তাপসকিরণ রায়







অনেক সময়ই প্রকৃতি আমদের হাসায়, কাঁদায়, ভালবাসতে শেখায়। রাত আমাদের নেশায়িত করে। দিন আমাদের স্বভাবসিদ্ধ করে। দক্ষিণের মুন্নারের কথা মনে পড়ে।  সেখানে একবার একলাটি ঘুরতে গিয়ে ছিলাম। সে জাগার প্রকৃতির মন মোহক দৃশ্যাবলী মনকে বড় আনন্দঘন করে তুলেছিল। সেখানে রংবেরঙের রকমারি ফুল, চা বাগান, নদী, ঝর্ণা, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত আর একটি বনপাহাড়ির মেয়ে আমার মনকে অনেক রঙিন করে তুলে ছিল। 

একদিনের কথা ছিল। দূরে একটা ঝর্ণা চোখে পড়েছিল। সেদিকেই ধীরে ধীরে পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। ঈষৎ ঝিরঝির ঝর্ণার জলপতনের শব্দ কানে আসছিল। সামনে চা বাগান। দূর থেকে দেখলে বোঝা যায়, চা বাগানের আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে। কেমন সারবদ্ধ, ছন্দবদ্ধ সাজানো সবুজের সমাবেশ। খুব ভাল লাগছিল। 

চা বাগানের মাঝখান দিয়ে সরু পথ নেমে গেছে সেই ঝর্ণার পদতলে। মাথার ওপরের দীর্ঘ ঝাঁপরা গাছের শাখা-প্রশাখার ফাঁক ফোকর গলিয়ে আসা সূর্যের নরম হলুদ রোদ্দুর গায়ে মেখে এগিয়ে যাচ্ছিলাম।  এই সেই ঝর্ণা। অনেকটা কাছে এসে পড়েছিলাম আমি। দেখলাম ঝর্ণার এক পাশে পাহাড়ের গায়ে ওপরে-নিচে কয়েকটা ঝুপড়ি ঘর। স্থানীয় বাসিন্দাদের বসত ভিটে হবে।  ঝর্ণার শোভা বেশ কিছুক্ষণ ধরে নিরীক্ষণ করছিলাম। এখানে নির্জনতার মাঝে এসে যেন পাহাড় তার ভাষা খুঁজে পেয়েছে। ঝর্ণার কলতানে সে যেন অনেক কিছু বলে যাচ্ছে। তার সুখ-দুঃখের কথা--সে যেন যুগ যুগান্তর ধরে বলে চলেছে ! কিন্তু সে ভাষা, আমরা হৃদয়ঙ্গম করতে বুঝি অক্ষম। এমনি আমাদেরও কত বোবা প্রতিবাদ জীবন ভর অনুচ্চারিত রয়ে যায় ! 

চায়ের তৃষ্ণা পাচ্ছিল। সকাল-বিকেলের এই তৃষ্ণা আমাকে নেশাতুর করে তোলে। মদের আর চায়ের নেশার মধ্যে কতটুকু পার্থক্য, এ ভাবনা মাঝে মাঝে আমার মধ্যে আসে বটে ! ঝুপড়ি ঘরের এক কোনায় এক ঝুপড়ি চায়ের দোকান। চা পাওয়া যাচ্ছে। কালো মোটা একজন বয়স্কা মহিলা চা বানাচ্ছে। সঙ্গে একটা কালো মেয়ে, স্থানীয় বলে মনে হয়, ওই চাওয়ালীরই মেয়ে হবে। একটা চা দাও, বলার আগেই মেয়েটা হেসে আমার হাতে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিল। মেয়েটির দিকে চোখ পড়ল আমার। বেশ কালো হলেও ওর মুখশ্রী বেশ সুন্দর। বেশ কাটা কাটা শিল্পী ছাঁচে তৈরি যেন। চোখ দুটো উজ্জ্বল, কিন্তু ধারাল নয়। ওকে বড় শান্ত-স্নিগ্ধ বলে মনে হল। 

