ইফতেখারুল হক




বৈশাখ আসলেই মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার কথা । তখন মনে মনে কবিতাটির কয়েকটি পঙ্ক্তি পড়ি আমি । অবশ্য শুধু যে বৈশাখ আসলেই মনে পড়ে তা নয় । মনে পড়ে যেকোনো সময়েই । কবিতাটির আবহই এমন যে সেটি পড়তে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়না বৈশাখ পর্যন্ত । কবিতাটির কয়েকটি লাইন পড়তে ইচ্ছে করছে এখন । ‘‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে/ পার হয়ে যায় গোরু,পার হয় গাড়ি/ দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি’’।‘আমাদের ছোট নদী’ । এক অসামান্য আবেগ, অনুভূতি জাগে মনে পুরো কবিতাটি পরে ওঠার পর ! দৃশ্যের পর দৃশ্যে ভেসে ওঠে চোখের সামনে ! আজো যখন ভাবতে বসি, কল্পনা করি চোখ বন্ধ ক’রে শহুরে কৃত্রিম এই জীবনে যাপনের মাঝেও, যুগ পরিবর্তনের হাওয়ায় উদ্ভ্রান্ত বিভ্রান্ত হয়েও; তখন দেখতে পাই সেইসব সোনালী দিনগুলো যা আজ কেবলই অতীত ! কিন্তু তার সৌন্দর্য আজো চোখে লেগে আছে । চোখ বন্ধ করে যখন চ’লে যাই আমাদের ছোট নদীর কাছে আর পা রাখি হাঁটু জলে; ধরি মাছ, দেখি বৃষ্টি কোলাহল, তখন অপার সুন্দর এসে কল্পলোকে ঢুকে যায়, মনোজগতে প্রবেশ করে আশ্চর্য হিমেল হাওয়া ! ফলশ্রুতিতে যে সুখের ভিতর আচ্ছন্ন হই তা অন্য যেকোনো সুখের চেয়ে অতি গভীর, ব্যঞ্জনাময় । এবং দেখতে পাইনা অতো সৌন্দর্য আর কোথাও !

পুরো বাঙলায় সুখে আচ্ছন্ন হবার মতো অনুষঙ্গের অভাব নেই, । তেমনই এক সুখের মাস বৈশাখ । যদিও তার রয়েছে বহুরূপ ! বৈশাখ এক রুদ্র মায়ার নাম । বৈশাখ রোদে পুড়া এক ছায়ার নাম । নাম তার জলের ঢেউ, নাম তার কাঙ্খিত হাহাকার ! এই যে বৈশাখের মিশ্র রূপ, তাকে তবুও বলি প্রসন্নতা । আদর করি প্রেমিকা রূপেই ! বাঙলা বছরের শুরুর এই মাসটি আমাদেরকে উপহার দেয় দুটি জিনিস । বৈশাখী উৎসব এবং রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী । একের সাথে অপরের রয়েছে প্রাণের যোগাযোগ । এই বৈশাখের যত তাপ এবং দমকা হাওয়া, তাণ্ডব তার সবকটি গায়ে ও মনে মেখেই আমাদের চলাচল । সবকটি পথের সাথেই আমাদের মিলন, সংঘর্ষ ও সন্ধি স্থাপন । উপেক্ষা করার তো কোন পথ নেই, উপায়ও নেই । আসলে উপেক্ষা এখানে নিষ্প্রয়োজন ।

