“মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপরাধ বলে মনে করি”। খুব গভীর জীবনবোধ ও ইতিহাস জ্ঞান থেকেই এই বিশ্বাসটুকু অর্জন করেছিলেন কবি। কিন্তু জীবনের একেবারে প্রান্ত সীমায় এসে এক দ্বান্দ্বিক সংকটে পড়লেন বিশ্ববরেণ্য কবি রবীন্দ্রনাথ। যে সংকট থেকে জন্ম নিল তাঁর বহু পঠিত রচনা ‘সভ্যতার সংকট’। শেষ বেলাকার রবিকে যখন বার বার নিজেকে প্রবোধ দিতে হচ্ছে এই বলে যে, “সত্য বড়ো কঠিন, সেই কঠিনেরে ভালোবাসিলাম”। কিন্তু সত্যই কি যা কঠিন, যা নিদারুণ, যা ভয়ানক তা যতই সত্য হোক তাকে ভালোবাসা যায়? না কি আমরা শুধু তাকেই ভালোবাসতে পারি, যা মনোরম, যা সুন্দর, যা মানবিক। আর এক কবি তো এক সময় বিশ্ববীণার ললিত ছন্দকে বেঁধেই দিয়ে গিয়েছিলেন এই বলে যে, “সত্যই সুন্দর। সুন্দরই সত্য’। যে ছন্দের নির্যাসে অবগাহন করেই আত্মপ্রকাশ যুবক রবীন্দ্রনাথের কাব্যভুবনের। শুধু তো যুবক রবীন্দ্রনাথের কাব্যভুবনের দিগন্তই নয়, সেই সুরেই বাঁধা পড়েছিল সমগ্র রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাসের ভুবনটুকুও অনুভবের অতলান্ত পরিসরে। কি সাংঘাতিক কাণ্ড! কিন্তু প্রান্ত বেলায়, দিবসের শেষ সূর্য যখন প্রশ্ন করছে শেষ বেলাকার রবিকে ‘কে তুমি’ যে প্রশ্নের উত্তরে নিরব রয়ে যায় জগৎ চরাচর। সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতো আসা নিস্তবদ্ধ সন্ধ্যায় জীবনের সব লেনদেন ফুরানোর লগ্নে যখন থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন, তখন কি সত্যই শান্তি খুঁজে পেয়েছিলেন অশীতিপর চিরনবীন কবি রবীন্দ্রনাথ? না কি নিজের মধ্যেই ভুগছিলেন এক অপরাধ বোধে, মনুষ্যত্বের অপরাজেয় শক্তির উপর টলে যাওয়া বিশ্বাসের ট্রাপিজ দড়িঁতে দাঁড়িয়ে? নয়তো কেন বলতে হবে তাকে, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ? তবে কি সত্যই সেই বিশ্বাটুকু নিজেই হারিয়ে ফেলেছিলেন বেদান্তদর্শনের ঔরসজাত আমাদের প্রিয় কবি? তাই কি তাকে বলতে হচ্ছিল সত্য বড়ো কঠিন? সেই কঠিনেরে (প্রাণপন প্রয়াসে রক্তের শেষবিন্দু দিয়ে দেউলিয়া বিশ্বাসের শেষ তলানিটুকু দিয়েও) ভালোবাসতে হচ্ছিল ক্রান্তদর্শী কবিকে?
