রুমকি রায় দত্ত

rumki





পাতা ঝরার মাস চলছে,এই সময় এমনিতেই সকলের মন উদাস থাকে। পরিবেশে কেমন একটা একাকিত্ত্বের ‘লু’ বয়। শরীর এমন শুকিয়ে যায়,মনে হয় শরীরের সব জল পরিবেশের সাথে মিশে গেছে। বন্দনার শরীরেও যেন ‘লু’ লেগেছে। চামড়ায় আর আগের মত চিকনতা নেই। গায়ের রঙ ওর বরাবরই কালোই ছিল,কিন্তু জৌলুস ছিল ষোলোআনা। হবে নাই বা কেন,আগে শরীরের কত যত্ন নিত। রাতে শোয়ার আগে শহর থেকে আনানো জলপাই তেল আর ঘৃতকুমারীর রস মিশিয়ে গায়ে হাতে-পায়ে মাখতো। অল্প অল্প করে সঞ্চিত অর্থে ওই দামি তেল কিনতো। আর মাখবে নাই বা কেন? আগে তো ওর একটা লক্ষ ছিল। এখন সে লক্ষভ্রষ্ট হয়েছে। ও ভালো করেই বুঝে গেছে রুকবানুরকে আর কোনো দিনই ও পাবে না। সে এখন রুকাইয়ার।

উঠে দাঁড়ালো বন্দনা। ঠোঁট ফেটে চৌচির,ঠিক ওর মনটার মতো। ঠোঁটে সজীবতা আনতে জিভ দিয়ে চেঁটে নিল ঠোঁটটা কে। আয়নাটাও ভাঙা,চারটে ফাটল ধরেছে। মা কতবার বলেছে “ ওলো মুখপুড়ি,ভাঙা আয়নায় মুখ দেখিসনি,কপালখানাও ভাঙা পড়বে যে’। অস্ফুটে বললো “ভাঙা আয়না” আয়নাটাকি আর নিজে নিজে ভেঙেছে? সেদিন যখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছিল,ঠিক তখনই তো শুনলো দাদা মাকে বলছে ‘ ঐ অজাত-কুজাতের ছেলেটা রুকাইয়াকে নিয়ে ভেগেছে, আর কোনো চিন্তা নেই গো মা’। সেদিনই তো হাত থেকে পড়ে আয়নাটার এই দশা।

রুকবানুর সেই মাসখানেক আগে রুকাইয়াকে নিয়ে কোথায় যে গেল,আর কোনো হদিস পায়নি। তবু যেন ওর চোখে মুখে প্রতিক্ষা লেগে আছে। বাপ-মা মরা অনাথ অসহায় বলেই না একদিন ভালোবেসে ছিল রুকবানুরকে।লোকের দোকানে মুটেগিরি করে দুবেলা পেট ভরাতো। রুকবানুরের মত অমন সুপুরুষ চেহারার ছেলে চোখে-মুখে কালি মেখে লোকের দোকানের সামনে পড়ে রাত কাটায়,শীতের রাতে ছেঁড়া কাঁথায় কুঁকড়ে শুয়ে অপেক্ষা করে ভোরের সূর্যের উত্তাপের জন্য, সহ্য হয়নি বন্দনার। প্রতি মুহূর্ত মনে হয়েছে ছুটে গিয়ে সাহায্য করে ওকে, কিন্তু পারেনি।ওদের ধর্ম যে আলাদা। যতদিন ও এবাড়িতে থাকবে ততদিন রুকবানুরের কাছে যেতে পারবে না। আর সব ছেড়ে যে রুকবানুরের কাছে যাবে,সেটাও সম্ভব ছিল না। ওর ভালোবাসা যে একতরফা। কত চেষ্টা করেছে রুকবানুরের মন যাচাই করার,পারেনি। কোনো দিন রুকবানুর ওর দিকে মুখ তুলে তাকায়নি পর্যন্ত। তবু বন্দনা ওকে ভালোবাসে, আজও ভালোবাসে,রুকবানুর আর কোনোদিনও ওর হবে না জেনেও ভালোবাসে। ভালোবাসায় তো কোন শর্ত থাকে না। দু’পা এগিয়ে এসে মাটির দেওয়ালে টাঙানো কালি মূর্তিটার সামনে এসে দাঁড়ায় বন্দনা। মনে মনে প্রার্থনা করে বলে “ হে ভগবান, আমার রুকবানুরকে তুমি ভালো রেখো, সুখে রেখো। আর আমি কিছু চাই না, শুধু একবার তার খোঁজটি যেন পাই”। ফটোর পিছনে হাত ঢুকিয়ে বার করে আনে এক থোক টাকা। তিল তিল করে জমিয়েছে। সে যে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে রুকবানুরকে সাবলম্বি বানাবে। আর লোকের দোকানে কাজ করতে দেবে না। ওর জমানো টাকায় রুকবানুরকে একটা রিকশা কিনে দেবে। রিকশার মালিক হয়ে রুকবানুর অনেক টাকা কামাবে, মাথার উপর ছাদ বানাবে আর দূর থেকে ওর সুখ দেখে ভরে উঠবে বন্দনার মন-প্রাণ। রুকবানুর এভাবে হারিয়ে না গেলে সামনের ঈদেই ও রুকবানুরকে টাকাটা উপহার দিত। যদি না নিতে চায়তো, তবে সে ব্যবস্থাও ওর ভাবা ছিল। রুকবানুরকে ধার হিসাবে ও টাকাটা দিতো, তেমন হলে রুকবানুরের বন্ধুদের সাহায্য নিত,তবু ও রুকবানুরকে রিকশাওয়ালা বানিয়েই ছাড়তো।

