি তখন কোথায় ছিলেন?
ওই সামনের ঘাটে। স্নান করছিলাম। দেখলাম একটি মেয়ে ঝাঁপ দিল। আমি ভালো সাঁতার জানি না। চিল্লিয়ে ছিলাম। কিন্তু এমনি কপাল, কোন সাঁতারু যুবক সে সময় ঘাটে উপস্থিত ছিল না। ফলে মেয়েটিকে বাঁচাতে পারিনি।
আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন কেঁপে উঠল। বললাম, কেমন দেখতে ছিল সেই মেয়েটিকে?
খুব সুন্দরী ছিল সে। একেবারে পুতুলের মত। পরনে ছিল লাল-সবুজ ফুল আঁকা চুরিদার।
আর ওড়নাটা কি সাদা ছিল?
হ্যাঁ।
মাথার চুল পিছন থেকে বাঁধা ছিল?
ছিল।
সঙ্গে কলেজের ব্যাগ। তাতে বইখাতা। ব্যাগে বাবার মানিব্যাগ ও আলমারি খুলে চুরি করে আনা অনেকগুলি টাকা। পাঁচ হাজার। তখনকার দিনে অনেক টাকা, তাই না?
হ্যাঁ!
কলেজ ব্যাগের ভেতরে লুকিয়ে রাখা একটা বেনারসি। তার মায়ের। ঠিক?
বুড়োটা উত্তেজিত হয়ে বলতে থাকে, ঠিক! আপনি কি করে জানলেন?
একটু চুপ করে থেকে বলি, আসলে সেদিন আমারও ঝাঁপানোর কথা ছিল।
তা হলে ঝাঁপালেন না কেন?
সাহস হয়নি!
সাহস হল না?
না। স্বাতী বলেছিল, আগে আমি ঝাঁপাই, পিছন পিছন তুমি এসো। আমি রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু ওকে ওই ভাবে অমর অমর বলে আর্ত চিতকার করে জলের দিকে নেমে যেতে দেখে আমার মাথা ঘুরে যায়। আমি সেখানে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপতে থাকি।
কি করলেন তখন?
উল্টোদিকে দৌড় দিলাম।
পালিয়ে গেলেন!
হ্যাঁ!
তারপর কি করলেন?
সেদিনটা ভুলে যেতে চেষ্টা করলাম।
পারলেন ভুলতে?
না! কতদিন রাতে অন্ধকার বালি ব্রিজের দিকে তাকিয়ে থেকেছি, রাতের পর রাত ঘুমুতে পারিনি। কাউকে বলতেও পারেনি। এতগুলো বছর আমি সে সব কথা চেপে ছিলাম। কিন্তু দু’দিন আগে একটি মেয়ে ঝাঁপ দিয়েছিল, যার কথা আমি আপনাকে মিথ্যে করে বলেছি আমার আত্মীয় হয়। আসলে সে আমার কী হয় না। কিন্তু ট্রেনে তার আত্মীয়ের মুখে যখন সেই আত্মহননের কথা শুনলাম, আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। একমাস আগে মেয়েটির প্রেমিক জলে ঝাঁপ দিয়ে মারা গেছে, সে কিন্তু নিজেকে সেই অভিঘাত থেকে সরিয়ে নিতে পারেনি। এক মাস ধরে সেই বিরহ, সেই প্রেমিকের ত্যাগ তাকে কুরে কুরে খেয়েছে। সে ভেবেছে, তারই কারণে তার প্রেমিক আজ আর পৃথিবীতে নেই! সে কী করে সব ভুলে থাকে?
আপনি তাহলে এখানে এসেছেন কেন?
প্রায়শ্চিত্ত করতে।
কিন্তু আপনি কিভাবে করবেন। এখন কি আর আপন ঝাঁপাতে পারবেন?
না।
তবে?
আমি রোজ এখানে এসে ওই জলের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে চাই। আর প্রতি মুহুর্তে আমার সেই কাপুরুষতাকে ধিক্কার দিতে চাই!
