ছুটির সময় হয়ে গেছে সবাই বের হবার তোড়জোড় করছে। রিমির কোন ব্যস্ততা থাকেনা কোনদিন, কিন্তু আজ আছে। মা কয়েকবার ফোন করেছেন ছুটির পর যেন ঠিক বাসায় ফেরে জরুরী কথা আছে । ও অপেক্ষা করছিল সুমির জন্য ওরা দুজন একসাথেই রোজ বের হয় । সুমন এসে বলল কি হল ম্যাডাম বের হবেন না ? আজ তো উইকএন্ড চলুন আজ সন্ধ্যেটায় আড্ডা দিই শাহিন ভাইদের সাথে । রিমি মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল যেতে পারবে না এর বেশি উত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করলো না সে । এই এক যন্ত্রনা এরা জানে রিমি এসব পছন্দ করে না তবুও ওদের কথা বলতেই হবে আর এই সুমন রিমির থেকে বয়সে অন্তত তিন বছরের ছোট রিমি ওর বস তবুও ভাবটা এমন যে ওর গার্জিয়ান ...আসলে বিয়ে হয়নি বলে অনেকেই ওকে বেওয়ারিশ ভাবে , তাই তো যখন তখন জালাতন করে । অপমানে চোখ জ্বালা করে ওঠে। রোদ প্রায় মরে এসেছে ... বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হতে চলল,অজান্তেই রিমির চোখ চলে যায় ওপরের বারান্দায় ।
রাস্তা ঘেঁসে বাড়িটার বারান্দায় অল্প বয়সী বউটা ছোট বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হয়ত দেখছে এই রাস্তা দিয়েই তার স্বামী ঘরে ফিরবে খুব আনমনা হয়ে যায় রিনি ..ওর টেবিল থেকে ঐ বাসার ভেতরের অনেকটা দেখা যায়। রিমি প্রায়ই দেখে ঐ ছোট্ট সংসারের ঘর কন্না বরটা একটু রাগি ধরনের ছোট খাটো ভুল হলেও খুব রেগে যায় আবার প্রচণ্ড ভালোও বাসে বউটাকে । একদিন বাচ্চাটা পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছিল বলে বউটাকে মারতে গিয়েছিল । সেদিন রিমির খুব রাগ হয়েছিল মনে মনে ভাবছিল আমার সাথে এমন হলে আমি ঠিক রাগ করে বেড়িয়ে আসতাম, পরক্ষনেই মনে পড়ে বিধাতা ওর কপালে সংসার সুখ রাখেন নি । ওর বিয়ে ঠিক হয়েও ভেঙ্গে গেছে সেই থেকে ও একা ।
নাহ আর অপেক্ষা করার মানে নেই ... ফাইল পত্র গুছিয়ে ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে উঠে দাঁড়ানো মাত্রই এসে হাজির সুমি ...বলল দেখ বের হওয়ার মুখে বস কাজ ধরিয়ে দিলেন খুব জরুরি ফাইল কাজ শেষ করে তবে এলাম । রিমি কপট রাগ দেখিয়ে বলল থাক অত কৈফিয়ত দিতে হবে না চল চল এমনিতেই অনেক দেরী হয়ে গেছে ...
