মানুষটি মিতবাক । আপাত গম্ভীর। শান্তিপ্রিয়। পুরোপুরি কাজের মানুষ । তবে কাছে গেলে বোঝা যায় রসবোধও তার পূর্ণ মাত্রাতেই আছে । কোনো ফালতু বখেরায় নেই, আপন মনে সাহিত্যসেবা করে যাচ্ছেন। আর একটা কাজও করেন তিনি। গুণীর কদর। আসলে যে উচ্চতায় উঠলে একটি মানুষ আত্মবিশ্বাসী হয়ে অন্যের দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে পারে, তিনি মেপে নিয়েছেন সেই শৃঙ্গ। এহেন মানুষটিকে খানিকটা ভয়ে ভয়েই অ্যাপ্রোচ করা, আর সঙ্গে সঙ্গে যে আন্তরিকতায় তিনি আমাদের মুখোমুখি হলেন, আমরা কৃতজ্ঞ এবং অভিভূত। এবারের ‘একমুঠো প্রলাপ’ এ আমরা হাজির সেই মানুষটির কাছে যিনি আমাদের অতন্ত্য শ্রদ্ধেয় এবং বিশিষ্ট সাহিত্যিক শ্রী ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত।


এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য একটাই, কবিতা তথা সাহিত্য সময়ে সময়ে দুর্বোধ্য হতে চায়। অথচ পৃথিবী যাবতীয় স্বীকৃত ধ্রুপদী এবং জনপ্রিয় সাহিত্য মূলত সহজবোধ্য। সহজ কবিতার বা সাহিত্যের টানে মানুষকে তাড়িত করতে হবে। কলকাতা থেকে দিনের বেলার ট্রেনে শিলিগুড়ি বা আসানসোল যাচ্ছে যে মানুষ সে ষ্টেশন থেকে একটা বাংলা কবিতা বা গল্পের বই কিনে পড়তে পড়তে যাক, যেমন ভাবে সে রঙচঙে পত্রপত্রিকা পড়তে পড়তে যায়, সাহিত্যের জনপ্রিয়তাকে সেই জায়গায় নিয়ে আসতে হবে। দুর্বোধ্যতার পরীক্ষা নিরীক্ষা তার পরে হোক।


চাকরির চাপ কোনদিনই গায়ে মাখিনি। এত কম বয়েসে চাকরিতে ঢুকেছি আর প্রথম থেকেই চাপের মধ্যে থেকে চাপটা এক রকমের অভ্যেস হয়ে গেছিল। লেখালেখি আমাকে একটা বিকল্প জগত এনে দিত, এখনও দেয়। বাস্তবে আমাদের নড়াচড়া সীমারেখার মধ্যে। লেখার জগতে আমি সম্পূর্ণ স্বাধীন। আমি সম্রাট। এটা আমাকে একটা জমিদারী মনোভাব এনে দেয়। সংবেদনশীল উদার জমিদারী। অত্যাচারী নয়। এই সাহিত্যচর্চাই আমার বিনোদন, তাই এইদিকে ঝোঁকা।




আধিকারিকের চাকরিতে দ্বৈত ভূমিকা থাকে। আদেশনামা পালন করা এবং আদেশ পালন করানো। যুগসাগ্নিকের সিদ্ধান্তগুলির ক্ষেত্রেও একই কথা। তবে অনেক সময়েই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সম্পাদক প্রদীপ আমার পরামর্শ গ্রহণ করেন, আমার সঙ্গে আলোচনা করেন। এমনকি দেশের বাইরে থাকলেও। তবে এটা তো স্বেচ্ছাব্রত। পরিকাঠামো নেই। নিজেদের কাজ নিজেরাই দৌড়োদৌড়ি করে করি। বাবলু, মিঠু, ইন্দ্রাণী, পামেলা, শুভাশিস, আমরা সবাই মিলেমিশে কাজ করি। তুমি, জয়া, নন্দিতা, অমিত আরও অনেকে আছেন, আসছেন। এখানে সরকারি চাকরির মত স্ট্রাকচারড হায়েরারকি নেই। তবে ওয়ার্কিং অ্যারাঞ্জমেন্ট তৈরি হয়ে যায় স্বাভাবিক নিয়মে।
অন্য পত্রিকাগুলোতে আমার ভূমিকা মূলত কন্ট্রিবিউটরের। মৃণালদা, পুণ্যশ্লোকদা, সোমা লাহিড়ী, ওবায়েদ আকাশ, বিভাস, ফাল্গুনীদা, কাজলদা, অমিত, জুবিন, মিলন ছাড়াও বহু সম্পাদক আমার কাছে লেখা চান। আমি চাইলেই লেখা দিই। নিজে থেকে কোথাও পাঠাই না। পাঠাবও না। ফেসবুক গ্রুপগুলোতেও না চাইলে সচরাচর লেখা দিই না।