হাতে ধরা টাকার থোকা মুঠোয় চেপে ধরে বন্দনা। অস্থির হয়ে ওঠে ভিতরে ভিতরে। কত কষ্টে মদখোর ভাই, পাকা ব্যবসায়ী মা’র শ্যেন দৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে তিলতিল জমিয়েছে টাকাটা,কিছুতেই জলে যেতে দেবেনা। যেমন করেই হোক রুকবানুরকে খুঁজে বার করতে হবে। টাকা কটা ঠাকুরের ফটোর পিছনে, বাঁশের খুঁটির আড়ালে লুকিয়ে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে বন্দনা। কলতলার পাশে ছোট্ট বাথরুমের দেওয়ালে টাঙানো ব্রাশদানি থেকে নিজের ব্রাশটা তুলে নেয়। পেস্ট সহ ব্রাশটা মুখে গুঁজে পুবদিকের দুয়ার খুলে দাঁড়ায় গিয়ে। সামনে বিস্তীর্ণ খেত ঠিক ওদের বাড়ির সামনের ছয়ফুটের চওড়া রাস্তার পর থেকেই শুরু হয়েছে, যার কোনো সীমানা নেই, দিগন্ত বিস্তৃত। ব্রাশ মুখে উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বন্দনা। কষ বেয়ে গড়িয়ে নামতে থাকে সাদা ফেনা। টপ করে একফোঁটা ফেনা এসে পরে ওর কালো চামড়ার পেটের উপর। চমকে ওঠে বন্দনা। এতক্ষণ যেন কোন খেয়ালে ভেসে বেড়াচ্ছিল। ঐ খেতের দিকে তাকালেই ও হারিয়ে যায়। এক অলিক স্বপ্ন জাগে ওর মনে। সিনামার নায়ক-নায়িকার মতো ও আর রুকবানুর খেতের মাঝে হাত ধরে ছুটে ছুটে বেড়ায়। হাওয়ায় উড়তে থাকে ওর আঁচল। 

