রিয়া চক্রবর্তী

riya



পরিযায়ী, উড়ে বেড়ায়, ঘুরে বেড়ায় দেশ থেকে আরেক দেশে। প্রকৃতি ভৌগোলিক পরিবেশ আর আবহাওয়ার পরিবর্তনের উপর জন্য ওরা ছুটে চলে প্রকৃতির অনুকূল পরিবেশে। হেমন্তের শেষে কুয়াশাকে সাথে নিয়ে ছোট্টো শীত যখন গুটিগুটি পায়ে টুপটাপ ঝরে পরে গ্রাম থেকে শহরে, মাঠ থেকে খাল, বিল, জলাশয়ে। ঠিক তখনই তাদের আগমন হয় ঝাঁকে ঝাঁকে। শীতও আসে তাদের ডানায় ভরে করে, ভোরের আকাশকে বরণ করে নেবার জন্য মালার মতো ডানা মেলে উড়ে আসে বহুদূর থেকে। প্রচন্ড শীতের দেশ থেকে অপেক্ষাকৃত উষ্ণ শীতের দেশে খাবারের সন্ধানে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে দল বেঁধে পাখিরা আসে রৌদ্রোজ্জ্বল পরিবেশ আর ঠান্ডা-রোদের মিশেল আবহাওয়ার দেশে। শীতের শুরুতেই ওদের পাখনার ঝাপটায় নান্দনিক ছন্দে মুখরিত হয়ে ওঠে নদ-নদী, খাল-বিল, ঝিল, জলাশয় এবং বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ। পরিযায়ী পাখির ডানার কাঁপনে চঞ্চল হয়ে ওঠে প্রকৃতিও, তাদের কলতান, ডুব-সাঁতার, গুঞ্জনে- কুহনে-কুজনে নির্জন প্রান্তর হয়ে রূপবতী লাস্যময়ী। আবার শীতশেষে আমাদের এই ’কুটুম’রা চলে যায় তাদের পুরোনো ঠিকানায়। অনেকে আবার নতুন রূপে মোহিত হয়ে এখানেই ঘর বাঁধে।

পরিযায়ী যে পাখিদের ক্ষেত্রেই হয় তা কিন্তু নয়। পরিযায়ী মানুষও ঘুরে চলে নিজেদের ইচ্ছেতে অনিচ্ছেতে। জীবন এতো বড় এক সংগ্রাম,সেই সংগ্রামে কেউ হারে, কেউ জেতে। তবুও মানুষ আশায় বুক বেঁধে জীবন শুরু করে দেয়। প্রধানত চারটি কারণে মানুষ দেশ ফেলে আরেক দেশে যেতে চায়। ১. ইকোনমিক মাইগ্রেশন, ২. সোশ্যাল মাইগ্রেশন, ৩. পলিটিক্যাল মাইগ্রেশন, ৪. এনভায়রনমেন্টাল কারন। অর্থাৎ যদি কোনো দেশে কোনো বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় তাহলে অন্য কোথাও যাওয়ার চেষ্টা। প্রধান কারণ খাবার, বাসস্থান ও মানুষের মতো বাঁচবার স্বপ্ন। যেখানে কাজ পাওয়া যায়, যেখানে কোনো রাজনীতির থাবা কাউকে শেষ করে না দেয়, যেখানে প্রকৃতিতে খরা, প্লাবন, সুনামি, সাইক্লোন এসব নেই।

তাহলে প্রশ্ন আসতেই পারে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের এ পরিযায়ীর শুরুটা কোথায়?

ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বের দিক থেকে বিচার করলে এ পরিব্রজনের শুরু হয়েছিল খ্রিস্টের জন্মেরও হাজার হাজার বছর আগে। হলোসিন যুগের দ্রুত প্রাকৃতিক রদবদল মানুষের জীবন কঠিন করে দেয় বলে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকদের ধারণা। হঠাৎ করে সংঘটিত প্রাকৃতিক বিপর্যয় আর আহার সংকট মানুষকে বাধ্য করে অভিবাসনে। ধীরে ধীরে মানুষের সংস্কৃতিগত পরিবর্তন দেখা দেয়। এ সময়ে সংগ্রাহক জীবন থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে মানুষ অভ্যস্ত হয় শিকারি জীবনে। খনিজ ও শিলাখণ্ডের তৈরি হালকা ও নিক্ষেপযোগ্য বিভিন্ন ধরনের হাতিয়ার ব্যবহার করে মানুষ তখন জীবনধারণের প্রয়োজনে শিকার করত। এ সময়ই বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অভিবাসন ঘটেছিল বলে প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা।আবার অন্য ভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক থেকে শুরু করে নৃবিজ্ঞানী কিংবা ইতিহাসবিদ প্রত্যেকেই মানেন যে, একটি স্থানে রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন, সাংস্কৃতিক রূপান্তর কিংবা জীবনযাত্রার ধরনে আমূল পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এর ভূমিকা রয়েছে। প্রখ্যাত তাত্ত্বিক এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাইদ ‘রিফ্লেকশন অব এক্সাইল’ শীর্ষক দীর্ঘ নিবন্ধে দেখিয়েছেন, বিশ্ব সভ্যতার জন্য পরিযায়ী কতোটা গুরুত্বপূর্ণ।

পাখি তুই কি জানিস কঠিন যে এই এডাপটেশন প্রক্রিয়া?

