পিয়ালী গাঙ্গুলি



অ্যাকোয়া গার্ড থেকে জল ভরতে ভরতে রীতি রান্নাঘর থেকে চেঁচাল “এই তোমার জলের বোতলটা দিয়ে যাও, ভরে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখি”। অফিস থেকে ফিরে গা ধুয়ে সবে আরাম করে পত্রিকাটা নিয়ে বসেছিল অমূল্য। ধড়মড় করে উঠে অফিসের ব্যাগ থেকে বোতল বার করতে গেল। ব্যাগের চেনটা খুলতেই মুখটা শুকিয়ে গেল। যাহ্‌, বোতলটা তো অফিসেই ফেলে এসেছে। আবার কপালে বকুনি। ছাতা আর জলের বোতল এই দুই হল অমূল্যর চিরশত্রু। সবসময়েই যেন তাকে বিপাকে ফেলার জন্য প্রস্তুত। কাচুমাচু মুখ করে রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে বলল “বেরোনর সময় এমন একটা কাজ এসে গেল না, তাড়াহুড়োয় বোতলটা ঢোকাতে ভুলে গেছি”। রীতি কিছু বলল না, শুধু কটমট করে তাকাল। ওই বাঘিনীর মত চাহুনই যথেষ্ট। অমূল্য গুটিগুটি পায়ে ঘরে ফিরে এসে আবার পত্রিকায় মন দিল। নিজের ওপর রাগ ধরল। সত্যি, কেন যে এত ভুলে যায়? 

বাজারের ফর্দ হাতে ধরিয়ে না দিলে অর্ধেক জিনিষ আনতে ভুলে যায়। এতদিন ইলেক্ট্রিসিটি বিল, ফোন বিল এসবও সময়ে জমা দিতে ভুলে যেত। আজকাল ‘ই সি এস’ এর সুবিধা হওয়াতে সে সমস্যা মিটেছে। জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী এসব মনে রাখা তো সাংঘাতিক কঠিন কাজ। মেয়ে শিখিয়ে দিয়েছে মোবাইলে রিমাইন্ডার সেট করতে, তাই আজকাল অমুল্যকে আর আগের মত অপ্রস্তুত হতে হয় না। তিথি বড় হওয়াতে অমূল্যর অনেক সুবিধা হয়েছে। এরকম ছোটখাটো অনেক বিষয়েই মেয়ে তাকে বকুনির হাত থেকে বাঁচিয়ে দেয়। রীতি বাবা-মেয়ের এই ‘অশুভ আঁতাত’ ভালোই বুঝতে পারে। মুখে যতই রাগ দেখাক, বাবা-মেয়ের এই ভালোবাসা আর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে সে অনেকটাই নিশ্চিন্ত বোধ করে। এখনকার ছেলেমেয়েদের সাথে বাবা মায়েদের অনেক দুরত্ব লক্ষ্য করে সে আসেপাসে। অমূল্যর এই ভুলো মনের জন্য যতই বকাঝকা করুক, মনে মনে কিন্তু অমুল্যকে নিয়ে সে গর্বিত। কি ভালোই না লেখে। প্রতিটা লেখাই মন ছুঁয়ে যায়। এই লেখার জাদুতেই তো একদিন সে অমুল্যর প্রেমে পরে গেছিল। অফিসের এত কাজের চাপ সামলেও সময় বার করে লেখে। ইতিমধ্যেই প্রায় একশোটা পত্রিকায় লেখা হয়ে গেছে, কয়েকটা বইও ছেপেছে। নিজের চেষ্টায় একটা পত্রিকাও চালায়, কত ছেলেমেয়েদের লেখার সুযোগ করে দেয়। 

