শাঁওলি দে

shaunli



পেছন ফিরে তাকালে আজকাল নিজেকে বড্ড অচেনা মনে হয় প্রিয়াংশুর।নো লুক ব্যাক এটাকেই জীবনের মূলমন্ত্র বানিয়ে ফেলেছে ও এখন। শুরু করেছে অচেনা আমির খোঁজ! ভাগ্যিস চাকরি নিয়ে কলকাতায় চলে এল ও, নাহলে কপালে কি ছিল কে জানে! বাবার ইটভাটায় কাজ করার ইচ্ছেকে কোনকালেই প্রশ্রয় দেয় নি, বরং ছোটবেলা থেকে নিজের গন্ডী নিজেই ভাঙার চেষ্টা করে গেছে ও।

প্রায় দু'বছর হতে চলল প্রিয়াংশু এখন কলকাতায়.. বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ নেই বললেই চলে। সেই যেদিন বাবার অনুরোধ, মায়ের চোখের জলকে উপেক্ষা করে এক কাপড়ে বাড়ি ছেড়েছিল তারপর আর ওপথ মাড়ায় নি। নির্দ্বিধায় ফেলে এসেছে টুসিকেও। দায়িত্ব নিতে বরাবর ভয় পেয়ে এসেছে প্রিয়াংশু। তাই তো তুমুল প্রেমের জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেওয়ার পরও অন্তসত্ত্বা টুসির হাত ধরতে ভয় পেয়েছে সে। প্রিয়াংশু জানে এই কলকাতা তাকে সাহায্য করবে পালাতে, লুকিয়ে রাখবে ওকে। কিন্তু নিজের ছায়ার থেকে ও বাঁচবে কি করে এই উত্তর নেই ওর কাছে। আসা অবধি শুধুই নিজেকে খুঁজে চলছে প্রিয়াংশু;এই সম্পূর্ণ স্বজন বিসর্জিত এই কাঠখোট্টা শহরে আস্তে আস্তে নিজেকে হারিয়েই ফেলে ও।

দিন পেরিয়ে যায় ব্যস্ততায়. . রাতগুলো নির্ঘুম। নিজেরই নেওয়া সিদ্ধান্ত বার বার কাঁটার মত গলার কাছে আটকে থাকে। তবু প্রবল এক অভিমানে সে ফেরে না। ফিরতে চায় না।

টুসিকে নিজেদের কাছে এনে রেখেছে প্রিয়াংশুর বাবা-মা। বাচ্চাটার এখন ছ'মাস বয়স। পিতৃ পরিচয়হীন ছেলেটি ঠাকুরদা আর ঠাকুরমার আদরে ভালোই থাকে। শুধু টুসি ভালো নেই। যাকে বিশ্বাস করে নিজের সবটুকু বিসর্জন দিয়েছিল নির্দ্বিধায় . . যাওয়ার সময় সে একবারও পিছন ফিরে দেখেনি। ছোটবেলার ধরা সেই হাতের উষ্ণ স্পর্শ এখনো লেগে আছে শরীর জুড়ে। ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারে না টুসি। জানালা দিয়ে উদাস চোখে বড় রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে থাকে দিনরাত। রাতদিন।বার বার চলে যাওয়ার দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে।না,সেদিন যেতে বাধা দেয়নি টুসি। আর কেনইবা দেবে? গ্রামের স্বল্প শিক্ষিত মেয়ে বলে কি এতটুকু আত্ম সন্মান থাকতে নেই ওর। যাক্‍ ও চলে যেখানে ওর মন চায়। জোর করে আর যাই হোক ভালবাসা পাওয়া যায় না।

প্রিয়াংশুর ব্যস্ততা বাড়তে থাকে দিনে দিনে। অতীত ভোলার নেশায় পেয়ে বসে ওকে। ভেতরে ভেতরে ভাঙতে থাকে আস্তে আস্তে। তবু বাড়ি ফেরে না। মাস পেরিয়ে বছর আসে। বছর যায়।প্রিয়াংশু আর টুসির ছেলের এখন পাঁচ বছর বয়স। প্রিয়াংশুর বাবা-মারও বয়স বাড়ে,সাথে টুসিকে নিয়ে চিন্তা। ওদের কিছু হয়ে গেলে মেয়েটার কি হবে? টাকা পয়সার অভাব হয়ত সেভাবে হবে না। কিন্তু সঙ্গী? একজন সঠিক সঙ্গী ছাড়া জীবন কাটানো যে কত দুস্কর তা ওনারা ভালোই বোঝেন। বাপের বাড়িতেও তো ঠাঁই হবে না মেয়েটার। তলে তলে সম্বন্ধ দেখা শুরু হয়। ছেলে শুদ্ধ টুসিকে যদি কোন মহানুভব গ্রহন করে তাকে ইটভাটার দায়িত্বও দিয়ে দেওয়া হবে বলে ঠিক করে ওরা...শর্ত একটাই ওদের ভালো রাখতে হবে। খবর মেলে অনেকেরই। অবশেষে পাওয়া যায় সেই মানুষটিকে যার হাতে টুসি ও তার ছেলেকে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হবে দুই বুড়োবুড়ি। ওদের কথা ফেলতে পারেনা টুসিও। রাজী হয়ে যায় বিয়েতে। ঠিক হয় বিয়ের দিন।

এদিকে একা থাকতে থাকতে ক্লান্ত প্রিয়াংশু হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেয় ফিরে আসার। যে ভাবে অসহায় অবস্থায় ফেলে এসেছিল টুসিকে তা ভেবে অনুশোচনাবোধ হয় ওর। অসুস্থ বাবা মার জন্য মন কেমন করে ওঠে। ছয় বছর কাপুরুষের মত পালিয়ে বেরিয়েছে সে। এখন ঘরে ফেরার জন্য উতলা। আর কোনদিকে তাকাবে না ও। দরকার হলে ওই ইটভাটাতেই আজীবন কাজ করবে। ভাবামাত্রই চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনার দেয় ও।

প্রিয়াংশু যখন বাড়ি পৌঁছায় ততক্ষণে টুসির বাসি বিয়ে হয়ে গেছে . . .




Previous Post Next Post