জয়দীপ চক্রবর্তী



পৃথিবীতে এমন এক-একজন মানুষ জন্মান যাঁদের-কলম নিংড়ে প্রকাশিত হয় মানব প্রবাহের উষার স্বণদ্বারের চাবিকাঠি।থেকে যায় সব সময়ের, সব কালের মানুষের উত্তরাধিকার।থাকে অপ্রতিরোধ্য ঋণ।আমাদের জীবনে এমন একজন মানুষ-রবীন্দ্রনাথ।'' ...পুরাতন যাক ভেসে যাক''- কেননা চির নতুনের সাধনা-রবীন্দ্রনাথের সাধনা।আমাদের কাছে - বাংলা ভাষাভাষীদের রবীন্দ্রনাথের কাছে যে ঋণ তো মাতৃঋণের মতোই।আমার অনুভব একান্তভাবে আমার বাংলা-সাহিত্য-সংস্কৃতি-কৃষ্টির সব পরিপূর্ণতা, সর্বাধুনিকতা, সুব্যাপ্তি ঘটেছে একা রবীন্দ্রনাথেই।সমগ্র মানবীয় আস্বাদনে সমগ্র মানবের অন্তরেই তার অধিকার।নিজের সম্পর্কে নিজেই বলেছেন-আমি এসেছি এই ধরণীর মহাতীর্থে-এখানে সব দেশ, সব জাতি, সবকালের ইতিহাসের মহাকেন্দ্রে আছেন নর দেবতা-তাঁরই বেদীমূলে নিভৃতে বসে আমার অহংকার আমার ভেদবুদ্ধি স্খলন করবার দুঃসাধ্য চেষ্টায় আজও প্রবৃও আছি।এই কথা বা উক্তি তার মৃত্যুর একদশক আগে।মানুষের যৌবন প্রবাহের প্রস্থস্থলে নিজেকে স্থাপন করে নিজের ব্যাক্তিগত অহংকার ভেদবুদ্ধি স্খলন করবার প্রকৃয়ায় নিমগ্ন থেকেছে যৌবনভোর।তাই তিনি বলতে পারেন-

''যে তারেতে বাঁধিলাম তার
গাহিলাম আরবার-
মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক
আমি তোমাদেরই লোক
আর কিছু নয়
সেই হোক শেষ পরিচয়''।

প্রকৃতপক্ষে তার সমগ্র সৃষ্টি কালপ্রবাহের মধ্যে-ধ্বনিত হয়েছে স্বদেশ, স্বাধীনতা, মানবতার জয়গান।''বড় আমির'' অস্তিস্ত্বের অনুসন্ধান করেছেন।উদ্বোধন করেছেন।ধর্মগুরু বা জননেতা না হয়েও তামাম বিশ্বের মানব হৃদয়ে যে প্রীতি ও শ্রদ্ধা লাভ করেছেন, সে এই মানবীয়তার কারনে।তিনি বলেছেন-''আমি সত্য বুঝতে পারি সুখ-দুঃখ-বিরহ-মিলন-পূর্ণ ভালোবাসা প্রবল না সৌন্দর্যের নিরুদ্দেশ যাত্রার আকাঙ্ক্ষা প্রবল।এই বোঝা না বোঝার টানাপোড়েন ছিল তাঁর জীবনভর।যৌবনের প্রথম প্রভাতকালে -মানে প্রাক্ বলাকা পথ পর্যন্ত কবি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রূপারূপ অনুসন্ধান করেছেন।

পরবতীর্ কাল থেকে -মানুষের দুঃখ-সুখ-বিরহ-মিলন ও ভালোবাসার টান সহ বৃহত লোকসমাজের ওপর ক্ষুদ্র মানবগোষ্ঠির আক্রমণ,শোষন,বঞ্চনা,নিপীড়ন, দেখে নরদেবতার সঙ্গে একসূত্রে গেঁথেছেন তাঁর জীবন। ''মুক্তধারা, রক্তকরবী''-নাটক, ''গোরা'' উপন্যাস, চিত্রকাব্য ''মন্ত্রী অভিষেক'' প্রবন্ধ প্রভৃতি সৃজনের মধ্যে দিয়ে-জাতপাত, আধ্যাত্মিকতা, শ্রেণী বৈষম্যের বিরুদ্ধে ঘোষনা করেছেন- জেহাদ।সীমা-অসীম-সৌন্দর্য্যে- সুদূর অভিষার ছেড়ে তাঁর তরী ভিড়েছে-মূঢ়-ম্লান-মূক-মানুষের ঘাটে এসে।হারিয়ে গেল জীবন দেবতার সাধন।তাঁর জীবনের একেক পর এক প্রিয়জন বিয়োগের ব্যথা তাঁকে পারেনি ক্লান্ত করতে-অবসন্ন করতে।সুগভীর মানবিক শুভবোধের অবিনাশী আস্থাকে পারেনি শিথিল করতে।

