শ্রী প্রদীপ গুপ্ত


শব্দের মিছিলের বর্ষপুর্তি সঙ্কলনের  ‘একমুঠো প্রলাপ’ এ আমরা মুখোমুখি  এক অসম্ভব বর্ণময় চরিত্রের। যিনি একদিকে কবি, গল্পকার, সম্পাদক অন্যদিকে দক্ষ সংগঠক। তিনি একাদিক্রমে একটি প্রতিষ্ঠান। আবার পুরোপুরি মাটির কাছাকাছি। তিনি শ্রী প্রদীপ গুপ্ত।  ‘শব্দের মিছিল’ তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ, অভিভূত তার আন্তরিকতায়। 

আপনি কবি, গল্পকার, গায়ক … আরো অনেক কিছু হওয়া স্বত্বেও আপনাকে লোকে এক ডাকে চেনে ‘যুগ সাগ্নিক’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে । কতদিন ধরে এই পত্রিকা সম্পাদনা করছেন ? এর পেছনের ইতিহাসটা একটু শুনতে চাই, আই মিন এই রাজ্যে কম তো ছিল না, হঠাত আরেকটা যোগ করার ভাবনা এল কিভাবে ? 



সত্যি বলতে কি এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেওয়া যাবে না। প্রথমত কবিতা লেখার কথায় বলি, লিখি এটা ঠিক কিন্তু কি লিখি সেটা আমি জানি না। অন্যেরা বলতে পারেন। তবে আমি কাল মানে সময়কে খুব মানি। যিনি তার কলমের ছোঁয়ায় কাল কে অতিক্রম করেন তাকেই কবি বলা উচিৎ বলে আমার মনে হয়। গল্পের ক্ষেত্রেও একই কথা। তবে আমি নিরাশাবাদী নই। আর কাল যে কাকে দিয়ে কি করিয়ে নেন সেকথা কেউ জানেন না, একমাত্র কাল ছাড়া। এবারে গান, বাবা খুব ভালো গাইতেন। যদিও সে অর্থে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক  সংগীত শিক্ষায় তিনি তালিম নেননি। পরে দিদিরা শিখতেন। পাড়ার গন্ডি ছাড়িয়ে আমার দিদিরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও তালিম নিয়েছেন। শুভ গুহ ঠাকুরতার " দক্ষিণী" ছাড়াও মায়া সেনের কাছেও আমার মেজদিদি দীর্ঘ দিন তালিম নিয়েছেন। আর এই আবহে কান পেতে থেকে যতটুকু সুরকে হৃদয়ে নিয়ে নিতে পেরেছি সেটুকুই আমার পরম পাওয়া। আমি বরং বেশ কিছুকাল দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আবৃতি শিক্ষা করেছি। আবৃতিকার হিসেবে নয়,ওর ছোট ভাই হিসেবে প্রশ্রয়ও বেশ ভালোই পেয়েছি।কানে কানে বলি আমি কিন্তু আমাদের ভগবান শম্ভু মিত্রর সাথে রবীন্দ্রসদনে প্রোগ্রামেও অংশ নিয়েছি। এটা আমার একটা অহংকার তো বটেই। এছাড়াও আরও কিছু কিছু বিষয় আছে কিন্তু সব কিছু বলা এখানে সম্ভব নয়। শুধু একটু করে ছুঁয়ে যাই। গ্রুপ থিয়েটারে বহু নাটকে নির্দেশক হিসেবে ছিলাম। ব্যবসায়িক মঞ্চেও কাজ করেছি বেশ কিছুদিন। ডিবেট টাও আমার খুব ভালোবাসার বিষয় ছিলো।

এবারে ‘যুগ সাগ্নিকের’ সম্পাদক হিসেবে চেনে কেন? আচ্ছা এত বিদঘুটে বিপদে ফেললে? এত কিছু বলার তো কিছু নেই এ ব্যাপারে। প্রথমত এর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা। দ্বিতীয়ত মাটির কাছাকাছি এই পত্রিকাকে নিয়ে আসতে পারা। তৃতীয়ত একটা টিম হিসেবে এর আত্মপ্রকাশ অনেকের চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। এর আগে সম্ভবত এই পরিবার কথাটি ছোট পত্রিকার ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবহার হতে কেউ দেখেন নি। আর সবশেষে আমাদের সারা বছরের কর্মসূচী গ্রহন। এমন একটি ছোট পত্রিকার কথা আমায় বল , যারা বাংলা আকাদেমি, জীবনানন্দ সভাঘর ছাড়াও কোলকাতা বই মেলার ও রকম বর্ণময় মঞ্চকেও ব্যবহার করার হিম্মত রাখে। এ সমস্তই ‘যুগ সাগ্নিককে’ এতটা জনপ্রিয় করেছে।

আর একটু কথা না বললে কিছুটা বাদ থেকে যাবে।তুমি বলেছ কবি প্রদীপ নয় গল্পকার প্রদীপ নয় বা অন্য কোন প্রদীপ গুপ্ত নয় সম্পাদক প্রদীপ গুপ্তকে লোক বেশি চিনছে। খুব ভালো বলেছ ,  সম্পাদক নয় ‘যুগ সাগ্নিকে’র সম্পাদক। কোন ‘যুগ সাগ্নিক’?  সেই ছোট পত্রিকাটি? যারা নেপালের ভূমিকম্পের জন্য বাষট্টি হাজার টাকার ত্রান তুলে দেয়? সেই ‘যুগ সাগ্নিক’ যারা একশো জনের বেশী কবিকে দিয়ে চক্ষু দানের অঙ্গীকার করায়? সেই পত্রিকার পরিবার যারা শারদীয়ার আলো ঝলমলে দিনগুলোতে সেই সব হত দরিদ্র পরিবারে শিশুদের হাতে তুলে দেয় নতুন জামা পড়ার আনন্দ। দিদি এর থেকে বড় কবিতা এর থেকে বড় গল্প এর থেকে আনন্দের গান,আর কিই বা হতে পারে? আপনাদের সার্বিক সহযোগিতায়য় আমি যেন সত্যিকারের একজন সামাজিক সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীকে গড়ে তোলার রূপকার হতে পারি এই শুভেচ্ছাই আশা করি।

ইতিহাসের প্রশ্নপত্র শুনেছি খুব নিরীহ হয়, কিন্তু উত্তর দিতে কালঘাম বেড়িয়ে যায়। ‘যুগ সাগ্নিক’ এই এপ্রিলে চার বছরে পা দিল। মাত্র চার বছরের শিশু সে। আমি যখন কলেজে পড়ি তখন আমাদের কলেজ পত্রিকারও ( দেওয়াল) নাম দিয়েছিলাম সাগ্নিক। যেহেতু আমি সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলাম কাজেই সেটা সম্পাদনার দায়িত্বটাও স্বাভাবিক ভাবেই আমারই ছিলো। একই সাথে আমরা ‘দিঙমাত্র’ নামেও একটি পত্রিকা চালাতাম যেটি আমরা কলেজ ছাড়ার পর আর চলেনি। সেটি সম্পাদনা করতেন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়। ( ক্ষিতি গোস্বামীর স্ত্রী ও বর্তমানে মহিলা কমিশনের চেয়ারম্যান)। এরপর আমি কাজের প্রয়োজনে মেদিনীপুরে যাই ও সেখানে আমার বড় দিদি শ্রদ্ধেয়া সীমা গুপ্তার সাথেই থাকতে শুরু করি। তিনি তখন ভারতের কমিউনিস্ট পারটির অখন্ড মেদিনীপুর জেলার সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য।ওর সাথেই আমি পার্টির জেলা কমিউনে থাকা শুরু করি। সেখানে " অগ্নিকোন" নামে একটি লিটিল ম্যাগ শুরু করি যার সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন দিদি ও জামাইবাবু শ্রদ্ধেয় অশোক মিশ্র।এই পত্রিকাটি এখনও নিয়মিত ভাবেই কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হচ্ছে।আমি এখনো এর অন্যতম সম্পাদক। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে আমি আমার যৌবনের শুরু থেকেই পত্র পত্রিকার সাথে যুক্ত আছি। এবারে প্রশ্ন হোলো আরো একটির কি প্রয়োজন ছিল? আমি বলবো কিছুমাত্র প্রয়োজন ছিল না। শুধু হৃদয় লালিত একটি স্বপ্নের প্রশ্রয় ছিল। আমার জীবনের তিরিশ থেকে সাতচল্লিশ। এই দীর্ঘ অথচ শ্রেষ্ঠ সময় টুকু অন্ধকারে কোথায় যে হারিয়ে গেল সে খবর আমিও জানিনা। শুধু বেঁচে থাকার তীব্র লড়াইতে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে সে সময়কাল। তাই সেই দিদিই আমাকে জাগিয়ে তুললেন। সেই লড়াইয়ের মাঝেই আবার কলম গুঁজে দিলেন হাতে। অগ্নিকোণে আবার প্রকাশ হতে শুরু করলো আমার লেখা। সাথে কিছু অন্যান্য পত্রিকাতেও। আমার সাহিত্য জীবনের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হোল। কিন্তু সেই যে দীর্ঘ লালিত স্বপ্ন সেটা পিছু ছাড়লো না। উস্কানি দিতে থাকলো। জন্ম নিল এযুগের অভিমান বুকে নিয়ে  ‘যুগ সাগ্নিক’।

