অনন্যা ব্যানার্জি



হাসি ,কান্না ,আনন্দ ,দুঃখ , বিভিন্ন স্মৃতি বিজড়িত মুহূর্ত গুলো নিয়ে দেখতে দেখতে কেমন করে পেরিয়ে যাওয়া একটা বছর । বিগত বর্ষে কিছু স্মৃতি যেমন সুখের ঠিক তেমনই কিছু স্মৃতি আছে ,  পাওয়া না পাওয়ার বেদনা , প্রিয়জনদের হারানোর বেদনায় । তবুও আমাদের এগিয়ে চলতে হয় পথে , আগামীর আহবানে প্রাণে মনে । 

চিরসত্য এই ভাবনায় নতুন বর্ষকে বরণ করে নিয়ে, গানঘরে শব্দের মিছিলের পক্ষ থেকে প্রত্যেক শুভাকাঙ্খী কে জানাই নববর্ষের আন্তরিক শুভেচ্ছা সেই সাথে শব্দের মিছিলের বর্ষ পুর্তি লগ্নে - অভিনন্দন ও ভালোবাসা। সকলের মঙ্গল কামনা করেই শুরু করছি গানঘর । 

আজ ২৫শে বৈশাখ ,অর্থাৎ বঙ্গ জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ দিন । বলা না বলার উর্ধ্বে প্রত্যেক বাঙ্গালীর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ২৫ শে বৈশাখ আমাদের প্রাণের কবির জন্মদিন । বাংলা , বাঙালী তথা সমগ্র ভারতবাসীর আত্মার কবি। তিনি শুধু কবিই নন আরও ব্যাপ্ত তাঁর পরিচিতি , ব্যাপ্ত তাঁর আত্মীয়তা । তিনি কবি নন কবি-গুরু, অন্তরাত্মার উপলব্ধিতে তিনি প্রাণের ঈশ্বর , সামগ্রিকতায় জীবন দেবতা , বাঙালী জীবন ও মননের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র ।  বাল্যকাল থেকে ব্রাহ্মধর্মের আনুকূল্যে বেড়ে ওঠা জীবনচর্যায় কবি যেমন একাধারে ছিলেন ঈশ্বর বিশ্বাসী তেমনি অপরপ্রান্তে ছিলেন অহেতুক আস্তিকতাবাদের বিরোধী। পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংস্পর্শে থাকাকালীন তিনি লাভ করেছিলেন আধ্যাত্মিক চেতনা জ্ঞান । শিলাইদহে থাকাকালীন একাকী নিভৃতে নিমগ্ন থেকেছেন ঈশ্বর সাধনায়। শব্দের আঁকড়ে তিনি বলেছেন – ‘ গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে। ভরা পালে চলে যায় কোনও দিকে নাহি চায় ঢেউ গুলি নিরুপায় ভাঙে দু-ধারে— দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে । ওগো , তুমি কোথা যাও কোন বিদেশে , যেয়ো যেথা যেতে চাও, যারে খুশী তারে দাও , শুধু তুমি নিয়ে যাও ক্ষণিক হেসে আমার সোনার ধান কূলেতে এসে । যত চাও তত লও তরণী পরে । আর আছে ? আর নাই , দিয়েছি ভরে। এতকাল নদীকূলে যাহা লয়ে ছিনু ভুলে সকলি দিলাম তুলে থরে বিথরে ---- এখন আমারে লহ করুণা করে । ঠাই নাই ঠাই নাই—ছোটো সে তরী আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি। শ্রাবণ গগন ঘিরে, ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে , শূন্য নদী তীরে রহিনু পড়ি – যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী ।

কবি তাঁর বিবাহের কিছু বৎসর পরেই পিতার নির্দেশে পারিবারিক জমিদারী দেখা শোনায় পূর্ববঙ্গের শিলাইদহে যান। দিনের পর দিন পদ্মার বুকে ভেসে বেড়ানো সময়গুলো নিয়োজিত হয় সাহিত্যে। আঁধার শেষে ঊষালগ্ন কিম্বা প্রভাত পাখীর কলতান তাঁর কলমে অপরূপ সৌন্দর্য লাভ করে। দিনের পর দিন পদ্মার বুকে ভেসে থাকা সময়গুলোয় তিনি দেখেছেন পদ্মাতীরের ছোট ছোট গ্রামগুলোর মানব জীবনের ইতিবৃত্ত । তাঁর লেখায় উঠে আসে ছোট প্রান, ছোট ব্যাথা , ছোট ছোট দুঃখ কথার দুর্দমনীয় প্রতিচ্ছবি । সৃষ্টি হয় মেঘ ও রৌদ্র , ছুটি , শাস্তি প্রভৃতি গল্প। আকাশ ভরা সূর্য তারা , বিশ্ব ভরা প্রাণের মাঝেই পূর্ণতা পান তিনি , তাঁর আরাধ্য ঈশ্বর কে খুঁজে পান মানুষের মাঝেই । তিনি উপলব্ধি করেন – যে পরশ পাথরের খোঁজে মানুষ দিশে হারা , তা যে আছে নিজেরই চার পাশে । তিনি বলেন – সম্মুখে গরজে সিন্ধু অগাধ অপার তরঙ্গে তরঙ্গ উঠি হেসে হল কুটিকুটি সৃষ্টি ছাড়া পাগলের দেখিয়া ব্যাপার । আকাশ রয়েছে চাহি নয়নে নিমেষ নাহি হু হু করে সমীরণ ছুটেছে অবাধ । সূর্য ওঠে প্রাতঃকালে পূর্ব গগনের ভালে , সন্ধ্যা বেলা ধীরে ধীরে উঠে আসে চাঁদ । জল রাশি অবিরল করিতেছে কলকল অতল রহস্য যেন চাহে বলিবারে। কাম্য ধন আছে কোথা জানে যেন সব কথা সে ভাষা যে বোঝে সেই খুঁজে নিতে পারে । কিছুতে ভ্রূক্ষেপ নাহি মহাগাথা গান গাহি সমুদ্র আপনি শুনে আপনার স্বর । কেহ যায় কেহ আসে কেহ কাঁদে কেহ হাসে খ্যাপা তীরে খুঁজে পায় পরশ পাথর ।