বৈশাখের যে আমেজ যে আবহ যে সুর তার সাথে বাঙালির রয়েছে এক আত্মিক সম্পর্ক । তাকে কেন্দ্র করে যে সাংস্কৃতিক আয়োজন উৎসবের প্রস্তুতি, তা আমাদের কে মনে করিয়ে দেয় আমরা আজো বাঙালি আছি । কিন্তু আজকাল হওয়া কাজটাকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা করছে একটা শ্রেণী ! আমাদের সাংস্কৃতিক যোগাযোগটাকে ভেঙে দেবার চেষ্টায় লিপ্ত তারা । প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে ওদের বসবাস । তবে আশা কথা বেশির ভাগ মানুষ নেই এই দলে । উৎসবকে উপেক্ষা করার ইচ্ছা আর চেষ্টার ফল মূল স্রোতের বিপরীতে ধাবিত হওয়া । বাঙালিসত্ত্বা কে অস্বীকার করা । আজকাল বৈশাখ আসলেই শুনতে পাই কিছু কথা । বৈশাখ আসলেই তার উৎসবকে সামনে রেখে এক শ্রেণীর মানুষ সমাজে ছড়িয়ে দিচ্ছে মিথ্যা ভাষণ ! ভাষণটি নতুন একেবারেই, যা এক দশক আগেও শুনতে পাইনি ঠিকঠাক । ভাষণটি কী ? আর তার সুরটি কেমন ?

ভাষণটি হলো-বৈশাখী উৎসব মুসলমানের উৎসব নয় । সুরটি হলো-ইসলামিক, তাই তাকে ইসলাম পরিপন্থী বলতেও দ্বিধা নেই ! মূলত বৈশাখ হিন্দু সম্প্রদায়ের; এই হলো মূল বক্তব্যটি। আসলেই কী তাই ? গভীর ভাবে বিষয়টি যদিও ভাবার দরকার নেই। অত্যন্ত স্থুল ভাষণ । সুরটিও তাই । এই ভাষণে কান দেবার কিছু নেই । তবে শঙ্কা আছে বৈকি । শঙ্কাটা কীসের ? সন্দেহ নেই যে বিচ্যুতির । মাইকে বারবার একই ভাষণ দেয়া হলে তা মিথ্যা হলেও প্রভাবিত করবে মানুষকে। ফলশ্রুতিতে সভায় আগমন ঘটবে সাধারণ থেকে অতি সাধারণ মানুষের, যারা সাধারণত না বুঝেই প্রভাবিত হয় ! কিন্তু এই ভাষণের মধ্যে, এই সুরের মধ্যে রয়েছে চরম হঠকারিতা । নিজের সাথে নিজেই প্রতারিত হবার জোর প্রয়াস । কিন্তু যারা বলছে এইসব কথা, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম গুলোতে তারা কী বাঙালি নয় ? নিশ্চয়ই বাঙালি। তবে প্রতিক্রিয়াশীল মুসলমান বাঙালি । যাদের দলটি খুব ছোট নানা কারণেই । তাদের দল ভারির অপচেষ্টা কেমন ক’রে নস্যাৎ হয়ে যায়, দেখা যায় কিংবা বোঝা যায় উৎসব শুরু হলেই ।

এই যে সংস্কৃত বিরুদ্ধতা ধর্মের নামে; তা খুবই মারাত্মক ! ক্ষতি সংস্কৃতির, ধর্মেরও নয় কী ? এবং ক্ষতি মানসিকতার । একটি দেশের সংস্কৃতি তার দেশে পালিত এক কিংবা বহুমুখী ধর্মের বিরুদ্ধে নয় কোন কালেই । এবং ধর্মও নেই কোন দেশের নিজস্ব সংস্কৃতির বিরুদ্ধে । অবস্থাটা এমন যে ধর্ম নিজেই এখন একটি দেশের সংস্কৃতির অংশ । এমনকি অঙ্গ হয়েও দাঁড়িয়ে গেছে । অবস্থাটা একেবারেই নতুন ভাবে সৃষ্টি করা ! যা বয়ে নিয়ে বেড়াতে পারে দীর্ঘকাল । ভিন্নমতের এই যে দুটি শ্রেণী মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, তারা অধিকাংশই মধ্যবিত্তের । ওরা সমাজ পরিবর্তনের নামে মিছিল করে, নানা আন্দোলনের সাথে জড়ায় যখনতখন । প্রয়োজনে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে । ধর্মের নামে অরাজকতা সৃষ্টি করে । কিন্তু মাঝে মাঝেই তারা দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ে না বুঝে ওঠার কারণেই । তাঁদের পেছনে আছে আরো একটা শ্রেণী আর তারা হলো শাসক । শাসকের কাজ শোষণ করা, শ্রেণীতে শ্রেণীতে বিভেদ সৃষ্টি করা । এবং ঝোপ বুঝে কোপ মারা । তারা ধনী সঙ্গত কারণেই । টাকার জোরেই তারা পেরিয়ে যায় প্রশান্ত মহাসাগর ! আর সাধারণ থেকে অতি সাধারণ, মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণীটা সেই সাগরের জলে নাকানি-চুবানি খায় । আসলে ওরাই খাওয়ায় । অধিকাংশ বোঝাটাই তাঁদের নিজেদের মতো ক’রে নয় । তাই তাঁরা সংগঠিত নয়, সংবেদনশীলও নয় ।