বৃদ্ধকে রেখে সন্ধের মুখে জেটিঘাট থেকে উঠে আসি। দু পা এগোলেই একটা চা দোকান। সেখানে বসি। কতদিন পর হালকা লাগছে বুকটা। রিমি নামক মেয়েটির স্মৃতি আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেই কুড়ি বছর আগে যেখানে রিমির প্রেমিকের মত স্বাতীও আমাকে বিয়ে করবে বলে ব্রিজের মাঝে এসে উপস্থিত হয়েছিল। ওকে আমি বার বার করে বলেছিলাম, আমরা এখন দু’জনেই স্টুডেন্ট স্বাতী, এখন আমি তোমায় বিয়ে করব কি করে, খাওয়াবোই বা কি? স্বাতী ওসব শুনতে চায়নি। সে বলেছিল, তুমি যদি এখন না আসো, এখুনি আমায় যদি বিয়ে না কর, তবে আমি গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করব। আমি সময় চেয়েছিলাম। অন্তত একবছর। ততদিনে কলেজ শেষ হয়ে যাবে। চাকরি না হোক, চুটিয়ে টুইশনি করে--। স্বাতী বলেছিল, আমার হাতে এত সময় নেই। হয় আমাকে বিয়ে কর, নইলে নামি আর থাকব না পৃথিবীতে। কারণ আমাদের কথা বাড়িতে জেনে গেছে। বিয়ের জন্য উঠে পড়ে সবাই লেগেছে। আর আমি কেবল তোমায় ভালোবাসি। বিয়ে করলে কেবল তোমাকেই, আর কাউকে নয়। আর জেনে রেখ, এটাই আমার শেষ সিধান্ত। মুখ ফিরিয়ে বাড়িতে ফেরার জন্য আমি এতগুলো টাকা চুরি করে বেরইনি।
আমি স্বাতীকে ফেরাতে পারিনি। বাঁচাতে পারিনি। লোক ডাকিনি পাছে আমার কেউ সন্দেহ করে। চুপচাপ মিটে গেছে ব্যাপারটা।
এখানে বসে এক বুক বাতাস নিই। অনেকটা জল খাই। তারপর এক ভাঁড় চা। সবে চা নিয়েছি, তখন দেখি জেটিখাটের সেই ছেলেটা এসে হাজির। কোন ভনিতা না করে বলে, বুড়োটার সাথে কথা হল কাকু?
হল।
আমি অল্প কথায় কাজ সারতে চাই। এখন আর এর সঙ্গে কথা বুলতে ভালো লাগছে না। চা দোকানি বলে, কোন বুড়োটা রে?
ছেলেটা বলে, ঐ যে গো মধুদা, জেটিতে বসে থেকে, চোখে মোটা কাচের চশমা।
ও। মধু নামক চা দোকানি বলে, ওর মেয়ে কুড়ি বছর আগে ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দিয়েছিল। বুড়োটা তখন ঘাটে ছিল। নিজের মেয়েকে চিনতেও পারেনি, বাঁচাতেও পারেনি। সেই থেকে ও এখানেই দুপুরের পর এসে বসে। মেয়ের শোকে লোকটা ক্ষ্যাপাটে মেরে গেছে।
কেন মরল গো?
ওই যে কারণে সেদিন মেয়েটা ঝাঁপাল, সেই প্রেমরোগ। আর কি! ওর প্রেমিক কিন্তু খুব সেয়ানা, লাফায় নি। দিব্যি অন্য মেয়েকে নিয়ে সংসার সাজিয়ে বসেছে। বোকা মেয়েটাই তার সঙ্গে সংসার করবে বলে বাপের টাকা পয়সা হাতিয়ে ঘর ছেড়েছিল। হল কি? ছেলেটা ধোঁকা দিল, আর সে জলে হাঁকপাঁক করতে করতে মরল।
তখনো তোমার দোকান ছিল নাকি?
ছিল তো।
বাব্বা! তুমি যে হেবি পুরানো লোক মধুদা—
তাদের কথা এগিয়ে যেতে থাকে। আমি স্তব্ধ হয়ে বেঞ্চে বসে থাকি। ভাঁড় কখন শেষ হয়ে গেছে। ফেলার কথা মনেও থাকে না। যাকে আমি ভুলে গেছি, জেটিঘাটের লোকেরা যে তাকে এভাবে মনে রেখেছে তা ভাবতেও পারিনি!

