বড় অসহ্য সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছে সময়। প্রতিদিন আকছার খুন হচ্ছে মানুষ। সে সব ঘটনাগুলি গা সওয়া হয়ে গিয়েছে আমাদের। কবে যে কে কোথায় কার হাতে কেন খুন হচ্ছে, অতসত খোঁজখবরও রাখা সম্ভব নয় সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন ব্যস্ততার কঠিন বাস্তবতায়। কিন্তু তার মধ্যেই বেছে বেছে কোন কোন ঘটনা আমাদের সমাজে বেশ সাড়া ফেলে দেয়। যেমন দিয়েছিল রিজয়ানুরের কেসটি, সেই কেসের নিস্পত্তি না হোক সেই কেসের পিঠে সওয়ারী হয়ে তৎকালীন বিরোধী দল তার জনসমর্থনের ভিতটুকু বেশ পাকাপোক্ত করেই বেঁধে নিয়েছিল। তারপরের ইতিহাসও সকলেরই জানা। রিজকাণ্ডের অভিযুক্ত পুলিশ অফিসাররাই বর্তমান প্রশাসকের নয়নের মণি হয়েও উঠেছেন সাম্প্রতিক সময়ে। এই হল এরাজ্যের সমাজিক সংস্কৃতি। ২০০৭ এর মোমবাতি মিছিলের সেই সংস্কৃতি যে আজও স্তিমিত হয়ে যায় নি, তা আবার প্রত্যক্ষ করছে কলকাতা। এবার অন্য আরেকটি কেস। এই কেসেও জনগণ আশংকা করছে রিজকাণ্ডের মতোই প্রশাসন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের যুগলবন্দীতে আইনের ফাঁক গলে বেড়িয়ে যাবে দোষীরা। সত্যিই এই যুগলবন্দীর সংস্কৃতিই আজকের চুড়ান্ত বাস্তবতা। আমারা সকলেই ওয়াকিবহাল সেই বিষয়ে। আর তাই আবেশের মৃত্যুর তদন্ত নিয়ে সঙ্কিত আপামর রাজ্যবাসী। সকালের কাগজ থেকে বিকালের টিভি সরগরম দুইবেলা। ঠিক কি ঘটেছিল। দোষী কারা। প্রভাবশালীদেরই বা পরিচয় কি। বিচার পাবেন তো সদ্য পুত্রহারা জননী? সকলেরই পরম আগ্রহ এই বিষয়গুলি নিয়েই।
আর সেই আগ্রহের আতিশয্যেই আড়ালে পড়ে যাচ্ছে আরও গভীর এক সঙ্কট। না প্রায় কেউই আমরা সেই সঙ্কটের কথা ভাবছি না। আমাদের অতশত ভাবা ভাবনা করার মতো সময়ই বা কই। আমরা দেখতে চাই, দোষী ধরা পড়ুক। পুত্রশোকাতুর মা সঠিক বিচার পান আর উপযুক্ত শাস্তি পাক দোষীরা। তাহলেই আমরা খুশ। ২১১র ভোটার সমতে সকলেই দু হাত তুলে অভিবাদন জানাবে বর্তমান প্রশাসনকে। যদিও প্রশাসন সেই পথে আদৌ হাঁটবে কিনা সেটা ভবিষ্যতই বলবে। কিন্তু যে ঘোরতর সঙ্কটের কবলে বদ্ধ আজ আমাদের চারপাশ, ঘরের ভিতর থেকে সমাজের সর্বত্র যে পচন ধরে গিয়েছে বাঙালির অস্থিমজ্জার পরতে পরতে, সেই বিষয়ে সত্যই কি আমরা সচেতন হব না আজও? আজও কি আমরা বালখিল্য শিশুর মতোই আঘাত পেলে ডাক ছেড়ে কেঁদেই হালকা করব মনবেদনা? কেন আঘাত পেলাম কতটা আঘাত পেলাম, ঠিক কোন ভুলের কারণে পেতে হলোর এমন কষ্টকর আঘাত, কি কি সাবধানতা অবলম্বন করলে ভবিষ্যতে এই