‘যুগ সাগ্নিক’ এর ব্যনারের তলায় মোচ্ছব লেগেই থাকে। আর ‘যুগ সাগ্নিক’ এর অনুষ্ঠান মানেই হই হই রই রই ব্যাপার । বড়, মেজ, সেজো, ছোট, উঠতি সব ধরণের লেখক, শিল্পির এই সহাবস্থান আর কোথাও এভাবে দেখি নি । আপনার ইউ এস পি কি ?



মোচ্ছব কথাটায় আমার তীব্র আপত্তি আছে। এ কথাটায় একটু ব্যাঙ্গ, শ্লেষ মেশানো থাকে। যাই হোক, হ্যাঁ, অন্যদের যেখানে কোনক্রম আমাদের সেখানেই বিক্রম। আমরা জীবনের লক্ষনগুলো নিয়েই এগিয়ে যেতে চাই। হাসি আর গানে গানে সারাদিন ফুল ফোটানোর খেলা খেলতে চাই। বেশির ভাগ মানুষ যেখানে হেরে  গোমরা মুখ করে জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ায় আমরা তখন হেরে যাওয়া জীবনেও আবীরখেলা খেলি। বুঝিয়ে দিই পালিয়ে বাঁচা নয়, মাঠের ভেতরে থেকে খেলে যেতে হবে। আমাদের খেলায় কোন দর্শক থাকে না, সবাই খেলোয়াড়। সবাই জীবনটাকে উপভোগ করার জন্য মাঠে দৌড়চ্ছে। তাই আমরা পালা করে পার্বণ করি, পার্বণের থেকে পালিয়ে বেড়াই না। এ জন্যই জীবনের ঘোষণা করার জন্য আমাদের সাথে সবাই এসে মেশে।সবাই জানে এখানে রাম গরুড়ের ছানাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। বেঁচে থাকার আনন্দের এখন বড় অভাব দিদি। অভাবের মধ্যে  বেঁচে থাকতে থাকতে মানুষ স্বপ্ন দেখতে ভুলে যাচ্ছে। ‘যুগ সাগ্নিক’ জন্ম নিয়েছে এই অঙ্গীকার নিয়ে যে সে মানুষকে স্বপ্ন দেখার জীবনকে ফিরিয়ে এনে দেবে। তাই এত ভিড়। তাই মানুষ দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসে প্রানের সন্ধানে, খুশির খোঁজে, মুখের হাসিকে ফিরে পেতে। এখানে বিশ্বাস কর আমার ব্যক্তিগত কোন কৃতিত্ব নেই। আমি শুধু গুড়ো গুলোকে দলা পাকিয়েছি। আর যেই আমাদের লেখা পাঠাক সেই আমাদের পরিবারের একজন একথাটা আশা করি আমাদের পরিবারের সবাইকে বোঝাতে পেরেছি। যাতে কারুকেই আমরা বোঝা না ভাবি। সকলেই আমাদের সম্পদ। শুধু একটা কাজ আমি করি ব্যক্তিগত ভাবে সকলের সাথে আন্তরিক ভাবে যোগাযোগ রাখি। সবার খোঁজখবর নিই। বিপদে আপদে স্বান্তনা দিই।আর কতটুকুই বা করতে পারি বলুন। প্রায় প্রতিটি কবি লেখকের সাথে মিলে মিশে থাকার চেষ্টা করি। এলাকার হলে বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে, একটু দূরের হলে কারু মাধ্যমে বা কমন কোনো জায়গায় মিলিত হয়ে আর বহুদূরের জনকে টেলিফোনে প্রায় প্রতি  নিয়ত খোঁজখবর নিয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। কিছু করতে না পারি মানসিক ভাবে সবসময় সবার সাথে থাকার মানবিক প্রচেষ্টাটাই এসময় আমরা হারিয়ে ফেলেছি। হতে পারে বন্ধুরা হয়তো দু দন্ড জিরোতে চায়। দুটো কথা বলে একটু শান্তি পেতে চায়। এই মানবিক বোধ থাকাটাই তো জরুরী। এতে কোন কৃতিত্ব আছে বলে আমি অন্তত মনে করি না

শুধু ব্যক্তি ম্যানেজমেন্ট নয় , এমনকি প্রতিষ্ঠান কেও একত্রিত করার ক্ষমতা রাখেন আপনি। ‘যুগ সাগ্নিক’ এর ‘ভাষা দিবস’ এর অনুষ্ঠানে সত্তরের ওপর লিটিল ম্যাগাজিন দুদিন ধরে অংশগ্রহণ করলো। এই মারাত্মক সময়ে রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলিয়ে এই অসাধ্য কি করে সাধন করলেন মশাই ? আপনি কি ম্যাজিক জানেন ?



দেখো সমস্ত সম্পর্কইই দাঁড়িয়ে আছে দুটো বিষয়ের ওপর। ১/ আন্তরিকতা ২/ যোগাযোগ। ধরো একুশে প্রোগ্রাম শেষ হবার পর দিন থেকেই আমি পরের বছরের জন্য উদ্যোগ নেওয়া শুরু করে দিই। যে সমস্ত ব্যানার ফেস্টুন আমি সম্পাদকদের থেকে গিয়ে নিয়ে আসি তাদের ব্যানার বা ফেস্টুনগুলো ফেরত দেবার সাথে সাথে তাদের সাথে দেখা করাও হয় আবার আত্মীয়তা তৈরী করার একটা প্রচেষ্টা শুরু করা হয়। প্রোগ্রাম কেমন লাগলো, আর কি কি করা যেত, ইত্যাদি প্রভৃতি। দু কাপ চা নাকি অনেক সম্পর্ক তৈরী করে। আন্তরিক ভাবে আমার ভালোবাসার কথা তাদের কাছে কতটা পৌছোয়, তারা কতটা গ্রহন করেন সেটা আমি বলতে পারবো না। তবে আমার আন্তরিকতায় আমি কোনো ঘাটতি রাখার চেস্টা করিনা। তুমি বিশ্বাস কর, এখনো পর্যন্ত কতগুলি ব্যনার আমার কাছে গচ্ছিত আছে  জানো ?  না হলেও অন্ততপক্ষে গোটা পঁচিশ খানা।