সভ্যতার সংকট না কি কবিরই আত্মিক সংকট? নাতিদীর্ঘ এই লেখাটি কবির দূর্বলতম লেখাকয়টির অন্যতম। কারণ দ্বিবিধ, বয়সের ভারে অসমর্থ শরীরে লেখার মতো পরিশ্রম সহজ সাধ্য ছিল না। এবং আত্মিক সংকটের নিবিড় ঘোরে লেখাটি মূলত স্বগতোক্তির বেশি কিছু নয়। তাই মনোনিবেশী পাঠক মাত্রই অনুভব করবেন লেখাটিতে আমরা আমাদর পরিচিত কবিকে ঠিক সেভাবে পাইনি। পাইনি সভ্যতার সংকটের মূলীভুত প্রশ্নগুলির গভীরে পৌঁছানোর কোন দিকনির্দেশ! যে নির্দেশ আমরাই পেয়েছিলাম রক্তকরবীতে। কিন্তু পেয়েছি এক বিশ্বখ্যাত রবীন্দ্রনাথের আড়ালে পড়ে থাকা আমাদেরই মতো রক্তমাংসের সাধারণ এক রবিঠাকুরকে। অনেক কাছ থেকে দেখার এক সুবর্ণ সুযোগে। কিন্তু কে সেই রবিঠাকুর? আমদের মতো কেউ কি? সে কথা জানতে গেলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে আরও একটু। সেও আর এক সংকটের কাল। একদিকে ধর্মের নামে অর্থহীন আচার বিচারের চর্চায় মৃতপ্রায় একটি জাতি। জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার আলোবঞ্চিত অদৃষ্টের হাতে সমর্পতি একটি জাতিসত্ত্বা ও অন্যদিকে ভোগবিলাসে প্রমত্ত শাসকশ্রেণী। আর সেই সুযোগে বৈদেশিক বণিক সম্প্রদায়ের বাণিজ্যিক রণকৌশল। সেই রকমই এক সময়ে উদয় হলো বর্গী হানার নৃশংস নিদারুণ কাল। জনপদের পর জনপদ বিদ্ধস্ত! দিশাহারা মানুষ। ভোগবিলাসে উন্মত্ত অপদার্থ অলস শাসকশ্রেণী জনগণের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ সম্পূর্ণতই। আর সেই ক্রান্তিকালেই ইংরেজদের এদেশের মাথায় প্রভু হয়ে বসার ঐতিহাসিক ঘটনা। যাদের হাতে পরাভুত সেই দুর্দমনীয় অপরাজেও নৃশসংস বর্গীকূলও। তাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচা একটি জাতি স্বভাবতঃই বরণ করে নিল বৈদেশিক বৃটিশ শক্তিকে ত্রাতার ভূমিকায়। শুরু হলো আধুনিক যুগের। শুরু হলো তথাকথিক বাংলার নবজাগরণের। তাথাকথিত এই কারণে যে, নবজাগরণের সাথে জাতি হিসাবে বাঙালির সার্বিক কোন সংযোগ ও সমন্বয়ই গড়ে উঠে ছিল না বলে। যে নবজাগরণ ঘটে ছিল মুসলিম শাসনের জগদ্দল পাথরটা সরে যেতেই সুচতুর বৃটিশের শাসন কৌশলে বর্ণহিন্দুদের উত্থানের অতি সীমায়িত পরিসরেই। যার বাইরেই পড়ে ছিল বৃহৎ বঙ্গ প্রদীপের তলার জমাট অন্ধকারের মতোই। রাজা রামমোহনের হাত ধরে বৃটিশের মদতপুষ্ট সেই নবজাগরণের রাজপথেই হেম মধু বঙ্কিম নবীনের পরপরই আবির্ভাব যুবক রবীন্দ্রনাথের।
সে কথা আমরা সবাই জানি। তাই সেদিনের যুবক রবীন্দ্রনাথ বৃটিশের তৈরী করে দেওয়া জানলা দিয়েই পরিচিত হয়েছিলেন বাকি বিশ্বের সাথে। আরও সঠিক ভাবে বললে যে জানলা তৈরী হয়েছিল ইয়ংবেঙ্গলের যুগসন্ধিক্ষণেই। সেই ধারারই পরিবর্ধিত কালসীমায় আমাদের কবির বিশ্বদর্শন শুরু। আপ্লুত কবির কথায় “বৃহৎ মানবগোষ্ঠীর সাথে আমাদের প্রত্যক্ষ পরিচয় আরম্ভ হয়েছে সেদিনকার ইংরাজ জাতির ইতিহাসে” আরও একটু তলিয়ে দেখলে দেখব আমরা, ইংরেজের লেখা ইতিহাস মুখস্থ করেই আমাদের বিশ্বাসের ভূমিটি তৈরী হয়েছিল সেই বাংলার নবজাগরণের কাল থেকেই। ফলে আমাদের বিশ্বকে দেখা, সেও ইংরেজ জাতির অঙ্গুলি নির্দেশের পরিসীমায় মাত্র। তার বাইরে বিশ্বের অস্তিত্ব বাঙালির চেতনায় প্রায় অনুপস্থিত। ঠিক এই ঘটনাই ঘটে ছিল রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও। ইংরেজদের প্রচারিত ইতিহাসে, ইংরেজী সাহিত্যের প্রতিবিম্বে আমাদের বিশ্বদর্শন! এইটিই ছিল বাংলার নবজাগরণের মূল ভিত্তিভূমি। আর সেখানেই মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন যুবক রবীন্দ্রনাথও। যে মোহ থেকে ইংরেজী সাহিত্যের আলোতেই এদেশের বৃটিশ প্রশাসন আর ইংরেজ জাতির সংস্কৃতি ও কৃষ্টি তাঁর ও তাঁর সমসাময়িকদের কাছে এক বলেই প্রতিভাত হয়েছিল। আর মূল গণ্ডগোলের সূত্রপাত সেইখান থেকেই। ঠিক সেই আবেগ থেকেই কবি আহ্বান করেছিলেন:
“এসো হে আর্য, এসো আনার্য, হিন্দু মুসলমান।
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ, এসো এসো খৃষ্টান
এসো ব্রাহ্মণ। সূচী করি মন ধরো হাত সবাকার।
এসো হে পতিত, হোক অপনীত সব অপমানভার।
মার অভিষেকে এসো এসো ত্বরা, মঙ্গলঘট হয় নি যে ভরা
সবার পরশে পবিত্র করো তীর্থনীরে-
আজি ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।।”
সেদিন রবীন্দ্রনাথ বুঝতেই পারেন নি ‘শক -হুন-দল পাঠান-মোগল এক দেহে লীন’ হবার মতন করে ইংরাজ জাতি আসেনি এখানে। তারা এদেশে ইউরোপীয় সংস্কৃতির অন্তর্নিহীত শক্তির বীজ বপন করতেও আসেনি। এদেশকে শোষণ করে লুঠ করে ইংল্যাণ্ডকে বলশালী ধনবান করে তোলা ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্যই যে তাদের ছিল না, এবং সেই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে ও সুরক্ষিত রাখতে তারা যে আসলেই কতটা নির্মম ভাবে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং সেই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে সর্ব প্রকার নীচতাও যে তাদেরই চারিত্রিক বৈশিষ্ট সে কথাও অজানা ছিল রবীন্দ্রজীবনের প্রাথমিক পর্বের চৌহদ্দিতে। এখানেই ঠকে গিয়েছিলেন আমাদের রবিঠাকুর। ঠিক যেভাবে আমরা ঠকে যাই রাজনৈতিক দলের দেওয়া প্রতিশ্রুতিতে, বুদ্ধিজীবীদের দেওয়া তত্ত্বে। সরকার প্রচারিত তথ্যে। অনেকটা সেই রকমই। বৃটিশ শাসনের প্রথম আমলে এদেশে বৃটিশ শাসনতন্ত্র দৃঢ়ভাবে কায়েম করার জন্যে ইংরেজদের প্রয়োজন ছিল ইংরেজী ভাষায় দক্ষ বৃটিশ সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে মোহাবিষ্ট একটি বুদ্ধিজীবী শ্রেণী তৈরী করে তোলা। সুচতুর ইংরেজ জাতি এদেশে ঠিক সেটাই করেছিল অতি নিপূণতায়। কারণ তারা জানতো জাতির বাকি অংশ এই বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকেই জাতির প্রতিনিধি স্বরূপ মানবে। তাই যে সময়ে যুবক রবীন্দ্রনাথের মতো উচ্চবর্ণের আলোকপ্রাপ্ত অভিজাত সম্প্রদায়ের ‘দিনগুলি মুখরিত ছিল বার্কের বাগ্মীতায়, মেকলের ভাষাপ্রবাহের তরঙ্গপ্রবাহে; নিয়তই আলোচনা চলতো শেক্সপীয়ারের নাটক নিয়ে, বায়রণের কাব্য নিয়ে’, সেই সময়েই এদেশের সম্পদ লুঠ করে সাধারণ মানুষকে সর্বস্বান্ত করে সারা দেশব্যাপি মানুষকে শিক্ষার আলোক থেকে বঞ্চিত রেখে কেবলমাত্র চাকুরিজীবী একদল রাজভক্ত বৃটিশ অনুরাগী শ্রেণীর সৃষ্টি করে বৃটিশ তার জাতধর্ম রক্ষা করে চলেছিল সুদৃঢ় পদক্ষেপে। যে বাস্তবতার হদিশ ছিল না যুবক রবীন্দ্রনাথের কাছে। তাই অল্প বয়সে ইংল্যাণ্ডে গিয়ে বৃটিশ পার্লামেন্টে জ্বন ব্রাইটের বক্তৃতাকেই তিনি চিরকালের ইংরেজের বাণী বলে ভুল করতে একটুও দেরি করেননি। তাঁর মনেও আসেনি, কেন এই জাতটি আফ্রিকা এশিয়ার দেশের পর দেশ দখল করে শত শত জাতিকে পরাধীন করে পঙ্গু করে খর্ব করে রাখছে। কারণ তিনি তখন ইংরেজদের প্রচারিত সাংস্কৃতিক মুখটাকেই বিশ্বাস করে ফেলেছিলেন অন্ধেরই মতোন মোহাবিষ্ট হয়ে। ঠিক আজকের সময়ে আমরা যেমন পেন্টাগণ প্রচারিত বাণীকেই বিশ্বাস করি বিশ্বের একমাত্র সুপারপাওয়ারের শক্তির ঝলকানিতে মোহান্ধ হয়ে। জানতে চাই না কেন আবিশ্ব সন্ত্রাসবাদের চাষ করে চলেছে মার্কিণ প্রশাসন। ঠিক আমাদের সাধারণ মানুষের মতোই যুবক রবীন্দ্রনাথও একই ভুল করেছিলেন সেদিনের একমাত্র বিশ্বশক্তির প্রচারে। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন সুসভ্য ইংরাজ জাতির হাতেই বিশ্বের মুক্তি! তাঁর নিজের ভাষায়, “তখন আমরা স্বজাতির স্বাধীনতার সাধনা আরম্ভ করেছিলুম, কিন্তু অন্তরে অন্তরে ছিল বৃটিশ জাতির ঔদার্যের প্রতি বিশ্বাস। সে বিশ্বাস এত গভীর ছিল যে একসময়ে আমাদের সাধকেরা স্থির করেছিলেন যে এই বিজিত জাতির স্বাধীনতার পথ বিজয়ী জাতির দাক্ষিণ্যের দ্বারাই প্রশস্ত হবে”। অন্ধমোহের কি সাংঘাতিক পরিণতি? চোর নিজেই গৃহস্থকে নিয়ে যাবে পুলিশের কাছে চোরাই মাল উদ্ধারের জন্যে! বিষয়টা অনেকটাই যে সেইরকম সে কথা বুঝতে অনেক কাল চলে গিয়েছিল সেদিনের মানুষদের। তার আসল কারণ সেদিন তারা দেশের বৃহৎ অংশের জনসাধারণের থেকে সম্পূর্ণই বিচ্ছিন্ন ছিলেন, এবং দেশ বলতে তাদের চেতনায় নিজ সম্প্রদায়ের বাইরে আর কোন অনুভব সজীব ছিল না। হ্যাঁ যুবক রবীন্দ্রনাথের মানসলোকও মুক্ত ছিল না এই অভিশাপ থেকে। একদিকে আপন জাতির অন্তর্গত অন্ধকার ও অন্যদিকে বৃটিশ সভ্যাতার চোখ ঝলসানো আলো আমাদের কবিরও চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল তাই প্রবল ভাবেই। পারিবারিক সংস্কৃতির চৌহদ্দিতেই বেড়ে ওঠা রবীন্দ্রনাথও তাই ইংরেজকে অনেক বড়ো এক উচ্চাসনে বসিয়ে ফেলেছিলেন প্রথম বয়েসের প্রগলভ দূর্বলতায় কল্পবিলাসী আবেগের আতিশজ্জে!