ভাবে আর আঘাত খাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না, তদন্ত করে দেখবো না সেই সব গুরুতর ও প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি? দুঃখের বিষয় আজ আমাদের দশা সত্যই বালখিল্য শিশুর মতোই। তাই আবেশের মৃত্যু তদন্তের সন্তোষজনক পরিণতির আশায় চলেছে আমাদের মোমবাতি মিছিল। দোষী ধরা পড়লেই আমরা নিশ্চিন্ত! ঠিক যেমন মেঝেতে পড়ে গেলে, বাড়ির বড়রা মেঝেতে পা ঠুকে মেঝেকে বকে দিলেই আমাদের কান্নার বেগ কমে আসত অবোধ সেই শৈশবে’! আজ আমাদের দশাও যেন সেই অবুঝ শিশুর মতোই। কোন মোমবাতির শিখাই আজ আর পথ দেখাতে পারছে না অন্ধকারের বুক চিরে।
না। আবেশ মৃত্যু রহস্যের যবনিকা পতনেই বা দোষী ধরা পড়লেই কিংবা যথোপোযুক্ত শাস্তি পেলেই বিষয়টির সুরাহা হবে না কোনভাবেই। কেন হবে সে কথাটুকু বুঝতে গেলে আমাদেরকে আরও একটু চক্ষুষ্মান হয়ে উঠতে হবে। পৌঁছাতে হবে বিষয়ের গভীরে। মোমবাতি জ্বেলে ধূপধূনোর আরতি করে সে কাজ হওয়ার নয়। আবেশের মৃত্যু যত বড়োই দুঃখজনক ঘটনা হোক না কেন, দোষীদের ধরা ও উপযুক্ত শাস্তি বিধান যতবড়োই প্রয়োজনীয় বিষয় হোক না কেন, মূল বিষয়টি এর কোনটিই নয়।

কেউ কি অবাক হচ্ছেন একজন প্রখ্যাত লেখকের সদ্য ঠাকুমাহারা কন্যা কি করে নিজের জন্মদিনে বন্ধুবান্ধব সহকারে হুল্লোর আনন্দে মেতে উঠতে পারে ভেবে? বিশেষ করে যে মাত্র দু তিনদিন আগেই তার ঠাকুমাকে হারিয়েছে। কিন্তু মূল প্রশ্ন হলো হারিয়েছে কি? হারিয়েছে তো আদৌ? আমরা কোন জিনিষটা হারাই, না যে জিনিষটার সাথে আমাদের প্রাণের স্পন্দনের একটি সজীব সংযোগ থাকে। সেই জিনিসটি যে কারণেই গত হোক না কেন, গত হলেই সেটি হারিয়ে ফেলি আমরা। আর হারিয়ে ফেলার সেই কষ্টেই শোকাতুর হয়ে উঠি প্রাথমিক পর্যায়ে। এইটিই স্বাভাবিক স্থান কাল পাত্রভেদে মনুষ্য জীবনে। কিন্তু আধুনিক বঙ্গজীবনে দাদু ঠাকুমা দিদিমা এই মানুষগুলি নাতি নাতনির জীবনে ততটা প্রাসঙ্গিক নয় আর। তাই বাবা মায়ের পিতা মাতার সাথে এযুগের নাতি নাতনিদের প্রাণের স্পন্দনের সংযোগটি আর সজীব নেই। সেটি লৌকিকতার ঘেরাটপে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। এই কঠিন ও দুঃখজনক সত্যটিকে আর আড়াল করে রেখে অস্বীকার করার উপায় নাই। উপায় নাই এটি জেনারেশন গ্যাপ বলে বিষয়টিকে লঘু করে দেখার। কারণ এটি আদৌ জেনারেশন গ্যাপের ফলাফল নয়। প্রতি যুগেই সকল সমাজেই জেনারেশন গ্যাপ ছিল ও থাকবেই। কিন্তু এই যে নিজের দাদু দিদিমা ঠাকুর্দা ঠাকুমার সাথে নাতি নাতনিদের প্রাণের স্পন্দনের সংযোগটি আজ আর সজীব নাই, তা যে নেহাৎই পারিবারিক লৌকিকতার একটি বিষয়, এই সত্যটির দিকে নজর দিতে হবে আমাদের। সন্ধান করতে হবে এর কার্য কারণ। আমাদের প্রত্যেকের ঘরেই এই একই চিত্র ঊনিশবিশ প্রতিফলিত। আমরা জেগে ঘুমাই বলেই সেই সত্যটিকে দেখেও দেখি না। কারণ না দেখে থাকার মধ্যে আপাত শান্তি আছে একটা।