বাস থেকে নেমে রোদের হলকা গায়ে লাগতেই খেয়াল হল “এই যাহ্‌, ছাতাটা তো নেয়া হল না”। বাসের ভীরে হ্যান্ডেল ধরে জিমন্যাসটিক করার সময় সামনের সিটে বসা সহযাত্রীকে ছাতাটা ধরতে দিয়েছিল। ব্যাস আর মনে নেই। এই ভুল অমূল্যর প্রথমবার নয়। এই নিয়ে এই গ্রীষ্মে চতুর্থ ছাতা গেল। কখনো সহযাত্রীকে ধরতে দিয়ে ভুলে যায়, কখনো ভীর বাসে ব্যাগ থেকে চুরি হয়ে যায়, আবার কখনো অফিসে ফেলে আসে। ওদের অফিসে কিছু ফেলে এলে তা আর পাওয়া যায় না। জলের বোতল, টিফিন বক্স, ছাতা, পেন অমুল্যর কত যে গেছে। মাইনের অর্ধেক টাকা তো বোধহয় ছাতা কিনতেই চলে যায়। একবার এক পাঠক শুনে বলেছিল “আচ্ছা দাদা তুমি তো বাচ্চাদের মত কপালে ইলাস্টিকয়ালা ছাতা ব্যাবহার করতে পার। তাহলে আর ভুলবেও না আর কেউ চুরিও করবে না”। ইশ, সত্তিই যদি এমনটা সম্ভব হত। কথাটা শুনে তিথি খিলখিলিয়ে হেঁসে বলেছিল “গুড আইডিয়া বাবা”। রীতিও হেঁসে বলেছিল “ইশ, কি ইমেজ তোমার, ছিঃ”। 

নিত্য দশটা সাতটার অফিস, লেদার প্র ডাক্ত এক্সপোর্ট কোম্পানির নানান ঝামেলা – কখনো ডিজাইনে, কখনো কোয়ালিটিতে, কখনো আবার এক্সপোর্ট আইনের নানা গ্যাঁড়াকল। সুদক্ষ ম্যানেজার হয়ে সেসব সামলে যেটুকু সময় পায়, লেখালিখি নিয়ে ডুবে থাকে। একটা পত্রিকা চালানোর কি কম হ্যাপা? তিথির সামনে সি বি আস ই। কিন্তু ওসব চাপ অমুল্যকে দেয় না রীতি। মেয়ের সব দায়িত্ব, সংসারের খুঁটিনাটি, এমনকি ফ্ল্যাটের ট্যাক্স, মেনটেনেন্স এসব দেয়ার দায়িত্বও রীতি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। আসলে অমূল্য মানুষটাকে যে বড্ড ভালোবাসে। তাই ওর সাহিত্যচর্চায় কোনরকম ব্যাঘাত ঘটাতে চায় না। এমনি করে ভালোয় মন্দয়ে দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল। হটাৎ অমূল্যর একটা ভালো চাকরির অফার আসে। আরও বড় এক্সপোর্ট হাউস, আরও বেশি মাইনে। অমূল্য আর রীতি ভীষণ খুশি। মেয়ের ক্লাস টেন। আর দু বছর পরে কোথায় কি পড়তে যাবে, কত লাখ টাকা খরচা হবে কে জানে। আজকাল পড়াশুনোর যা খরচা। এই সময়ে বাড়তি টাকা পেলে ভালোই হবে।

দেখতে দেখতে তিন মাস নোটিস পিরিয়েড কেটে গেল। পুরনো কোম্পানিতে আজ অমুল্যর শেষ দিন। দশ বছরের মায়া কাটানো কি সহজ কথা? হটাৎ ল্যাম্বের ‘ডা সুপারঅ্যানুয়েটেড ম্যান’ রচনাটার কথা মনে পড়ে গেল। গত দশ বছরে এই চেয়ার টেবিল, ওয়ার্ক স্তেশানের সঙ্গে যেন এক আত্মার সম্পর্ক হয়ে গেছে। এই জায়গাটায় অন্য কেউ বসবে ভেবে একটু হিংসাই হচ্ছে। নানা মিশ্র অনুভুতির মধ্যে দিয়ে দিন টা কেটে গেল। সন্ধেবেলা সহকর্মীরা তার জন্য ফেয়ারওয়েলের আয়োজন করেছে। অনুষ্ঠানে সবাই অমুল্যর কাজের, ব্যাবহারের সবকিছুর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন। সত্যিই ওর সহকর্মীরা ওকে ভালোবাসেন। অমুল্যর স্বভাবটাই ওরকম। দীর্ঘ এত বছরে কর্মক্ষেত্রে কারুর সাথে কোনরকম ঝগড়া বা মনমালিন্য হয়নি। খাওয়া দাওয়া হল। বাড়ি ফেরার সময় ফুলের তোরা আর মিষ্টির বাক্সর সাথে ওনারা অমুল্যর হাতে তুলে দিলেন ওনাদেরই কোম্পানির তৈরি সুন্দর একটা চামড়ার ব্যাগ।