সুমি বলল তো ? তাতে তোর সমস্যাটা কি ? বাসায় তো এমন কোন রাজকার্য পড়ে নেই তোর জন্য । তুই একা মানুষ তোর কাজই বা কতটুকু তারপর তো সেই টিভি দেখা আর একা একা বোর হওয়া। আর দেখ আমাকে বাসায় গিয়েই রাজ্যের কাজ করতে হবে। ছেলেমেয়েদের নাস্তা তৈরি, রান্না করা ওদের সাথে গল্প করা আরও কত কাজ !!! জানিশ সারাদিন পর বাসায় ফিরে ওদের মুখ দেখলেই না আমি সব ক্লান্তি ভুলে যাই ।
সুর্যের আলো নিভে গিয়ে নিমেষেই যেভাবে অন্ধকার নেমে আসে রিমির মুখটাও মুহুর্তেই মলিন হয়ে যায়। ও জানে সুমি ওকে আঘাত করার জন্যে কথাগুলো বলেনি তবুও তো আঘাত লেগেছে মনে । এভাবে প্রায় প্রতিদিন তাকে কতজন নিজের অজান্তেই আঘাত করে যায় ওকে ... সত্যিই তো ওর বয়সি প্রায় সব মেয়েই এখন কারো বউ কারো মা, অথচ ওর সংসার করা হল না। লোকে ছেড়ে কথা বলবে কেন ? আইবুড়ো মেয়ের গতিবিধি, রিতিচরিত্র নিয়ে কথা বলা এ বড় মুখরোচক একটা টপিকস ।
রিমি বলে, সত্যি রে তোর অনেক কাজ আর এই কাজে কত আনন্দ নারে! সুমি বুঝতে পারে অনিচ্ছায় হলেও সে রিমির দুর্বল জায়গায় আঘাত করেছে তাই মর্মে মরে যেতে যেতে বলে তুই মন খারাপ করেছিস আমার কথায় ? দেখ আমি তোকে দুঃখ দিতে চাইনিরে কথায় কথায় এত কথা বলে ফেলেছি । রিমি বলল জানি রে আমি কিছু মনে করিনি তুই তো আমাকে কিছু বলিসনি তুই তোর নিজের কথা বলেছিস।
কথা বলতে বলতে দুজনে রাস্তায় নামে। সুমি রিক্সা নিয়ে বলে আয় , নাহ তুই যা আমার কিছু কেনা- কাটা আছে আমি শপিং করে ফিরব । আদতে ওর শপিং করারও কিছু নেই এ শুধু সুমির থেকে ছাড়া পেতে বলা তাছাড়া আজ তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে , এ কথাটা না বললে হয়ত সুমি এখন ওকে সুমির বাসায় নিয়ে যেতে জোর করত । সুমির বাসায় যেতে আগে কখন ওর আপত্তি হত না বরং ভালই লাগতো ওর বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাতে কিন্তু ইদানিং আর ইচ্ছে হয় না , এই তো গত কয়েকমাস আগে একদিন সুমির মেয়ের জন্মদিনে রিমি সারাদিন ছিল ওদের বাসায়। হাতে হাতে রান্নার কাজে ঘর সাজানোর কাজ করছিল , বিকেলের দিকে সাজগোজ করে পার্টিতে গেল তখন সুমির হাসবেণ্ড কি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। শুধু তাই নয়, খুব কাছে এসে বলেছিল এইচল্লিশ ছুঁই ছুঁই বয়সেও তুমি কত সুন্দর আছ ? নিজের এই ফিগার ঠিক ধরে রেখেছ অথচ আমার বউকে দেখ কি রকম মুটিয়ে গেছে। নিজের একটুও যত্ন নেয় না ,রিমি শুধু বলেছিল ছিঃ কি সব বলছেন আপনি ? লোকটা তবুও থামেনি বলেছিল একাই তো আছো বিয়ে করনি, ইচ্ছে করেনা বিবাহিত জীবনের স্বাদ নিতে?
রিমি ঘেন্নায় সরে গিয়েছিল অন্যদিকে । এরপরও লোকটা বেশ জালিয়ে ছিল ফোন করে, এস এম এস করে । কিন্তু এসব কথা রিমি সুমিকে বলতে পারেনি নিজেদের বন্ধুত্ব নষ্ট তো হতই তার চেয়ে বড় কথা স্বামী- স্ত্রীর সম্পর্কে চির ধরত, এটা কিছুতেই হতে দেয়া যায় না । রিমির খুব কষ্ট হয়েছিল এই ভেবে যে লোকটা সুমির বিশ্বাস নিয়ে খেলা করে অথচ সুমি বুঝতেও পারেনা কিছু । সেই থেকে রিমি ও বাড়ি যাবার কথা উঠলেই কাটিয়ে দেয় । নিতান্তই অপারগ হলে এমন সময় যায় যখন লোকটা বাসায় থাকে না , দেখতে দেখতে সুমির রিক্সাটা দৃষ্টির আড়ালে চলে যায় ।রিমি হাঁটতে থাকে বাড়ির দিকে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে হয় না সেইত একঘেয়ে জীবন । মা কত চেষ্টা করে যাচ্ছে ওর বিয়ের জন্য ... এইত সেদিন মা পাশের বাসার খালাম্মার সাথে গিয়ে রিমির জন্য তাবিজ নিয়ে এসেছিলেন পীরের কাছ থেকে ,তিনি নাকি বলেছেন কেউ শত্রুতা করে ওর বিয়ে বন্ধ করে রেখেছে তাই দেখে ভাবী কটাক্ষ করছিলো ,ভাইয়া মহা বিরক্ত হয়েছিলেন আর রিমি বিব্রত হয়ে তাবিজ পড়েছিল ঠিকই মায়ের মন রক্ষা করতেই ।