কবিদের পরস্পরের ভার্বাল ডুয়েলের একটা সদর্থক দিক আছে। সেটা হচ্ছে প্রচারের আলো কেড়ে নেওয়া। তবে খারাপ দিক এই যে তাতে খেলো খেলো ভাব তৈরি হয়। এটা এড়াতে পারলেই ভালো। তবে রাজনৈতিক মতবাদের সমর্থন করার বদলে যদি কবিতার নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয় তবে মন্দ কী? কিন্তু দেখতে হবে ঐ প্ল্যাটফর্ম যেন ছেঁদো রাজনীতি আর কুঁদুলেপনার নতুন আখড়া না হয়ে ওঠে।


লিটিল্ম্যাগের সাথে তো সম্পৃক্ত হয়ে আছেন বহুদিন । পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে সম্পাদনার ? একক ভাবে সম্পাদনার কথা কখনো ভেবেছেন কি ?

এই সাহিত্য জগতে বেশিরভাগই যখন কাঁকড়ার মত এ ওর ঠ্যাং ধরে নামাতে চাইছে , আপনার মত সংখ্যালঘুরা যারা আলুফ থাকেন , তাদের কি নিঃসঙ্গ লাগে , নাকি আলাদা হয়ে একটা কলার তোলা ফিলিং হয় ?

এটা নিয়ে মাথা ঘামাই না। আমার প্রত্যাশা কিছু নেই। পাবার কিছু নেই। সাহিত্যে থাকি নিজের আনন্দে। কারও ভালো লাগলে ভালো, নইলে একা হেঁটে যাই। দলাদলি অকর্মণ্যতাকে প্রশ্রয় দেয় মেধাকে নয়, এটা আমার বিশ্বাস।

মাঝেমাঝেই দীর্ঘসময় বিদেশবাস করেন । কথায় বলে ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে । তো আপনি ওখানেও কোনো লিটেরারি সার্কেলে জয়েন করেছেন কি ? স্যোসাল মিডিয়া ছাড়া আর কিভাবে যোগ রাখছেন সাহিত্যের সাথে ?

বিদেশে বাংলা লেখার পত্রিকাগুলোতে আমার লেখা অনেকেই ছেপেছেন, ছাপাচ্ছেন। বিদেশি লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে ফেসবুকে। এখানে লিটেরারি সার্কেলে বন্ধুত্ব করলে আরও নতুন ক্ষেত্র উন্মুক্ত হবে। অতটা সামলাতে পারবো না। আর বিদেশে তো আমি অতিথি হয়ে থাকি। নিজের গাড়ি বা ডলার কিছু নেই। কাজেই এখানে অনেক সীমাবদ্ধ গতিবিধি। সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়াও কিছু অর্ডারি লেখা লিখছি। এভাবেই সাহিত্যের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে।


আবার বলি, যা করি নিজের আনন্দে করি। কোন কিছুর প্রত্যাশায় নয়। আর আমি যে অসফল তেমনও নয়। এই যেমন তুমি বলছ তেমনি অনেকেই বলেন আমি অন্যের গুণটাই তুলে ধরতে ভালোবাসি। আমার এই স্বাভাবিক আচরণ অনেকের কাছে ব্যতিক্রমী মনে হয়েছে। এখানেই আমার সাফল্য।

কবিতার পাশাপাশি আপনাকে দেখি ফিচার , ট্রাভেলগ ইত্যাদিও লিখতে । আপনার গদ্যগ্রণ্হের কোনো সংকলণ আছে কি ?

এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত আপনার কাব্যগ্রণ্হের সংখ্যা কটি ও কি কি ? এগুলি সবই কি ফ্লিপকার্টে পাওয়া যায় ? আপনি কোনো ই-বুক করেছেন কি ? ভেবেছেন করার কথা ?

ঠিক ইবুক নয় তবে আমার পিডিএফ করা আছে পাঁচটি বই। বিকেলে হ্রদের ধারে, জিরাফের বাগান, সে আসে ধীরে, জ্বলন্ত গিটার আর মৎসকন্যা। কেউ চাইলে এগুলো আমি ইমেল করে বা ফেসবুকে ইনবক্সে পাঠিয়ে দিই।


আপনার কলমের প্রতি আমাদের অকুন্ঠ ভালোলাগা, আপনার সাহিত্য জীবনের দীর্ঘ ঔজ্জ্বল্য এবং সাফল্য কামনা করি। আমাদের শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা নেবেন দাদা । শব্দের মিছিলের এক মুঠো প্রলাপে আপনার উপস্থিতির জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
Tags:
একমুঠো প্রলাপ