ডুংরিনদীর জলে ভেসে যাচ্ছে রুপোলি জ্যোৎস্না। জঙ্গলের বাতাস মত্ত মহুয়ার নেশায়। এমন রাতে সময় চলে অভিসারে। শরীরের উপত্যকা ছন্দময় ধামসা-মাদলের বোলে।বুকের গহন জুড়ে নেশাতুর দ্রিমি দ্রিমি শব্দ।
শামলি মুখে মেখেছে করৌঞ্জের তেল। মাথায় গোঁজা পলাশ ফুল । শামলির চোখের পাতায় তির তির করে প্রতীক্ষার প্রহর। কাজের শেষে, জঙ্গলের বাঁক ঘুরে ফিরবে মলু। মলুর কষ্টিপাথর খোদাই শরীরটা বাঁক ঘুরলেই, জঙ্গলের বাঁক ছুঁয়ে থাকা শামলির চোখ ঘুরে যায় পিটিসের ঝোপে। যেন পিটিসের ঝোপেই দামী কিছু খুঁজছে শামলি! মলুর চোখ ছুঁয়ে যায়, তাকে না দেখেও কেঁপে ওঠে শামলি! দু’হাতে শালপাতার দোনোয় করে আনা চালভাজা দেয় মলু, “আইজ হাইটে গেছিলাম, তুয়ার জইন্যে পুঁতির মালা আইনলাম। একটুক্ষণ পইড়ে দ্যাহা।”
ভালোবাসার গন্ধ করৌঞ্জের থেকেও তীব্র, মহুয়ার থেকেও তার নেশা অনেক বেশী। সেই নেশায় কেটে যায় শামলির দিন-রাত।
হঠাৎ একদিন শামলির কানে আসে, আজ মলুর বিয়ে! জঙ্গলের হাওয়া বইছে বেসামাল। মলুর বিয়ের ধামসা-মাদল বাজছে। ধীরে ধীরে তীব্র হচ্ছে সে আওয়াজ। যেন শামলির দিকেই এগিয়ে আসছে। মাদলের আওয়াজ চিৎকার করে বলে যাচ্ছে শামলির কানে,...... “ তুই হইলি গিয়া দারিয়ানির বিটি, তুয়ার সঙ্গে পিরিত করতেক লাই! মলু ভদ্দর ঘ্যইরের মরদ। চাইলেই কি উকে পাওয়া যায় রে?”
আগুনের তেজ বড্ড বেশী আজ। পুড়িয়ে দিচ্ছে শামলির গা। সারাটা রাত দূর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে কাটে। মলু বলেছিল মাঘী পূর্ণিমার রাতে ওই পাহাড়ের চূড়োতে নিয়ে যাবে শামলিকে। পাহাড়ের চূড়োর দেবী মন্দিরে সে বিয়ে করবে শামলিকে। এতো আগুন বুকে নিয়ে কেউ ঘুমোতে পারে!
ঘুরতে থাকে জঙ্গলের ঋতুচক্র। বসন্ত বনে ফিসফিসানি জাগে। পিউকাঁহা পাখিটা ডেকে ডেকে ফেরে তার প্রিয়াকে। সারা পায় না। দিন যায়। বরষা আসে । সেগুন পাতা থেকে ওঠে সোঁদা গন্ধ। শরতের সোনালি রোদ ছুঁয়ে যায় বনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। হেমন্তে শালিবাঁশের বন, কটকটি আওয়াজ তোলে। ঘুরে আসে শীত। বুড়ো আমলকি গাছটার পাতা হাওয়ায় নড়ে। প্রকৃতি খোলস ছেড়ে নতুন হয়। অর্জুন গাছে নতুন ছাল আসে। বনে হরিণের শিং খসে নতুন শিং গজায়। শামলির মন খোলস ছাড়ে না। বুকের কোরকে তার যন্ত্রনা এপাশ থেকে ওপাশ ফিরে জাগে।
এক মাঘী পূর্ণিমার রাতে ডুংরির ধারে চিতার ধোঁয়ায় শান্ত হয় শামলির যন্ত্রনার আগুন। শামলির ছাই নদীর জলে ভাসে। বসন্ত বনে আবার প্রজাপতি উড়ে ফুলের উপরে বসে। পরাগ মাখে পায়ে। প্রকৃতির কাছে ফুল যে দারিয়ানি নয়।
এক মাঘী পূর্ণিমার রাতে ডুংরির ধারে চিতার ধোঁয়ায় শান্ত হয় শামলির যন্ত্রনার আগুন। শামলির ছাই নদীর জলে ভাসে। বসন্ত বনে আবার প্রজাপতি উড়ে ফুলের উপরে বসে। পরাগ মাখে পায়ে। প্রকৃতির কাছে ফুল যে দারিয়ানি নয়।
Tags:
অণুগল্প