যে কটা পত্রিকা আমাদের এই উৎসবে অংশ নেয় তাদের প্রত্যেকের সাথেই আমি ব্যক্তিগত ভাবে যোগাযোগ রাখি। এই। যোগাযোগ সবটাই কিন্তু সাংগঠনিক কারনেই। এদের কোন সম্পাদকের সাথেই কিন্তু আমি কখনো আমার লেখা প্রকাশ করার তাগিদে সম্পর্ক তৈরী করিনি। অথবা তাদেরও কখনো বলিনি আমার পত্রিকায় তাদের লেখা ছাপবো বলে। আসলে ওই যে বললাম আন্তরিক ভাবে বলতে পারলে অপরিচিতরাও আপনার সাথে একাত্ম হয়ে যায়। এবার পরের অংশে আসি। আচ্ছা রাজনীতি আমাদের কি শিক্ষা দেয়? মানুষের সাথে মানুষের বিভেদ তৈরী করা নাকি একাত্মতার সৃষ্টি করা। এটা ঠিক বর্তমান দিনের বেশী সংখ্যক নেতা বিভেদ তৈরী করাটাকেই হয়তোবা তাদের সাংগঠনিক কৌশল হিসেবে দেখেন। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আমি এমন এক পরিবারে জন্মছিলাম যেখানে অ,আ,শেখার সময় থেকেই রাজনৈতিক কথাবার্তা শোনবার কান তৈরী হয়ে গেছিলো।বাবা ঢাকা জেলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে শুধু যুক্তইই ছিলেন না তিনি তার জীবনের দীর্ঘ ষোলটি বছর কারান্তরালে ছিলেন এবং সেখানে থাকা কালীন সময়ে আই এ, বি এ, এম এ, তিনটি ডিগ্রী লাভ করেছিলেন। তখনকার দিনের ঢাকা জেলার কমিউনিস্ট পার্টি র কমিউনে আমার বড়দিদি, মেজদিদি ও বড়দা জন্ম নিয়েছিলেন। মাও স সময়কার একজন সর্বক্ষনের কর্মী ছিলেন। এটুকু বলতে হল এজন্য আমার রাজনৈতিক স্ট্যাটাস টা বোঝানোর জন্য, দয়া করে এটিকে প্রচারের অংগ হিসেবে ভাববেন না। তাহলে কুন্ঠার অবকাশ থাকবেনা। যেটা বলছিলাম, রাজনীতি মানুষকে ইউনিফাই করতে শেখায়। আমি ছোটবেলা থেকেই সেই রাজনীতি শিখেছি যাতে করে বিপদে আপদে সম্পদে একজন আরেকজনকে পাশে থাকতে শেখায়। বন্ধুত্বের আসল ক্ষেত্রকে চেনায়। বিভেদ, বা আইসোলেশনের রাজনীতি আমি কোন দিনই রপ্ত করতে পারিনি। তাই আমার কাছে মানুষের প্রথম পরিচয় মানেই সে কোন দলের মতাবলম্বী সেটা নয় সে যে মানুষ সেটাকেই মনে করিয়ে দেওয়া, তার ন্যূনতম চাহিদা অনুযায়ী তার সাথে সম্পর্ক তৈরী করে তাকে সংগঠিত করার চেষ্টা করা। এক্ষেত্রে কবিতা, গল্প, ইত্যাদিকার চাহিদা অনুযায়ী তার সাথে একনৌকার সওয়ার হওয়া। দিদি আজ রাতভোর হলেই বিপ্লবের পদধ্বনি শোনা যাবে আর একই শ্রেনীভুক্তদের ভেতরে শুধুমাত্র সস্তার সাংগঠনিক প্রয়োজনে শ্রেনী সংগ্রামের লড়াই লড়িয়ে,দেওয়ার দলেও আমি নই। তাই সমস্ত দল মত পথের কবি সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক কর্মীদের সাথে মিশতে আমার ভেতর কোন অনুশোচনা করতে হয় না। জানিনা এ জন্যই দলমত নির্বিশেষে সবাই আমার সাথে পা মেলান কিনা।

সম্পাদক মানেই আমাদের ধারণা বেশ পেখমধারী ব্যক্তিত্ব। যে বেরহমীসে উঠতি লেখকদের মাথা কাটার জন্য রেডি। আপনি এর একদম বিপরীত মেরুর লোক। এমন দিলদরিয়া সম্পাদক উঠতি লেখকদের অনেক জন্মের আকাংঙ্খার ফল। এত প্রশ্রয় দেন কেন আমাদের মত নগন্য দের ? 



এ প্রশ্নের উত্তরে একটা গল্প বলি। আশা করি এতেই আমার উত্তরটা পেয়ে যাবে । আমার কলেজ জীবন শেষ হয়েছে বছর দেড়েক হবে। আমরা কলেজে থাকতে দিঙ্মাত্র বলে যে পত্রিকাটা করতাম সেটা চোখ বুঁজেছে। কাঠ বেকার। সিগারেটের পয়সাতো আর বাবার কাছে চাওয়া যায় না। এক আধটা টিউশন করি আর সুজাতা সদন বলে একটা থিয়েটার হলে পরদা টানার কাজ করি। ( সে এক মজার গল্প, সুযোগ পেলে মনে করিও)। সেদিন বৃহস্পতিবার। থিয়েটার থেকে বাড়ি ফিরছি। পথে মুক্তাঙ্গনে ঠেক মেরে চায়ের দোকানে ঢুকেছি। ঢুকতেই দেখি আমাদের কলেজের তিনজন প্রফেসর বসে আছেন। আমি যথারীতি একটু দূরে গিয়েই বসলাম। কান্তি  গুপ্ত(বাংলা), সমীর মুখার্জী (পল সায়েন্স) আর বিশ্বজিৎ গুহ (অর্থনীতি) । বিশু দা আমাদের পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে লেখেন। তিনজনই আমাকে অসম্ভব ভালোবাসেন। কেন জানিনা। আমি একাই ছিলাম। কান্তিদা, যেমন দেখতে তেমনি গলার স্বর। আমি যদিওবা কমার্স এর ছাত্র। কিন্তু গা জোয়ারি করে বাংলা ক্লাশ করতাম আর এ ব্যাপারে কান্তিদাও প্রশ্রয় দিতেন। আমাকে ওদের টেবিলে ডেকে নিলেন। দু চার কথার পর কান্তিদা আমায় বললেন " তোকে খুজছিলাম। এক কাজ কর, কাল আমার বাড়িতে একটু আয় তো। সকাল দশটায়। একসাথে চা খাবো আর কিছু কথাও আছে’’ । বলে জোর করে বুক পকেটে একটা দশ টাকার নোট গুঁজে দিলেন।

তা পর দিন আমি গিয়ে হাজির হলাম ওর ভবানীপুরের বাড়িতে। দু চার কথার পর উনি একটা খাতা বের করলেন। খাতাটা দেখেই আমি চমকে গেলাম। আমার হারিয়ে জাওয়া কবিতার খাতা। হাত বাড়াতেই তিনি ঘাড় নাড়লেন। " নাহ এটা আমি তোকে ফেরত দেবো না। এটা যদি তোর দরকারি হোত তাহলে হারাতিস না " বুঝলাম তর্ক করা বেকার। আমার হাতে তিনি একটা তখনকার দিনে ( সাতাত্তর) পঞ্চাশ টাকার নোট দিলেন। আর একটা ' পরিচয়' এর কপি। "তোকে জিজ্ঞাসা না করেই আমি একটা কবিতা পরিচয়ে দিয়েছিলাম। ছেপেছে। আমি তখন চোখ বন্ধ করে টাকাটা হাতে নিয়ে বসে আছি। তিনি আমাকে আর একটা পত্রিকা হাতে দিলেন " সংবেদী মন "। এটা আমার পত্রিকা। এতেও একটা ছেপেছি, আমি কিন্তু কিছু দিতে পারবো না। কিরে জিজ্ঞাসা করলিনাতো খাতাটা কোথায় পেলাম? লাইব্রেরী রুমের ওয়েস্ট বক্সে। আপনাকে কি বলি সেদিনই হয়তো আমার ভেতর জন্ম নিয়েছিল আজকের এই আমি। সম্পাদক প্রদীপ গুপ্ত। " জন্ম নিয়েছি ধুলিতে দয়া করে দাও ভুলিতে দাও ভুলিতে, নাই ধুলি মোর অন্তরে। "

কারুকে প্রশ্রয় দিই নি আমি । আপনাদের প্রশ্রয়ে যেন বেচে থাকে যুগ সাগ্নিক। বাবা বলতেন নীচুতলার লোকেরাই হচ্ছেন আসল চালিকাশক্তি। যারা গাড়িতে বসে থাকেন তারা না বসলেও গাড়ি চলবে কিন্তু চালক ছাড়া নৈব নৈব চ। আপনাদের প্রশ্রয় দিতে লাগে না দিদি আপনারা প্রশ্রয় না দিলে সবকিছুই যে চিত্তির।

পরিশেষে শুধু একটা কথাই বলি সম্পাদক কথাটার কোন লিঙ্গ ভেদ করা উচিত না। সম্পাদক হলেন একাধারে বাবা অন্যদিকে মা। একই সঙ্গে বাবার মতো দায়িত্বসম্পন্ন আর মায়ের মতো স্নেহশীলা হতে হবে সম্পাদককে।মা যেমনি কোন সন্তানকেই ফেলে দিতে পারেন না সমস্ত সন্তানই তার কাছে সমান আদরের তেমনটিই একজন সম্পাদকেরও সমস্ত লেখকদেরই সমান গুরুত্ব সহকারে দেখা উচিত। তাদের ব্যক্তিগত সুখ দুঃখ , শরীর স্বাস্থ্যের খোঁজ খবর নেওয়া, তাদের পারিবারিক সুবিধা অসুবিধার খোঁজ নেওয়া, সবচাইতে প্রত্যেকের সাথে সত্যিকারের একটা নির্ভরশীলতার সম্পর্ক তৈরী করাই একজন আদর্শ সম্পাদকের দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে আমার মনে হয়। এ ব্যাপারে আমি শ্রদ্ধেয় গৌর কিশোর ঘোষএর ছবিকে পূজো করি।  

বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুতে আপনি গর্জে ওঠেন। ভয় নেই আপনার ? কেউ কেউ চিহ্নিত করে রাখছে আপনাকে ? এই ধান্দাবাজীর দেশে না ঘরকা না ঘাটকা হয়ে চুপচাপ মজা দেখাটাই তো নিরাপদ বেশি … আর খুব বেশি হলে একটা মোম মিছিল ? 