রিমি যখন বাড়িতে ঢুকল তখন সন্ধ্যে উতরে গেছে সবাই চা খাচ্ছে কিছু একটা বিষয় যে নিয়ে গুরুতর আলোচনা চলছে তা সে বুঝতে পারলো । শুদ্ধ দৌড়ে এসে বলল ফুপি আজ আমার চকোলেট আননি ? রিমি আজ ভুলেই গিয়েছিল ... বলল ইসস বাবা ভুল হয়ে গেছে আজ, কাল ঠিক নিয়ে আসবো বলেই রুমে চলে যায় । ফ্রেশ হয়ে বেরুতেই মা এক কাপ চা এনে রিমিকে দিলেন সাথে দুটো পাকোড়া। রিমি মনে মনে প্রমাদ গুনলো নিশ্চয় মা আজ আবার কোন হুজুরের কাছে যেতে বলবেন অথবা কোন পাত্রের কথা বলবেন ,আর পাত্র আসবে যথারীতি মেয়ে দেখে পছন্দ হবে কিন্তু মাধ্যমিক পাশের সাল শুনে উঠে চলে যাবে, ভদ্রতা করে বলে যাবে পরে জানাব । কিন্তু না মা আজ সম্পুর্ন অন্য কথা বললেন । বললেন রিমি আজ তো তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরলি আমাদের সাথে একটু মার্কেটে যাবি ? রিমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করে হঠাৎ তুমি এই সন্ধায় বের হতে চাইছ যে ? মা একটু হেসে বলেন তেমন কিছু নয় রে কিছু কাপড় -চোপড় আর ভাল দেখে একটা উপহার কিনতে হবে পরশু বৌমার ভাইয়ের বিয়ে মনে নেই তোর ? যেতেই হবে না হলে ওরা খুব কষ্ট পাবেন । তোর কথা বার বার করে বলেছেন কিন্তু আমাকে । ইদানিং রিমি সামাজিক এইসব অনুষ্ঠানগুলো এড়িয়ে যাচ্ছিল সঙ্গত কারনেই । গেলেই দেখা যায় এত বয়সেও কেন বিয়ে হয়নি ? কি করে ? কার হাতে কতটা পাত্র আছে অবশ্য সবই দোজ বড় নয়তো বিপত্নীক আর রিমির বাবার বয়সী বুড়ো ।
মা - মেয়ে আর শিলা মানে রিমির ভাবী তৈরি হয়ে বের হয় শপিং করতে। ঠিক কতদিন আগে এভাবে তিনজন মিলে বের হয়েছিল রিমির মনে পড়ে না । মা ওর আর ভাবীর জন্য দুটো শাড়ি কিনে দেন, শুদ্ধর জন্যও কেনেন সুন্দর ফতুয়া। ভাবীও কেনে মায়ের জন্য। তারপর ওরা একটা স্বর্নের দোকানে ঢুকে উপহার কিনতে, এটা ওটা দেখতে থাকে মার কোনটাই পছন্দ হয়না । রিমিই একটা কানের দুল পছন্দ করে দেয় । পেমেন্ট করতে যখন দাঁড়িয়েছে দেখে ঠিক ওর সামনেই দাঁড়িয়ে আছে ওর বস। তিনি বের হয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ান তারপর পেমেন্ট করে বেড়িয়ে যান। রিমিরা বের হতেই বস মানে শাকিল এসে সামনে দাঁড়িয়ে বলে ... রিমি দেখত এই আংটিটা তোমার পছন্দ হয় কি না ? রিমি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে ভাবে উনি কি বলছেন এসব ? শাকিলই বলে আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই তোমার পরিবারের সাথে সব কথা হয়ে গেছে তুমি চাইলে কালই আমাদের এংগেজমেন্ট হবে । আর তুমি যদি না বল তবে সব কিছুই শেষ হয়ে যাবে । রিমি শুধু বলল আমাকে একবার জানালে কি ক্ষতি হত ? মা বললেন অনেক ক্ষতি হত তাই জানাইনি। আমি জানি তোর অমত হবে না তাই আমি কথা দিয়ে দিয়েছি সব ব্যাবস্থাও করে ফেলেছি ।তবে তুই এখনো তোর মতামত জানাতে পারিস । রিমি বলল না মা আমি তোমার কথার বাইরে কিছু বলব না ।
বাড়ির পথে ফিরতে ফিরতে রিমি ভাবে, যাক এখন থেকে ওকে আর একাকিত্তে ভুগতে হবে না। বুকের মাঝে সব কথা জমিয়ে রাখতে হবে না। তার সুখ- দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়ার সাথি এসে গেছে জীবনে ।
Tags:
গল্প