কবির সাহিত্যে দেখা যায় বিশ্বের সঙ্গে তাঁর সুনিবিড় একাত্মতা বোধ , পৃথিবীর প্রতি যুগ – যুগান্তরব্যাপী এক হৃদয় সম্পর্ক , মৃন্ময়ী বসুন্ধরার প্রতি এক অবোধ জন্মান্তরীণ আকর্ষণ , এক গভীর জীবনাশক্তি । তিনি নিজেই এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন, বলেছেন – বিশ্বানুভূতি । তিনি এক জায়গায় বলেছেন – “ এ যেমন এক বৃহৎ ধরণীর প্রতি একটা নাড়ীর টান – এক সময়ে যখন আমি এই পৃথিবীর সঙ্গে এক হয়ে ছিলুম , যখন আমার উপর সবুজ ঘাস উঠতো , শরতের আলো পড়তো , সূর্যকিরণে আমার সুদুর বিস্তৃত শ্যামল অঙ্গের প্রত্যেক রোমকূপ থেকে যৌবনের সুগন্ধি উত্তাপ উত্থিত হতে থাকতো , আমি কত দূর দূরান্তর , কত দেশ দেশান্তর, জল স্থল পর্বত ব্যাপ্ত করে উজ্জ্বল আকাশের নিচে নিস্তব্ধ ভাবে শুয়ে পড়ে থাক্তুম, তখন শরত সূর্যালোকে আমার বৃহৎ সর্বাঙ্গে যে একটি আনন্দরস একটি জিবনীশক্তি অত্যন্ত অব্যক্ত অর্ধচেতন এবং অত্যন্ত প্রকান্ড বৃহৎ ভাবে সঞ্চারিত হতে থাকতো , তাই যেন খানিকটা মনে পড়ে – আমার এই যে মনের ভাব এ যেন প্রতিনিয়ত অঙ্কুরিত , মুকুলিত , পুলকিত সূর্যস্নাতা আদিম পৃথিবীর ভাব । যেন আমার এই চেতনার প্রবাহ পৃথিবীর প্রত্যেক ঘাসে এবং গাছের শিকড়ে শিরায় শিরায় ধীরে ধীরে প্রবাহিত হচ্ছে , সমস্ত শস্যক্ষেত্র রোমাঞ্চিত হয়ে উঠছে এবং নারকেল গাছের প্রত্যেক পাতা জীবনের আবেগে থর থর করে কাঁপছে । “ ঈশ্বর প্রকৃতি ও প্রেম ছুঁয়ে গেছে বারবার কবিকে , তিনি প্রেমের মধ্যেই খুঁজেছেন অনন্ত কে , ঈশ্বর কে। নর – নারীর মিলন মেলায় তিনি গেঁথেছেন প্রেম গীতি হার , আবার স্থিতধী ঈশ্বর বিশ্বাসে অর্পণ করেছেন নিজেকে প্রকৃতির কাছে , ব্যাকুল হয়েছেন বারবার আত্মিক মিলনের প্রজ্ঞায় । 

জীবনের শেষ লগ্নে এসেও তিনি ঈশ্বর চেতনায় থেকেছেন অবিকল মানব প্রেমের মূর্ত প্রতীক । নিজের তৎকালীন সমাজ জীবন কে ছাড়িয়ে বিস্তৃত হয়েছেন অধুনা সমাজে। তাই তিনি আমাদের ধ্যানে , জ্ঞানে , কর্মে প্রতিটি চেতনায়। মৃত্যুহীন এই মহৎ প্রাণকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি অনন্যা পর্য্যায়ক্রমে শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মোহন সিং ,তন্ময় মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস ,শ্রীরাধা বন্দোপাধ্যায়, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় , পূরবী মুখোপাধ্যায়, ইন্দ্রাণী সেন, শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং স্বাগতালক্ষী দাশগুপ্তের কন্ঠে গানগুলি সাজিয়ে নিবেদন করলাম এবারের গানঘর -

নব আনন্দে জাগো ...

হে নুতন দেখা দেখা দিক ...


গানে গানে তব বন্ধন ...


অরূপ তোমার বানী ...


দাড়িয়ে আছো তুমি আমার ...


আমি হেথায় থাকি শুধু গাইতে তোমার গান ...


এবার আমায় ডাকলে দূরে


শুধু তোমার বানী নয়গো হে বন্ধু হে প্রিয় ...


আমার হিয়ার মাঝে ...


আমার অভিমানের বদলে আজ ...


আমার সকল রসের ধারা



Previous Post Next Post