চিত্রা কাব্যের এবার ফিরাও মোরে কবিতায় -দুঃখ-ব্যথাভরা কষ্টের সংসার-দারিদ্র, শূণ্যতা, ও ক্ষুদ্রতার অন্ধকারে অন্নপ্রাণ ও আলো প্রতিষ্ঠার কাজে যুক্ত করেছেন নিজেকে... আহ্বান জানিয়েছেন শেষ অধ্যায়ের জন্মদিন কাব্যের ঐকতান কবিতায়। শেষ জীবনে কবির মনে হয়েছে-হলনা-হল-মাটির মানুষের কথা বলা হলনা।তেমন করে-তাই আহ্বান করেছেন-যে আছে মাটির কাছাকাছি এমন কবিকে কানপেতেও থেকেছেন এই হ'ল না হ'ল না তাঁর অনুভব - হতে পারে - তবুও কিন্তু আমার অনুভব হয়েছে-পেরেছেন।না হলে লিখলেন কি করে মুক্তধারা, রক্তকরবী-র মত কালের যাত্রার মত নাটক।সমগ্র জীবনধারায় মানবধারার ভালোমন্দে নিজেকে ভেঙে-গড়ে বারংবার নতুন রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছেন।এই নতুন রবীন্দ্রনাথ গড়ে ওঠার ধারায় তাঁর সাধনের প্রবাহে আমরা মানবধারার ভালোমন্দ, মানঅপমান, লাঞ্ছনা নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী রবীন্দ্রনাথ উদ্ভাসিত হয়েছিলেন বলে মনে করি।শেষ জীবনেও মানব সভ্যতার সংকট তাঁকে বিচলিত করেছে বারংবার।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কাল থেকেই সাম্রাজ্যলোভা যুদ্ধ ও তার পরিণতি দেখে অন্তরজগৎ ছেড়ে হয়েছেন বিশ্বমুখি ক্ষুধাতুর আর ভুঁড়ি-ভোজিদের সংঘাতই শেষ পর্যন্ত তিনি বললেন-''সেই বিনাশের প্রচণ্ড মহাবেগে একদিন শেষে বিপুল বীযশান্তি উঠিবে জেগে ''। আবেসিনিয়া, স্পেন,জাপান,জার্মান প্রভৃতি দেশে,দেশে হিটলার, মুসলিনী,-ফ্রাঙ্কোদের রৃপ দেখে -দ্রুত সরে গেল তাঁর নিরপেক্ষতা।উপরক্ত ঘৃণ্য পাশবিকতায় সমগ্র বিশ্ব শোষিত-বঞ্চিত-অপমানিত-আক্রান্ত মানবতার প্রতি কবির পক্ষপাত স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছিল প্রতিদিন।কবি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছেন-মুখোশের নির্লজ্জ নকল দেখে দেখে একদিন মানব মুখশ্রীকে প্রতিবাদ করতে হবে অবশ্যই।

দুটো দেশে তখন সাম্যবাদী বিনাশের তৃন মাথা তুলতে শুরু করেছে , আমাদের দেশের ভেতরে দেখা দিয়েছে-গান্ধীজীর অহিংস আন্দোলনে ভাটার টান।অন্য-দিকে তখন শোনা যাচ্ছে সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের জোয়ারের শব্দ।অহিংসা আর অক্ষম ক্ষমা যখন ভীরুতা আর হীন-দুর্বলতার নামান্তর হয়ে উঠে তখন আপোসহীন কঠিন-কঠোর হয়ে ওঠার মন্ত্রই দিয়েছেন আমাদের কানে।সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজের জালিওয়ানওয়ালাবাগের নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ড, হিজলী কারাবাসে বন্দী হত্যার ঘটনায় কবি আতঙ্কিত হয়েছেন।মসি ছেড়ে অসি ধরেননি ঠিকই-কিন্তু কলকাতার মনুমেন্টর সভাতে জ্বালাময়ী ভাষন দিয়েছিলেন এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে, জনমত গঠনের চেষ্টা করেছিলেন।তিনি চেয়েছিলেন মানুষ জাগুক,প্রতিবাদ করুক,।তিনি ইংরেজদের দেওয়া খেতাব নাইট উপাধি ত্যাগ করেছিলেন।দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দাপট, ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাস,হিংসার তান্ডবে কবিকে করেছে ক্ষতবিক্ষত।তবুও কবির বিশ্বাস। ''মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ, সেই বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করবো-মনুষ্যেত্বর অন্তহীন, প্রতিকারহীন স্বভাবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপরাধ মনে করি ''।ক্ষুদ্র মানবগোষ্ঠীর পেশীর অহঙ্কার হল নিত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী।চিরকালীন হল বৃহত্তর সমাজ, সংস্কৃতি, মানব ধারায় যুগেযুগে সু-প্রতিষ্ঠিত সংগ্রাম।নবজাগরণের শিক্ষায় ব্যাক্তিসতন্ত্রবাদ পরিস্থিতি সচেতনতা গরিষ্ঠ মানব সমাজের-মত ও বিশ্বাসের সঙ্গে কবি ব্যক্তিত্বের সংবেদনশীলতার অপূর্ব মিলন ঘটেছে কবির জীবন ও কর্মশীলতায়।মানুষের অন্তরের অন্তস্তলে একদিকে ''পরমমানব'' আর একদিকে লাভক্ষতির অঙ্ক করা নিয়ে সীমাবদ্ধ জীবমানব।এই দু'য়ের সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টায় পরিবেশ পরিস্থিতি অনুসারে হয় অভিব্যক্ত।তা না হলে জগৎসংসারে শুধু থাকবে সুবিধা-অসুবিধা, প্রিয় অপ্রিয় ইত্যাদি।সামাজিক ন্যায়-অন্যায়, কল্যাণ-অকল্যাণ নিয়ে ভাবতোনা মানুষ, করতো না কিছু মানুষ মানুষের জন্যে ।রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন মনুষ্যেত্বের চরম বিকাশ হোক। রক্তদান তো মানুষকে নিয়ে, মানুষের জন্যে।