পঞ্চম প্রশ্নে তুমি আমায় এ সময়ের জন্য একটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রশ্ন করেছ । দেখ , আমার মনে হয় প্রতিবাদ করাটা একটা অভ্যাস। আর এ অভ্যাসটাও একটা আশ্চর্য জীবন বোধ থেকেই বেড়ে ওঠে। মোমবাতি হাতে নিয়ে মিছিল করা যখন শুরু হয়েছিল তখন কিন্তু প্রতিবাদের এই ধরনটা যথেষ্ট শক্তিশালী ছিলো।

কিন্তু ধীরেধীরে এটা অনেকটাই ভোঁতা হয়ে গেলো। আর এটাই স্বাভাবিক কারন ললিপপ মার্কা কিছু মানুষ এই   প্রতিবাদের ধরনটাকে কেমন যেন সফি সফি করে ফেললেন। আমি যখন জন্মাই তখন থেকে বাংলায় প্রকৃত গণ আন্দোলন গুলো তৈরী হচ্ছে। তাছাড়া পূর্ব বঙ্গ থেকে প্রকৃত অর্থে ছিন্নমূল উদ্বাস্তু পরিবারের ছেলে আমি। বাবা মায়ের বিষয়ে কিছু কথা আমি ইতিপূর্বেই তোমাকে বলেছি। তা পূর্ববঙ্গ থেকে এপারে এসে বাবা প্রথম অবস্থায় তার দাদাদের সাথে যোগাযোগ করেন। বাবারা চার ভাই। বড় দুই ভাই ইতিমধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত। তারা কোনদিনই সে রকমভাবে রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন নি। জীবনে প্রতিষ্ঠা অর্জনের লক্ষে এগিয়ে গেছেন। বড় ঘরে ( বলা যাবে না) বিয়ে ইত্যাদি করে করে ইতিমধ্যে তারা সুপ্রতিষ্ঠিত। আর বাবারা বাকী দু ভাই আদর্শবাদ কেই পাথেয় করেছেন। দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকারের বিদ্যুৎ মন্ত্রী প্রয়াত শংকর গুপ্ত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির রাজ্য সম্পাদিকা শ্যামলী গুপ্তর স্বামী আমার খুড়তুতো দাদা । বাবা আর কাকা এখানে এসে প্রথমে যাদবপুর অঞ্চলে ওঠেন। সেখান থেকে অন্যান্য কমরেডদের ডাকে নেতাজী নগরে দখলি জমিতে দড়মার ঘর বাঁধেন। তখন আমার জ্যাঠা মশাইদের সম্মানে লাগায় তারা বাবাকে হিন্দু স্কুলে অথবা মিত্র ইন্সটিটিউশনে মাস্টারি করার ও ভবানীপূর অঞ্চলে একটা বাড়ি কিনে দেবার প্রস্তাব দেন। কিন্তু বাবা ততদিনে কলোনিতেই বিদ্যালয় স্থাপন করে সেখানেই কলোনির অধিবাসীদের শিক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন। এ কথাগুলো না বললে প্রেক্ষিতটা বোঝানো যেত না।

আমার ছেলেবেলা আর কৈশোরের দিন গুলো পরপর অনেকগুলো আন্দোলনের উত্তাপ ছুঁইয়ে দিয়ে গেছে আমার জীবনে। প্রফুল্ল সেন, অতুল্য ঘোষদের মন্ত্রিত্বের সময় কালীন খাদ্য আন্দোলন, ট্রামভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন, নুরুল ইসলাম আনন্দ হাইতের শহিদ হওয়া, পশিচমবংগ ছাত্র যুব উতসব,ইত্যাদি গণ আন্দোলনে  বাবা অথবা দিদিদের হাত ধরে মিছিলে মিছিলে পথ হাটা। সে এক উত্তাল দিনের সাক্ষী আমি। তখন কমরেড ডাকটার ভেতরে একটা অন্যরকমের মাদকতা ছিল। এখনকার মতো এতটা ফিকে হয়ে যায়নি।তখন ময়দানে বা শহিদ মিনারের তলায় বসে দশজন মিলে চপ মুড়ি খাওয়ার ভেতর একটা আত্মীয়তা ছিল। এখনকার বিরিয়ানির ভেতরেও যেটা খুঁজে পাওয়া যায় না। এরপর এল চীন ভারত যুদ্ধ। এই যুদ্ধ যে শুধু ভারতীয় অর্থনীতিকেই ধ্বংস করলো তাই নয় ধ্বংসের বীজ পুতে দিল ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের বুকেও। তখন থেকেই পরিচিত মুখগুলো ধীরে ধীরে কেমন যেন অপরিচিত হয়ে উঠলো। যে সব কমিউনিস্ট কর্মীরা এতদিন কাঁধে কাঁধ ছিলেন তারাই এ সময়ে একজন আরেকজনের দিকে সন্দেহের চোখে চাইলেন। ফিসফিস, গুজগুজ,শুরু হয়ে গেল। আমাদের ছোটদের ভেতর পর্যন্ত যে সমস্ত বাড়িগুলোতে অবাধ জাতায়াত ছিল সেখানেও বিভেদের পাচিল উঠলো। ছোটকাকা দের সাথে বাবার রাজনৈতিক দুরত্বের সৃষ্টি হলো। সে এক বিচ্ছিরি পরিস্থিতি। ধীরে কমিউনিস্ট আন্দোলন আরও বিভক্ত হলো আর পার্টির ভেতরে শুরু হলো বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়া। যার ফল এখন আমরা হয়তোবা কেউ কেউ বুঝতে পারছি। কারন অসুখটা এখন এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে আমরাই হয়তোবা জনগনের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। যাই হোক অনেক দর কষাকষি অনেক রক্তঝরা আন্দোলনের ফলে যুক্তফ্রন্ট সৃস্টি হলেও পারস্পরিক অবিশ্বাসের বাতাবরনে এই সরকার স্বাভাবিক ভাবেই টিকলো না। সত্তর সাল হলো বাংলার রাজনৈতিক আবহে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সময়।রাজনৈতিক হত্যা, সন্ত্রাস,এবং বারুদের ধোঁয়ায় তখন বাংলার আকাশ ছেয়ে গেছে। এ যেন সেই সময় যখন পশুরাজ ফরমান জারি করেছিল প্রতি ঘর থেকে একটি করে  প্রানকে তার ক্ষুধা নিবৃত্তি করার জন্য পাঠাতে হবে। বাংলার সবচাইতে কুখ্যাত মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ রায়ের আমল এল। তার ঠিক আগেই আমি আমার বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হই।কল্যাণীতে আমার পিসি বাড়িতে থেকে আমায় হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিতে হয়। আমাদের বাড়ি নেতাজি নগর তখনকার দিনে টালিগঞ্জের সবচাইতে উপদ্রুত এলাকা গুলির একটি। ততদিনে বাবা অবসর নিয়েছেন। নেতাজি নগরে স্থানীয় মানুষদের দেওয়া অর্থ দিয়ে গঠিত হয়েছে নেতাজি নগর কলেজ। পাড়ার কলেজ সে হিসেবে আমাকে সেই কলেজেই ভরতি হলাম। কলেজে পড়াকালীন শুধুমাত্র ছাত্র পরিষদকে আটকাবার জন্য সাংস্কৃতিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নিতে হল। ও বলতে ভূলে গেছি এর ভেতর আমার বড়দিদি বিয়ে করেছেন সি পি আই এর প: ব রাজ্য কমিটির নেতা ও মেদিনীপুর জেলার অন্যতম সম্পাদক অশোক মিশ্রকে। দুজনেই তখন পার্টি কমিউনে থাকেন। দুজনেই ক্ষেত মজুর আন্দোলনের প্রথম সারিতে। উনসত্তর সাল থেকে, যদিওবা তখন আমি নিতান্তই কিশোর। তবুও ওদের সাথে মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে জমি দখল আন্দোলনের ছবিও আমার চোখে এখনও জ্বলজ্বল করে।

