শ্রী ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত

sengupta


মানুষটি মিতবাক । আপাত গম্ভীর। শান্তিপ্রিয়। পুরোপুরি কাজের মানুষ । তবে কাছে গেলে বোঝা যায় রসবোধও তার পূর্ণ মাত্রাতেই আছে । কোনো ফালতু বখেরায় নেই, আপন মনে সাহিত্যসেবা করে যাচ্ছেন। আর একটা কাজও করেন তিনি। গুণীর কদর। আসলে যে উচ্চতায় উঠলে একটি মানুষ আত্মবিশ্বাসী হয়ে অন্যের দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে পারে, তিনি মেপে নিয়েছেন সেই শৃঙ্গ। এহেন মানুষটিকে খানিকটা ভয়ে ভয়েই অ্যাপ্রোচ করা, আর সঙ্গে সঙ্গে যে আন্তরিকতায় তিনি আমাদের মুখোমুখি হলেন, আমরা কৃতজ্ঞ এবং অভিভূত। এবারের ‘একমুঠো প্রলাপ’ এ আমরা হাজির সেই মানুষটির কাছে যিনি আমাদের অতন্ত্য শ্রদ্ধেয় এবং বিশিষ্ট সাহিত্যিক  শ্রী ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত।

আপনার কথা বললেই , আমার মনে পড়ে ‘সহজ কবিতা আন্দোলন’ এর কথা। একে জনপ্রিয় করবার জন্য এবং প্রাসঙ্গিকতা দানের ব্যাপারে আপনার অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই । কিভাবে এই আন্দোলনের কথা মাথায় এল ?


‘সহজ কবিতা আন্দোলন’ হঠাৎ করে জন্ম নিল। আমি আর উত্তরবঙ্গের শেখরবাবু একদিন ইনবক্সে গল্প করতে করতে ঠিক করি এই থিমের ওপরে একটা ফেসবুক গ্রুপ করতে হবে। পরে সেটাকে আমরা ‘সহজ সাহিত্য আন্দোলন' নাম দিয়ে পরিসরটা বাড়াই। বহু ভালো কবিতা ও গল্প পাচ্ছি। কিছু মানুষ গ্রুপকে বাঁচিয়ে রেখেছেন নিয়মিত লেখা দিয়ে। তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ।

এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য একটাই, কবিতা তথা সাহিত্য সময়ে সময়ে দুর্বোধ্য হতে চায়। অথচ পৃথিবী যাবতীয় স্বীকৃত ধ্রুপদী এবং জনপ্রিয় সাহিত্য মূলত সহজবোধ্য। সহজ কবিতার বা সাহিত্যের টানে মানুষকে তাড়িত করতে হবে। কলকাতা থেকে দিনের বেলার ট্রেনে শিলিগুড়ি বা আসানসোল যাচ্ছে যে মানুষ সে ষ্টেশন থেকে একটা বাংলা কবিতা বা গল্পের বই কিনে পড়তে পড়তে যাক, যেমন ভাবে সে রঙচঙে পত্রপত্রিকা পড়তে পড়তে যায়, সাহিত্যের জনপ্রিয়তাকে সেই জায়গায় নিয়ে আসতে হবে। দুর্বোধ্যতার পরীক্ষা নিরীক্ষা তার পরে হোক।

 আপনি তো কর্মজীবনে প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । কাঠখোট্টা জব । তারপরেও এই সাহিত্যের ভূত সামলাতেন কিভাবে ?