নতুন অফিসে আজ প্রথম দিন। লেট না হয়ে যায়। সকাল থেকেই তাড়াহুড়ো। সময়ের আগেই পৌঁছে গেল অমূল্য। টেবিলে ব্যাগ টা রেখে পকেট থেকে রুমাল বার করে ঘাম মুছছে অমূল্য। হটাৎ কানে এল একটা পিঁক পিঁক শব্দ। খুব কাছ থেকেই আসছে। তাড়াহুড়ো করে ব্যাগটা খুলল। খুলতেই আওয়াজ বন্ধ। কি ভাগ্যিস ব্যাগটা খুলল।  নির্ঘাত জলের বোতলটা বার করতে ভুলে যেত। কিন্তু ছাতাটা? না না, মনে পড়ল আজ তো সে ছাতা আনেই নি। নতুন জায়গায় কাজ বুঝতেই দিন কাবার হয়ে গেল। সন্ধেবেলা আবার সেই পিঁক পিঁক। অমুল্যর সকালের কথাটা মনে পড়ে গেল। বোতলের কথা মনে পরতেই খেয়াল হল বোতলটা ব্যাগে ঢোকাতে হবে। আজ বাড়ি ফিরে নিজের হাতে রীতিকে জলের বোতল বার করে দেবে। এই ভেবে বেশ খোশমেজাজে বাড়ি গেল অমুল্য। 

পরের দিন অফিস যাওয়ার পথে বাস থেকে নামার সময় হটাৎ ব্যাগ থেকে সেই পিঁক পিঁক। আসেপাসের লোক অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। ব্যাগ খুলে অমূল্য দেখল ছাতা আছে। এইবার বার করতে হবে। বাস থেকে নেমে অনেকটা পথ হাঁটা। সন্ধেবেলা বাড়ি ফেরার সময় আবার পিঁক পিঁক। অমূল্য খানিকটা অপেক্ষাই করছিল যেন। কিরকম একটা অভ্যেস হয়ে যাচ্ছে। ব্যাগটা রোজ অফিসে ঢোকা আর বেরনোর সময় আর বাসে ওঠা নামার সময় বাজে। এতটা কি কোইন্সিডেন্স হতে পারে? বাসে রোজই লোকে হাঁ করে দেখে, নানারকম মন্তব্যও করে। অফিসে তার আলাদা কিউবিকাল তাই বেঁচে গেছে। সহকর্মীরা ব্যাপারটা কেউ এখনও টের পায়নি। জানলেই হাঁসাহাঁসি হবে। এটা কি তাহলে ম্যাজিক ব্যাগ? তাকে সবকিছু মনে করিয়ে দেয়ার জন্যই যেন এসেছে। অমূল্যর মাথাটা গুলিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা কি আদৌ সত্যি? নাকি তার লেখক মনের কল্পনা। সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে ‘ম্যাজিক’, ‘সুপার ন্যাচারালিজম’ এসব তার দারুন লাগে। যাকগে, অত ভেবে কাজ নেই, যা চলছে চলুক। ম্যাজিক ব্যাগের কৃপায় অমূল্য আর এখন কিছু হারায় না। বাড়িতে মেয়ে, বউও খুশি। ওদের কিছু বলেনি অমূল্য। সে আর তার আশ্চর্য ব্যাগ, তাদের দুজনের মধ্যেই লুকনো থাক ব্যাপারটা। 


Previous Post Next Post