আসলে একটা চরিত্রকে বুঝতে গেলে তার জীবনবোধের শেকড় টাকে বুঝতে হবে। ভাসাভাসা আলগা আলগা কতগুলো কথা বলে দিলেই হয়তোবা শেষ করা যেত। কিন্তু আমি ইচ্ছে করেই সময় টাকে ধরতে চাইছি। যেখানে শুয়ে আছে এই উত্তরের বীজ।

বাবা অবসর নিয়েছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য নির্ধারিত একশো টাকা করে রাজ্য আর কেন্দ্রের দেওয়া পেনশন আর বাবার মাস্টারিরর পেনশন বত্রিশটাকা। এই তখন আমাদের পরিবারের মোট আয়। বাবা টিউশন করে আয়ের থেকে ব্যয় করতেন বেশি। যা টাকা পেতেন সেই টাকার সিংহভাগ দুস্থ ছাত্র এছাড়া পার্টির কাজের জন্য খরচ করে দিতেন। এদিকে আমাদের ছয় ভাই বোনের ভেতরে দিদির বিয়ে হয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু ওরা দুজনে মিলে যা ওয়েজ পান তার থেকে আমাদের দেওয়ার মতো সামর্থ্য ওদের থাকবার কথা নয়। দাদা চাকরি করে বিয়ে করে নিয়েছেন। আলাদা থাকতেন। কাজেই, আর বাকী রইলাম আমি আর আমার দুই দিদি আর ছোট বোন। এ অবস্থায় আমি একটা আয়ুর্বেদীক কোম্পানির ব্যাগ ধরে মেদিনীপুর বড়দিদির কমিউনে। ওখানে থেকে আমি যাদের সান্নিধ্যে এলাম তারা সে সময়কার বাঘা বাঘা নেতা। বিশ্বনাথ মুখারর্জী, গীতা দি, নারায়ন চৌবে,কামাখ্যা দা, সিপিআই এর এখনকার রাজ্য সম্পাদক প্রবোধ পান্ডা, আলাপ হোল গুরুদাশ দা, ইত্যাদি সব নেতাদের সাথে গভীর সম্পর্ক তৈরী হল।বছর দুই থাকলাম মেদিনীপুর। এর ভেতর ১৯৮০ সালে বাবা মারা গেলেন। আর আমার মাথা থেকে ছাতাটাও কে যেন কেড়ে নিল। এতদিনে আমার সত্তিকারের জীবন যুদ্ধ শুরু হোল। আমি আপনাকে আগেই জানিয়েছি যে আমার অনেক প্রভাবশালী স্বজন আছেন বা ছিলেন। স্বীকার না করলে অন্যায় হবে তখন তারা অনেকেই বিভিন্ন ধরনের চাকরীর, সরকারি বেসরকারি, প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আমার রাজনৈতিক দল থেকেও চেষ্টা করেছিল কিন্তু কারো দয়ায় কোনরকমভাবে অন্নের ব্যবস্থা করতে তখন আমি কোনোমতেই রাজী হই নি। যদিওবা তখন আমি আমার দলের যুব সংগঠনের রাজ্য কমিটিতে সাংস্কৃতিক সংগঠনেরও তাই এবং পার্টির জেলাস্তরে ছিলাম। কিন্তু কোনরকম রাজনৈতিক সুযোগ সুবিধা নিতে তখন মন একদম সায় দেয় নি। আমার জীবনের কালো দিনগুলোর কথা ভাবলে এখনো আমি শিউরে উঠি। অপারেশন ‘সান সাইন’ এর সময় আমি আমার অঞ্চলের হকার ইউনিয়নের দায়িত্বে। বাস্তবিক ভাবে আমিও তখন একজন হকার। ফুটপাথে বসে তখন আমি বিরিয়ানি বিক্রি করে আমার সংসার চালাচ্ছি। আমার মা, স্ত্রী, দুই সন্তানের দায়িত্ব তখন আমার মাথায়। আমার পায়ে হাড়ি ভর্তি গরম জল পরে সারাটা পায়ে ফোস্কা পড়ে গেছিল। সেই দাগ আজ অবধি আমার পায়ে আছে। একথা বলতে কিন্তু আমার কোন সংকোচ হচ্ছে না। আমি দীর্ঘ দিন প্রায় বারো বছর লরিতে লরিতে কোলকাতা বীরভূম, মালদা, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া করে বেড়িয়েছি। কত রকম ভাবে যে আমি  আমার জীবনকে কাটিয়েছি দিদি সে সব কথা আজও আমার স্বপ্নের মতো মনে হয়। কিন্তু আমি কোনদিনও কারো কোনরকম দয়া দাক্ষিণ্য গ্রহন করিনি। শেসে আমি ১৯৯৯ সালে আমাদের নিজেদের জমির ওপর বাড়ি বানিয়ে বাড়ি বানাবার ব্যাবসা শুরু করি। তোমার শুনলে ভালো লাগবে আমি আজ অবধি আঠারোটি বাড়ি ( চার পাঁচ কাঠা জমির ওপরে বহুতল) বানিয়ে বিক্রি করেছি। এ কথা গুলো বললাম এজন্য যে আমি কেন ভয় পাবো? কাকে ভয় পাবো,? জীবনের আসল ভয়ের সময়টাতেই যখন কাউকে পরোয়া করিনি, তখন জীবনের এই উপান্তে এসে কার ভয়ে মুখ লুকোবো? জীবনের অনেক সাদা কালো, চড়াই উতরাই আমি দেখেছি। জীবনে চলার পথে অসংখ্য চরিত্রের মানুষের সাথে আলাপ হয়েছে। রাত দুটোর সময় আমার মাথার পেছনে ধরা রিভলবারের মুখকে কথা বলে নীচে নামিয়েছি। নলহাটিতে পাথর খাদানে আমায় লেদ মেশিনের সামনে দাঁড় করিয়ে মেশিনে গলা ঢুকিয়ে দেবার হুমকির হাত থেকে আমাকে প্রায় জনা তিরিশেক অকুতোভয় ড্রাইভার বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে। প্রচুর মানুষের ভালবাসা পেয়েছি আমি। আমি মানুষকে বিশ্বাস করি, ভালবাসি। আমি সাধারন মানুষের থেকে কোনদিনও বিচ্ছিন্ন হইনি। আমি কেন ভয় পাবো? আমি বিশ্বাস করি সাধারন মানুষ, ঠেলাওয়ালা, রিক্সাওয়ালা, মুটে মজদুর, সমস্ত স্তরের মানুষ আমায় ভালোবাসে আমায় বিশ্বাস করে। আমি না থাকলে অন্তত দুফোঁটা চোখের জলে সবাই আমার কথা একমিনিট হলেও ভাববে। আমি তো কবির এ কথাটাকে আপ্তবাক্য করেছি " মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক "।

আসলে, সময়, পরিস্থিতি, পারিপার্শ্বিকতা, একজন প্রতিবাদী মানুষের চরিত্র তৈরী করে।

এবারের ‘কলকাতা বইমেলা’য় প্রকাশিত হয়েছে আপনার গল্প সংকলণ , ‘নুলিয়া এবং অন্যান্য’। এটাই কি প্রথম ? কবিতাও তো লেখেন অনেক , সেসব গুছিয়ে গাছিয়ে কবে নাগাদ পাচ্ছি ? 