বর্তমান সমাজবাস্তবতায় আমাদের পারিবারিক জীবনচিত্রে এই পরিস্থিতির সর্ব প্রধান কারণ মূলত দুইটি। এক একান্নবর্তী পরিবারের অবলুপ্তি। দুই ধনতান্ত্রিক ভোগবাদের কাছে বিনাশর্ত্তে আত্মসমর্পণ! যুগ পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয় চলতে গেলে একান্নবর্তী পরিবারেরর ভাঙ্গন অনিবার্য হলেও ধনতান্ত্রিক ভোগবাদের কাছে বিনা শর্ত্তে আত্মসমর্পণ কিন্তু অনিনার্য ছিল না। কিন্তু এই আত্মসমর্পণই আমাদেরকে যে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছে তারই অনিবার্য পরিণতি এইসব ঘটনা। ঘরে ঘরে ছেলে মেয়েরা এই ধনতান্ত্রিক ভোগবাদের চুড়ান্ত আবহেই কিন্তু বেড়ে উঠছে। কজন আমরা চিন্তিত হই তা নিয়ে? আর চোখকান বুঁজে এই যে একালের অভিভাবক প্রজন্ম বিনাশর্ত্তে এই ধনতান্ত্রিক ভোগবাদের কাছে চুরান্ত আত্মসমর্পন করে বসে আছে, তাদের কি একবারও ভেবে দেখার মতো মানসিকতা থাকে এর সরাসরি পরিণতি কি হতে পারে? কতটা খারাপ প্রভাব পড়েতে পারে তাদের সন্তানসন্ততিদের উপর? একটু ভেবে দেখলেই দেখতে পাবো নব্বইয়ের দশকের একেবারে গোড়া থেকেই এদেশে অর্থনীতির একটা চরিত্রগত পরিবর্তন ঘটে যায়। যার ফলে অনেকের হাতেই সহজ অর্থাগমের নানান পথ খুলে যেতে থাকে। সমাজের এক শ্রেণীর হাতে উঠে আসে বিপুল সম্পদের ঠিকানা। জীবনযাপনের মানে ঘটে যায় আবাক করা বদল। এইসব কিছুই আজকের অভিভাবক প্রজন্মের জীবনযাপনে নিয়ে আসে এক ভোগবাদী দর্শন। আর সেই আবহেই বেড়ে উঠছে আজকের ছেলেমেয়েরা। যে পরিবেশে কেবলই ভোগ্যপণ্যের রমরমা। আর সেই ভোগ্যপণ্য করায়ত্ত করার জন্যে নীতিহীন নৈতিকতাহীন এক নৃশংস প্রতিযোগিতা। কে কতটা ভোগ্যপণ্য মজুত করতে পারল, সেই নিক্তিতেই নির্ধারণ হয় তার সমাজিক অবস্থান। সেখানে পারিবারিক মূল্যবোধগুলি যে ক্ষয় হতে শুরু করবে সে তো খুবই স্বাভাবিক। আর ঘটেছেও ঠিক তাই।