সূর্য ডোবার আগের মুহূর্তই তো গোধূলি, সেই গোধূলিবেলা চলছিল। মোলায়েম আগুন রঙ ছড়িয়ে পড় ছিল চারিদিকে। ঝর্ণার টুং টাং শব্দ যেন কোন সুর তোলায় ব্যস্ত ছিল। এমনি এক মুহূর্তে আমার অজান্তেই চোখ দুটো ওই কালো মেয়েটির চোখে গিয়ে পড়ে ছিল। বয়ঃসন্ধি প্রকৃতি আমার ভেতর থেকে তাগাদা দিয়ে উঠল মনে হল। মেয়েটারও কি এমনি হচ্ছিল ? চায়ের খালি গ্লাসটা নেবে বলে সে এগিয়ে এলো আমার দিকে। ও মাথা নিচু করে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি। ওর কালো ঘন চুলগুলি মৃদুমন্দ হাওয়ায় নেচে উঠছিল। ও মুখ তুলল, গ্লাস হাতে নিলো, একবার তাকিয়ে নিলো আমার দিকে। ঈষৎ হাসি ছড়িয়ে দিল। 

এদিকে সন্ধ্যে নেমে আসছিল। কালো মেয়ে আঁধারে ঢেকে যাচ্ছিল। সান্ধ্য আকাশের টিমটিমে আলোক ছোঁয়ায় ও যেন আরও মায়াময়ী হয়ে উঠেছে। এবার নজরে পড়ল দু চারজন লোক যারা চা বাগানে ও ঝর্ণা দেখতে এসেছিল তারা পাশে কেউ নেই। তবে কি বাধা-বন্ধন ছন্নছাড়া একলাটি আমিই এখানে পড়ে আছি ! ফিরব বলে উঠে দাঁড়ালাম। মেয়েটি আমার কাছে এসে দাঁড়ালো। দুর্বোধ্য ভাষায় আমায় কি যেন বলল ! কিছু না বুঝে আমি ওকে প্রশ্ন করে বসলাম, তুমহারা নাম ক্যায়া হায় ?

খানিক চুপ থাকলো মেয়েটা। আমার কথা বুঝে নেবার চেষ্টা করছিল বোধ হয়। একটু পরেই ও সামান্য মুখ তুলে লজ্জা নিয়ে বলল, লা-লী। লালীর দেহছবি এখন আঁধারে ঢেকে গেছে, তার মাঝেই তার মুখচ্ছবির আকৃতি ধরা পড়ছিল। ছাঁচ আদলের সে কারুকাজ আমার চোখ ধরে নিচ্ছিল। 

গাঢ় অন্ধকার হয়ে গেছে চারদিক। তবু ফিরতে হবে। কিন্তু সামনের পথ- ঘাট, পাহাড়-পর্বত, গাছপালা, জঙ্গল সবকিছু ডুবে আছে অন্ধকারে। এদিকে লালীদের কুঁড়েতে কেরোসিন ল্যাম্প জ্বলে উঠেছে। এক চিলতা আলোর আস্তরণ চতুর্দিকে যেন মায়াবী রহস্য ছড়িয়ে দিয়েছে। লালীর দিকে একবার ফিরে তাকিয়ে, কি করে ফিরব ভাবতে ভাবতে পা বাড়ালাম।

এতক্ষণ বুঝতে পারিনি, এখন যেন ঝিঁঝিঁর রব, ব্যাঙের টরটরানি কানে এলো। অন্ধকারকে মায়াবী বানাতে জোনাকির জ্বলা-নেভা আলোসাজ চোখে পড়ল। কিছুটা এগিয়ে ঝর্ণা পড়ল। ও সদা-সর্বদা মুখর। মনে হল এই ঘন অন্ধকারের মাঝেও নিজের আনন্দ উচ্ছ্বাসে সে মগ্ন হয়ে আছে ! শুরুতে টের পাইনি, কখন যেন একটা আলোর শিখা রাস্তার সামনে এসে পড়েছে ! মুখ ফিরিয়ে দেখলাম, হ্যাঁ, লালী, একটা ল্যাম্প হাতে ও ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। ও আমার কাছে এসে হাসল, আবার নিজের ভাষায় কি বলার চেষ্টা করলো। আলো নিয়ে আমার পথ ধরে দু হাত এগিয়ে গেল। বুঝলাম ও অন্ধকারে আমায় পথ দেখাতে এসেছে। 