গ্রামের একেবারে শেষ প্রান্তে বন্দনাদের বাড়ি। বড় রাস্তা থেকে ওদের বাড়ি ছাড়িয়ে কিছুদূর গিয়ে ডান হাতে যে চায়ের দোকানটা আছে, ওই পর্যন্তই রাস্তাটা ইঁট বাঁধানো। তারপর মেঠোপথ গ্রামের ভিতরে ঢুকে গেছে। রুকবানুরকে ও প্রথম এই রাস্তাতেই দেখেছিল। সরকারি প্রকল্পের একশ দিনের কাজে রাস্তায় ইঁট পাতার কাজ করতে এসেছিল রুকবানুর। অমন রূপবান ছেলে রাস্তায় রোদে-জলে ইঁট পাতার কাজ করছে দেখে বন্দনা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখেছিল ওর কাজ। আনমনে নিষ্ঠা ভরে প্রতিদিন কাজ করতো রুকবানুর। আর বন্দনা পূবদিকের দরজা খুলে তাকিয়ে থাকতো ওর দিকে। অনেক চেনা মুখের মাঝে এই অচেনা মুখটি ওকে টেনে আনতো দরজার কাছে। রাস্তা তৈরির কাজে তদারকির দায়িত্বে ছিল বন্দনার দাদা। দাদার কাছেই জেনেছিল রুকবানুর আসলে এগাঁয়েরি ছেলে নয়,কেউ ওর আসল পরিচয়ও জানে না। পার্টির ছেলেরা বলে কয়ে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। একদিন রাস্তার কাজ শেষ হয়ে গেছে। বন্দনা ভেবেছিল রুকবানুরকে বুঝি আর ও দেখতে পাবে না, রুকবানুর আর আসবে না জেনেও কোন অমোঘ টানে প্রতিদিন সকালে পূবদুয়ার খুলে দাঁড়িয়ে থেকেছে। সেদিন বন্দনার সব আশঙ্কা মিথ্যে করে দিয়েছিল রুকবানুর। রাস্তার কাজ শেষ হওয়ার পরে প্রতিদিন সকালে রুকবানুর সামনের চায়ের দোকানে চা-খেতে আসতে শুরু করে। প্রথম প্রথম বন্দনা এলোমেলো হয়েই দাঁড়িয়ে থাকতো। ধীরে ধীরে নিজের সাজ পোশাকের পরিবর্তন আনে বন্দনা আর একে একে চোখে আঁকতে থাকে রুকবানুরের সঙ্গে নিজের আগামির স্বপ্ন। যেদিন প্রথম চায়ের দোকানে রুকবানুরের সাথে রুকাইয়াকে ঢলানিপনা করতে দেখেছিল, সেদিনই বুঝেছিল,রুকবানুরকে আর কোনোদিনই ওই শাকচুন্নির কাছ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। ভালোবাসার এক অদৃশ্য জ্বালায় প্রতিনিয়ত জ্বলেছে বন্দনা তবু ভালোবেসেছে রুকবানুরকে।----এভাবেই ভালোবেসে যাবে,যেদিন চিতায় শুয়ে বন্ধ চোখে নীল আকাশ দেখবে,সেদিনও একই ভাবে ভালোবাসে যাবে রুকবানুরকে। শুধু একটাই আফসোস, রুকবানুরকে খুঁজে না পেলে এত কষ্টে জমানো টাকা কটা আর দিতে পারবে না, ওর রুকবানুরের আর নিজের রিকশা কেনা হবে না,এভাবে লোকের দোকানে মুটেগিরি করেই হয়তো ওকে বাকি জীবনটা কাটাতে হবে।

বন্দনার দু’চোখ গড়িয়ে জল নেমে এলো। অনেক বছর পর ওর চোখ এভাবে ভিজে গেল। রুকবানুর চলে গেছে জেনেও এভাবে কাঁদেনি। কিন্তু আজ যেন ও এক উদ্ভূত বিলাসিতায় ভিজতে চায়ছে। এভাবে নরম সূর্যের আলোয় অতীতের স্মৃতিতে ভেসে যেতে চায়ছে ওর মন। মনে হচ্ছে এভাবে ঘন্টা-মাস-বছর এই পূবদুয়ারেই যদি কাটিয়ে দিতে পারতো রুকবানুরের প্রতীক্ষায়!

----‘বলি ওলো মুখপুড়ি, এভাবে সকাল থেকে মহারানির মত দোরের গোঁড়ায় দাঁইড়ে কার নাম জপ করা হচ্ছে শুনি। বলি সমত্ত মেয়ে মানুষ কি এমনে এমনে ভাত জুটবে? গতর খাটাতি হবিনি?” মা মহামায়র খনখনে গলার আওয়াজে চমকে পিছন ফিরে তাকায় বন্দনা। ওর মায়ের স্বভাবটা এমনই। অন্যদিন হলে এই কুকথার উত্তর দিতনা বন্দনা,কিন্তু আজ ওর মনটা ভালো নেই। যত দিন যাচ্ছে মনটা তত ওর অস্থির হয়ে উঠছে। মহামায়ার দিকে তাকিয়ে ঝাঁজিয়ে বলে উঠলো “অত রোঁয়াব দেখাইছো কাকে? এতবড় বিজনেজ কি তুমি একার দমে চালাচ্ছো? আমি না থাকলে চলতো তোমার বড়ির ব্যবসা এত রমরমিয়ে?”