কিন্তু এই কল্পনাবিলাসী আবেগের কাল শেষ হল সেইদিন যেদিন কবির সামনে উন্মোচিত হলো সমগ্র দেশের আসল চিত্র। স্বদেশবাসীর হৃদয়বিদারক দারিদ্র্য, অন্ন বস্ত্র শিক্ষা চিকিৎসা বঞ্চিত বৃহৎ জনগোষ্ঠীর নিদারুণ কষ্টের মূল কারণ যে বৃটিশের শোষণ ও লুঠন, অত্যাচার ও নিপীড়ণ সে কথা দিনে দিনে বুঝতে থাকলেন কবি নিরতিশয় বেদনার মধ্যে দিয়ে। বেদনা একদিক দিয়ে যেমন স্বজাতির প্রতিকারহীন পরাভবে, আর এক দিয়ে তেমনি বৃটিশের প্রতি তাঁর মোহভঙ্গের কারণে। যে বৃটিশের প্রচারিত সাহিত্য সংস্কৃতির উৎকর্ষতায় বিশ্বাসী রবীন্দ্রনাথ বৃটিশ জাতিকেও সুসভ্য বলে ভুল কল্পনা করে ঠকে গিয়েছিলেন। “যখন সভ্যজগতের মহিমাধ্যানে একান্তমনে নিবিষ্ট ছিলেম তখন কোনদিন সভ্যনামধারী মানব আদর্শের এতবড়ো নিষ্ঠুর বিকৃত রূপ কল্পনা করতেই পারি নি: অবশেষে দেখছি, একদিন এই বিকারের ভিতর দিয়ে বহুকোটি জনসাধারণের প্রতি সভ্যজাতির অপরিসীম অবজ্ঞাপূর্ণ ঔদাসীন্য” বক্তা সেই রবীন্দ্রনাথ। যে রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষ সময় অব্দি ইংরেজ জাতির উপর বিশ্বাস রাখার প্রাণপণ প্রায়সে ক্ষতবিক্ষত করেছেন নিজেরই অন্তরভূবন। তাঁর একান্ত ধারণা ছিল ভারতের বৃটিশ প্রশাসন ও বৃটিশ জাতির মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। নিজের সাথে নিজের একান্ত আলাপচারিতায় যুক্তি তর্ক বিশ্বাস অবিশ্বাসের টানাপোড়েনে আবেগ ভালোবাসা আর যন্ত্রণার নিদারুণ অভিঘাতে বিদ্ধস্ত হতে হতেও তিনি যেন প্রাণপণে আশা করতেন কোন একদিন ইংরেজ জাতি তাঁর বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবে। আর আবিশ্ব ঘটনা প্রবাহে এই জঘন্যতম সাম্রাজ্যবাদী শোষনবাদী ধনতান্ত্রিক জাতির আসল স্বরূপ যত বেশি করে উন্নুক্ত হতে থাকল ততই যেন আরও তলিয়ে যেতে থাকলেন আমাদের কবি। একদিকে তাঁর ভেঙ্গে পড়া তছনছ হয়ে পড়ে থাকা একান্ত বিশ্বাসের ভগ্নস্তূপ, ও অন্যদিকে কঠোর কঠিন বাস্তব সত্য। এই দুইয়ের মধ্যে নিরন্তর মিলনের প্রয়াসে দীর্ণ থেকে দীর্ণতর হয়ে উঠতে থাকল কবির অন্তর্ভূবন। সভ্যতার সংকট সেই অন্তর্ভূবনেরই রাবীন্দ্রিক স্বাক্ষার।
ভারতবর্ষকে পরাধীনতার নাগপাশে আবদ্ধ রেখে নির্মম শোষণ ও অত্যাচারের মধ্যে দিয়ে যে জাতির পরিচয় আর ইংল্যাণ্ডের সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে জাতির সামগ্রিক জীবনচর্চার যে পরিচয়, এই দুই পরিচয়ের আপাত ভিন্নতা কবিকে বার বার দোলাচলে ফেলেছিল তাঁর সমগ্র জীবনপর্বেই। আবার শুধু ভারতবর্ষইতো নয় আফ্রিকার বিস্তীর্ণ ভুখণ্ডে; মধ্য প্রাচ্য থেকে শুরু করে এশিয়ার একের পর এক দেশে এই জাতির নিপীড়ন ও শোষণ যে কোন সংবেদনশীল মানুষকেই অস্থির করে তুলবে। কবিকেও করেছিল। হয়তো তিনি নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দেওয়ার প্রয়াস করেছিলেন যে এই ভুমিকা শুধুই ইংল্যাণ্ডের নয় মাত্র। এইটিই সমগ্র ইউরোপের অন্যান্য অনেক জাতিরই চরিত্র লক্ষ্মণ! কিন্তু ইংল্যাণ্ডের সাথে তাঁর যে নিবিড় যোগ ছিল, ইউরোপের অন্য কোন দেশের সাথেই তা ছিল না স্বাভাবিক ভাবেই। পরাধীনতার কারণে ও ইংরাজী ভাষায় স্বাচ্ছন্দের দরুন একমাত্র ইংল্যাণ্ডের সাথেই কবি অধিকতর আত্মিক নৈকট্য অনুভব করতেন সন্দেহ নাই। যে নৈকট্যের কারণ তিনি নিজেই ব্যক্ত করেছেন ইংরাজী সাহিত্যের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার মধ্যে দিয়ে। তাই ইংল্যাণ্ডের বিদগ্ধ মনীষীদের সম্বন্ধে তাঁর একান্ত শ্রদ্ধাই সামগ্রিক ভাবে এই জাতি ও তার সভ্যতা সম্বন্ধে তাঁকে শ্রদ্ধাশীল করে তুলেছিল। কিন্তু প্রাথমিক ভাবে বাংলার নবজাগরণের কুশীলবদের অধিকাংশেরই ধারণায় ধরা পড়েনি যে একটি জাতির সামগ্রিক পরিচয় তার সাহিত্য সংস্কৃতির মধ্যে নয়। সেই পরিচয় বিশ্বের অন্যান্য দেশ জাতি ভাষা সংস্কৃতির সাথে তার সম্বন্ধের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়ে থাকে। আমার বাড়িতে আমি স্ত্রী পুত্র কন্যা নিয়ে প্রকৃত মানুষের ধর্ম পালন করে পারিবারিক গণ্ডীতে সমুন্নত সংস্কৃতির চর্চা করেও যদি সামাজিক পরিসরে অন্যন্য পড়শীর উপর অকথ্য অত্যাচার নিপীড়ণ শোষণ চালাতে থাকি, তাহলে কোন পাগলেও নিশ্চয় আমাকে মহান ধার্মিক উন্নত চরিত্রের বলে ভুল করবে না! কিন্তু আমাদের রবিঠাকুরের ও তাঁর সময়ের বিদগ্ধজনেদের কিন্তু সেই মারাত্মক ভুলটিই হয়েছিল। আজকের সময়ে একমেরু বিশ্বের একমাত্র বিশ্বশক্তি সম্বন্ধে আমরা অধিকাংশই ঠিক যে ভুলটি করে থাকি প্রতিদিন! রবীন্দ্রনাথের মূল সংকট ঘটেছিল এইখানে। শাশ্বত মানবতাবাদী কবি আবিশ্ব শোষণবাদী বৃটিশের বাস্তব রূপের সাথে বৃটিশের শিল্প সাহিত্য কাব্যকলার সম্বন্বয় করতে বারবার ব্যর্থ হয়েছেন আর ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন বারবার। তাঁর কল্পবিলাসের বিশ্বাসের সাথে বাস্তবের নিদারুণ কঠিন এই সংঘাতে নিজেকেই প্রবোধ দিতে চেয়েছেন তাঁর পরিচিত বৃটিশ মনীষীদের সমুন্নত চরিত্রকে দৃষ্টান্তস্বরূপ খাড়া করেই। তাঁর একান্ত সহচর কতিপয় বৃটিশ বন্ধু স্বজনের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কের নিরিখে। এ যেন কয়টা বালির বস্তা দিয়ে বন্যায় ধ্বসে যাওয়া বাঁধ মেরামতির অক্ষম চেষ্টা। সভ্যতার সংকট প্রবন্ধে তাই নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক লাগে যখন তাঁর প্রিয়তম এণ্ড্রুজকে এনে হাজির করেন কবি, এণ্ড্রুজের মধ্যে দিয়েই ইংরেজ জাতির মর্মগত মাহাত্ম্যকে মরিয়া প্রয়াসে রক্ষা করতে চান আমাদের কবি। কি মর্মান্তিক প্রয়াস! কি করুণ পরিণতি!