এ প্রশ্নটা সত্যি খুব সুন্দর। হ্যাঁ, ‘ নুলিয়া এবং অন্যান্য’  আমার প্রথম গল্পসংকলন। সত্যি বলতে কি গল্প লিখতেই আমি বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করি। জীবনের পথে চলতে গিয়ে যে অসংখ্য মানুষ জনের সাথে দেখা হয়েছে গল্পের অবসরে তাদের সাথে মুখোমুখি হওয়ার অবকাশ পাই। ভালো লাগে চেনা মানুষ গুলোর সাথে কথায় মেতে উঠতে। তাদের সুখ, দুঃখ,মান অভিমান, আনন্দ উতসব, তাদের ঘৃনা। বেশ লাগে।

আর কবিতা সম্পর্কে আমার যেটা মনে হয় আমি বোধহয় কবি হিসেবে কোনদিনই উচ্চতায় উঠতে পারবো না। তাছাড়া আমার একটা আড়ষ্টতাও আছে। আপনি একে inferiority complex ও ভাবতে পার । তবে বই সম্ভবত আমি আগামী বইমেলায় অথবা শারদীয় উৎসবে প্রকাশ করবো। অন্যের কবিতা বেছে দিতে কোন অসুবিধা হয় না। কিন্তু নিজের কবিতা বাছাটা খুবই সমস্যার।

আপনি তো প্রকাশনার সাথেও যুক্ত আছেন । বইমেলায় পর পর দু বছর , ‘একবিংশের কবিতা সংকলণ’, এবং ‘একবিংশের গল্প সংকলণ’ নাম দিয়ে নতুনদের লেখা প্রকাশের একটা প্ল্যাটফর্ম করে দিয়েছেন । এখানে কিসের ভিত্তিতে এই নামকরণ ? বয়স নাকি লেখার ধারা ? নাকি আদৌ তেমন কোনো ব্যাপার নেই ? 



কোন কবি বা গল্পকার এদের প্রথম স্বপ্ন কি জান ? দুই মলাটের ভেতরে ছাপার অক্ষরে নিজের সাহিত্যকর্ম কে সংরক্ষণ করা। কবিতার আসরে অথবা বিভিন্ন সভা সমিতিতে খাতার থেকে দেখে কবিতা পড়ার বদলে কোন গ্রন্থের থেকে কবিতা পড়ার মজাই আলাদা। সেটা যদি নিজস্ব কবিতার বই হয় তাহলে তো খুবই ভালো নিদেন কোন সংকলন গ্রন্থ হলেও কাজ চলে যায়। সেটাও না থাকলে কোন পত্রিকা। ওই যে ডায়াসে উঠে পৃষ্ঠা ওল্টানো ওর মজাই আলাদা। কিন্তু তুমি নিজেও জান , নিজস্ব একটা কবিতার বই কজনের ক্ষমতায় কুলোয়। সামান্য একটা তিন চার ফর্মার বই হার্ড কভারে প্রকাশ করতে গেলেই অন্তত বারো চোদ্দ হাজার টাকার ধাক্কা। তার ওপরে প্রকাশকের খেলা। তিনশ বই ছাপবে বলে একশো ছেপে তার থেকে পঞ্চাশ খানা লেখকের হাতে দিয়ে এইবারে দৌড় করানো। এমনিতেই বেশীরভাগ কবির বাড়িতে অশেষ লাঞ্ছনা ।

কথাটা খারাপ শোনালেও একদম খাঁটি। যতই আয় করুন না কেন আমাদের মত মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত সংসারে খরচ আর জোগানের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। ছেলে মেয়েদের পড়াশুনো, জামাকাপড়,অসুখবিসুখ, সামাজিকতা, সামলে ভবিষ্যৎ এর জন্য কজনের ভাঁড়ার ঘরে আর মা লক্ষ্মী অচঞ্চলা থাকতে পারেন? তার ওপরে কবিতা লেখা সে তো ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। আর মহিলাদের অবস্থা তো আরও করুন। কত গঞ্জনাই যে সহ্য করতে হয় তাদের সে তারাই জানেন। এ অবস্থায় যদি এমন একটা কিছু করা যায় যাতে করে অল্প পয়সায় সাধ্যের মধ্যে সাধ পূর্ণ করার ব্যবস্থা করা যায় ? তাহলে হয়তো ওই মানুষ গুলোর মুখে একটু হাসির ঝিলিক দেখা সম্ভব ।

এই ধারনার বশবর্তী হয়েই এগিয়ে গেছিলাম কবিতা আর গল্প সংকলন প্রকাশ করার উদ্দেশ্য নিয়ে। মাত্র বারোশো টাকায় আট পৃষ্ঠা, দেওয়া হবে বারোটা করে বই। প্রথমে ভেবেছিলাম একবিংশ শতাব্দী র একুশ জন কবিকে নিয়ে শুরু করি। সে হিসেবে নাম দিলাম একবিংশের একুশ কবি। ফেস বুকে বিজ্ঞাপন দিলাম। ওরে বাবাঃ , স্রোতের মত লেখা আসতে লাগলো ।

একুশের যায়গায় চল্লিশখানা। মানের প্রশ্নে দশজনকে বাতিল করে ত্রিশ জনের কবিতা নিয়ে প্রকাশ করলাম প্রথম খন্ড। প্রথম খন্ড এজন্য এরভেতরে আরও গোটা দশেক সেট এসে গেছে। তুমি ভাব একবার! যেখানে প্রকাশকেরা দিনের পর দিন বিজ্ঞাপন দিয়ে লেখা পায় না সেখানে এই বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস আমায় উতসাহিত করবে কিনা।

একই ভাবে প্রকাশ পেল দ্বিতীয় খন্ড, যেখানে গল্পকারের অল্পতায় আজ বঙ্গীয় সংস্কৃতির নাভশ্বাস উঠছে সেখানে তিনটি করে গল্প জমা দিলেন একুশ জন, তিনজনকে বাদ দিয়ে আঠারো জন গল্প কারের গল্প নিয়ে প্রকাশ হোল একবিংশের গল্প সংকলন। তোমাকে বলি , এদের ভেতর অনেকেই ব্যক্তিগত ভাবে আমায় এই বলে ধন্যবাদ দিয়েছেন , ‘যাক আমার পরবর্তী প্রজন্ম জানবে যে আমার অন্য স্বত্বার সাথে এই স্বত্বাটাও ছিল প্রদীপ দা’।  বাড়ির আলমরিতে অন্যান্য বইয়ের ভেতর আমার লেখাও ছাপার হরফে থাকবে।বই করার অত টাকা আমায় কে দিত বল ? এটাই প্রকাশক হিসেবে আমার প্রাপ্তি।আমার আনন্দ ।

আমার ইচ্ছা ছিল পয়সার অভাবে যারা তাদের লেখাকে ছাপার অক্ষরে দেখতে পান না কিন্তু নিজের অক্ষমতাকে ভীষণ ভাবে উপলব্ধি করছেন। অন্তরে অন্তরে গুমড়ে মরছেন তাদের মুখে একটু হাসি ফোটানো। অবশ্যই এখানে যারাই অংশ নিয়েছেন তারা প্রত্যেকেই যে অপারগ সেটা কিন্তু অবশ্যই নয়। আমার ব্যক্তিগত অনুরোধেও  অনেকেই লেখা দিয়েছেন। 

আপনার পত্রিকায় অনেক বিভাগ থাকে। ‘অর্ধেক আকাশ’ নাম দিয়ে মহিলাদের লেখা প্রকাশিত হয় , কেন ? লেখার ক্ষেত্রে এমন নারী পুরুষ ভেদরেখা তৈরীর চেষ্টা কেন ? লেখার মান ই তবে একমাত্র বিবেচ্য নয় ? বাসের লেডিস সিটের মত পাইয়ে দেওয়া ? 



না অবশ্যই কোন বিশেষ সুযোগ পাইয়ে দেওয়া নয়। তার কোন রকম ব্যবস্থাই নেই এখানে। আসলে এত কবিতা ছাপা হয় এ পত্রিকায় যে সেগুলোকে যদি একলপ্তে ছাপা হয় তাহলে সেগুলো আর কেউ পড়বেন না। ভাব ,  প্রায় তিনশো সাড়ে তিনশো কবির কবিতা। স্বাভাবিক ভাবে এগুলোকে বিভিন্ন অধ্যায়ে বা ভাগে বিভক্ত না করে দিলে কি অবস্থা হবে ভেবে দেখ । অন্যান্য পত্রিকায় খুব বেশি হলে ষাট সত্তর ।


আরেকটা বিষয়ে জিজ্ঞাস্য আছে। আপনার পত্রিকায় ‘জেলার লেখা’ বলে আলাদা ভাগ থাকে।এই আঞ্চলিকতা বোধ কিসের জন্য প্রয়োজন ? আজকের প্রতিষ্ঠিত অনেক লেখকই তো জেলাগুলি থেকে উঠে এসেছেন। মেইনস্ট্রিমে জায়গা করে নিয়েছেন কলমের জোরে । আলাদা করে এভাবে মার্কিং করা কেন ? 



