রত্নদীপা দে ঘোষ



আমরা স্মরণ করছি 



১।

জানালার দরজায় মুখ ঠেকিয়ে একটা হাসি আমাকে লক্ষ্য করে । দূর থেকে ভেসে আসা ট্রেনের মত ঝুঁকে থাকে ভূগোল । পেল্লায় বড় ভারি সেই হুইসিল । অমরতার ডগায় নাচে রোদ , আর তার অসামান্য বৃষ্টি ঢেকে দিতে চায় অন্যের আত্মকথা । গল্পের ঘুড়ি দিয়ে তুমি অনেক কলম এঁকেছিলে । কিন্তু তোমার কলমরা জানেই না কলস বোঝাই আলপনা পেতে হলে কোথায় যেতে হবে । কতদূর যেতে হয় জানে না তারা । 

তারারাও জানে না ফিরতে হবে কোথায় । লিপিকারিণীর কবরীতে না নীলাকাশের আলগোছে ।


২।

হাসি জানে । হাসি জানে চাবির সিন্দুক হারিয়ে গেছে গলির ভেতর । ভিক্ষাপাত্রের সাদা কালো রঙ , রঙবসন্তির চাঁদভাঙা গড়িয়ে আসছে ঢেউয়ের মত । যেন নক্ষত্রের খুদে ব্রোচ । স্লেট মুছে গেলে মাঝে মাঝে দেখা যায় এমন চোখের দাগ । একমাত্র কমলাই জানে পৃথিবীর পবিত্র বানীই শিশুদের হসন্ত খেলার পাঠশালা । 

যার বিবরণগুলি মাটিতে নেমে এসে মানুষের আকার নিয়েছে । 


৩।

মানুষ কি জানে তার জন্মরহস্য ? আনন্দলোকের শিরা কেটে রক্ত বেরোচ্ছে এতো … তার চিন্তায় ব্যাকুল ঈশ্বরের সুজনপাখি । দুপুরের মা-রোদ , সন্ধ্যার বাবা-মেঘ । ম ম করছে চার পাঁচ রকমের হাতপাখা । প্রলয়ের ঘাস চমকাচ্ছে । শস্যের গতি আছে ? নাকি ঝর্ণার চাবুকের মত স্থির ? অস্থিরতার ভেতরে হাঁটছে একটি আয়না । স্তন বাজছে কোথাও । 

বুকের কিংবদন্তী নানারকম আবহাওয়ার কথা বর্ণনা করছে । 


৪। 

আমি শুনতে পারছি । তোমার গভীরে বসে আমিও আমাকে শুনতে পারছি । তৈরি করছি নিজের মানচিত্র । জলের তলায় ডুবে যাচ্ছে নদী । পাথুরে মাছের রাস্তা নামাওঠা করছে । সাদা কাপড়ের নৌকো জড় হয়ে যাচ্ছে । দিগন্ত নাকি আজকাল রক্তাল্পতায় আছে । স্রোতের আগুন টের পাচ্ছি তবু । টেরাকোটার আড়ালে জপে যাচ্ছি কোকেন নিদ্রা । খোলামেলার খুব থেকে এগিয়ে আসছে কেউ । রাজাধিরাজ লিখে আমার লাভ হবে তো ভারি । 

সময়ের প্রতিটি গুপ্ত সাম্রাজ্যই এখন নিরুদ্দেশ । 


৫।

এক এক করে নিবছে উড়ন্ত জাহাজ । জাহাজের মাঠগুলি ভিজে উঠছে । আমাদের ডাঙাহীন গতজন্মের চেনা আদল । আদরের আদল ছিড়ে বিবাহের দাঁড়গুলি হেসে উঠছে । ঠিক এইখানে আমরা প্রথম বিরহে কেঁদেছিলাম । তোমার চিমনি থেকে এখনো গলগল বেরিয়ে আসছে চার চারটে ধর্মস্নান । কান্নার সরু তারের ওপর বসে কেঁপে উঠছে শীত।  ফিস্ফিস শুনলেই তাকে বিয়ে করতে ইচ্ছে করে ।  

তাই তো বিদায়ী সভায় আমরা একটি সম্বর্ধনাকে মহাশয়া সম্বোধন করেছিলাম । 


৬। 

এক ঝাঁক একাকীত্ব । এখানে বারো মাস পোশাক । পোশাকের ওপর চব্বিশ ঘণ্টাই বয়ে যাচ্ছে মহাকাল । আমাদের দেখা যায় না কোথাও । শুধু কথাগুলিকে স্পষ্ট শোনা যায় চৌহদ্দির বাইরে । ঝাঁঝালো কণ্ঠে স্বরগুলি , আমাদের বাগানজাত সরগুলি , খিলখিয়ে ওঠা তছনচের পাপড়ি । তোমাকে টেনে রাখছি নিজের ভেতরে । তুমি জেনে আছ লাল নীরবতার পদ্য । অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে তুমি এক সময় গদ্যি পড়াতে  । আমি ভাবছি তুমি এত শিল্প কেনো । আমার যখনটুকুই মনে পড়ছে বারবার । 

তোমার জোব্বা থেকে ঝরে যাওয়া সঙ্গমের ঝাড়বাতি । 


৭।

আমায় ডুবাইলি রে 
আমায় ভাসাইলি রে 

গানটি এসে হাত ধরেছিল 
আমি সেই হাতের আষাঢ়ে 
পুরোনো আত্মীয়ের ভাণ্ডারে 
গাইতে শিখেছিলুম প্রথম 

আসলে কোথাও এমন কেউ আছে 
যে আমাকে আজো ভুলতে পারেনি 
আসলে কোথাও এমন আমিও আছে 
যে বর্ষার কিছুক্ষণ আগে থেকেই 
বৃদ্ধ ব্যথার মত ভারী হয়ে আছে 


৮। 

আসলে আমরা ভুগছিলাম 
বাসবদত্তা রোগে  
আর আমাদের বয়নশিল্প 
তাঁতের গা ধুয়ে 
সেগুনের শিল্পাঞ্চলে ফিরে এসেছে ...




Previous Post Next Post