চাকরির চাপ কোনদিনই গায়ে মাখিনি। এত কম বয়েসে চাকরিতে ঢুকেছি আর প্রথম থেকেই চাপের মধ্যে থেকে চাপটা এক রকমের অভ্যেস হয়ে গেছিল। লেখালেখি আমাকে একটা বিকল্প জগত এনে দিত, এখনও দেয়। বাস্তবে আমাদের নড়াচড়া সীমারেখার মধ্যে। লেখার জগতে আমি সম্পূর্ণ স্বাধীন। আমি সম্রাট। এটা আমাকে একটা জমিদারী মনোভাব এনে দেয়। সংবেদনশীল উদার জমিদারী। অত্যাচারী নয়। এই সাহিত্যচর্চাই আমার বিনোদন, তাই এইদিকে ঝোঁকা। 


বৌদিকে কাছ থেকে দেখেছি। মনে হয়েছে , ইউ আর মেড ফর ইচ আদার । আমার এই অবলোকন কতটা যথার্থ ? আপনার সাহিত্যসেবাকে এটা কোনোভাবে প্রভাবিত করে কি ?



অজন্তা অত্যন্ত ভালো একটি মেয়ে। সরল এবং অনুভূতিপ্রবণ। আপনপর ভেদাভেদশূন্য। চাহিদাহীন। ওঁর পূর্বপুরুষদের অন্যতম শহীদ দিনেশ গুপ্ত। বাবার আপন কাকা। পরিবারটাই স্বার্থবোধ বিসর্জিত। মাঝে মাঝে মনে হয় ওঁর প্রতি আমি হয়ত যথাযথ যত্নশীল হতে পারি না। আমার সমস্ত কাজে অজন্তা নিরলস সঙ্গী। আমার বন্ধুরা সবাই ওঁর বন্ধু, সে চাকরিজগতেরই হোক বা লেখালেখির সুবাদেই হোক।

আপনি ‘যুগ সাগ্নিক’ ছাড়াও সম্ভবত ‘ভাষানগর’ এবং আরো কিছু লিটিল ম্যাগাজিনের সম্পাদকমন্ডলী বা অন্য গঠনতন্ত্রের সাথে যুক্ত আছেন । আপনার প্রশাসনিক দক্ষতা কি এইসব ক্ষেত্রেও ম্যানেজমেন্ট এ সাহায্য করে ?




'ভাষানগরে' এর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ক্ষীণ। সুবোধবাবু মাঝে মাঝে কিছু কাজের দায়িত্ব দিলে পালন করি। লিখতে বললে লিখি। সুবোধবাবু আমাদের পারিবারিক সুহৃদ। আমার স্নেহের জন। 'যুগসাগ্নিকের' সঙ্গে আমার যোগাযোগ অনেক বেশি। সম্পাদক প্রদীপ আমাকে যেমন কাজ করতে বলে তেমন করি। প্রুফ দেখা প্রেসে ছোটা কাগজ কেনা ওঁর সব কাজে আমাকে ডাকলেই থাকি। ওঁর সভাগুলোতে থাকি। আমার বাড়িতেও সভা বসাই 'যুগসাগ্নিকের' জন্য। এই আর কি।

আধিকারিকের চাকরিতে দ্বৈত ভূমিকা থাকে। আদেশনামা পালন করা এবং আদেশ পালন করানো। যুগসাগ্নিকের সিদ্ধান্তগুলির ক্ষেত্রেও একই কথা। তবে অনেক সময়েই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সম্পাদক প্রদীপ আমার পরামর্শ গ্রহণ করেন, আমার সঙ্গে আলোচনা করেন। এমনকি দেশের বাইরে থাকলেও। তবে এটা তো স্বেচ্ছাব্রত। পরিকাঠামো নেই। নিজেদের কাজ নিজেরাই দৌড়োদৌড়ি করে করি। বাবলু, মিঠু, ইন্দ্রাণী, পামেলা, শুভাশিস, আমরা সবাই মিলেমিশে কাজ করি। তুমি, জয়া, নন্দিতা, অমিত আরও অনেকে আছেন, আসছেন। এখানে সরকারি চাকরির মত স্ট্রাকচারড হায়েরারকি নেই। তবে ওয়ার্কিং অ্যারাঞ্জমেন্ট তৈরি হয়ে যায় স্বাভাবিক নিয়মে। 

