শ্রীশুভ্র













এক।

বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। খোল দ্বার খোল লাগল যে দোল। মধুর বসন্ত এসেছে, মধুর মিলন ঘটাতে আমাদের। আড়ালে আড়ালে কোণে কোণে। আজি এই গন্ধবিধুর সমীরণে বসম্তে আজ ধরার চিত্ত হলো উতলা। ওরে ভাই, ফাগুন লেগেছে বনে বনে- রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোকে পলাশে। আপন আলোর স্বপন মাঝে বিভোল ভোলা। সত্যই এই স্বপনের ভেলায় চড়ে ফাগুন দিনের আগুনরাঙা সেই যে তোমার চলনটুকু ডাক দিয়ে যায় বারে বারে। মধুর ভারি মধুর তারি ভাবনাটুকু মনের মাঝে সাঁঝ সকালে কাজের মাঝে দেয় যে দোলা দেয় যে দোলা।

আবার এসেছে বসন্ত তার ভরা ডালি হাতে। আজ সকালের রাঙা রোদের ঘোমটাটানা আকাশে। বাতাসের আদরটুকু নিয়ে আমারই জানলার ধারে। ডাক দিতে এবার বাইরে বেড়োবার। পথ চলে গিয়েছ দেখ সামনে। দুধারে জীবনের করতালি। মহাজীবনের উদ্বোধনের উৎসব আজ। সেই উৎসবে আজ যে আমারও নিমন্ত্রণ। কিন্তু সেতো একার নয় সে একার নয়। পথের সাথী সে নিমন্ত্রণ তোমারও। আমারই সাথে। তাকিয়ে দেখ আকাশে বাতাসে কিসের কানাকানি! আলোকিত সংগীতের সুরঝর্ণায় সিক্ত ভুবন। ভুবনময়ী সেতো তোমার আমার মিলনতীর্থেরই সৈকতে। সেখানে নির্জনতা নেই। কলরব আছে। সেখানে একাকীত্ব নেই। দ্বৈত সঙ্গীত বাজে। সেখানে বিশ্বভুবন জুড়ে মিলনের বাঁশি। সে বাঁশির কাব্যে মহাকাল দেখ অধীর হয়ে আমাদের প্রতীক্ষায়। আসবে না কি তুমি আজ?

তোমার আসন পাতব বলে হে অতিথি, হৃদকুসুমে রাঙিয়ে আছি পরাণবীথি। আজি এ বসন্তে তোমার চরণরেখার তুলিতে আমার আনন্দের পটে রাঙিয়ে দিয়ে যাও গো এবার তোমার হাসিখানি। এই বিরাট বিশ্বে মহাকালের যে বাঁশি বাজে, সে বাঁশিতে এসো আমাদের আত্মজীবনীর যৌথপর্বটুকু লিখে রাখি ভালোবাসার ইজেলে বাসনারাঙা তুলিটা ভিজিয়ে। হাতে রেখে হাত। চোখে চোখে ভালোবাসার কানাকানি। কানে কানে হৃদয়ের হাতছানি। অঙ্গজোড়া আলিঙ্গনের বরাভয়, ভরা জ্যোৎস্নার মতো মধুর হয়ে মদীর হয়ে উঠুক প্রিয় তোমার আমার মিলনরেখায়। এ বসন্তে এসো নবীন করে তুলি বিশ্বভুবন আমাদের বসন্তশয্যায়।