ইংরেজিতে যে কথাটি আছে ‘প্রোপাগান্ডা’ মানে রটনায় বিশ্বাসী ! বৈশাখী উৎসব নিয়েও তাই । যা হচ্ছে এখন, যা হয়েছে পূর্বে তার সবকটাই মানুষ সৃষ্ট । মন আমাদের এতই ছোট আর এতই সংকীর্ণ যে ভাবতে পারিনা বড়ো করে, খুলতে পারিনা মনের দরজা পুরোপুরি ভাবে । দৃষ্টিভঙ্গির জটিলতার কারণে আমরা দেখতে পাইনা সাংস্কৃতিক সৌন্দর্যের কাঠামো গুলো । গুলিয়ে ফেলি উৎসব আর ধর্মকে এবং বাতিল বলে ঘোষণা করি একসময় । ভাবতে অবাক লাগে আজো আমরা কতটা অন্ধকারে বসবাস করছি ! দেখতে পারিনা দিনের আলোতেও !

সহনশীল আর প্রগতিশীল মানুষের বড়োই অভাব সমাজ রাষ্ট্র জুড়ে । আরো রয়েছে অভাব হৃদয়ে যা সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তন হচ্ছে । অস্বাভাবিক ভাবেই, খুব দ্রুত গতিতে । মানুষ থেকে মানুষে ভুলতে বসেছে সাংস্কৃতিক সৌন্দর্যের নির্ধারিত ও সঠিক পথটি । ভুলে গিয়ে যাচ্ছে যে পথে, সে পথে আলো আছে ঠিকই তবে আবেদন নেই । নেই সৌন্দর্য, নেই শৈল্পিকতা এবং তার গুনাগুণ । তবে সে পথে মাঝে মাঝেই দেখা দেয় অন্ধকার, যার ছায়া মনে প’ড়ে তাকে কলুষিত করে । এই যে পরিবর্তন মানসিকতার বা হওয়ার চেষ্টা করা তা থেকে মানুষের নীতি বোধে দেখা নানাবিধ ক্রিয়া ! এই ক্রিয়ার ফলাফল সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে । পরিবারে, সমাজে এমন কী রাষ্ট্রে ! ব্যাপারটি হলো এই-মূল ধারার স্রোতে আমরা কেউ নেই । আমরা রয়েছি স্রোতের বিপরীতে । জিম্মি করে ফেলা নিজেকে যেমন ,তেমনি অন্যকেও । প্রভাবিতও করা । এই যে পরিবর্তন, এই যে সাংস্কৃতিক একটা সংকট তার উত্তরণের পথ কিন্তু খুঁজে বের করতে হবে আমাদেরই । অথচ এক বৈশাখ মাসের সৌন্দর্যের উপর নির্ভরশীল নয় আমাদের সংস্কৃতি । বাঙলা সংস্কৃতি তার নিজেরই রয়েছে বহুমাত্রিক রূপ ।