অন্য পত্রিকাগুলোতে আমার ভূমিকা মূলত কন্ট্রিবিউটরের। মৃণালদা, পুণ্যশ্লোকদা, সোমা লাহিড়ী, ওবায়েদ আকাশ, বিভাস, ফাল্গুনীদা, কাজলদা, অমিত, জুবিন, মিলন ছাড়াও বহু সম্পাদক আমার কাছে লেখা চান। আমি চাইলেই লেখা দিই। নিজে থেকে কোথাও পাঠাই না। পাঠাবও না। ফেসবুক গ্রুপগুলোতেও না চাইলে সচরাচর লেখা দিই না। 

আগেকার দিনে কবির লড়াই বলে একটা ব্যাপার চালু ছিল । সেটা একটা খেলা হিসেবেই দেখা হত । মানুষও বেশ উপভোগ করতো সেটা । জমিয়ে আসর বসতো । কিন্তু আজকাল গণ মাধ্যমে কবিতে কবিতে যে খিস্তি খেউড় চালু আছে তা বাংলা কবিতাকে কতটা পজিটিভ কি দিচ্ছে ?


কবিদের পরস্পরের ভার্বাল ডুয়েলের একটা সদর্থক দিক আছে। সেটা হচ্ছে প্রচারের আলো কেড়ে নেওয়া। তবে খারাপ দিক এই যে তাতে খেলো খেলো ভাব তৈরি হয়। এটা এড়াতে পারলেই ভালো। তবে রাজনৈতিক মতবাদের সমর্থন করার বদলে যদি কবিতার নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয় তবে মন্দ কী? কিন্তু দেখতে হবে ঐ প্ল্যাটফর্ম যেন ছেঁদো রাজনীতি আর কুঁদুলেপনার নতুন আখড়া না হয়ে ওঠে।


আপনি তো অনুবাদও করে থাকেন । আপনার বিষয় ছিল ইংরেজী সাহিত্য । কখনো সিরিয়াসলি অনুবাদের কথা ভেবেছেন কি ? মানে , একটি সংকলণের আকারে বড় কাজ ?




অনুবাদ করতে ভালোবাসি। কেউ কাজ দিলে কাজ করতে ইচ্ছে হয়। এলোপাথাড়ি কাজ করবো না। 




লিটিল্ম্যাগের সাথে তো সম্পৃক্ত হয়ে আছেন বহুদিন । পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে সম্পাদনার ? একক ভাবে সম্পাদনার কথা কখনো ভেবেছেন কি ?




এটার উত্তরও একই। কেউ সম্পাদনা করতে বললে করবো। সানন্দেই করবো।




এই সাহিত্য জগতে বেশিরভাগই যখন কাঁকড়ার মত এ ওর ঠ্যাং ধরে নামাতে চাইছে , আপনার মত সংখ্যালঘুরা যারা আলুফ থাকেন , তাদের কি নিঃসঙ্গ লাগে , নাকি আলাদা হয়ে একটা কলার তোলা ফিলিং হয় ?



এটা নিয়ে মাথা ঘামাই না। আমার প্রত্যাশা কিছু নেই। পাবার কিছু নেই। সাহিত্যে থাকি নিজের আনন্দে। কারও ভালো লাগলে ভালো, নইলে একা হেঁটে যাই। দলাদলি অকর্মণ্যতাকে প্রশ্রয় দেয় মেধাকে নয়, এটা আমার বিশ্বাস।



মাঝেমাঝেই দীর্ঘসময় বিদেশবাস করেন । কথায় বলে ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে । তো আপনি ওখানেও কোনো লিটেরারি সার্কেলে জয়েন করেছেন কি ? স্যোসাল মিডিয়া ছাড়া আর কিভাবে যোগ রাখছেন সাহিত্যের সাথে ?