জানি না তোমার ঠিকানা কোন পথের শেষে কার পদধ্বনীর মন্দিরায় মগ্ন। কিন্তু সে কি আমি নই? সে কি আমার স্পন্দনের উন্মুখ আদরে সমর্পিত নয়? আজি এ বসন্তে এমনও উল্টোপুরান কি হয়! কিন্তু আমি? এই যে এ বসন্তে পলাশে পলাশে তোমারই বকুলবনের ধারে ধারে আলিঙ্গনের গান গেয়ে যাই। দেখ ঠিক বসন্তেরই সুরে। এসো এসো বসন্তশয্যায় অনন্ত বাসর উন্মুখ প্রতীক্ষায়। তোমার আমার। বসন্তের এই মিলনলগ্নে জীবনের মহাসমারোহে বাঁধ ভাঙার ডাক চারিদিকে শোন কানপেতে। কেউই আর একা নয়। সকলের জন্যে সকলে প্রতীক্ষায়। ফুলের জন্যে যেমন ভ্রমর। জলের জন্যে যেমন তৃষ্ণা। সকালের জন্যে রাত্রি। পথিকের জন্যে যেমন পথ। তেমনই তো প্রিয় তোমার জন্যে আমি। আমাদের জন্যে মিলন। আজ এই বসন্তের মধ্যরাতের বাসর লগ্নে।

বসন্ত জীবনের প্রথম উদ্বোধন। যৌবনের উচ্ছ্বাসের উদযাপন। বসন্ত আমাদের মিলনের অনন্ত দিগন্ত। সেই দিগন্তপথের রাজপথে চলেছি আমরা অন্তরের অর্ঘ্য নিবেদনে প্রিয়তমের আলিঙ্গনে। সেই আলিঙ্গনের উৎসব আজ অন্তরে বাইরে। সেই উৎসবেই মহাকাল তার বাঁশিতে সুর বেঁধে দিয়ে যায় প্রতি বসন্তে। তুমি শুনতে কি পাও? আজ সকালে, সকালের প্রথম রোদটুকু যখন জানলা দিয়ে ডাক দিয়ে গেল, ঠিক তখনই বিজন ঘরের নিরালা অঙ্গনের চৌকাঠ জুড়ে গুঞ্জন করে উঠল যেন একটা হাহাকার- এতদিন যে বসেছিলাম পথ চেয়ে আর কাল গুনে, পাইনি দেখা তবু তোমার ফাল্গুনেও নয় ফাল্গুনে। তবুও ফাল্গুন গুনগুন করে পাঁজরের একতারায়। হে মাধবী দ্বিধা কেন, চলে যায় মরি হায় বসন্তের দিন। এ বসন্তেও সেই তুমি চির উদাসীন!

তবু এ বসন্তেও অঙ্গন জুড়ে জীর্ণপাতার ঝরার বেলায় আবারও ফাগুনের ডাকের অপেক্ষায় তোমার চরণচিহ্ন রেখার ধারে ধারে আমার বিজন বাসরের নির্জন প্রদীপের শিখা প্রতীক্ষার বাঁশিতে সুর তুলবে ফাগুনেরই আগমনীতে। আকাশ বাতাস জুড়ে ফাগুনের ঢেউ ভেঙ্গে ভেঙ্গে বসন্তও আমাদের মিলনতীর্থের সৈকতে অপেক্ষার প্রহর গুনবে জানি। গুনবেই। তুমি শুনবে তো? প্রিয়!


দুই।

জানি তুমি বলবে কোথায় ফাগুন? আগুন হয়ে জ্বলে পুরে খাক হচ্ছে চারিধারে মানুষের রোজকার জীবন। ধন মন যৌবন। বেঁচে থাকার রোজনামচায় প্রতিদিন যুদ্ধের দামামা। প্রতিদিন ঠকে যাওয়া আর ঠকিয়ে যাওয়ার পটচিত্র। মানুষে মানুষে বিভেদ বিদ্বেষ বিবাদের মেগা সিরিয়াল। মানবিক সকল পরিসরগুলি সঙ্কুচিত। খোলা হওয়ায় কেবলই খোলামেলা রিরংসা জীঘাংসা আর প্রতিহিংসার কুচকাওয়াজ। আর তারই তলায় চাপা পড়ে যায় প্রতিকারহীন আর্তনাদের মর্মন্তুদ আওয়াজ। 