আট নম্বর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া শুরু করেছিলাম।সেটাকেই কন্টিনিউ করি তবে নয় নম্বরটাও আমার মনে হয় একসাথে জুড়ে দেওয়া যাবে। যা বলছিলাম। এত সংখ্যক কবির কবিতা সাধারনত অনেকে এক বছর ধরেও ছাপে না। কিন্তু আমাদের মুশকিলটা কোথায় জান , কেউ ধর ,  পাঁচ দশ কুড়ি বা তারও বেশি টাকা খরচ করে পোস্টে বা কুরিয়ার করে লেখা পাঠালেন। তখন মনে হয় কি জানি , হয়তো সাধ্যের বাইরে গিয়েই কবি স্বপ্ন দেখছেন ছাপার অক্ষরকে বুকে নিয়ে ঘুমোনোর। মনটা কেমন যেন করে ওঠে,আগে দিইতো পাঠিয়ে প্রেসে, পরে কি হবে দেখা যাবে খন। এভাবে লেখার পাহাড় জমে। এবারে ছাপা তো হোল কিন্তু সাজাবো কি ভাবে? তখনই শুরু হোল পর্যায় ভাগ করার প্রক্রিয়া। আচ্ছা আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই সত্তরের পর গন সংগীতের দল করার একটা প্রবনতা খুব মাথা চাড়া দিয়েছিল? সে সময় একটা গান আমরা খুব গাইতাম " মুক্ত জনগন ভরিয়ে দেবে পৃথিবীতে মুক্ত বাতাস, যেখানে নারীরা থাকবে জুড়ে পৃথিবীর অর্ধেক আকাশ। " এটা আসলে মাও সে তুং এর একটা বিখ্যাত কথা "let's the thousand flowers bloom. " গানটিকে বাংলা করে হয়েছিল " শতফুল বিকশিত হোক "। গানটা আমার খুব পছন্দের ছিলো। তখন গানটার একটা বিপ্লবী তাৎপর্য ছিল। তখন সমানাধিকারের প্রশ্নে, নারী মুক্তি আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই গানটা বেশ ভালোই ব্যবহৃত হোত। তা আমার কবিতার পর্যায় ভাগ করার ক্ষেত্রে আমার মনে হলো তাইতো সমস্ত মহিলাদের লেখাকে যদি একত্রেএই শিরোনামে প্রকাশ করি তাহলে তো ভালোই হয়! আর তাছাড়া এভাবে নিশ্চয়ই মহিলাদের সম্মান দেখানোও হয়। কিন্তু এই ‘অর্ধেক আকাশে’  যে এখনকার মহিলা সমাজের একাংশের ঘোরতর আপত্তি আছে এটা আমার মাথায় আসার পর আমি এবারে এমন একটা চিন্তাকে মগজে আনি । যেটাতে হয়তো একটু অভিনবত্বও আছে। আমি ‘যুগ সাগ্নিকের’ ব্যানারে ফেসবুকে একটা খোলা বিতর্ক সভার আয়োজন করি। তুমি নিজেও সেই আলোচনায় বিভিন্নবার অংশ নিয়েছ। এছাড়া বিষয়টি খুব,জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সেই অবসরে আমি এই প্রশ্নটাও রেখেছিলাম সেটাতে বেশি সংখ্যক আলোচক এই অধ্যায়ের নামটার বিপক্ষে মত দিয়েছেন। তাদের মত আমি মেনে নিয়েছি । আর এবারের বৈশাখ সংখ্যা থেকে তিনটি অধ্যায়ের অবলুপ্তিকরণ প্রক্রিয়া শুরু করছি, ১/ অর্ধেক আকাশ তুলে দিচ্ছি, ২/ বাংলাদেশের হৃদয় হতে তুলে দিচ্ছি,৩/ বিভিন্ন জেলার কবিতা তুলে দেওয়া হচ্ছে।

বিভিন্ন জেলার কবিতার ক্ষেত্রেও আমার চিন্তায় ভুল ছিলো। আমি চেয়েছিলাম বিভিন্ন প্রান্তিক কবিরা যে শহরাঞ্চলের কবিদের চাইতে কম কিছু না সেটাকেই তুলে ধরা। কিন্তু এখানেও জনমত আমার চিন্তার বিপক্ষে যাওয়ায় আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এটাকেও এক করে দেবো। আসলে আমি বা আমরা চাই যুগ সাগ্নিক সত্তিকারের একটা জনমুখি পত্রিকা হোক। আর এজন্যই পাঠক লেখক আর পরিচালক দের একটা সাংস্কৃতিক মঞ্চ হিসেবে উঠে আসুক।আর সে জন্যই আমরা এই ভাবে মুক্তমঞ্চ ফেস বুকের মাধ্যমে জনমত যাচাই করে সেটাকেই কার্যকর করার প্রকৃয়া চালু করেছে।

এই যে আপনি ঘরের খেয়ে পরের মোষ তাড়িয়ে বেড়ান , এর পেছনে পরিবারের ভূমিকা কিরকম ? তাদের সমর্থন পান না বিরোধিতা ? 




এতো একটা মারাত্মক জিজ্ঞাসা। আজন্মও বলতে পার । কি সাংঘাতিক। হোম মিনিস্টারকে নিয়ে উল্টো পাল্টা কেউ লিখবে এটা চিন্তায় আনাটাও তো বিপদজনক। দেখ , আগে গল্প করতে গিয়ে আমি এমন অনেক কথাই বলেছি যেটাকে এই উত্তরের রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। আমার সাংস্কৃতিক ইচ্ছা অনিচ্ছা, ভালোবাসা, কাজকর্ম অনেক কিছুই বলেছি। আমি যখন বিয়ে করি তখন আমার বত্রিশ আর আমার তেনার বয়স মাত্র উনিশ। নিজের সংসার সম্পর্কিত কিছুই যার জ্ঞান হয়নি তাকে ধরেই নিয়ে এলাম আমার সংসারে। আমার ছোট বোনেরও বিয়ে হয়ে গেছে ততদিনে। মা বৃদ্ধা হয়েছেন। বিভিন্ন কারনে রাত বিরেতে বাড়ি ফিরি। একরাতে মা দরজা খুলতে পারলেন না। ঘটনার কথা বড়দিদির কানে যেতেই তিনি হাত ধরে হিড়হিড় করে নিয়ে গেলেন সোদপুর। ওখানেই ওর বাপের বাড়ি। গিয়েই সোজাসুজি প্রস্তাব। আমাদের একদম অপেক্ষা করার সময় নেই। মায়ের শরীর খুব খারাপ। একমাসের মধ্যেই বিয়ে দিতে হবে। প্রস্তাব শুনে ওরা তো আকাশ থেকে পড়লেন। সেও কখনো হয় নাকি, প্রথমত মেয়ের বিয়ে বলে কথা, তার ওপরে ঘরে ওর বড় বোন আছে। এ কি করে সম্ভব। না না এ কিছুতেই ---, মানে? দিদি রুদ্রমূর্তি ধরলেন। দিতেই হবে। আপনাদের কিছুই করতে হবে না। কিছুই করতে হবে না মানে? বিয়ে দেব অনুষ্ঠানতো করতেই হবে। তাছাড়া ব্রাহ্মন পুরোহিত। এবারে আমি বেকে বসলাম। পুরোহিত দিয়ে বিয়ে হলে আমি বিয়েই করবো না। রেজিস্টারি করতে হবে। বেশ তাহলে দু রকমই হোক। কিছুতেই না। যাই হোক আমাদের যাওয়ার চল্লিশ দিনের মাথায় বিয়ে করে ওকে ঘরে আনলাম। আগেই বলেছি বয়স উনিশ। মাথার ওপরে শ্বাশুরী, চার ননদ, এক ভাসুর। কি বিপজ্জনক অবস্থা বাপ রে বাপ। আশ্চর্যজনক ভাবে তিনি সব কিছু সামলালেন। মায়ের পেনশনের পাচশো আর আমার কোনরকম এই নিয়ে হাসিমুখে ---- নাহ আমি সত্যিই কখনো কখনো একা একা অবাক হয়ে ভাবি , মেয়েরা কোন শক্তি নিয়ে পৃথিবীতে আসে ? রাত দেড়টা, দেওয়াল লিখে তিন চার জন মিলে চলে এসেছি। ঘরে কি আছে না আছে কিচ্ছু জানি না। ‘কি দেব’ ? ‘আমি জানিনা , আমাদের যাকিছু আছে সেটাই ভাগ কিরে দাও হয়ে যাবে’। মিনিট পনেরো পর ভাতের থালা এল, ‘তোমার?’ ‘ আছে’। ‘নিয়ে এসো একসাথে খাবো’।‘ তোমরা খেয়ে নাও আমি খাচ্ছি’।