সত্যই এই রবীন্দ্রনাথ আমাদের পরিচিত বিশ্বকবির খ্যাতির আড়ালে পড়ে থাকা আমাদেরই মতো অতি সাধারণ এক সংবেদনশীল মানবাত্মা। বিশ্বাস আর যুক্তি, বাস্তব আর কল্পনা, ভালোবাসা আর বিচ্ছেদের নিরন্তর দ্বন্দ্বে বিদ্ধস্ত ক্ষতবিক্ষত একজন সাধারণ রবি ঠাকুর। ভালোবাসার মানুষ ঘর ভেঙে দিয়ে সংসার তছনছ করে দিয়ে চলে গেলে যে কষ্ট হয় মানুষের, না পারা যায় ভালোবাসার মানুষটিকে ভুলে যাওয়া, না পারা যায় সম্পূর্ণরূপে ক্ষমা করে দেওয়া, না করা যায় কোন প্রতিবিধান। এক অসীম ব্যর্থতার অবসাদ গ্রাস করতে থাকে তখন আমাদেরকে। যে ব্যর্থতা- বিশ্বাসভঙ্গের যন্ত্রণা আর কঠিন সত্যকে প্রতিকারহীন পরাভবে মেনে নিতে না পারার দ্বান্দ্বিক অন্বয়ে পরস্পর সংলগ্ন রয়ে রয়ে যায় আমাদের জীবনের পরতে। তাতে শুধুই ক্ষতবিক্ষতই হতে হয়। আর তাই এই রবিঠাকুর যিশু খৃষ্ট নন, যে ক্ষমার দ্বারা নিরসন করবেন যাবতীয় কষ্টকে। উত্তীর্ণ হবেন সম্পূর্ণ ভাবলোকে। এই রবি ঠাকুর হযরত মহম্মদও নন, যে খোলা তরবারি নিয়ে রুখে দাঁড়াবেন যাবতীয় অন্যায়ের প্রতিবিধানে নিঃশঙ্ক চিত্তে। এই রবি ঠাকুর বিবেকানন্দের মতো প্রফেটও নন, যে বিশুদ্ধ দার্শনিকের দৃষ্টিতে সব কিছুর উর্ধে মানুষকে শিশু দেখে বরণ করবেন ইচ্ছামৃত্যু! এই রবি ঠাকুর আমাদের পরিচিত গীতাঞ্জলীর সাধক রবীন্দ্রনাথও নন, যে মহাকাল আর মহাজীবনের প্রেক্ষিতে বর্তমানের জীবন সংকটকে উপলব্ধি করতে চাইবেন শাশ্বত সত্যের বেদীমূলে। না তিনি আমার আপনার আর পাঁচ জনের মতোই অতি সাধারণ রক্তে মাংসে গড়া এক রবি ঠাকুর। যিনি মানুষের শুভ বোধে বিশ্বাস করতে উদ্গ্রীব। বারবার বিশ্বাস করবেন, আবার বারবার ঠকে যাবেন। বলবেন সত্য বড়ো কঠিন, সেই সত্যরে ভালোবাসিলাম। কেননা সেই কঠিন সত্যকে তিনি নিজেই ভালোবাসতে পারেননি। পারেননি তিনি আমাদেরই মতো সাধারণ একজন বলে। কোন অতিমানব নন। যদিও মানেন মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, কিন্তু জাতি হিসাবে ইংরেজদের প্রতি সেই বিশ্বাস তার হারিয়ে গিয়েছিল বলেই প্রাণপণে নিজেকে রক্ষা করতে চেয়েছেন ছেলে ভুলানো ছড়ায়। নিজের প্রত্যয় ও বিশ্বাসের ভগ্নস্তূপে বসে তখনো তিনি নিজেকেই ভোলাতে থাকেন। কিন্তু পারেন কই? পারলে নিজের এই আত্মসংকটকে সভ্যতার সংকট নাম দিয়ে চালাতে হতো না আমাদের কবিকে। যিনি আমাদেরই মতো বড়ো দূর্বল চিত্তের একজন সত্যিকার অর্থেই ভালো মানুষ। বড়ো সরল আর বড়ো সাধারণ। ইংরেজকে মানুষটি বড়ো বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলেন, বড়ো বেশি বিশ্বাস করে ফেলেছিলেন তাদের প্রচারিত মাহাত্ম্যকে। আর তারই জন্যে এত বড়ো চরম মূল্য দিতে হল তাঁকে, যাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল বৃটিশ শক্তির নজরবন্দীতে। জানতেন আমাদের কবি। কিন্তু ভালোবাসা সে বড়ো চরম মূল্যই আদায় করে নেয়। নিয়েছিল কবির কাছ থেকেও। সেইখানেই কবির আত্মিক সংকট। সভ্যতার সংকট নয়।
Tags:
বিশেষ পাতা