পাশাপাশি হাঁটছিলাম। বাতাসে আলোক শিখা কেঁপে কেঁপে উঠছিল। সামান্য শিহরিত হচ্ছিলাম আমি। আমি যেন অন্য এক পৃথিবীতে আছি। লালীর সঙ্গে আমার ছোঁয়া লাগছিল। একটা বুনো গন্ধ টের পাচ্ছিলাম। বুঝলাম, লালী বনের মেয়ে। তাই বন-পাহাড়ীর গন্ধ কিছুটা তার গায়ে তো লেগেই থাকবে। কিন্তু হাল্কা বুনো গন্ধে আমি যেন ভেতর থেকে আরও সজাগ হয়ে উঠছিলাম। 

-- তুন ক নাম কোন ? অনেকটা এমনি উচ্চারণ করেছিল লালী। 
আন্দাজ করে আমি আমার নাম বলে উঠলাম। 
-- তুলা লার ছিস--লালী বলে উঠলো।

আদৌ কিছু বুঝলাম না, তবে ও আমার প্রশংসা করছে বলে মনে হয়েছিল। মাঝে মাঝে আমি মোহিত চোখে ওর দিকে তাকাচ্ছিলাম। ওর চোখও আমার চোখে এসে আটকাচ্ছিল। চক্ষু বিনিময়ে ও মাঝে মাঝে মাথা নিচু করছিল। চা বাগানের রাস্তা পেরলেই আমি একলা চলে যেতে পারব। 

এক সময় এসে গেল চা বাগানের শেষ সীমা। দাঁড়িয়ে গেল লালী। আমিও দাঁড়ালাম। ব্যাস, আর দু পা এগোলেই আমার যাবার চওড়া রাস্তা। 

-- লালী, ম্যায় আব যাউঙ্গা--আমি ধরা গলায় বলে উঠলাম। 

লালী এক দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চিকচিক করছিল ওর চোখ। ল্যাম্পের আলোক শিখায় ওর মুখচ্ছবি ঈষৎ কেঁপে কেঁপে উঠছিল। কেন জানি না, আমি আমার একটা হাত লালীর দিকে এগিয়ে দিলাম। আমার দিকে ও তাকিয়ে ছিল, ধীরে ধীরে ও আমার দিকে ওর হাত বাড়িয়ে দিল। আমি ওর হাতটা আমার হাতে তুলে নিলাম। ভাষাহীন আমরা, একজন আর একজনের দিকে শুধু তাকিয়ে আছি। তবু সমস্ত ভাল লাগার আবেগ আমাদের জড়িয়ে ধরেছে। আসলে প্রকৃত ভালবাসা জন্ম নেয় মনে, মনের গভীরে সে অঙ্কুরিত হয়। ভালবাসার কাছে সমস্ত ভাষা হারিয়ে যায়।

লালীকে আবেগে নিজের কাছে টেনে নিলাম। ওর আপত্তি নেই, বরং ওর মাঝে সমর্পণ দেখলাম। আমি ওর মুখটা তুলে ধরে ওর ঠোঁটে গভীর এক চুম্বন এঁকে দিলাম। লালী আমার মুখের দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে থাকল। ওর মুখমণ্ডলের সামনে যেন মায়াঝর সোনালী আলোক বিন্দু ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছিল। আমরা মূক দুটি প্রাণী, কয়েক মুহূর্তে যেন কয়েক যুগ পার করে যাচ্ছিলাম ! 


Previous Post Next Post