উত্তরণের পথে ভূমিকাটি কার ? আর কে-ই বা সম্পন্ন করবে কাজটি ? বিশেষ ভাবে বললে মধ্যবিত্ত শ্রেণীরই কাজ এটা, ভূমিকাটিও গুরুত্বপূর্ণ । আজ যদি তাকাই নগর উৎসবের দিকে যা বেশ কয়েক দশক আগেও দেখতে পাইনি বিশেষ করে এই ঢাকা শহরে । তাহলে দেখি এই দিনে মানুষের ঢল নামে । নানা রঙে নানা বর্ণে শোভিত হয় রাজপথ । উদ্যানে দেখা মেলে নাগরদোলা, বায়স্কোপ নানাবিধ কর্মকাণ্ড । যা ছিল একসময় গ্রামের তা এখন শহরের । মানুষের ভিড়ে, মানুষের সমাগমে এই গ্রামীণ আবহ যদিও তার সৌন্দর্য কে পরিপূর্ণতা দেয়না তথাপি এই যে চেষ্টা বাঙালি থেকে আরো বাঙালি হবার তা বোধকরি সুখকরই আমাদের জন্য । এতসব হচ্ছে যে আজকাল শহরে তা কিন্তু ওই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্যেই । তাঁদের কাছে সাধারণ জীবনযাপনের যে ভাষা তা তারা খুঁজে পায় দেশীয় উৎসব গুলোয় । আর বৈশাখী উৎসব সেই ধারাবাহিকতারই ফল । খুব মিষ্টি এবং খুব মধুর । নিজে বিভ্রান্ত হয়ে অন্যকে বিভ্রান্তিতে ফেলতে যাওয়ার এইসব অপচেষ্টা রোধ করবে কারা ? এই উত্তর পেতে আমাদের বেশিদিন হয়ত অপেক্ষা করতে হবে না কারণ বাঙলা এবং বাঙালির রয়েছে নানা বর্ণের সংস্কৃতি । যা অস্বীকার করার মতো দুঃসাহস কোন প্রগতিশীল মানুষের তো নয়-ই এমনকি নেই কোন প্রতিক্রিয়াশীল মানুষেরও । আর যদি করেও তাহলে সে দণ্ডিত হবে সাংস্কৃতিক আইন দ্বারা-ই ।

বাঙালির উৎসবের শেষ নেই । নিজেকে বাঙালি করে রাখার জন্য, বাঙালি হওয়ার জন্য, বাঙলা এবং বাঙালি চেতনা ধারণ করবার জন্য আমাদের অবশ্যই থাকতে হবে সংস্কৃতির পাশাপাশি; এবং তাকে উদ্ধার করতে হবে যেকোনো বিপদ থেকে । হাতে হাত মিলিয়ে । যেমন হাত মিলিয়েছিলাম আমরা একাত্তরের রণাঙ্গনে । তখনও কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য ছিল এক ও অভিন্ন । ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার যৌথ প্রয়াস । যেখানে হিন্দু, মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষেরা অস্তিত্ব রক্ষার ( যা আদতে নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা ) প্রশ্নে কুরুক্ষেত্রে রক্তবিনিময় খেলায় মেতে ওঠেছিল ! ধর্ম ছিল যেখানে গৌণ । এ কথাটিও সত্যি যে, কেবল মাত্র বৈশাখ মাসে তার উৎসব পালনের ভেতর দিয়ে এবং রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকী পালনে লাল-শাদা কিংবা শাদা-কালো শাড়ি আর রঙবেরঙের পাঞ্জাবী প’ড়ে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে অথবা বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায়; আমতলায় কিংবা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে কিছু কবিতা আবৃত্তি আর সংগীত পরিবেশন করলেই বাঙালি সংস্কৃতি রক্ষা হয়না । যায়না বাঙালি হওয়া-ও । তার জন্য দরকার মনে ও প্রাণে সকল সময় বাঙালি সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে লালন করা, বহুবিধ সংস্কৃতির বাতাস গায়ে আঁচর কাটলেও । মোটকথা বৈঠা হাতে নৌকাটি বাইতে হবে মনঃসংযোগের সাথে, আপন মনে সঠিক পথে । অন্য পথে বাইতে গেলে আর মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটলেই সমূহ বিপদ । 


Previous Post Next Post