লিপিকা ঘোষ

lipika



‘মহানগর’
‘মহানগর ?’
‘মহানগর !’
‘মহানগরই?

‘হ্যাঁ । নেক্সট প্লে’ 
‘আরেকটা মেলোড্রামা । পাবলিক খিস্তি’ । 
‘খেয়েছিস ? এবারেরটায় ?’
কিছুক্ষণ চুপ করে অর্নব উত্তর করে ‘না তা খাইনি । খাব ভেবেছিলাম’। 
‘এটার আগেও লাফিয়েছিলি তোরা খিস্তি খাবি বলে’। 
‘এবারেরটায় খাব । ক্যালানি ও’ । পূর্বা উত্তর করে । 
‘হ্যাঁ , একটাও বাইরে পড়বে না’ । 

‘খিস্তি আর ক্যালানি দুটোই খাওয়া ভালো । দিতে শিখবি’ । সাদা শার্টের হাতা গুটোতে গুটোতে বলে শরদিন্দু । অর্নব ,পূর্বা , পৃথা , সোমা , রক্তিম , সত্যব্রত সহ আরো কয়েকজনকে নিয়ে বসে ওদের পরবর্তী নাটকের আলোচনা চলছে । 
‘তুমি তাহলে অনেক খেয়েছো?’ পূর্বা খোঁচায় । 
‘হ্যাঁ । এখন নতুন নতুন খিস্তি বানাই । ক্যালানি দেওয়ার নতুন ধরন গুলোও নবা , রাকেশ , ইকবাল দের সাপ্লাই দিই’ । নবা, রাকেশ , ইকবাল রা হল শরদিন্দুর জিগরি দোস্ত । পাড়ার মাস্তান । ওকে দেখলেই সেলাম ঠোকে । এখন শরদিন্দুর পাশে বসা সাদা জমিন কমলা পাড় ঢাকাই পড়া লম্বা বেনির মেয়েটিকে দেখলেই ওরা সেলাম ঠুকতে শুরু করে । কমলা পাড় ঢাকাই যা তা রকমের লজ্জা পায় যেন । 

‘কিন্তু তা বলে নাম টা মহানগর ? বিখ্যাত সিনেমা হয়ে আছে’ । নাম শুনেই আওয়াজ দেবে সবাই । একটু দমে যাওয়া গলায় বলে দলের আরেকটি ছেলে । কলকাতা ইউনিভার্সিটির কলেজস্ট্রীট ক্যাম্পাসে আশুতোষ বিল্ডিং এর উলটোদিকের বিল্ডিংটার বিশাল লম্বা লম্বা সিঁড়ির ধাপে ধাপে ছেলে মেয়েদের জটলা । ‘কেউ বা একলা কারো বা সঙ্গী ক্লান্ত’ ... রবীন্দ্রনাথের ‘লিপিকা’ কাব্যগ্রন্থের ‘সন্ধ্যা ও প্রভাত’ থেকে পাঠ করে শোনাচ্ছে একটি ছেলে তার পাশের মেয়েটিকে । 

‘তোর নাম তো রবীন্দ্রনাথ । তুই বিখ্যাত হয়েছিস ? হবি ? সেটা ইস্যু না’ । অর্নব বলে । 
‘ও তো ঠাকুর না । পাঁজা’ । পৃথা হাসতে হাসতে বলে । 
‘সত্যি বাপ মা আর নাম পায়নি । জন্মালাম ভরা বর্ষায় । বৈশাখে জম্মালেও মানতাম’ । রবীন্দ্রনাথ নামের ছেলেটির তীব্র অনুযোগ । 
‘শ্রাবনে বোধহয়’ । শাদা শার্টের শরদিন্দু বলে । 
‘ও বাইশে শ্রাবন আসে পাশেই ছিল । তাইই? যত্তসব’ । 
‘এটা হিট হবে । মহানগর নাটক টা’ । 
‘তুমি মাইরি আর মেলোড্রামা নামিও না বস । এত খরচাপাতি করে মঞ্চ ভাড়া করা , বিজ্ঞাপন । আরো হাবিজাবি । একটাও টিকিট বিক্রী হবে না । প্লীজ’ । 

শরদিন্দু উত্তর করার আগের হুড়মুড় করে আরেকদল ছেলে মেয়ে এসে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড় ওদের পাশেই । 

‘শিল্পা শেটঠির থাই’ 
‘জুহির নাভি’ 
‘কাজলের পেটি’ 
‘মাধুরীর বুক’

‘তোর মাথা । ঐ মাল টা কি যেন নাম কুলকার্নি , ওর বুক’ 
‘মমতা কুলকার্নি’ 
‘শালা নিতু সিং বুড়ি হয়ে গেল ওর কাছে’ 