আবার যদি তাত্ত্বিক দিক থেকে দেখি তাহলে ১. ইমিগ্রেশন, ২. মাইগ্রেশন কিংবা ৩. এনফোর্সড মাইগ্রেশন অর্থাৎ এই তিনটি ভিন্ন বিষয়ও মানুষ অনেক ক্ষেত্রে নিজ থেকে বাইরের দেশে যায়, সোজাসাপটা কথায় কেউ যায় নিজের দেশে পড়াশুনো শেষ করে অন্য দেশে আরও ডিগ্রী নেবার জন্য। আবার কেউ যায় অন্য দেশের আমন্ত্রণে কিংবা কাজের সন্ধানে। সেখানে গিয়ে নতুন করে বসতি স্থাপন করে। এক্ষেত্রে নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে মানুষকে পোহাতে হয় নানা ঝক্কি-ঝামেলা। কিন্তু যদি কাউকে জোর করে কোনো স্থানে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে সেটা হয় আরও ভয়াবহ। সম্প্রতি সমীক্ষায় দেখা গেছে বেশকিছু মানুষকে চাকরি দেবার নাম কিরে ধরে নিয়ে গিয়ে এ ধরনের মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে কোনো কোনো অসাধু চক্র। শেষ পর্যন্ত কিছুই না মেলায় কারো কারো ঠাঁই মিলেছে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে সেই গণকবরে। আর কেউ কেউ অসহায় অবস্থায় প্রহর গুনছে মৃত্যুর।

নিওক্লাসিক্যাল কিংবা ডুয়েল লেবার ইকোনমিক থিওরির কথাও বলা যেতে পারে, যা এই সম্পর্কিত ধারণাগুলোকে বদলে দিতে সহায়তা করেছে। তাই পরিযায়ী নতুন কোনো ধারণা নয়, প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই হয়ে আসছে। যেমন জোরপূর্বক মানুষ ধরে এনে দাস বানানো হতো। তবে এই ঘটনাও নতুন নয়, ঔপনিবেশিক যুগে যে ক্রীতদাস ব্যবসার প্রচলন হয়েছিল, সেটাও ছিলো পরিব্রাজন। ঔপনিবেশিক যুগে শিল্প-কারখানার শ্রমিক হিসেবে বিভিন্ন দেশের মানুষকে ধরে আনা হতো। এক্ষেত্রে কাজের লোভ দেখিয়ে অনেককে করা হয়েছে অপহরণ। শুরু হতো তাদের যন্ত্রণাময় জীবন।

ও পাখি তোর যন্ত্রণা কে বুঝেছে কোথায় কবে?

এই পরিযায়ীদের সম্পর্কে বলা অসম্পূর্ণ থেকেই যাবে যদি নারীদের কথা না বলি। হ্যাঁ এই পাখিদের যন্ত্রনা কেউ বোঝেনি কোনোদিন। ঠিক যেভাবে মাইগ্রেশন এ লিড রোল প্লে করে বড়রা, মানে প্রভাবশালী দেশগুলো অনুন্নত দেশগুলোকে কন্ট্রোল করে থাকে। বড় দেশ ছোট দেশকে যেমন করে তার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় তেমনি এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজও শুধু নারীকেই পরিযায়ী করতে চেয়েছ যুগ যুগ ধরে। একজন মেয়ে ছোটো থেকে তার ভালোলাগা, ভালোবাসা, ইচ্ছে, স্বপ্ন নিয়ে একটু একটু করে যখন বড় হয়ে ওঠে, একটা বয়সের পরে সে জানতে পারে যে ঘরে সে বড় হয়েছে সেটা তার ঘর নয়। সেটা বাবার ঘর।তারপর তাকে নিজের চেনা ঘরকে ছেড়ে দিতে, পাড়ি দিতে সম্পূর্ণ অচেনা এক পরিবারে বিয়ে নামক একটা পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে। চলে যেতে হয় একদল মানুষের মাঝে যাদের চেনে না,জানেনা , আগে কখনো দেখেনি বা যাদের চিন্তা ও শিক্ষার সাথে হয়তো কোন মিলও নেই তারপরেও সেই ঘরে থাকতে হয় একজন মেয়েকে।যখন সে একটু একটু করে তাদের মতো করে নিজেকে গড়ে নিচ্ছে তখন সে জানতে পারে এটাও তার ঘর নয়। স্বামীর ঘর, আরও একটু বয়স হলে সন্তানের ঘর বৃদ্ধ বয়সে বৃদ্ধাশ্রম। এইভাবে ঘুরে যেতে হয় একজন মেয়েকে।


Previous Post Next Post