বিসর্জন নাটকে আমরা দেখি - নিজের আত্মহননের মধ্য দিয়ে গুরু রঘুপতির নির্দেশে এনে দিয়েছেন রাজ রক্ত।শিষ্য জয়সিংহ-র রক্ত দেখে রঘুপতির সন্তান স্নেহ হয়েছে বলবৎ-কালি প্রতিমাকে দিয়েছে বিসর্জন।কেননা দেবী নয়-অনেক বড় মানুষ জয়সিংহ।''রক্ত করবী'' নাটকে দেখা যায় যক্ষরাজের তাল তাল সোনা সঞ্চয়ের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের বিদ্রোহ ও বিষুর আহ্বানে-''আয়রে ভাই লড়াই এলো"। সমস্ত শ্রমিক রাজার এঁটো নাম হয়েছে খ্যাত।তাদের ব্যক্তি পরিচয় মুছে হয়েছে ''69-র ঙ, কেউ 47-র খ'এইরকম  আর কি।এতটুকুও বিদ্রোহ হলেই তাঁরা মিলিয়ে যায় বুদবুদের মতো।যেমন গাছে কিশোর রঞ্জন আর কত শ্রমিক। ''কালের যাত্রা '' নাটকে দেখি -গ্রামে- রথের মেলা।পুরোহিত মন্ত্র পরে টানলেন রথের দড়ি- চললনা রথ।মন্ত্রী, সেনাপতি, ধনিক,বণিক, টানলো রথ, তবুও চললনা রথ।

রাজ নির্দেশে নাবিক ঘোষনা করলেন রথ চলছে না।সে সংবাদ পৌছালো শুদ্র পাড়ায়।এতদিন ছিলনা তাদের রথের রসি ছোঁয়ার অধিকার কারন তথাকথিত সমাজ বিধিতে তাঁরা অস্পৃশ্য,অশুচি, মন্ত্রহীন ব্রাত্য।নাটকের শেষ দৃশ্যে-মন্ত্রহীন ব্রাত্য-অস্পৃশ্যদের টানেই চলছে রথ এবং সেই রথ ধনিক বণিকদের প্রাসাদ, ধনভান্ডার ভাঙতে চলেছে -এই রথ রাষ্ট্র যন্ত্রের প্রতীক।বিবেকানন্দের মত রবীন্দ্রনাতো বুঝেছিলেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা একদিন শুদ্রের হাতেই যাবে।রবীন্দ্রনাথের মতে খেটে খাওয়া মানুষের হাতে যাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা -বলতে চেয়েছেন একদিন শ্রেণীহীন সম্প্রদায়হীন, ধনবৈষম্যহীন সমাজ গড়ে উঠবে ।তবে আমার মতে এই সময়ের মত করে , এই সময়ের আধুনিকতায়, বাস্তব পরিস্থিতি বিচার ও তার হিসাব নিকাশের মধ্যে দিয়ে, কোন একশ বছর আগের থিয়োরিতে নয় তবে তার মধ্যের নিশ্চিত ভাবেই কিছু ভালো বিষয় আছে, সেগুলির সংযোজনের মধ্যে দিয়ে শ্রেষ্ঠেত্বর সমস্ত উপাদানই হতে পারে আমাদের আগামী চলার পথের পাথেয় যার মধ্যে দিয়েই গুরুদেব ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন স্বপ্ন দেখেছিলেন ঐই রূপ সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার।

জীবন যত এগিয়েছে- ততই রবীন্দ্রনাথ পরিণত হয়েছেন-পরিবর্তিত হতে হতে। জানিনা দাজ ক্যাপিটাল রবীন্দ্রনাথ পড়েছিলেন না পড়েন নি।
হয়ত পড়েছিলেন, হয়ত পড়েননি তবে শেষ জীবনে সাম্যবাদে বিশ্বাসী হয়েছিলেন। রাশিয়া থেকে ফিরে -রাশিয়ার চিঠিতে তাই লিখেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ প্রতিভা প্রবহমান নদীর মত বাঁকে - বাঁক ন্যায়। পলি পড়ে সেই পলিতে নতুন ফসল  জন্মে............




Previous Post Next Post