তাই আবেশের মৃত্যুর দায় যে এই ছেলেমেয়েদের পারিবারিক সংস্কৃতিই, তারা সমাজের যে শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে সেই সমাজের সমাজিকতাই, কবে বুঝতে শিখব আমরা সেই সহজ সরল সত্যটি? না শুধু তো সাংসারিক পরিবেশের ভোগবাদী আবহই দায়ী নয়। দায়ী তো আরও অনেকেই। বালক বালিকা কিশোর কিশোরী যারা স্কুল কলেজের সিলেবাসের মধ্যে দিয়ে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠার পথে এগিয়ে চলেছে, তাদের উপর পঠন পাঠনের সিলেবাস থেকে শুরু করে বিদ্যালয়ের আবহেরও রযে যায় বিরাট প্রভাব। তেমনটিই তো হওয়ার কথা। আর এই সতেরোটি ছেলে মেয়ে যে রকম অভিজাত বিদ্যলয়ের শিক্ষার পরিসরে গড়ে উঠেছে, তাতে তাদের জীবনবোধ গড়ে তোলার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট স্কুল ও সামগ্রিক শিক্ষা পরিকাঠামোর দায় এড়িয়ে যাওয়ারও তো কোন উপায় নাই আর। শুধুই কি সিলেবাস মুখস্থ করিয়েই বেশি বেশি নম্বর তোলার কৌশল দেখিয়ে দেওয়ার মধ্যেই বিদ্যালয়ের দায়িত্ব শেষ? এইটিও কি কোন প্রকৃত শিক্ষাব্যবস্থার কাজ হতে পারে? শিক্ষার কাজ তো একজন সমগ্র মানুষ তৈরী করে তোলা। উন্নত আদর্শে ও সুস্থ সুন্দর বলিষ্ঠ মূল্যবোধের মধ্যে দিয়ে। আজকের সমাজে কোথায় আছে সেই ব্যবস্থা? কেন নেই? দায়ী কে? আবেশের তথাকথিত খুনের কিনারা করে দোষীকে ধরে দিলেই সাতখুন মাফ? কে করবে আসল বিচার?
আজকের সামাজিক পরিসরে বালক বালিকারা চারিধারে কোন সমাজচিত্র দেখে বেড়ে উঠছে? গোটা সমাজের সর্বত্র যে পচন ছড়িয়ে গিয়েছে, কি করে আশা করবো তার ভিতরেই এই কচিকাঁচারা সুস্থ স্বাভাবিক ভাবেই বেড়ে উঠবে? অমিত চৌধুরীদের মতো খ্যাতির মধ্যগগনে বিরাজ করা লেখক বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সমাজসংসারেও যেখানে নিজেদের সাংসারিক পরিসরটিকেই সুস্থ স্বাভাবিক রাখতে পারা সম্ভব হচ্ছে না; সেখানে কি করে তাঁরা সমাজের মুখে দর্পন তুলে ধরবেন? একজন সাহিত্যিকের আসল কাজটিই তো সমাজের মুখের সামনে বলিষ্ঠ দর্পন তুলে ধরা, যাতে সমাজ চিনতে পারে নিজেকে। না হলে শিল্পের জন্যেই শিল্প বলে নিজেকেই তো ঠকাতে হয় সাহিত্যিককে। বস্তুত আজকের বঙ্গসমাজের সাহিত্য আর বেগবান নদীর মতো নাব্য নয়। তা বিদ্যেধরী স্বরসতী নদীগুলির মতোই মজে গিয়েছে। গিয়েছে। এইভাবেই এই সময়ের বুদ্ধিজীবী সমাজের দেউলিয়েপনা প্রতিফলিত হয়ে উঠছে, তাই একটু ঠিক মতো উঁকি দিলেই দেখা যাবে ঘরে ঘরে হাঁড়ির খবর ঊনিশবিশ একই। যার প্রভাবে আর্থ সামাজিক শ্রেণী বিভাজনের প্রায় সব কয়টি স্তরেও হাঁড়ির খবর প্রায় এক। সমস্য ও রোগটা ঠিক সেইখানেই।
দুঃখের বিষয় আজ আমাদের সমাজে টলস্টয় দস্তয়েভস্কি ডি এইচ লরেন্সের মাপের কেউ নেই। তাই আমদের সমাজেরও রেজারেকশানের আশু কোন সম্ভাবনা নেই।
Tags:
সোজা সাপটা