মেয়ের কথায় রে রে করে তেড়ে আসে মহামায়া, ওর মনে ইচ্ছা হয় ছুটে গিয়ে ছুঁড়ির চুলের মুঠি ধরে দরজার চৌকাঠে ওর মাথাটা ঠুকে দিতে। কিন্তু থেমে যায়, মেয়েটাতো ভুল কিছু বলেনি, সত্যিই ওর মত লক্ষ্মী গড়নের মেয়ে বলেই না অমন সুন্দর বড়ি দেয়। সত্যিই মেয়েটা একেবারে শিল্পী। কারোর কাছে শেখেনি তবুও গহনা বড়িতে ও দক্ষ কারিগরকেও হার মানায়। মেদনিপুরের এই শিল্প যে ও কেমন করে এত নিক্ষুঁত ভাবে শিখলো! ভাবলে অবাক লাগে মহামায়ার। সেই কোন ছোটোবেলায় এক মেলায় গিয়ে এভাবে বড়ি দিতে দেখেছিল কাকে। তারপর বন্দনার বাবা হঠাৎ মারা গেলে মহামায়ার সামনে যখন অথৈ জল তখন বন্দনায় তো স্বনির্ভর গোষ্ঠির থেকে লোন তুলে মাকে বড়ির ব্যবসা করার কথা বলে। এই মেয়ের ভরসাতেই তো আজ ছেলে-মেয়ে নিয়ে মাথা তুলে বেঁচে আছে মহামায়া। নিজের ব্যবহারে কেমন একটা আফসোস জাগে মহামায়ার মনে। আসলে ওই এক চালচুলোহীন মুছলমানের ছেলের জন্য তিলেতিলে মেয়েটাকে কষ্ট পেতে দেখে আজকাল ওর ও আর মাথার ঠিক থাকে না। ওরা যদি সমাজের বাইরে থাকতো তাও না হয় একবার ভেবে দেখতো,কিন্তু সমাজে থেকে এতবড় অনাচার ওরা করে কেমন করে? আর এখন তো সে সুযোগও নেই। সে ছোঁড়াতো ভেগেছে। তবু মেয়েটা কার পথচেয়ে ওভাবে দাঁইড়ে থাকে কে জানে। এগিয়ে আসে মহামায়া। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ‘ এভাবে কাজ না করে, সময় নষ্ট করলে আমাদের চলবে কি করে বলতো? আসছে সপ্তাহের মধ্যে অর্ডারটা পূরণ করতে হবে তো,যা মা, বড়ি কটা তাড়াতাড়ি দিয়ে দে মা”। বন্দনা ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় কাজের ঘরের দিকে। কাপড়ের উপর পোস্ত ছড়ানো,তার উপর বাঁটা কলাইডাল দিয়ে এঁকে ফেলতে হবে গয়নার নকসা। বন্দনার হাত ঘুরতে থাকে। তার উপর ফুটে উঠতে থাকে গয়নার নক্সার বদলে বাংলা বর্ণমালার অক্ষর। যে অক্ষর গুলো ওর মনে গাঁথা আছে।

[২]

বসন্ত বিরহে কেটে যায় বন্দনার। গ্রীষ্মের তাপদগ্ধ মনে জাগে অতৃপ্তির হাহাকার। যন্ত্রণার ক্ষতে আর নতুন করে রক্তক্ষরণ হয় না। বন্দনা এসে বসে দাওয়াতে,একটা বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে থোকা থোকা কালো মেঘ সরে সরে যাচ্ছে। বর্ষা আসছে। এই সময়টা ওদের ব্যবসার মন্দা সময়। কাজের চাপ কম। ফাঁকা বসে থাকতে ভালোলাগে না বন্দনার। ফাঁকা থাকলেই মনে পড়ে রুকবানুরের কথা। পৃথিবীর যত যন্ত্রণায় মানুষের বুকে বাজুক না কেন, একমাত্র কাজই পারে মানুষের যন্ত্রণার প্রলেপ হতে। বিগত ছয়টা মাসে বন্দনা তাই শুধু কাজের কথায় ভেবেছে। তাই এবছর এত ভালো উপার্জন হয়েছে যে, মন্দার মাস কটা যদি ওরা বসেও থাকে, খাওয়ার অভাব হবে না। কিন্তু শুধু পেটের খিদে মেটালেই যে বন্দনার চলবে না। মনের পেট ভরাতে ওর কাজ চায়। এত কাজ যে নিজের কথাও ভাবার সময় থাকবে না। যে ভাবে রুকবানুরে ডুবে কাজকে ভুলেছিল,ঠিক সেই ভাবে কাজে ডুবে রুকবানুরকে ভুলতে চায়। কিন্তু এই মুহূর্তে তো অবসর তাই বারবার রুকবানুর ওর মনে আসা-যাওয়া শুরু করেছে। ভাবতে থাকে বন্দনা—‘ভক্তের একনিষ্ঠ ভজনায় ঈশ্বরও পৃথিবীতে নেমে আসে। তবে কি রুকবানুরের প্রতি ওর ভালোবাসা একনিষ্ঠ নয়!”---তখনি একঝাঁক ঝুরোঝুরো বৃষ্টি ঝিরঝির করে ঝরে পড়ে বন্দনার চোখে মুখে। বন্দনা একটু একটু করে ভিজতে থাকে। পূবদিকের সদর দরজার কড়াটা কিনকিন করে বেজে উঠতেই দৌড়ে যায় বন্দনা। একটানে ছিটকিনি খুলে বাইরে বেরোতেই দেখে সামনে দাঁড়িয়ে ছোটন। অপ্রত্যাশিত ছোটনকে সামনে দেখে স্থির হয়ে যায় বন্দনা। জিজ্ঞাসা করে 

কি হয়েছেরে ছোটন? তুই এখন এখানে?