‘তোরা শালা দিন রাত কার বুক কার নাভি কার থাই কার পেট এই নিয়ে ছাড়া কথা বলতে পারিস না ?’ ঝাঁঝিয়ে ওঠে ঐ হুড়মুড় করে ঝাঁপয়ে আসা দলের একটি মেয়ে । এতক্ষণ ঐ গ্রুপের ছেলেগুলো ঐ কথোপকথনে ব্যস্ত ছিল । 

‘না পারি না । কেন পারব ? শালার ক্লাশে কচকচি শোনো বুড়ো মাল গুলোর । মাথা ঝিমঝিম করে । জি,বি বুড়োটা তো তোর বুকের দিকে তাকিয়ে পড়ায় রে । তুই কি ভাবিস তোর ট্যালেন্ট ধুয়ে জল খায় ?’ একটা ছেলে ঝাঁঝালো মেয়েটা কে বলে । বাকিরা হো হো করে হাসে । 

‘জি,বি র বউ মারা গেছে ক্যান্সারে । তাই হয়ত মনের দুঃখে’ । আরেকজন । 
আবার হো হো । 

‘আবে এ এ , মুখ সামলে বল । ঠাস করে চড় খাবি’ । ঝাঁঝিয়ে ওঠে মেয়েটা । 
‘কেন শা... তোর গায়ে লাগছে কেন বে ? জিবি বিছানায় শুয়েছিস না কি । কতক্ষণ সময় নেয় ?’ 
‘শালী বলতে মুখে বাধল কেন রে ? বল বাঞ্চোত । বলে নে । তোরা যা তাই ভাবিস সবাই কে’ । মেয়েটা ক্ষেপে লাল । 
‘ছাড় না বে । ছিল মমতা কুলকার্নি হল জি,বি র বাল’ । 
‘মমতা কুলকার্নির শুধু বুক ? পেছন না ?’
‘পেছন কি বে পাছা বল’ ।

‘কেন গাঁড় বলতে ভদ্দরলোকের বাচ্চার গালে বাধছে বাপ ? মারা না জিবির কাছে গিয়ে । নম্বর বেশি তুলতে তাইই তো করবি শেষ অবধি তোরা’ । মেয়েটার মুখের আগল খুলে ভেঙে গেছে এবার । দলে আরো দুটো মেয়ে আছে । তারা একেবারে চুপ মেরে গেছে । 


‘মহানগরের জন্য ওদের চাই আমার’ । এদিকে বলে শরদিন্দু । এতক্ষণ ওরা এই হুড়মুড় করে আসা দলটার কথাবার্তা শুনছিল। 
‘আমি নেই । ওরা ? তোমার নাটকে অভিনয় ? প্লীজ শরদিন্দু দা । আমাকে বাদ দাও । ওরা নাটকের কিছু বোঝে ? অভিনয়ের ? পুরো ঝুলে যাব । ইজ্জত থাকবে না’ । 

‘ইজ্জত তো তোর ক্লাশরুম আর ক্যান্টিন। দরকার নেই। আমার মহানগরে ওরাই থাকবে। তোদের মধ্যে কারো সঙ্গে ওদের যোগাযোগ আছে? ’ । শরদিন্দুর উত্তর ও জিজ্ঞাসা । ওর পাশে বসা সাদা ঢাকাই কমলা পাড়ের বড় বড় চোখের পলক পড়ছে না। এমনিতেই বেশ ধীরে ধীরে চোখের পাতা ওঠে নামে মেয়েটির । এটা নিয়ে শরদিন্দুর বিশেষ বিশ্লেষন হল ‘তোর চোখের পাতা ওঠা পড়া যেন মঞ্চের পর্দা ওঠা নামা’ । কমলা পাড় শুধু হাঁ করে শুনছে আর দেখছে । 

‘তুমি মেলোড্রামা করতে চাও তো টালিগঞ্জে নাম লেখালে না কেন । শেয়ালদা স্টেশনে তো এক দাদাল পাকড়াও করেছিল কোন বাংলা সিনেমায় নামাবে বলে ? গেলেই তো পারতে । নাটক ফাটক করা কেন ?’ রবীন্দ্রনাথ নামের ছেলেটি বলে । 

‘এটা আবার কবে হল ? তোমার পেছনে লোক ঘুরছিল?’ কমলা পাড় ঢাকাই এতক্ষণে মুখ খোলে । 
‘হয়েছে । ক’দিন আগে’ 
‘কেন লোক কি একা তোর পেছনেই ঘুরবে’ ? শরদিন্দু চশমার ওপর দিয়ে কমলা পাড়ের দিকে তাকিয়ে বলে । লজ্জায় চোখ নামায় কমলা পাড় । বাকিরা হেসে ওঠে । 

