ঝিলিমিলি





“আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি 
চিরদিন তোমার আকাশ , তোমার বাতাস আমার প্রাণে 
ও মা আমার প্রাণে বাজায় বাঁশী।”

... একী সহজ কোন কথা! কিন্তু এ আবার অনেক সহজ কথা প্রাণে প্রাণে মিলে থাকার।  তুমি সবার মনের কথাখানিরে এক সূত্রে গেঁথে দিয়েছ আমাদের চিরন্তন মনের ভাব চিত্তকে রঞ্জিত করে, দ্রব করে আমাদের হৃদয়বৃত্তিকে জাগ্রত করে। আমাদের ভাব সম্পদের কোন অভাব নাই, তাই এত সুরের আলিঙ্গন, আকাশে সৌন্দর্যের ডানা মেলে বিস্তার করে আছে। ভাষা যেখানে মূক সেখানে গানে গানে তার প্রকাশ ঘটেছে সুরের কাকলীতে ।

তোমার প্রেমের সীমা নাই, তুমি ধূলার আসন থেকেও প্রেমের রাখী পরে থাক। ফুলগুলোর দলে মিশে থাকো যখন পূজার আয়োজন নিয়ে মানুষ ব্যতিব্যস্ত। ভক্তদের হৃদয়সুরা পান করার প্রতি আগ্রহ বেশী, তুমি চাও না সাধু বেশে মঞ্চে বসে মালা পরতে বরং যে হাত মালা গাঁথে তাকে জড়িয়ে ধরে তার জয়ধ্বনি করেছ। তোমার দর্শন, নীতিবোধ বা প্রজ্ঞা, সৌজন্যের সাধনায় এমনি এক সৌন্দর্যের বীণায় বেধে দিয়েছ যে বাঙালি মানুষের জন্য, অনেক ঋণ তোমার প্রতি। আবার দেখ সেই ঋণ পরিশোধ করার পথখানিকেও সহজ করে রেখেছ আর সেখানেই তুমি হচ্ছো ঋদ্ধ। তোমার আদর্শের পথে, তোমার যত সৃজনশীল কলাকৌশল তা অনন্তের সাথে বাস্তবের এক মেলবন্ধনের ইঙ্গিত রেখে গেছ । বলেছ যত কল্যাণকর পথ সেখান থেকে ফসল তুলতে । আর গোলাভরা ফসল যখন দুখী মানুষের নাগালের হবে তোমার প্রতি ঋণের বোঝা ততই কমে আসবে তাতে। 

রবি ঠাকুর, আমরা আজ বড়ই দুর্দিনদেরকে নিয়ে আছি। তোমার সোনার বাংলা আজ নাজেহাল হচ্ছে দুর্বৃত্তদের হাতে। পায়েস আর পিঠা পার্বণের দেশ নেই আজ। স্বাদের ইলিশ সেও আজ বড় দূর্মূল্যের। এক শ্রেণীর কালো হাতে অনেক দাপট, ওদের করায়ত্তে সবকিছু চলে গেছে। সাধারণ সরল শিশু মানুষ আজ কলের পুতুল।

বৈশাখ আসে শাঁখ বাজিয়েই, ঋতু বৈচিত্রের পরম্পরা ঘটে আগের মতই। কিন্তু জানো থমথমে আকাশ, ধূলাগুলো মনের মতন করে হাসে না, ঘাসে বিছিয়ে প্রেমের শিশিরকণা আদরে জড়ায় না। সবাই জড়োসড়ো বড় –কোথাও উচ্ছাস নাই প্রাণ খুলে কথা বলবার, হৃদয় তাই গাইতে চায় না। মনে হয় তোমার এই সোনার বাংলা দুর্বৃত্ত রোগে শয্যাশায়ী। তাকে দেখবার কেউ নাই , সেবা করার কেউ নাই।  

রবীন্দ্রনাথ, তুমি কি কান্না শুনতে পাও? জানো আজকের যুগে সৌহার্দ্য নাই , সম্প্রীতি নাই এমন কি বিশুদ্ধ প্রেমও নাই। আছে যা, তা নগদ কারবারের। এখানে প্রেমের ব্যবসা বসে দু’পয়সা বা নামকে কামিয়ে নেবার জন্যে। আমার ভীষণ লজ্জা হচ্ছে, অপরাধবোধ জাগছে তোমাকে কথাগুলোকে খোলাখুলি বলে ফেলার জন্যে। বড় নিরুপায় হয়ে বলা, জানো তো বিশ্বস্ত বন্ধু নাই।

আছে এক দল। চাপাতির দল। তাদের ভয়ে অনেক কথাই চেপে রাখতে হয়। বড়ই কষ্ট এই চাপাচাপির জায়গাখানিতে দম বন্ধ হয়ে আসছে। বিশাল প্রাচীর উঠে যাচ্ছে নিরীহদেরকে ঠেকিয়ে রাখার জন্যে। তোমার পুঁথিপত্র যাদু ঘরে রেখে দেওয়া আছে, ওগুলো রাজনৈতিক ব্যবহারে রাখা হয় বড় বড় আমলাদের দ্বারা । রবি ঠাকুরের জয়ধ্বনির ঘন্টা বাজায় তাদের স্বার্থ রক্ষার কারণেই – তুমি ঠিকই বুঝে নিয়েছ আসল রবিকে তারা কি করে মৃত ঘোষণা করে রেখেছে। তবু কানকথা তো থেকেই যায়, আমরা সাধারণ মানুষ বুকের ভেতরেই রবিকে পালন করে থাকি। তোমার মন্ত্রবলে আমরা রক্ষিত আছি তবে পুরোপুরি দীক্ষিত হতে পারিনি বলে সর্বোস্তরে এই দীনতা আমাদের। দেশ সেতো আমাদেরই মা, তার কষ্ট যেন আমরা আর সহ্য করতে পারছি না।

আজও যখন সোনার বাংলা গানটা গাইতে যাই, চোখ ছাপিয়ে জল আসে। অনেক দরদ আর মমতা দিয়ে গানটা গাইতে গিয়ে, সোনার বাংলার অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ হয়ে মিলেমিশে  একাকার হয়ে যাই।


Previous Post Next Post