সুমিত্রা পাল




'ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত' 

বিখ্যাত কবির বিখ্যাত এই পঙক্তি আমাদের উৎসাহিত করে যায়- বসন্তের জন্য বিশেষ কোন দিনক্ষণের দরকার নেই। মন যদি হয় ভরপুর বসন্ত সবসময়। 

তবে এও ঠিক, ভিন্ন ভিন্ন ঋতু ভিন্ন ভিন্ন ভাবে প্রভাব ফেলে যায় আমাদের চেতনায়-ভাবনায়-মনে। আর তাই, খোলা বাতায়ন যখন জানান দেয়- সূর্য এখন উত্তরায়ণে, বিদায় নিয়েছে কনকনে উত্তুরে হাওয়া। পৌষের পাতাঝরা তপোবনের ছবির বদলে চারিদিকে এখন নবযৌবনের আবেশঘন পরিবেশ। কোণায় কোণায় ছড়িয়ে পরেছে এক ভব্য অথচ মাদকময় ঐশ্বর্য, এক মধুরতার মধুরতম দাহ। বাতাস হয়ে উঠেছে উতলা আকুল, পথতরুশাখাগুলিতে একটু একটু করে ধরছে মুকুল, ফুটে উঠেছে বকুল-পারুল-রজনিগন্ধা। ক্ষণে ক্ষণে শোনা যাচ্ছে পিউ কাঁহা পাখি আর কোকিলের দুরন্ত গুঞ্জন, রাগ বাহারের সুরালাপ... মনে হয়, এই তো এসে গেছে বসন্ত, ঋতুরাজ বসন্ত। মধুঋতু বসন্ত। অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে ধ্বনিত হয় প্রাণের কবির গান-

"আহা আজি এ বসন্তে, এত ফুল ফোটে, এত বাঁশি বাজে..."

একদা কবি শেলি বলেছিলেন- " If winter comes can Spring be far behind? "

যার আক্ষরিক অর্থ- শীত এলে বসন্ত কি দূরে সরে থাকতে পারে? অর্থাৎ শীতের ভয়ানক কষ্ট ও রুক্ষতার। পর বসন্ত আসে নব চেতনাবাহী হয়ে। আবেশ আর আবেগে মাখামাখি হয়ে। হবে না-ই বা কেন? বসন্ত মানেই তো নবজাগরণ, নবযৌবন। প্রকৃতি থেকে আরম্ভ করে মানুষ, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, সব যেন নতুন রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ-ছন্দে মেতে ওঠে। স্বপ্নবীজ যেন ছড়িয়ে পড়ে এখানে ওখানে সবখানে। 

আমাদের পৌরাণিক গ্রন্থে, বিভিন্ন মহাকাব্যে, সাহিত্যে বসন্ত ঋতুর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে কামদেব বা অনঙ্গদেবের নাম। কুসুমরথে চড়ে মধুপবনে, মকরধ্বজ উড়িয়ে, ঘুরে যখন বেড়াতেন তিনি নবনব ভুবনে, তার পঞ্চশরে ঘায়েল হয়ে উঠত কত পথিকললনা, কত জনপদবধূ, কত আকুল তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীরা...। পৌরাণিক কথানুসারে কামদেব যখন দেবতাদের প্রেরণায় উপস্থিত হয়েছিলেন কৈলাসপর্বতে, দেবাদিদেব মহাদেবের ধ্যানভঙ্গের নিমিত্তে তখন তিনি সঙ্গে নিয়েছিলেন মিত্র বসন্ত ঋতুকে। যাতে সমস্ত পরিবেশ, সমস্ত বাতাবরণ হয়ে ওঠে অত্যন্ত সুরভিত, মাদকময় ও অনুপম সৌন্দর্যময়। হয়েছিলও তাই। বসন্তঋতু দ্বারা প্রকৃতির সৌন্দর্য পরিবর্তনের অনুপম এবং রোম্যান্টিক বিবরণ লিপিবদ্ধ করে গেছেন মহাকবি কালিদাস তাঁর "কুমারসম্ভব"কাব্যে ও গোস্বামী তুলসীদাস তাঁর "রামচরিত মানসে"। এই ঋতু বড় বড় ঋষি, তপস্বীর তপস্যা ভঙ্গ করে দিতে সক্ষম হয়েছে। মানবজীবনে বসন্তঋতু যেমন অবিরাম হর্ষ-উল্লাস সৃষ্টি করে তেমনি মুহূর্তে চিত্ত চাঞ্চল্যও ঘটাতে পারে। 

বসন্তঋতু উৎসবের ঋতু। আকাশে বাতাসে তখন ফাগ ও আবিরের নিবিড় কোলাকুলি। বিবর্ণ সব রং সরে গিয়ে রংবাহারের রঙ লাগে সবার প্রাণে। বেজে ওঠে মুরজ-মৃদঙ্গ, বেজে ওঠে মুরলী। নেচে ওঠে গোপবালা আর গোয়ালের নন্দনেরা। উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে সমস্ত অলিগলি। মারে পিচকারি ব্রজভূমি বৃন্দাবন, গেয়ে ওঠে হৃদয়ের গান কবিভূমি শান্তিনিকেতন। শিমূল-পলাশে আগুন লাগে বনে, বসন্তোৎসবের ঠিক সেই ক্ষণে। আগুন লাগে তখন আমাদের মনে। আমাদের প্রাণে। বাসন্তী হয়ে উঠি আমরাও।



Previous Post Next Post