‘ওদের দলের ঐ মেয়েটা সম্ভবত ছাত্র ইলেকশনে দাঁড়াচ্ছে । জিতেও যাবে । বাপ রাজনীতির চাঁই । আলাপ আছে’ । ‘ব্যস । ওদের সঙ্গে কথা বলে আমার সঙ্গে ছেলেমেয়ে গুলোকে আলাপ করিয়ে দে । ওরা ভালো কাজ করবে’ । 
‘হ্যাঁ ভালো খিস্তি দিতে পারবে আর ভালো ক্যালানি খেতে পারবে’ । পূর্বা বলে । 




পাহাড়তলির সবুজ ঘেরা একটি এলাকা । শিলিগুড়ি থেকে একটু দূরে । একটা স্কুল বাউন্ডারি । ভেতরে আবাসিক স্কুল । খেটে খাওয়া অত্যন্ত গরীব বা চা বাগানের না খেতে পাওয়া বাচ্চাদের জন্য প্রায় পনেরো কুড়ি বছরের অক্লান্ত চেষ্টায় একটা প্রতিষ্টান দাঁড় করানো হয়েছে । বাবা মা আর শরদিন্দুর স্বপ্ন পূরনের চেষ্টা । শরদিন্দুর মহানগর নাটক টা সফল হয়েছিল । তার পরই রোড এক্সিডেন্ট । তারপর । তার আর পর থাকল না । যা হতে থাকল ঠিক তাইই হওয়ার ছিল । অনেক কষ্ট লড়াই করে নয় চারপাশের প্রতিটি মুখোশ পরা মুখ গুলোর মুখোশ টেনে খুলতে খুলতে এগোনো । আবাসিকের ছেলেমেয়েদের হাতে তৈরি হস্তশিল্পের একটা বাজার তৈরি করতে পেরেছে । শুধু এতে বাচ্চাদের উৎসাহ টা কমে যায় না । নিজেদের বাড়িতে কিছু কিছু করে টাকা পাঠাতে পারে ওরা । ওরাই এগিয়ে নিয়ে যাবে এবার প্রতিষ্ঠান টি কে । চিন্তা নেই আর । কমলা পাড় ঢাকাই ধীরে ধীরে আবাসিক প্রতিষ্ঠানের বড় গেটের দিকে এগোয় । শিলিগুড়ি টাউনে এডমিনিস্ট্রেশনের বড় কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে একটি মিটিং আছে । একটা ছোট্ট বাচ্চা , কিছুদিন আগে আলিপুরদুয়ারে হওয়া ভুমিকম্পে বাড়ি ধ্বসে চাপা পড়ে ওর বাবা মা মারা গেছে । বাচ্চাটা কোনো ভাবে বেঁচে গেছে । নিয়ে আসা হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানে । কমলা রঙ এর ফ্রক পড়ে টালমাটাল পায়ে দৌড়ে আসতে গিয়ে আছাড় খায় । গেটের দারোয়ান টা ছুটে যাচ্ছিল । কমলা পাড় ঢাকাই থামায় । ‘এস উঠে এস । তুমি পারবে । ওঠো দৌড়ও’ । হাসি মুখে বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে বলে কমলা পাড় ঢাকাই । বাচ্চা টি ওঠে । কমলা ফ্রক হাওয়ায় উড়িয়ে দৌড়তে থাকে আবার এদিক থেকে ওদিক প্রজাপতির মতো । শরদিন্দু ঠিক এভাবেই বলত ‘তুই পারবি’ । 

গেটের বাইরে বেরিয়ে আসে কমলা পাড় ঢাকাই । গেটের পাশে কিছু ছেলে মেয়ে অপেক্ষা করছিল । এলাকার নয় । দেখেই বোঝা যায় । শাদা শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে একটা সুঠাম ছেলে এগিয়ে আসে । ‘আমার নেক্সট প্লে র নাম মহানগর । লিপিকা আপনি আমার এই নাটকে অভিনয় করছেন’ । 

কমলা পাড় ঢাকাই অর্থাৎ লিপিকা , প্রৌঢ় থেকে বৃদ্ধা হওয়া্র পথে এগোতে শুরু করেছে সবে । চশমার ফ্রেম টা একটু তুলে নাক কুঁচকে দেখে । এরা ক’দিন ধরেই এই এলাকায় দল বেঁধে ঘোরাফেরা করছে । ওর নজর এড়ায়নি । নাটকের দল । সাদা শার্টের ছেলেটি কে দেখে একটু চমকে গেছিল । একইরকম । 

‘আমার একটা মিটিং আছে । প্রতিষ্ঠানের জন্য । সেরে আসি । কথা হবে’ । 
‘জবাব টা হ্যাঁ তো?’
‘না শুনবে কি ?’ ঠোঁটে একচিলতে পাহাড়ি বিকেলের রোদ যেন লেগে আছে হাসির মতো ...



Previous Post Next Post