কথায় বলে জোর যার মুলুক তার। কথায় বলে বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। কথায় বলে সারভাইভ্যাল অফ দ্য ফিটেস্ট। সেখানে সাফল্যের জন্যে যা কিছু করনীয়, সেটাই আইন। সেটাই নীতি। বেঁচে থাকাটাই আসল। চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। তাতে তোমারই হাতে আহত নিহত পরিজনও বড়ো কথা নয়। বড়ো কথা সার্ভাইভ্যাল অফ দ্য ফিটেস্ট। তুমি পারলে তুমি বিজয়ী।  না পারলে বসন্ত তোমার জন্যে নয়। বসন্ত তাদেরই ঘরে আসবে যারা জানে সাফল্যের কৌশল। যারা জানে কি করে অন্যকে সরিয়ে দিয়ে নিজের উপরে ওঠার পথটুকু মসৃণ করে নিতে হয়। কি করে পৃথিবীর সম্পদের উপর করতে হয় কর্তৃত্ব। বসন্ত তাদের ঘরে বাঁধা। বসন্ত তো কবির কাব্যের ছন্দ মিলিয়ে আসা যাওয়া করে না। বসন্ত প্রেমের অভিষেকে অধিষ্ঠিত কে বলেছে? বসন্তকেও নির্নাণ করে তুলতে হয়। সেই নির্মাণের পথে যে যত নির্মম হতে পারবে, সেই তত সফল।  সেই নির্মমতাই ইতিহাসের পাতায় তোমার নামটা লিখে রাখবে দোর্দণ্ডপ্রতাপে। সেই প্রতাপেরই আর এক নাম বসন্ত বন্ধু। 

প্রতিদিনের এই যে জীবন, যে জীবনের পরতে পরতে বিশ্বাসভঙ্গের রোজনামচা; মানুষ যেখানে মানুষকেই সিঁড়ি বানিয়ে উপরে উঠে সেই মানুষকেই আগে ভুলে যাওয়ার নাটকে ব্যস্ত। সেখানে মানুষের সম্বন্ধে শ্রদ্ধা রাখাই দায়। মানুষে মানুষে অশ্রদ্ধার মৈথুনজাত বিদ্বেষ বিষে কমবেশি সবাই অসুস্থ। ঘরে বাইরে সমাজ সংসারে এই অসুখের মধ্যে বসন্ত উঁকি দেবে কোন ভরসায় হে বন্ধু। যে বসন্তের বন্দনায় কবির কাব্যতর্পণ! না বসন্তের বাস্তব রূপ আর কাব্যরূপের মধ্যে ফারাক আসমান জমীন। সামাজিক পরিসরে রাষ্ট্রের কাঠামোয় সর্বত্র যে ঘূণ ধরেছে তার বীভৎসতায় বসন্ত আজ প্রাণের স্পন্দনহীন কেবল ক্যালেণ্ডারের আর পঞ্জিকার কয়েকটি ঘর মাত্র। যে ঘরে মানুষ আছে। উৎসব নেই। ভিড় আছে। মিলন নাই। কোলাহল আছে সঙ্গীত নাই।  বাসনা আছে। ভালোবাসা নাই। সাফল্যের যজ্ঞ আছে। আনন্দের উদ্বোধন নাই। 

ওরে গৃহবাসী এ কোন জীবনের রিরংসায় ডাক দিতে চাও তুমি। এই কথা ভেবেই জানি এ পথে পড়েনি তোমার চরণচিহ্নখানি। এ মরুভূমে বসন্ত সমাগম শুধুই কবিকল্পনায় কাব্যময়। জীবনের রঙ্গমঞ্চে জুয়ার ঠেক কেবল। কেউ জিতছে। জিতছে ঠকাতে পারলেই। না পারলেই মাথা ঠোকা কেবল নিয়তির কোলে। তবু কেন এই ক্লীবতা? তবু কেন নয় সঙ্গবদ্ধ প্রতিরোধ। প্রতিকার। প্রতিবিধান? যে বসম্ত ফাগুনে সকলের সমান উৎসব, যেখানে সকলের নিমন্ত্রণ সেখানে নয় কেন রাষ্ট্রিক নোঙড়। সামাজিক বেদী। মানুষে মানুষে ভালোবাসার কোলাকুলিতে? 


Previous Post Next Post