ছোটন বুঝি দৌড়াতে দৌড়াতে এসেছে,তাই হাঁপাতে হাঁপাতে সামান্য ঢোক গিলে বলে “ সে এসেছে রে বন্দনাদি, তারে আমি স্পষ্ট দেখলাম”

“কে এসেছে ছোটন? তুই কাকে দেখলি?”

“তারে তারে, যার জন্য তুই একায় বসি কাঁদিস। জিগায়ছিল তোর কথা,আমি বলিনি। বলেছি,একবার নিজের চোখেই দেইখে এসো। সেইখান থেকে এক্কেবারে ছুটতে ছুটতে আসছি। এখন তো তোর বাড়িতে কেউ নেই। যাবি তুই?’

বৃষ্টির বেগ যে কখন বেড়ে গেছে বুঝতেই পারেনি বন্দনা। সপসপে ভেজা শরীরে কাঁপুনি লাগলো ওর। থরথর করে কাঁপছে ওর শরীর। এ কাঁপন কিসের জানে না বন্দনা শুধু যেন অনুভব হয় ও বুঝি মাটি ছেড়ে শূন্যে ভেসে আছে। বন্দনাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঠেলা লাগায় ছোটন ‘ কিরে বন্দনা দি, যাবি তুই?’

বন্দনা দু’পা বাড়িয়ে থেমে যায়। মনে পড়ে যায় রুকাইয়ার কথা। ওর আর রুকবানুরের পথ দু’দিকে বেঁকে গেছে এখন, যেন সরলরেখার দুটি বিন্দু। ভেজা শরীরে কাঁপতে কাঁপতে বলে ‘

অনেক দেরি হয়ে গেছে রে ছোটন, এখন আর তার কাছে গিয়ে কি হবে বল? সে এখন সংসারী। রুকাইয়ার স্বামীর সাথে আমার দেখা করা ঠিক হবে না রে’।

কিন্তু সঙ্গে তো কাউকে দেখলাম না,শুধুই দেখলাম ওই ছেলেটা একায় দাঁড়িয়ে আছে বড় রাস্তার ধারে খেতের দিকে চেয়ে। পাশে একটা রিকশা। আমায় দেখে ডেকে বলল—‘ এটা কিনলাম রে। এখন আমি রিকশাওয়ালা’। 

বন্দনা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না, ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে রুকবানুরের বুকে। সন্ধ্যা নেমে আসে ধীরে ধীরে। বৃষ্টি আরো তীব্র হয়।একজোড়া নারী-পুরুষের দেহ ভিজিয়ে বৃষ্টির ধারা বয়ে চলে নদীর পথে। বন্দনা ওর রিকশাওয়ালার রিকশায় বসে পাড়ি দেয় অজানিতের পথে।

[৩]

ঈদের চাঁদ উঠেছে। গোটা শহর মেতে উঠেছে উৎসবের মেজাজে। বন্দনা শহুরে চারতলা কোঠাবাড়ির চিলেকোঠার একচিলতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। এই শহরের মস্তবড় পতিতালয়ের জানালা থেকে শহরটাকে বড্ড ছোট মনে হয়, ছোটো মনে হয় মানুষগুলোকে। তার মাঝেও ওর চিনতে ভুল হয়না রুকবানুর রিকশাওয়ালাকে। সে আর এখন রিকশাওয়ালা নেই। বন্দনার শরীর বেচা টাকায় কেনা নতুন অটোটা নিয়ে ক্রমশ মিশে যাচ্ছে ভিড়ের মাঝে। বন্দনা জানতো না যে,সে নিজে এত অসামান্য এক নারী। রুকবানুরের জুহুরীর চোখ। রুকবানুর ওকে রত্ন বানিয়েছে, শহরের বাজারে যার মুল্য হাজারে নয়, লাখে। বন্দনা রাস্তার ভিড় থেকে চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকায়। ঈদের একফালি চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলে “ ঈদ মুকবারক রুকবানুর, আমার রুকবান” ওর দুচোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে স্বচ্ছ দু’ফোঁটা ‘জল’ রুকবানের দেওয়া ঈদের ছোট্ট উপহার। 

Previous Post Next Post