ছেলে হবে। মায়ের শরীর খুব খারাপ, দুবেলা আয়া রাখা উচিৎ। কিন্তু কোথা থেকে রাখবো? সংস্থান কোথায়? ওই তখন আয়ার কাজ সামলাচ্ছে। ছয়মাসের সময় মায়ের খুব বাড়াবাড়ি। দিদিরা বললেন আয়া রাখ ভাই, ওতো মরে যাবে। একা ও পারে নাকি কখনো? ও দরজার ওপার থেকে ঠোটে আঙুল ছোঁয়ায়। একবেলা আয়ার টাকা দিদিরা দিলেন আর একবেলার আয়া ও। আটমাসের সময় মারা গেলেন। যাবার সময়তেও ওর কোলেই মায়ের মাথা। পরে যখন অবস্থা ভালো হলো। বাড়ি ভরতি লেবার মিস্ত্রি। আমি কোনদিনও লেবার ঠিকাদার রাখিনি। নিজেই লেবার গ্যাং তৈরী করেছিলাম। সন্ধ্যার সময় দল বেধে সব আসতো হাজিরা তুলতে, সবার জন্য চা মুড়ি কে দেবে? কেন? বৌদি আছে তো!

আমি এটা বলবো না,  যে আমার সব লেখাই আগে ওকে দেখাই। না তা করি না। কারন এ ব্যাপারে ওকে আমি ভীষণ ভয় করি। ও ভীষণ কট্টর সমালোচক। দাড়ি কমা ধরে ধরে আলোচনা করে। সত্যি বলতে কি ভগবান কারুকে কারুকে দয়া করেন এমনি কিছু মানুষকে তাদের সংগের সঙ্গী করে পাঠান। আমরা হয়তো সময় থাকতে সেটা বুঝে উঠতে পারিনা, তাদের কে ঠিক মতো সম্মান করতে পারিনা।

আর একটা কথা। মায়ের চলে যাওয়ার সময় আমার মেয়ের বয়স আড়াই বছর। ওর পেছনেও ওর পরিশ্রমের কমতি ছিলো না। এতে করে আমার অপদার্থতা হয়তো প্রমানিত হচ্ছে কিন্তু ওর চরিত্র আকতে গেলে এটুকু না বলা তো আরও অপদার্থতার সামিল।

যৌথ পরিবারের ধারণা ভেঙ্গে যাচ্ছে যে যুগে , আপনার টিম ‘যুগ সাগ্নিক’ এক বিশাল যৌথ পরিবার । এখানে কর্তা আছেন কেউ , নাকি ‘আমরা সবাই রাজা’ টাইপ স্বপ্নরাজ্য ? বড় কাজে কোনটা বেশি জরুরি মনে করেন , গাইডেন্স না কমরেডারি ?



democratic centralism বলে একটা কথা আছে। সেটাকে কতটা নিখুঁত ভাবে অনুসরন করা সম্ভব আমি জানি না, কিন্তু কোন সংগঠনকে মজবুত ভিতের ওপরে দাড় করাতে গেলে এই কনসেপ্ট টাকে ফলো করা খুব জরুরী। একান্নবর্তী পরিবার গুলো ভেঙে যাওয়ার পেছনে আবার একটা অন্যরকম অর্থনৈতিক কারন আছে যেটা এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করার দরকার নেই বলেই মনে হয়।কিন্তু আমাদের পত্রিকার পরিবার, অন্তত আমি যেটুকু বুঝি, এক ঝাঁক প্রগতিশীল মানুষ, তারা মানসিক ভাবে কতটা কবি সাহিত্যিকদের মতো নিজেদেরকে মনে করেন সেটা আমার জানা নেই কিন্তু এখনকার সাহিত্য ও বাস্তব দুনিয়ার শেষ খবরটি পর্যন্ত তাদের নখ দর্পনে সেটা বিলক্ষন জানি।

বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে সাথে আমরা কিন্তু সামাজিক দায়বদ্ধতার কথাটাকেও বিশেষ ভাবে মনে রাখি। আর তাছাড়া একটা গোষ্ঠি হিসেবে নিজেদেরকে দাড় করাতে পারলে এখনকার যুগে নিজেদের বৃত্তটাকেও বাড়িয়ে নেওয়া যায় ও নিজের নিজের অবস্থানকে আরো দৃঢ় করা যায় সেটা আমাদের প্রত্যেকটি সদস্য শুধু জানেন তাই নয় বিশ্বাস করেন।

এবারে কথা হোল আমাদের এক থাকার রেসিপি টা কি? দেখ ,  প্রথমত সম্মান করতে জানা, দ্বিতিয়ত, কোন ব্যক্তিগত স্বার্থকে চরিতার্থ করতে গোষ্ঠি স্বার্থকে কাজে না লাগানো। তৃতীয়ত বাকি সব কিছুকে বজায় রেখে যতটুকু সম্ভব ততটুকুই গোষ্ঠির কাজে খরচ করা। মূলত এই তিনটি বিষয়কেই আমরা প্রাধান্য দিই। আর একটা কথা এমনভাবে কারুর কাছেই অর্থনৈতিক দায় দায়িত্বের কথা বলা হয় না যাতে করে এই দায়িত্ব তার কাছে বোঝা হয়ে না দাড়ায়। সম্পাদক হিসেবে আমার ব্যক্তিগত ভাবে একটু বেশিই হয়তো খাটতে হয়, দুশ্চিন্তার ভারও হয়তো স্বাভাবিক ভাবেই বইতে হয় কিন্তু তার জন্য আমার কোন অসুবিধা নেই।

এক্ষেত্রে আমিও বিভিন্নভাবে আমাদের সদস্যদের কাছ থেকে মতামত নিই। মতের আদান প্রদান করার জন্য মাঝে মাঝেই সভায় বসে সিদ্ধান্ত গ্রহন করি। মানে এককথায় এরকম কথা যেন কখনওই কোন সদস্যর মাথায় না আসে যে আসলে তার কোন গুরুত্বই নেই।
এবারের সভায় যেমনি অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যার মধ্যে একটি হোল আমারা ধীরে ধীরে মেশিনারি সেট আপের দিকে যাবো। এছাড়া প্রতি মাসে নির্দিষ্ট একদিন করে আমরা সাহিত্য সভার আয়োজন করবো ইত্যাদি।

মোট কথা কমরেডারিও যেমন আছে, তেমনি লিডারশীপের বিষয়টিও যে নেই তা নয়। তবে নিজের কথা বলার সুযোগ এখানে পুরোপুরিভাবেইই আছে। গোড়ায় যেটা বলছিলাম যে কোন মতামতই ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া নয় বরং নীচ থেকে মতামত যদি সত্যি সত্যি তুলে আনা যায় তাহলে যে কোন সংগঠন শক্তিশালী হতে বাধ্য।

পরিশিষ্টঃ আপনাদের কাছেও আমরা অনুরোধ করি সকলে আমাদের সাথে বন্ধুতার হাত বাড়ান। আসুন আমাদের দেশে যে জিনিষটির এখন সবচাইতে অভাব সেটি হচ্ছে, মূল্যবোধ, নীতি, নৈতিকতার চরম অবনতি। আমরা বিশ্বাস করি একমাত্র সৎ সংস্কৃতিই পারে আমাদের এই মানবিক মূল্যবোধ গুলোকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে। আর সেজন্য যেটা সবচাইতে প্রথম প্রয়োজন সেটি হচ্ছে সৎ সংহতি। আশা করি এ ব্যাপারে যুগ সাগ্নিক আপনাদের থেকেও সহয়োগিতা পাবে। আপনাদের কাছে এই নগন্য মানুষটিকে মনে করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন সকলে, ভালো ভাববেন।আপাতত এখানেই শেষ করছি। ভবিষ্যৎকালে যে কোন প্রয়োজনে মনে করবেন। ধন্যবাদ।


শব্দের মিছিলের পক্ষ থেকে আপনার সর্বাঙ্গী্ন সাফল্য কামনা করি । আপনি এগিয়ে চলুন আরো প্রাণে । আমরা সাথে আছি , গণ কণ্ঠে ।





বিস্তারিত -
শ্রী প্রদীপ গুপ্ত  /  শর্মিষ্ঠা ঘোষ 


Previous Post Next Post