বিদেশে বাংলা লেখার পত্রিকাগুলোতে আমার লেখা অনেকেই ছেপেছেন, ছাপাচ্ছেন। বিদেশি লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে ফেসবুকে। এখানে লিটেরারি সার্কেলে বন্ধুত্ব করলে আরও নতুন ক্ষেত্র উন্মুক্ত হবে। অতটা সামলাতে পারবো না। আর বিদেশে তো আমি অতিথি হয়ে থাকি। নিজের গাড়ি বা ডলার কিছু নেই। কাজেই এখানে অনেক সীমাবদ্ধ গতিবিধি। সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়াও কিছু অর্ডারি লেখা লিখছি। এভাবেই সাহিত্যের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে। 

এই বেঁটে বামনদের দুনিয়ায় সকলেই প্রায় উদ্ভ্রান্ত ছুটছে নিজের নিজের ঢাক পেটাতে । সেখানে আপনি নিয়মিত অন্যের প্রপাগন্ডা করে যান, লেখা শেয়ার করেন । অন্যকে এই শ্রদ্ধা ভালোবাসা সম্মান প্রদর্শন আপনাকে কতটুকু ফিরিয়ে দেয় ?


আবার বলি, যা করি নিজের আনন্দে করি। কোন কিছুর প্রত্যাশায় নয়। আর আমি যে অসফল তেমনও নয়। এই যেমন তুমি বলছ তেমনি অনেকেই বলেন আমি অন্যের গুণটাই তুলে ধরতে ভালোবাসি। আমার এই স্বাভাবিক আচরণ অনেকের কাছে ব্যতিক্রমী মনে হয়েছে। এখানেই আমার সাফল্য।



কবিতার পাশাপাশি আপনাকে দেখি ফিচার , ট্রাভেলগ ইত্যাদিও লিখতে । আপনার গদ্যগ্রণ্হের কোনো সংকলণ আছে কি ?




 আমার গদ্যগ্রন্থের সংকলন বের করেছিলো রোহণ কুদ্দুস। ‘টুকরোগুলো’। সৃষ্টিসুখ প্রকাশনার পক্ষে।





এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত আপনার কাব্যগ্রণ্হের সংখ্যা কটি ও কি কি ? এগুলি সবই কি ফ্লিপকার্টে পাওয়া যায় ? আপনি কোনো ই-বুক করেছেন কি ? ভেবেছেন করার কথা ?


আমার দুটি কবিতার বই আছে। বিকেলে হ্রদের ধারে আর জিরাফের বাগান। প্রথমটির প্রকাশক দীপ প্রকাশন আর দ্বিতীয়টির কিরীটী সেনগুপ্ত। ওঁরাই জানেন কীভাবে পাওয়া যাবে।

ঠিক ইবুক নয় তবে আমার পিডিএফ করা আছে পাঁচটি বই। বিকেলে হ্রদের ধারে, জিরাফের বাগান, সে আসে ধীরে, জ্বলন্ত গিটার আর মৎসকন্যা। কেউ চাইলে এগুলো আমি ইমেল করে বা ফেসবুকে ইনবক্সে পাঠিয়ে দিই। 


 কেমন বুঝছেন বাংলা কবিতার ভবিষ্যত ? 




বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ কতগুলো ইফস অ্যান্ড বাটসের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। বিদেশে না এলে বোঝা যায় না আমরা কতটা অজ্ঞানতার স্বর্গে বাস করি। সমাজবদ্ধতার মূল লক্ষ্য যৌথ অগ্রগতি। আমরা অনেকাংশেই ব্যক্তিচিন্তায় ডুবে যাই। কবিতা যদিও ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিল্প তথাপি এর প্রচার এবং প্রসারে একসঙ্গে ঝাঁপানো দরকার। আগে কবিতা আর সাহিত্যকে বাঁচাও। নিজে স্বাভাবিক নিয়মেই বেঁচে থাকবে। হাত ধরো, হাত বাড়াও। ভালোই হবে।



আপনার কলমের প্রতি আমাদের অকুন্ঠ ভালোলাগা, আপনার সাহিত্য জীবনের দীর্ঘ ঔজ্জ্বল্য এবং সাফল্য কামনা করি। আমাদের শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা নেবেন দাদা । শব্দের মিছিলের এক মুঠো প্রলাপে আপনার উপস্থিতির জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।

Previous Post Next Post